#ত্রিমোহনী
(১)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
________________________
আলতা মাখা তিন জোড়া পা একসাথে দুলছে অর্নবের গানের তালে তালে। বড়বোন রুপশ্রী’র আজ বাইশতম জন্মদিন। তিনবোন মিলে তাই সূর্যডোবা কমলা আকাশের নিচে ছাঁদের রেলিংয়ে পা ঝুলিয়েছে। গোধূলি বেলার রক্তিম আলোয় গা মাখিয়ে কোন স্মৃতির ক্যানভাস সাজাতে আজকের আয়োজন। হরদম হৈ হল্লায় মেতে থাকা বাড়ির এই কন্যারত্নগুলো বছরে তিনটে দিন ঈদ আয়োজনে লাগিয়ে দেয়। আর সেই তিনটি দিন হলো তাদেরই জন্মদিন। বড়রাও এ নিয়ে কম যায় না। রুপশ্রী দেওয়ানের জন্মদিন উপলক্ষে ছোট দু’বোন তনুশ্রী আর শ্রেয়সী মিলে ছোট্ট একটা কেক বানিয়েছে। আবার মুঠোভর্তি চকলেটও পাশের বাড়ির ইকবাল ভাইয়ার কাছ থেকে এনেছে। ইকবাল ভাইয়া নাকি রুপশ্রীর প্রেমে আছাড় খেয়েছিলো কবে সেই আছাড়ে কোমর তার এখনও বাঁকা। আর সেই কোমরবাঁকা ইকবালের পকেট ফাঁকা করা সবচেয়ে ছোট দুরন্ত আর চঞ্চল কন্যা শ্রেয়সীর কাজ।
‘কিরে! আর কতক্ষণ লাগবে তোর?’ বিরক্তমুখে বলল তনুশ্রী। রুপশ্রী তখনও অর্নবের গানে মগ্ন। ছাঁদের কোনে আলতা আর নীল রঙ মিলিয়ে নকশা করছে শ্রেয়সী। বড্ড চঞ্চল আর আলাভোলা এই মেয়েটির আলপনাতে হাতখানি খুব পাকা। রঙের জোগাড় করতে পারেনি বলেই এসব দিয়েই আজকের আলপনা তার। হাতে ধরা মোবাইলটিকে তবলার মত বাজাতে বাজাতে তনুশ্রী কখনও আলপনা তো কখনও ছোট বোনটির দিকে তাকাচ্ছে বিরসমুখে। শরতের মেঘহীন আকাশে পশ্চিমে ডোবা সূর্যের রঙটা মুছে যেতে বেশি দেরি নেই। সন্ধ্যে নামলেই হয়তো মেহমান আসতে শুরু করবে। আর মেহমান আসা মানেই বাড়ির নিস্তব্ধতা ভেঙে যাবে৷ নিস্তব্ধতা ভেঙে যাওয়া মানেই তনুশ্রীর বিরক্তি শতাধিকহারে বৃদ্ধি পাওয়া। গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে থাকা পড়াশোনায় ডুবন্ত এই মেয়েটি দেওয়ান বাড়ির প্রথম আর একমাত্র শান্ত মেয়ে। ছেলেবিহীন এই দেওয়ান বাড়ির তিনজন উত্তরসুরীর তিনজনই মেয়ে। রুপশ্রী,তনুশ্রী,শ্রেয়সী তিনজনই সম্পর্কে চাচাতো বোন। তিনজনই বাবা মায়ের একমাত্র কন্যা। সম্পর্কে চাচাতো হলেও ঘনিষ্ঠতায় আত্মার আত্মীয় এই তিনটে বোন।
‘আলপনার সমাপ্তি এখানেই হলো মহোদয়াগণ।’ হাতের তুলিটা এক পাশে রেখে হাসি হাসি মুখে বলল শ্রেয়সী। ততক্ষণে ছাঁদের কিনারা ছেড়ে উঠে এসেছে বাকী দু’বোন। তিনজনের মুখেই চওড়া হাসির রেখা আলপনার দিকে তাকিয়ে। নীলরঙা লতাপাতায় মোড়ানো আলপনায় ফাঁকে ফাঁকেই লালরঙা ছোট্ট ফুল উঁকি মেরে আছে। রুপশ্রী খুশিতে জড়িয়ে ধরলো বোনটিকে। কি সুন্দর আলপনা তার মাঝেই তনুশ্রী ছোট্ট একটা কাঠের পিড়ি রেখে চারপাশটায় প্রদীপ বাটি সাজিয়ে দিলো। সন্ধ্যেমুখে মাগরিবের আজানটাও হয়ে গেল। প্রদীপ বাটির সলতেগুলো তেলে ভেজাতে ভেজাতে তনুশ্রী বলল, ‘ আজ কি নয়ন ভাইয়ার পরিবারও আসবে আপু?’ কথাটা শুনতেই যেন চমকে উঠলো রুপশ্রী। সত্যিই তো আজ কি আসবে নয়ন ভাইয়ার পরিবার! কথা তো ছিলো আমার বাইশতম জন্মদিনেই তিনি আসবেন সপরিবারে৷ হাত রাঙা করতে নাকি বাইশের চেয়ে উত্তম আর কোন সংখ্যা নেই। আমার জন্মের তারিখ বাইশ উনার জন্মের তারিখও বাইশ শুধু মাসটাই যা অমিল। আবার নাকি তিনি আমায় দেখেছিলেনও বাইশ তারিখেই। কোন মাসের বাইশ তা আর বলেননি।
-‘ও ডাক্তারের হবু বউ কল্পনা ছেড়ে বাস্তবে ফিরে আসুন। নইলে সন্ধ্যা না একদম রাতও এখানেই পার হবে।’ তনুশ্রীর কথায় হেসে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো শ্রেয়সী আর রুপশ্রী হাত তুলে মাইর দেখালো।
-কিসের হবু বউ? হুম! একদম পিটিয়ে মানুষ বানিয়ে দিবো তোকে। কপট রাগ দেখিয়ে বলল রুপশ্রী।
‘হয়েছে হয়েছে এবার রাখো তো তোমাদের লড়াই। আমি কেক খাবো জলদি কাটো।’ বলতে বলতেই প্রদীপগুলো জ্বালিয়ে দিলো তনুশ্রী ।তিন বোন গোল করে বসে কেক রাখলো পিড়িটার ওপর। শ্রেয়সী একটু দূরে সেলফিস্টিক একটা গাছের সাথে বেঁধে ফোন আটকে দিলো। টাইমার সেট করা ফোনটাতে ঠিক ত্রিশ সেকেন্ড পরপর ফটো ক্যাপচার হবে প্রতিটা মুহুর্ত যা কোন এক বর্ষার বিষন্ন রাতে সঙ্গী হবে অথবা কোন অশ্রমাখা নিঃসঙ্গ বিকেলের। রাত্রী নামার শুরুর পথে ঘন অন্ধকারে প্রদীপের নিভু আলোর মিশ্রণে আলো আধারিময় ছবি একের পর এক ভবিষ্যৎ স্মৃতি বহন করতে তৈরি হচ্ছে সগৌরবে। ছবি উঠলো,কেক কাটলো,প্রদীপ নিভলো ক্লান্তি এলো তিনটি মনে। নদীর তিনটি মোহনার মতই দোওয়ান বাড়ির ত্রিরত্ন এই মেয়ে তিনটিই বরাবরই একই জায়গায় মেশে। তিনটিতেই স্বভাবে দুরত্ব মনে মিলিত এক জায়গায়।
‘অনেক হয়েছে এবার নিচে আসো তোমরা। মেহমান চলে আসছে আর তোমরা এখনও তৈরিই হওনি?’ শ্রেয়সীর মা ছাঁদে উঠেই তিনজনকে তাড়া দিলেন নিচে যেতে। কেক খেতে খেতে তিন বোন ঝটপট প্রদীপগুলো নিভিয়ে বাকি থাকা কেকটুকু নিয়েই নিচে নামলো।
বাড়ির সামনে এক টুকরো উঠান চারপাশ ঘেরা ছোট ছোট ফুল গাছে। সারি সারি গাছগুলোয় রোশনাই ঝলমল। রুপশ্রী নিজের ঘরে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কিছু সময় ব্যয় করলো উঠান জুড়ে সাজানো চেয়ার,টেবিল আর আলোয় মোড়ানো গাছগুলো। কত ঝিকমিকে আলোতে সব অন্ধকার ঢাকা পড়েছে ওই এক চিলতে উঠোনটায়। আজ নয়ন সাহেব আসবেন তাদের বিয়ের কথা বলবে বলে। সকালে অবশ্য ছোট্ট একটি বার্তা পাঠিয়েছেন মুঠোফোনে।তাতে লিখেছিলেন, ‘ প্রস্তুতি নিয়েই আসবো তৈরি থেকো।’ হাসি পেলো রুপশ্রীর খুব। মনে পড়লো এই ডাক্তারের সাথে দেখা হওয়ার প্রথমদিনটা। রুপশ্রীর টাইফয়েড হয়েছিলো সেবার। প্রচন্ড জ্বরে জ্ঞান হারিয়ে হাসপাতালের পনেরো দিনের মেহমান হতে হয়েছিলো তাকে। সেই পনেরোদিনের শেষ দিন নয়নের কাছেই রিপোর্ট দেখাতেই সাক্ষাৎ হয় তাদের। নয়ন হাতের টেস্ট রিপোর্ট হাতে রেখেই তাকিয়ে থাকে রুপশ্রীর দিকে। রুপশ্রী তখন রোগে ক্লান্ত, হাসপাতালের ঔষধ ঔষধ গন্ধে তিক্ত অবস্থায় নয়নকে বলেছিলো, ‘হ্যাংলামি ছেড়ে রিপোর্ট দেখুন আর ডিসচার্জের পারমিশন দিন।’ রোগীর মুখে এমন কথায় লজ্জায় লাল হয় নয়ন। দ্রুত রিপোর্ট খানায় নজর বুলিয়ে রোগীকে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়। তারপরই কেমন করে যেন নয়নই খোঁজ লাগায় মেয়েটির আর এক সময় সেই খোঁজ বন্ধুত্বপূর্ণ এক সম্পর্কের তৈরি করে দু পরিবারে। পরিবারের দেখা, সাক্ষাৎ, ঘনিষ্ঠতা সবই হয় কোন আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া। নয়ন ভালোবাসে রুপশ্রীকে তা সবাই জানে। রুপশ্রী এখন লজ্জা পায় নয়নকে দেখলে সেই খবরটাও সবার জানা শুধু রুপশ্রী কাকে ভালোবাসে সেই কথাটাই অজানা।
‘এই তোরা জলদি আয় নিচে দেখ কে এসেছে।’ চিৎকার করে ডেকে বলল রুপশ্রীর বাবা। কথাটা শুনতেই কেমন বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করে শব্দ হলো। পোশাক পাল্টে লিপস্টিক ছোঁয়ালো ঠোঁটে, চুড়ি দুটো হাতে নিয়ে আবার বারান্দায় দাঁড়ালো রুপশ্রী। অবাধ্য দৃষ্টি উঠোন জুড়ে একোণ ওকোণ খুঁজে বেড়ালো কাউকে। নাহ, আসেনি নয়ন সাহেব হঠাৎ চোখ আটকালো বাড়ির সীমানা পেরিয়ে পাশের বাড়ির টিনশেড একটি ঘরের দরজায়। অন্ধকার সেই ঘরের দরজায় লম্বাচওড়া একটা দেহ। আঁধারেও যেন দেখা যাচ্ছে সেই দরজার মানুষটা এদিকেই তাকিয়ে আছে গভীর দৃষ্টি মেলে। রুপশ্রীর হাসিখুশি মুখটাতে মেদুর ছায়া নেমে এলো। কেন এই বিষন্নতা পর্দা হয়ে নামলো মুখে কে জানে!
‘আপু নয়ন ভাইয়া চলে এসেছে।তাড়াতাড়ি নিচে আসো আমি আর তনু আপি চললাম।’ শ্রেয়সীর কথাটা কানে আসতেই হাসি ফুটলো রুপশ্রীর মুখে। দৃষ্টি সরে এলো সেই দরজার মানুষটাকে একলা করে। তড়িঘড়ি একটুখানি পারফিউম লাগিয়ে বের হলো রুপ ঘর ছেড়ে যেন কত অপেক্ষার পর কাঙ্ক্ষিত মানুষের দেখা মিলবে এখন। আদৌও কি তাই!
চলবে
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। ভালো কি মন্দ যেমনই লাগে ছোট্ট করে কমেন্টে জানাবেন আশা করি।)