তোমার প্রণয় নগরে
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব- ৩৪
আরসাল চলে গেছে। সায়রা ঢাকায় ফিরে এসেছে। সিলেট থেকে ফিরে নিজেকে একদম গুটিয়ে নিয়েছে। আগের চেয়ে আরো বেশি গম্ভীর নিশ্চুপ হয়ে গেছে। নিজের সবচেয়ে কাছের, প্রিয় মানুষটা থেকে এত বড় ধাক্কাটা মেনে নিতে পারেনি সায়রা। নির্বাক কষ্ট গুলো তার ভিতর কুরে কুরে খাচ্ছে। দহনে পুড়ছে সারাক্ষণ।
দুমাস কেটেছে। এই দুমাসে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে,
এই তো সাপ্তা দু এক বাদে তুর্জয় আরমিনের বিয়ে। শেষবার সিলেট থেকে ফিরে যখন তুর্জয় নিজের ভালোবাসা অনুভূতির স্বীকারোক্তি করেছিল, ফিরিয়ে দিতে পারেনি আরমিন। সে বেশ বুঝেছে যেই মানুষটা তার দুর্দিনে হাত বাড়িয়ে ছিল সেই মানুষটা আর যাই হোক কখনো তাকে ছেড়ে যাবেননা। দুই পরিবারের সম্মতিতে বেশ ধুমধাম আয়োজন করে বিয়ে হবে তাদের।
প্রতিদিনের মত আজও ঠিকঠিক বারটায় ফোনটা বেজে উঠল সায়রার। সে জেগেই ছিল। আজকাল দুচোখে ঘুম খুব কম বললেই হয়। দিন দিন সে কি নিশাচর হচ্ছে! কি জানি! ফোনের দিকে চোখ বুলাল, ‘ আননোন নাম্বার ‘! বুক চিড়ে চাপা নিশ্বাস বেরিয়ে এলো । সে জানে ‘আরসাল’ ফোন করেছে। কিন্তু কথা বলার মত বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই তার। সিলেট থেকে ফিরার পর আরসালের সাথে কথা বলেনি আর। এই দুমাসে বেশ কয়েকবার মুনতাহা বেগম আহনাফ সাহেবকে ফোন করেছে আরসাল। কিন্তু সায়রার সাথে কথা হয়নি একবারও। ফোন করলেও তুলেনি সায়রা। বুকে শক্ত এক অভিমান জমেছে। এই অভিমানের বরফ এত তাড়াতাড়ি গলবে না। আরসাল তার সাথে যা করেছে, তা ভীষণ জঘন্য। কারণ যাইহোক না কেন, সে এত তাড়াতাড়ি সব ভুলে ক্ষমা করতে পারবেনা আরসালকে। ভাবল সায়রা।
ফোন বাজছে তো বাজছেই! বেশ কয়েকবার বাজার পর বিরক্ত হয়ে ফোন তুলল সায়রা। অপর পাশ থেকে শান্ত আওয়াজ ভেসে এলো,
–” কি চাস মরে যাই? এমনিতেই তোর থেকে দূর ছটফট করছি সারাক্ষণ, তার উপর ফোনটাও তুলছিস না! আমার উপর তোর এত অভিমান, এত রাগ!”
উত্তর দিলো না সায়রা। বেশ কিছুক্ষণ উত্তরের আশা করল আরসাল। উত্তর মিলল না। পিনপতন নীরবতা, নীরবতা ভেঙে বলল আরসাল,
–” আগামীকাল অনেক বড় একটা দিন। সবটা ঠিকঠাক হলে খুব দ্রুত তোর কাছে ফিরব! ”
এবারো সায়রা চুপ রইল। আরসালের নিমিষ আওয়াজ,
–” শুনে খুশি হোসনি? কিছু বলবি না!”
এবার মুখ খুলল সায়রা। প্রত্যুত্তরে বলল,
–” আপনার জীবন আপনি কি করবেন, কি করবেন না আপনার সিদ্ধান্ত। এখানে আমি খুশি কি না তার প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে!”
অপর পাশ থেকে কোন উত্তর এলো না। সায়রা কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্ত স্বরে বলল,
— ” আমার ঘুম পাচ্ছে, রাখছি! ”
বলেই ফোন কাটল। নিশ্বাসের প্রচণ্ড উঠানামা। থরথর কাঁপছে সারা শরীর। পাশ ফিরে অস্থির দৃষ্টিতে দেয়ালে টানানো আরসালের বড় ছবিটার দিকে তাকাল। আঁখি জোড়া জলে ভরে এলো। ঠোঁটের কোণঘেঁষা তৃপ্ত হাসি সায়রার।
.
রাত এগারোটা। ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। চারিদিক বৃষ্টির ঝুমঝুম আওয়াজে নাচছে। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। চায়ের কাপ হাতে শুধু সায়রা জেগে। ঝুম বৃষ্টি ভেজা রাত আর সাথে চায়ের কাপ, বেশ দারুণ কম্বিনেশন! এই বৃষ্টি ভেজা রাতে পুরানো অতীত কুরাচ্ছে সায়রা। বছর দু এক আগে এমনি এক ঝুম বৃষ্টির রাতে বাড়ি ফিরেছিল আরসাল। মন বলছে আজ এমনি কিছুর পুনরাবৃত্তি হবে আবার! বৃষ্টির আঁচ জানালা গড়িয়ে গা ছুঁইছে, হুশ ফিরল সায়রার। ওড়না প্রায় ভিজে একাকার। ওড়নার থেকে পানি ছাড়াতে ছাড়াতে বিছানা অবধি আসলো। এমন সময়ই নিচের ডোর বেল বেজে উঠল। ভ্রু কুঁচকে এলো সায়রার। এই সময়, এত রাতে কে এলো! দ্রুত পায়ে সিড়ির দিকে পা বাড়াল। সায়রার আগেই মুনতাহা বেগম আহনাফ সাহেব বেরিয়ে এসেছে। কয়েক সিড়ি নিচে নামতেই পা থেমে গেল সায়রার। সায়রার বাবা মা বাকি সবাই ও এখানেই আছে। সাথে অচেনা মাঝবয়েসী একজন। ঘটনা কি জানতে সিড়ির দিকে বাড়াল কয়েক কদম বাড়াতেই আবারো থামল। চক্ষু তখন চড়কগাছ! ড্রাইং রুমে মাঝামাঝি সোফায় আরসাল বসে। বিদ্যুৎ চমকানোর মত চমকাল সে। হতভম্ব, কিংকত্র্তব্যবিমূঢ় সায়রা! শরীর কাঁপছে, মাথা ঘুরছে! নিজেকে সামাল দিতে শক্ত করে সিড়ির রেলিং চেপে দাঁড়াল। মাঝবয়েসী লোকটা কিছু বলছে, মূলত সবার দৃষ্টি উনার দিকেই। আরসাল মাথা নুয়ে চুপচাপ বসে। দূর থেকে স্পষ্ট কিছু শুনা যাচ্ছেনা। আরসালকে দেখে নিচের দিকে আর পা বাড়াল না সায়রা। দ্রুত পায়ে রুমে চলে গেল।
.
রাত তিনটা! থমথমে পায়ে ঘরের দিকে পা বাড়াল আরসাল। বৃষ্টি নেই। আকাশ এখন পরিষ্কার। মেঘেদের আড়ালে লুকিয়ে থাকা চাঁদটাও বেরিয়ে এসেছে। যার জ্যোৎস্নায় আলোকিত চারিদিক। বৃষ্টি স্নান স্নিগ্ধ পরিবেশ। জানালার পর্দা গুলো মৃদু হাওয়ায় দুলছে। চন্দ্রসুধা জানালা মাড়িয়ে বিছানায় পড়ছে। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে সায়রা। ফর্সা পিঠ স্পষ্ট ভেসে, এলোমেলো চুল গুলো বিছানায় ছড়িয়ে। রুমে কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে চোখ বুজে নিলো সায়রা। চোখের কোণ বেয়ে দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল বালিশে। হাঁটু গেড়ে সায়রার মুখোমুখি বসল আরসাল। গাঢ় দৃষ্টিতে দেখতে লাগল সায়রাকে। চাঁদের চাঁদনি চুয়ে চুয়ে পড়ছে তার মুখশ্রীতে। ভেজা চোখ, রক্তিম নাক। আঁখিপল্লব এখনো জলে ভিজে। আরসালের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো! ছুঁয়ে দিতে হাত বাড়াল আরসাল। অতি নিকটে সেই চিরচেনা ঘ্রাণকে অনুভব করে মুখ ফিরিয়ে নিলো সায়রা। দীর্ঘ দেড়বছর যেই মানুষটা তাকে ছেড়ে থাকতে পেরেছ, এখনো ঠিক পারবে! এক রাশ অভিমানে চোখ বেয়ে অঝোরে জল পড়তে লাগল সায়রা। চাই না এই মানুষটাকে তার, চাইনা আর!
আচমকা সায়রাকে কোলে তুলে নিলো আরসাল। শক্ত ভাবে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো। চোখমুখ কুঁচকে নিলো, বিন্দুমাত্র নড়চড় করল না সায়রা। নিজেকে শক্তভাবে চেপে রাখল। নিমিষ আওয়াজে বলল আরসাল,
–” আমি তোর অপরাধী! শাস্তি দেওয়ার সম্পূর্ণ অধিকার আছে তোর। তাই বলে এভাবে মুখ ফিরিয়ে নিস না! ছটফট করতে করতে মরে যাবো আমি।”
কোন প্রতিক্রিয়া করল না সায়রা। আগের মতই নিজেকে শক্ত ভাবে চেপে রাখল। আরসাল আবার বলল,
–” আমাকে নিজের দিক এক্সপ্লেইন করার একটা সুযোগ দিবি সায়রা?”
উত্তর দিলো না সায়রা। সায়রার মৌনতাকে সম্মতির লক্ষণ মেনে নিলো আরসাল। নিজে থেকে বলতে শুরু করল,
–” দেড়বছর আগে সেই দিন বাড়ি ফেরার পথে গাড়ীর ব্রেক ফেইল হয়ে এক্সিডেন্ট হয় আমার। নিরিবিলি রাস্তা হওয়ায় এক্সিডেন্টের পর ঘন্টা খানেক সেখানে সেভাবেই পরে ছিলাম। সাহায্যের জন্য কাউকে পাইনি। সেই এক্সিডেন্টের রাস্তায় রিটায়ার মেজর তাহির সাহেব উনার অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে হসপিটালে যাচ্ছিলেন। এক্সিডেন্ট দেখে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন তিনি। হসপিটালে নিয়ে যায়। ততক্ষণে কোমায় চলে গেছি আমি। এক বছর চার মাস পর যখন কোমার থেকে ফিরলাম, তখন আমার চারিদিক পুরোপুরি পাল্টে গেছে। মেজর তাহির আহমেদের স্ত্রী মানসিক ভারসাম্যহীন, আমাকে উনার মৃত ছেলে ইফতি মানতে শুরু করেছে। আমি সবটা ক্লিয়ার করতে চাইলে তাহির সাহেব বাঁধা দেয় আমাকে, তিনি জানান, আমার এক্সিডেন্টের ঠিক ছয় মাস আগে তার বিয়ের কিছুদিন আগে এক এক্সিডেন্টে ইফতি মারা যায়। একমাত্র সন্তানকে হারানোর শোকে মেজরের স্ত্রী মানসিক ভারসাম্য হারায়। এক্সিডেন্টের দিন আমাকে দেখে মেজরের স্ত্রী নিজের মৃত ছেলে ইফতি ভাবতে শুরু করে। কারণ ইফতিরও ঠিক একই ভাবে এক্সিডেন্ট হয়েছিল। উনার হার্ট ডিজিজ ছিল, অবস্থা ছিল ক্রিটিকাল! খুব শীঘ্রই অপারেশন করার কথা ছিল। মানসিক ভারসাম্যহীন হওয়ায় ডক্টর তা করতে সাহস জোটাতে পারেনি। আমাকে পেয়ে অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তাই মেজর আর আমার ঠিকানা খুঁজে বের করেনি। স্ত্রীর প্রাণ বাঁচাতে বিষয়টা গোপন রেখেছিল। কোমা থেকে ফিরে যখন বাড়ি ফিরতে চেয়েছিলাম। তখন আমার কাছে খুব করে অনুরোধ করেন মেজর সাহেব। আমি যেন অপারেশন অবধি ইফতি হয়ে উনাদের কাছে থাকি। অপারেশনের বাঁচার চান্স ছিল অল্প, তাই যতটুকু সময় উনার হাতে আছে উনি যেন হাসি খুশি থাকে, আমি উনার কাছে উনার ছেলে হয়ে থাকি। মেজর সাহেবের অনুরোধ ফেলতে পারিনি আমি। ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে। বাবা মা তুই নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছিলি অনেকটাই। যোগাযোগ করে ব্যাপারটা ঘাটতে চাইনি। তাই আমিও আর সামনে আসিনি। চারটা মাসের ব্যাপারই তো! এই চারটা মাস নিজেকে আড়াল করে রাখতে চেয়েছিলাম, অপারেশন শেষে আমি নিজেই তোদের কাছে ফিরে আসতাম।
কিন্তু ঢাকা থেকে অদূর সিলেটে যে হুট করে তোর সাথে দেখা হয়ে যাবে। তা আমার কল্পনাতীত ছিল। হ্যাঁ সেই রাতে আমিই তোর পাশে ছিলাম! সেদিন উনার সামনে অচেনাদের মত আচরণ করতে বাধ্য হয়েছি।
সেদিন যদি সিলেটে এভাবে হুট করে দেখা না হতো হয়তো তোর এতটা রাগ অভিমান হতো না! আমি তোকে ঠকাইনি সায়রা! কৃতজ্ঞতা বশত বাধ্য ছিলাম শুধু!”
কোন উত্তর এলো না। ডুকরে কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো শুধু। আরসাল সায়রার দিকে হাত বাড়াতেই সরে গেল সায়রা। চিৎকার আওয়াজে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
–” সব বুঝলাম! কিন্তু এসব কিছুতে আমার কি দোষ ছিল আরসাল? দিনের পর দিন আপনার অপেক্ষা করেছি। নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি। পাইপাই মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করেছি! আপনি জানেন এই দেড় বছর আমাকে কি কি সহ্য করতে হয়েছে? অলক্ষ্মী, অর্থলোভীর মত আরো কত ট্যাগ লেগেছে আমার উপর। অনেকে তো এটাও বলেছে আমি আমার স্বামীকে খেয়েছি। রাক্ষসী আমি! পারবেন আমার সব অপমান কষ্ট গুলো মুছে দিতে!”
চলবে…….