#ত্রিকোণ চতুর্থ_পর্ব
#সুচন্দ্রা_চক্রবর্তী
#চতুর্থ_পর্ব
— ‘যদি অন্যায় না ই হয়ে থাকে, তাও আমি জানতে চাই নামটা, বলো।’
— ‘আই অ্যাম সরি স্যার, আমি বলতে পারব না।’
— ‘বেশ, বলবে না তো? আমি তাহলে নিজেই খুঁজে বের করব তাকে।’
— ‘আমি যদি তার নাম না বলি, আপনি কোনোদিন তাকে খুঁজে বের করতে পারবেন না, দেশের সব পুলিশকে লাগালেও না।’
— ‘ওকে ফাইন, এতই যখন জানো তাহলে নিজেই বলো নামটা।’
অভিনন্দার নীরবতা আরও রাগিয়ে দেয় ঐশিককে, ও রাগের মাথায় চেঁচিয়ে ওঠে, ‘অনেক ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়েছ তুমি আমার, এবার তোমায় বলতেই হবে! আমি তোমার বস, আমি অর্ডার…..’
— ‘সরি স্যার, আপনি আর আমার বস নন, আমি রিজাইন দিচ্ছি’, বলেই ঘরের দেওয়ালে থাকা একটা তাক থেকে রেজিকনেশন লেটারটা ঐশিকের হাতে ধরিয়ে দেয় ও।
ঐশিক লেটারটা পড়েও দেখল না, ছিঁড়ে কুচি কুচি করে দিয়ে বলল, ‘তোমার রিজাইন আমি অ্যাক্সেপ্ট করছি না, গট ইট? এইবার বলো!’
— ‘আচ্ছা স্যার, আমার জায়গায় যদি অন্য কোনো এমপ্লয়ির সাথে এই ঘটনা ঘটত, আপনি কি একই কাজ করতেন? নিজের সব কাজকর্ম ফেলে তার বাড়িতে ছুটে যেতেন?’
— ‘আমি জানিনা, সত্যিই জানিনা। হয়ত যেতাম, বা হয়ত যেতাম না, আই ডোন্ট নো!’
— ‘যেতেন না স্যার। আপনার মনে হচ্ছে না একজন অতি সাধারণ এমপ্লয়িকে আপনি বড্ড বেশি ইম্পর্ট্যান্স দিচ্ছেন?’
— ‘হ্যাঁ যদি সেটাই করে থাকি তাহলে বেশ করেছি! তুমি একদম কথা ঘোরানোর চেষ্টা করবে না!’ অভিনন্দাকে চেপে ধরে ঐশিক, ‘তোমার মুখ থেকে উত্তর না নিয়ে তো আমি ফিরছি না!’
এইবার আর নিজেকে সামলাতে পারে না ও, অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে অভিনন্দা, ‘আপনি শুনতে চান তো আমার হবু সন্তানের বাবার নাম? তাহলে শুনুন, সে আর কেউ নয়, তার নাম ঐশিক রায়চৌধুরী, আপনি!’
অভিনন্দার মুখ থেকে এই উত্তর একেবারেই আশা করেনি ঐশিক। হঠাৎ যেন শক লাগার অনুভূতি হয় ওর, অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, ‘কি বললে?’
নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে ধরা গলায় ও প্রশ্ন করে অভিনন্দাকে, ‘কিন্তু কিভাবে হল এসব? আমার তো কিছু….’
— ‘এইজন্যই বারবার বললাম স্যার, এই প্রশ্নের উত্তরটা আপনার না জানাই মঙ্গল, কিন্তু আপনি তো না শুনে ছাড়বেনই না! শুনুন স্যার, সেদিনের ঘটনাটা আপনার মনে থাকার কথাও নয়!’
— ‘কেন?’
— ‘বলব স্যার, সবটাই বলব। আপনার নামটা যখন আমাকে বলিয়েই ছেড়েছেন তখন বাকিটা তো বলতেই হবে আপনাকে, তবে আপনি বিশ্বাস যদি না করেন তাহলে অবশ্য আমার কিছুই করার নেই।’
ঐশিক অভিনন্দার কাঁধে হাত রেখে বলে, ‘আমি ব্যবসায়ী অভিনন্দা, মানুষের চোখ দেখে বলে ফেলতে পারি সে সত্যি বলছে না মিথ্যে। তুমি যে একটা কথাও মিথ্যে বলছ না সে আমি বুঝতে পারছি।’ ঐশিক বলে যায়, ‘আর কিছু আড়াল কোরো না আমার কাছে, প্লিজ সবটা খুলে বলো!’
— ‘জানেন স্যার, আপনি যদি আপনার নামটা শুনে আমায় অবিশ্বাস করে এখান থেকে চলে যেতেন, তাহলে অনেক বেশি খুশি হতাম আমি, কিন্তু আমি নিরুপায়, আমাকে এখন সবটা বলতেই হবে। স্যার আপনার মনে আছে, সেই মাসতিনেক আগের কথা, যেদিন আপনি জানতে পেরেছিলেন গীতালি ম্যাডামের একটা বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক আছে তন্ময় বলে একজনের সাথে?’
— ‘হ্যাঁ, মনে থাকবে না আবার? গীতালি যে একজন স্বার্থপর, অহংকারী কেয়ারলেস মানুষ সেটা আমি জানতাম, জানতাম যে এইসব ভালোবাসা, সম্পর্ক এসবের কোনও মূল্য নেই ওর কাছে, টাকাটাই সব ওর কাছে, কিন্তু তাই বলে ও যে এইভাবে অন্য একজন পুরুষের সাথে নোংরা সম্পর্কে জড়াবে এটা আমার কাছে আনএক্সপেক্টেড ছিল সত্যিই, আর সেই দিনই আমার জীবনের সেই অভিশপ্ত দিন, যেদিন আমি ফার্স্ট টাইমের জন্য ড্রিংক করি। সেদিন তুমিই তো ড্রাইভ করে আমায় বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলে, না? পরেরদিন সকালে মা আমায় বলেছিল, যদিও আমার কিছুই মনে ছিল না।’
— ‘হুম স্যার, শুধু ড্রিংক করেন ই নি, সেদিন আপনি ড্রিংক করে গাড়িও চালিয়েছিলেন যেটা অত্যন্ত অন্যায় করেছিলেন আপনি।তখন রাত্রি নয়টা কি সাড়ে নয়টা হবে, অফিস থেকে সবাই বেরিয়ে গেছে, শুধু সিকিওরিটি গার্ডরা ছাড়া। আমি সেদিন অফিসের দিকে একটা শপিং মলে এসেছিলাম কিছু কেনাকাটা করতে, হঠাৎ দেখি আপনার গাড়িটা ভীষণ স্পিডে অফিসের দিকে ঢুকছে। ভীষণ অবাক হয়ে যাই আমি, এই সময় তো আপনার অফিসে থাকার কথা নয়! তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে দেখি, আপনি গাড়ি থেকে নেশার ঘোরে টলতে টলতে নামছেন, আমায় দেখেই আপনি একগাল হেসে বললেন, ‘আরে অভিনন্দা ম্যাডাম, তুমি এখানে? তোমায় অনেক কথা বলার আছে আমার, এসো কেবিনে এসো’, বলেই আমার হাত ধরে আমায় নিয়ে আপনার কেবিনে গেলেন। গোটা অফিস খাঁ খাঁ করছে, একটাও জনমানব নেই, সেই বীভৎস শূন্যতায় প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আপনার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা সদ্য মন ভাঙার শ্লেষের হাসি। চোখে জল, অথচ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছিলেন আপনি। ওই অবস্থাতেই মোবাইল খুলে তন্ময়ের আপনাকে পাঠানো তন্ময় আর গীতালি ম্যাডামের ঘনিষ্ঠ ছবিগুলো দেখালেন আমায়, সেই সাথে তন্ময় আর গীতালি ম্যাডামের মেসেজের স্ক্রিনশটগুলো। এইসব পাঠিয়ে তন্ময় আপনাকে লিখেছেন, ‘ঐশিকবাবু, গীতালিকে এইবার ডিভোর্সটা দিয়েই দিন, বুঝলেন? আর কেন আমার জিনিসটাকে নিজের কাছে রাখছেন জোর করে?’ স্যার জানেন, আপনাকে ওইভাবে কাঁদতে দেখে আমিও আটকাতে পারিনি নিজেকে, আমার চোখ দিয়েও জল গড়িয়ে পড়েছিল অজান্তেই। তারপরেই আপনি আমায় কাছে টেনে নেন।’
এই পর্যন্ত বলে অভিনন্দা থামল। চোখটা বন্ধ করে ফেলল, গালদুটোও ভিজে গেল অজান্তে।
ঐশিকের গালদুটোও ভিজেছিল। অনেকক্ষণ ঘরে এক নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিল, ঐশিকই নিস্তব্ধতা ভাঙল।
— ‘তোমার সাথে যা হয়েছে অভিনন্দা, সেটা অন্যায়ই, আর আমি কালপ্রিট। কিন্তু অভিনন্দা, তুমি আমায় বাধা দিলে না কেন সেদিন? বাধা দিলে কি আমি তোমার চাকরিটা কেড়ে নিতাম? এতটাও খারাপ মানুষ বোধহয় আমি নই।’
— ‘স্যার, এই উত্তরটাও আমাকে দিয়েই বলাবেন? বেশ শুনুন’, কিছুক্ষণ থেমে অভিনন্দা বলতে থাকে, ‘আসলে স্যার, আপনাকে আমি বরাবরই ভীষণ শ্রদ্ধা করতাম। আসলে আপনার মতো মানুষ তো কমই দেখেছি জীবনে, এত বড়োলোক, উচ্চশিক্ষিত, তবু অহংকারের লেশমাত্র দেখিনি কখনো আপনার মধ্যে। সবসময় সততা আর নিষ্ঠা দিয়েই কাজ করে গেছেন, কখনো বাঁকা পথে ওপরে উঠতে চাননি আপনি। সব মিলিয়ে এক অপার মুগ্ধতা ছিল আপনার প্রতি, সেই মুগ্ধতা আর শ্রদ্ধাই যে কবে ভালোবাসায় বদলে গেছে আমি নিজেই বুঝিনি কখনো। যাকে ভালোবাসি, তাকে বাধা কিভাবে দিই বলুন তো?’ একটু থেমে অভিনন্দা বলল, ‘সবসময় চেয়েছি আপনি সুখী থাকুন, গীতালি ম্যাডাম যেন আপনাকে বোঝেন। আমি জানতাম, আপনি যদি আমার প্রেগন্যান্সির ব্যাপারে সব সত্যিটা জানতে পারেন, তাহলে কিছুতেই চুপচাপ বসে থাকবেন না, আর তাই তো আপনাকে অ্যাভয়েড করে গেছি এই ক’দিন। আমি কোনোদিনই চাইনি আমার জন্য আপনার সংসারটা ভেঙে যাক।’
(ক্রমশ)