তোমার প্রণয় নগরে
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব- ৩২
বিছানা ছেড়ে ধরফরিয়ে উঠে বসল সায়রা। এলোমেলো চুল ঘুমঘুম চোখ। শরীরের রক্ত দ্রুতবেগে চলাচল করছে। বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে আর ফেলছে। বিছানার পাশে ডিভাইনটায় হেলান দিয়ে বসে ছিল আরমিন। সায়রাকে জাগতে দেখে, দ্রুত পায়ে বিছানার দিকে এগিয়ে আসে। অস্থির কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে সায়রা,
–” আমি বাগানে ছিলাম, এখানে আসলাম কি করে? উনি কই?”
–” কার কথা বলছিস সায়রা?”
আগের মত অস্থির আওয়াজে বলল সায়রা,
–” আরসাল! কোথায় উনি?”
আরমিন তপ্ত নিশ্বাস ছাড়ল। বিরক্তি সহিত উত্তর দিলো,
–” আরসাল ভাই কোথা থেকে আসবে? হোটেলের কোন একজন গেস্ট তোকে বাগানে অচেতন পড়ে থাকতে দেখে রিসিপসনে নিয়ে এসেছে। সেখান থেকে আমাদের কল এসেছে। আচ্ছা, সায়রা এমন বেখেয়ালিপনা কেউ করে? যদি উল্টাপাল্টা কিছু ঘটে যেত!”
আরমিনের কথা কর্ণ কুহরে পৌঁছাল না সায়রার।ঝটপট প্রশ্ন ছুঁড়ল,
–” তোমরা লোকটাকে দেখেছ?”
আরমিন ভাবুক কন্ঠে উত্তর দিলো,
–” না! আমরা পৌঁছানোর আগেই রুমে ফিরে গেছেন তিনি। অনেক রাত হয়েছে তাই আমরাও বিষয়টা ঘাটতে যাইনি। তোকে নিয়ে রুমে ফিরে এসেছি।”
দ্বিতীয় কোন কথা বলল না সায়রা। গায়ে কোন রকম ওড়না জড়িয়ে দ্রুত পায়ে বিছানা থেকে নেমে নিচে রিসিপসনে চলে গেল। সেখানকার একজন স্টাফকে জিজ্ঞেস করল,
–” গতরাতে আমাকে যিনি বাগান থেকে নিয়ে এসেছে আপনি উনাকে চিনেন? উনার রুম নাম্বার দেওয়া যাবে প্লিজ! ইট’স আর্জেন্ট! ”
স্টাফের সায়রাকে চিনতে ভুল হলো না। গতরাতে তিনি- ই ডিউটিতে ছিলেন। এখনি ব্যাগপত্র গুছিয়েছে বাড়ির জন্য রওনা হতেন। এমন সময়ই সায়রা এসেছে। ভাগ্যিস এসেছে , না হয় এখনি বের হতেন তিনি। ভদ্রলোক মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলেন,
–” হ্যাঁ চিনি! কিন্তু সরি, আমি তা বলতে পারবো না! এভাবে গেস্টের ইনফরমেশন অন্যকারো সাথে শেয়ার করা আমাদের হোটেল রুলসের খেলাফ! কথাটা ছড়াছড়ি হলে বিপদে পড়ব আমি।”
সায়রার করুন কন্ঠে বলল,
–” প্লিজ! আমার সাহায্য করুন। আমি কাউকে কিছু বলব না উনার সাথে দেখা করাটা আমার জন্য ঠিক কতটা ইম্পরট্যান্ট তা আমি বলে বুঝাতে পারব না!”
লোকটা কিছু একটা ভেবে বললেন,
–” উনি 314 রুমে আছেন।”
সায়রার চোখেমুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। চোখ জোড়া জলে ভরে এলো। অনুগৃহীত কন্ঠে বলল,
–” আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।”
সায়রা যেতে নিলে পেছন থেকে লোকটা ডেকে বললেন,
–” ব্যাপারটা প্লিজ গোপন রাখবেন! ”
হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল সায়রা। মুচকি হেসে চোখের জল মুছতে মুছতে লিফটের দিকে ছুটে গেল। লিফট চার তলায় আটকে আছে। অপেক্ষা করার মত বিন্দু মাত্র ধৈর্য নেই সায়রার। সিড়ি বেয়ে তিনতলায় উঠে গেল। রুম নাম্বার 314 এর সামনে এসে দাঁড়াল সায়রা। নিশ্বাসের গতি বাড়ছে। ভিতরে প্রচন্ড ভয় কাজ করছে। কাঁপাকাঁপা হাতে দরজা নক করল সায়রা। ভেতর থেকে মাঝবয়সী এক নারীর কন্ঠ ভেসে এলো। সায়রা চাতক পাখির মত অপেক্ষা করতে লাগল। এই মিনিট দুএকের ব্যবধান যেন হাজার বছর সমান। রুমের দরজা খুলল এক মাঝবয়সী মহিলা। সায়রার দিকে সাবধানী চোখ বুলিয়ে বললেন,
–” ইয়েস! কাকে চাই?”
— ” এই রুমের মালিক মানে… গতরাতে যিনি আমাকে বাগানে… থেকে আমাকে নিয়ে এসেছেন। উনাকে একটু ডেকে দেওয়া যাবে!”
সায়রার কথা বারবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। নার্ভাসনেসে ঠিকঠাক গুছিয়ে বলতে পারছে না সে। সামনে মাঝবয়েসী মহিলাটা বুঝল ব্যাপারটা। কম্ফোর্ট করার জন্য চওড়া হেসে বললেন,
–” ধন্যবাদ জানাতে এসেছ বুঝি! গতরাতে তোমার কথা বলেছে ইফতি। ডিফেন্সের লোক তো কাউকে বিপদে দেখলে থেমে থাকতে পারেনা। সাহায্যের জন্য ছুটে যায়। ছেলেটা আমার ছোট থেকেই এমন। আচ্ছা, মেয়ে এখন কেমন আছো তুমি? ইফতি তো রুমে নেই, একটু বেরিয়েছে! তুমি কি ভিতরে আসবে?”
সায়রা চমকাল। ইফতি? এই ইফতি কে? তার স্পষ্ট মনে আছে গতরাতে সে আরসালকে দেখেছে। তাকে ছুঁয়েছে। জড়িয়ে ধরেছে। এই ইফতি লোকটা এলো কোথা থেকে। তবে কি সেটা সত্যি তার স্বপ্ন ছিল! আরসাল কল্পনায় এসেছিল! এত বাস্তবানুগ স্বপ্নও কি হয়! ভেতরে ভেতরে আবারো গুঁড়িয়ে গেল সায়রা।
সায়রার ভাবনার ছেদ পড়ল সুশ্রী কন্ঠে। মাথা তুলে সামনের দিকে তাকাল সায়রা। মাঝবয়েসী মহিলার পেছনে বাইশ- তেইশ বছর বয়েসী এক মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। ভীষণ মিষ্টি চেহারা তার। মহিলাকে মা বলে সম্বোধন করলেন। ধীর আওয়াজে বললেন,
–” মা ভিতরে চলুন, আপনার ঔষধের সময় হয়েছে।”
ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে সায়রা। মাঝবয়েসী মহিলা সায়রাকে হতভম্ব চেয়ে থাকতে দেখে বললেন,
–” ও, আমার ইফতির হবু বউ প্রীথি! আমি একটু অসুস্থ। এই তো আমার অপারেশনের পরই ওদের বিয়ে। সুন্দর নাহ আমার বউমা!”
সায়রা ম্লান হাসল। মেয়েটার দিকে চেয়ে বলল,
–” ভীষণ সুন্দরী আন্টি! অভিনন্দন আপনাকে।”
সায়রার কথায় তেমন একটা প্রতিক্রিয়া করল না প্রীথি মেয়েটা। কৃত্রিম হাসল শুধু। বিদায় নিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়াল সায়রা। টলতে টলতে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছে সে। আর কতবার নিরাশ হবে তাকে। আর কতবার ভাঙলে তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে! দেড় বছর ধরে তাকে তন্ন তন্ন করে খুঁজে যাচ্ছে। যখনি বাড়ির বাহিরে বেরিয়েছে তার চোখ শুধু আরসালকেই খুঁজে গেছে! কিন্তু প্রত্যেকবার শুধু নিরাশাই মিলেছে। আর পারছেনা সে। আর পারছেনা! কি এমন পাপ করেছে সে, যার জন্য এত যন্ত্রণা এত কষ্ট ভুগতে হচ্ছে তাকে। এরচেয়ে মৃত্যুও শান্তির!
.
সারা সকাল মন খারাপে কাটল সায়রার। দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে পাশেই চা বাগানে বেড়াতে গেল সবাই। সায়রাকে জোরাজোরি করলেও রাজি করতে পারেনি কেউ- ই! সায়রা যাবেনা বলে সাথে আরমিন তুর্জয়ও রয়ে গেল। সারা দুপুর রুমে কাটিয়ে শেষ বিকালে আরমিন তুর্জয়ের জোরাজুরিতে বাগানে বেড়াতে বের হলো সায়রা। আরমিন তুর্জয় কথা বলছে। পাশেই নিশ্চুপ হাঁটছে সায়রা। গভীর কোন চিন্তায় ডুবে। গতরাতের কথা ভেবে চলছে বারংবার। কিছুতেই সেই ছবি গুলো স্মৃতি থেকে মুছতে পারছে না। গেটের বাহিরে হাওয়াই মিঠাই দেখে চেঁচিয়ে উঠল আরমিন। উল্লাসিত আওয়াজে বলল,
–” আমরা ছোটবেলায় হাওয়াই মিঠাই খেয়ে জিহ্বা লাল করতাম তোর মনে আছে সায়রা? মামীমা তা দেখে কি বকুনি- ই না দিতো! ”
মিহি হেসে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল সায়রা,
–” হ্যাঁ, মনে আছে আপু!”
তুর্জয় প্রশ্ন ছুঁড়ল,
–” হাওয়াই মিঠাই খাবে তোমরা?”
সায়রা না করতে চাইল। কিন্তু তার আগেই আরমিন জানাল ‘সে খাবে’। তুর্জয় হাওয়াই মিঠাই আনতে গেল। সায়রা আরমিন পাশেই একটা বেঞ্চে বসে পড়ল। আরমিন গল্প করছে সেই দিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই সায়রার। সে চেয়ে আছে লেকের ওপারে বেঞ্চের দিকে। চোখ ঘুরাতেই থমকে গেল সায়রা। সামান্য দূরে ছাউনির সামনে কারো উপর চোখ আটকাল তার। পড়ন্ত বিকালের শেষ বেলার হলদেটে আলো মানুষটার মুখে পড়ছে । ক্ষিপ্র মুখশ্রী। কানে ফোন। কারো সাথে কথায় ব্যস্ত। সায়রার চোখ মুখ বিস্ময়ে ভরে এলো। উঠে দাঁড়াল সে, গাল বেয়ে অঝোরে জল ঝরছে। ছুটে গেল মানুষটার দিকে। ধপ করে বুকে পড়ল তার। নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজে নিলো সায়রা। অঝোর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল সে। ভাঙ্গা আওয়াজে বলল সায়রা,
–” অবশেষে আমি আপনাকে পেয়েছি আরসাল! আমার তপস্যা সফল হয়েছে! আমি আপনাকে খুঁজে পেয়েছি!”
আর কিছু বলতে পারল না সায়রা। চিৎকার করে কাঁদছে তো কাঁদছেই সে। এই দেড় বছরের সকল কষ্ট, আবেগ যেন আজ কান্না হয়ে বেরিয়ে আসছে। যতটা শক্ত করে পারছে সামনের মানুষটাকে জড়িয়ে ধরছে। হাতের বাঁধন হালকা হলেই যেন হারিয়ে যাবে সে। সামনের মানুষটার বুকে মাথা ঠেকিয়ে পিঠ খামচে ধরেছে সায়রা, যেন এখনি বক্ষপিঞ্জরে ঢুকে পড়বে সে। সেখানে লুকিয়েই তার পরম শান্তি।
সায়রাকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে পিছুপিছু আরমিনও ছুটে এসেছে। সামনে আরসালকে দেখে স্থব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। এটা কি আদৌ সত্যি নাকি কল্পনা! এটা কি সত্যি আরসাল। সায়রার দৃঢ় বিশ্বাস কি ফিরিয়ে এনেছে আরসালকে! দুজনকে এক সাথে দেখে খুশিতে চোখ ভরে এলো আরমিনের। ততক্ষণে তুর্জয় চলে এসেছে। আরমিনের মত তারও একই দশা। বিস্ময় তার আকাশ চুম্বী!
আশেপাশে ভিড় জমেছে। এভাবে লোক সম্মুখে জড়িয়ে থাকতে দেখে লোকে কথা বানাচ্ছে। হঠাৎ ভিড় ঠেলে সকালের সেই মাঝবয়েসী মহিলাটা বেরিয়ে এলো। সায়রার হাত টেনে দূরে ছিটকে ফেলল। চিৎকার করে বলল,
–” তোমাকে ভালো মনে করেছিলাম! তুমি তো দেখছি রাস্তার মেয়ে। তোমার সাহস কি করে হলো আমার ছেলের সাথে ছ্যাঁচড়ামো করার! শুনো মেয়ে এসব কাজ করার হলে রাস্তায় যেয়ে করো। আমার ছেলের দিলে চোখ দিলে চোখ তুলে নিবো। ইফতি তুই এই মেয়েটাকে কিছু বলছিস না কেন বাবা! এরা দয়ার মানুষ না। এরা সুযোগ সন্ধানী। বড়লোক সুন্দর দেখলেই গলায় ঝুলে পড়ে। এই মেয়ের এমন কাজে প্রীথির কতটা কষ্ট পাচ্ছে তোর ধারণা আছে?”
মাটি থেকে তুর্জয় আরমিন টেনে তুলল সায়রাকে। কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছেনা তারা। মহিলার কথায় হতভম্ব সায়রা। এসব কি বলছে উনি? আরসালকে বার বার ইফতি বলে ডাকছে কেন। এটা তো আরসাল। তার আরসাল!
ইফতি নামক লোকটার গালে হাত ছুঁয়ে কান্না করতে করতে বলল সায়রা,
–” এসব উনি কি বলছে আরসাল! বলুন সব মিথ্যা। আপনি আরসাল। আমার আরসাল তাইনা ? বলুন উনাকে এসব মিথ্যা! আপনি ইফতি না আরসাল। আমার আরসাল! চলুন আমার সাথে! চলুন! ”
ইফতি হাত টেনে নিয়ে যেতে চাইল সায়রা। পেছন থেকে মহিলা আটকাল। বড় বড় শ্বাস ফেলছেন উনি। আক্রোশে চিৎকার করে বললেন,
–” আমার ছেলের হাত ছাড়ো মেয়ে। না হয় বড় কোন অঘটন ঘটে যাবে তোমার! ছাড়ো বলছি!”
শেষ চিৎকারে মহিলা হাঁপিয়ে উঠলেন। ধীরেধীরে গায়ের শক্তি ছেড়ে দিচ্ছেন তিনি। ঝাড়ি মেরে সায়রার হাত ছেড়ে মহিলাকে জড়িয়ে ধরলেন ইফতি। পেছন থেকে প্রীথি মেয়েটাও ছুটে আসল। ইফতির গায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ালেন মহিলাটি। ইফতি নামক লোকটা আশ্বস্ত কন্ঠে বললেন,
–” শান্ত হও মা। আমি কোথাও যাচ্ছি না । এই দেখো তোমার কাছেই আছি।”
— ” এই মেয়েটা এসব কি বলছে ইফতি। কি বলছে এসব!”
অসুস্থ স্বরে ধীর আওয়াজে বললেন মহিলা। ইফতি সায়রার দিকে নরম দৃষ্টিতে একবার চাইল। অঝোরে কান্না করছে সায়রা। বাচ্চাদের মত কাঁদছে সে। আরমিন তুর্জয় কোন রকম চেপে ধরে আছে। সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নিলো ইফতি। নরম স্বরে বললেন,
–” আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে আমি আরসাল না ইফতি!”
এতটুকু বলেই মহিলাকে নিয়ে জায়গা ছাড়ল ইফতি। এক সেকেন্ডও অপেক্ষা করল না। পেছন থেকে চিৎকার করে কেঁদে উঠল সায়রা। সেই চিৎকার কান্না ভারী আহাজারি কান অবধি পৌঁছাল কি ইফতির!
চলবে……….