তোমার প্রণয় নগরে

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব- ৩০

” আজ একবছর পাঁচমাস বিশদিন। আপনি নেই আরসাল। আপনিহীন আমার প্রতিটি বেলা এক যুগ সমান। প্রতি প্রহর নিমিষ প্রাণহীন। এই দেহ তো বেঁচে আছে, কিন্তু এতে প্রাণ নেই । নিষ্প্রাণ বেঁচে আছি এতকাল! আমার দিবা কাটে আপনাকে ভেবে, রাত্রি কাটে জেগে। আচ্ছা, আমার অপরাধ কি এতই বড়! যার শাস্তি এত ভয়ংকর! কেন ছেড়ে গেলেন আরসাল! কতটা ভালোবাসি কতটা চাই একবার বলা সুযোগও কি পাওনা ছিল না আমার? আমি আছি, আপনার ছেড়ে যাওয়া সেই গলির মরেই আছি! চিরকাল অপেক্ষায় রইলাম আপনার। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনি আসবেন,ফিরে আসবেন। আপনাকে যে আসতেই হবে। আপনার পুতুল বউ যে আপনার অপেক্ষায়!”

চোখ মেলে ব্রিজের রেলিং চেপে নিচে জলের গভী্রে দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সায়রা। গাল বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে। চোখে মুখে তিক্ত যন্ত্রণার আভাস। ডুকরে কেঁদে উঠে সায়রা। খানিক দূরে তুর্জয়ের গাড়ি থেমে। গাড়ির ফ্রন্ট সিটে আরমিন বসে। এই দেড় বছরে সায়রা নিজেকে ঘর বন্ধী করে নিয়েছে, ঘরের চার দেয়ালই যেন তার দুনিয়া। অন্ধকার যেন তার ভীষণ প্রিয়। আরসালের স্মৃতি জড়িয়ে ঘরের এক কোনে চুপচাপ পড়ে থাকে। এই দিনদুনিয়ার কোন কিছুর ধ্যান নেই তার। কখনো জোর করেও বাড়ির বাহিরে আনা যায়না তাকে, শুধু মাঝেমাঝে এই জায়গাটায় আরসালের স্মৃতিচারণ করতে আসে। যতবার আসে প্রত্যেকবারই খুব করে কাঁদে সায়রা। চাতক পাখির মত ছটফট করে শুধু।
সায়রাকে কাঁদতে দেখে গাড়ি থেকে নেমে যেতে নিলে, তুর্জয় আটকায় আরমিনকে।বলে,

–” ওকে কাঁদতে দেও! খুব করে কাঁদতে দেও। শান্তি পাবে! ভেতরের যন্ত্রণা গুলোকে অশ্রু সাথে বেরিয়ে আসতে দেও।”

আরমিন আর এক পাও বাড়াল না। গাড়িতে গুটিয়ে বসে রইল। ডুকরে কেঁদে উঠল,

–” এই দুনিয়াতে আমি- ই বুঝি সবচেয়ে নিকৃষ্ট বোন। যে নিজের বোনের জীবন ধ্বংস করতে দিনরাত প্রার্থনা করেছি। আমার জন্যই আজ আমার বোনের জীবন এমন ছন্নছাড়া , এলোমেলো! ঘৃণা হয়, নিজেকে প্রচণ্ড ঘৃণা হয়।”

পাশ থেকে আরমিনের হাতের উপর আলতো করে হাত রাখল তুর্জয়। অন্যহাতে চোখের জল মুছে দিতে দিতে বলল,

–” ভাগ্যের উপর কারো কথা চলে না। নিজেকে দোষারোপ করোনা আরমিন। তোমার প্রার্থনায় আরসাল আমাদের ছেড়ে যায়নি, হয়তো তাদের নিয়তিতেই এক সাথে থাকা লিখা ছিল না! নিজেকে ঘৃণা না ভালোবাসো। নিজের আশেপাশে যারা তোমাকে ভালোবাসে তাদের জন্য বাঁচো দেখবে জীবন কত সুন্দর!”

আরমিন নিমিষ দৃষ্টিতে তুর্জয়ের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। এই মানুষটা তাকে এত কেন বুঝে? আরমিনের প্রত্যেক অন্যায় অপরাধ সবটাকে এত সুন্দর ভাবে কি করে মেনে নেয়! আনমনা হয়ে জিজ্ঞেস করল আরমিন,

–” আমাকে এত কেন বুঝেন? আমার সব অন্যায় অপরাধকে এত ইজিলি কি করে মেনে নেন? কেন?”

তুর্জয় ম্লান হেসে উত্তর দিলো,

–” শুনোনি? তুমি যাকে ভালোবাসো নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসো। তার ভালোটাকেও ভালোবাসো, মন্দটাকেও ভালোবাসো!”

ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আরমিন। তুর্জয়ের দৃষ্টিতে এক সমুদ্র ভালোবাসা। বেশ কিছুক্ষণ কাটল। সায়রাকে গাড়ির দিকে আসতে দেখে আরমিনের হাত ছাড়ল তুর্জয়। আরমিন দূরে সরে গেল। সায়রা চুপচাপ গাড়ির দরজা খুলে পিছন সিটে গা এলিয়ে বসল, চোখ বুজে নিলো। আরমিন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সায়রাকে দেখছে। মেয়েটা আর আগের মত নেই। ভীষণ পাল্টে গেছে। চেহারায় আগের মত সেই উজ্জ্বল ভাব নেই। শরীর দিনদিন শুকিয়ে কাঠ হচ্ছে। রক্তিম চক্ষু , চোখ জোড়ায় যেম অনন্তকালের ঘুম। শেষবার কবে সায়রাকে হাসতে দেখেছে মনে নেই আরমিনের। চেহারায় সারাক্ষণ গম্ভীর ভাব। সবকিছুতে ছন্নছাড়া অনিয়ম বেখেয়ালি। সেই আগের চঞ্চলা ,হাসি উজ্জ্বল ,লাজুকলতা সায়রা যেন কোথাও হারিয়ে গেছে। প্রিয়জন হারানোর পীড়া বুঝি এমনি তীব্র হয়? চোখ ভরে এলো আরমিনের। আহত আওয়াজে বলল,

–” তুই ঠিক আছিস সায়রা?”

সায়রা চোখ বুজে আগের মত রুখা উত্তর দিলো,

–“আমি ঠিক আছি আপু, বাড়ি চলো! ”

.
বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। ড্রইং রুমে বসে পান চিবাচ্ছেন জুলেখা বেগম। মুনতাহা বেগমের অসুস্থতার খবর পেয়ে এসেছেন। পানের ছিট ফেলতে ফেলতে বললেন,

–” আপনাকে আগেই বলেছিলাম ভাবী এই মেয়ে একটা অলক্ষি। এই মেয়েই আমাদের ছেলেটাকে খেয়েছে। কেন যে আরসাল এই মেয়েটাকে বিয়ে করল, আর আপনারাও মেনে নিলেন। যদি আরসাল ওকে বিয়ে না করত তবে আমাদের ছেলে আজ বেঁচে থাকত!”

মুনতাহা বেগম বিরক্ত হলো। জুলেখা বেগমকে শক্ত ভাবে কিছু বলতে চাইল। কিন্তু দরজায় সায়রাকে দেখে চুপ করে গেল। মুনতাহার পাশে এসে বসল সায়রা। টেবিলের উপর থেকে স্ফিগমোম্যানোমিটার নিয়ে বিপি চেক করল। শক্ত আওয়াজে বলল,

–” বিপি লো, দুপুরে খাওনি তাই না? কেন এমন হেলামি করো । এখন কে ভুগছে? কে কষ্ট পাচ্ছে? আমি বাড়িতে না থাকলেই তোমার যত হেলামি আর অনিয়ম। এমন কেন তুমি বলো তো!”

মুনতাহা বেগম বাচ্চাদের মত অপরাধী ভঙ্গিতে মাথা নুয়ে নেয়। আমতা আমতা করে বললেন,

–” তুই বাড়ি ছিলি না। একা একা খেতে ভালো লাগেনা মা।”

সায়রা তপ্ত নিশ্বাস ছাড়ল। শাসানোর আওয়াজে বলল,

–” আর যেন হেলামি না হয়। তুমি এখনি খাবে। আমি নিজ হাতে তোমাকে খায়িয়ে দিবো। দিনদিন তুমি বড্ড বেখেয়ালি হচ্ছো। এমন হলে কি হবে?”

পাশ থেকে জুলেখা বেগম ধমক দিয়ে বললেন,

–” বেয়াদব মেয়ে তোমার সাহস কত বড়! ভাবীকে তুমি শাসাচ্ছ! এই মেয়ে এই। তুমি কে হ্যাঁ? এই বাড়িতে কেন পড়ে আছো? এখনো যাচ্ছনা কেন? বুঝেছি এসব নাটক করে সম্পত্তি হাতাতে চাইছ! নিলজ্জ মেয়ে, লজ্জা করেনা! আমাদের ছেলেকে খেয়েছ এখনআবার ভাই ভাবীকে মারতে চাইছ?”

সায়রা চুপ থাকল। আজকাল লোকের এসব কথা আর কানে তুলে না সায়রা। প্রতিনিয়ত এসব কথা শুনতে শুনতে অনুভূতি জিনিসটাই মরে গেছে। সত্যি এখন নিলজ্জ হয়ে গেছে। লোকের এসব অপমান গায়ে মাখে না আর। না অন্যের কথায় ফ্যাচফ্যাচ কাঁদে। এখন শরীর যেন লোহার তৈরি, লোকের হাজারো অপমান অপবাদ কোনকিছুতে ভাঙ্গে না সে! প্রতিবাদী আওয়াজে মুনতাহা বললেন,

–” আমার ঘরের লক্ষি, আমার মেয়ে সায়রা! শুধু ওর মুখের দিকে তাকিয়েই বেঁচে আছি আমরা। এটা সায়রার বাড়ি। সায়রার যা ইচ্ছে ও করবে। খবরদার! আমার মেয়ের সাথে সাবধানে কথা বলবে জুলেখা। বাহিরের লোক এসে আমার মেয়েকে কথা শুনাবে আমি তা সহ্য করব না!”

প্রচণ্ড অপমানে মাথা নুয়ে নিলো জুলেখা বেগম। মনে মনে বেশ কিছুক্ষণ বিরবির করল। তা কারো কান অবধি পৌঁছাল না।

.
ঘরে ফিরে রিদ্ধিকে দেখে বেশ চমকাল সায়রা। ম্লান হেসে রিদ্ধির ছয় মাসের কন্যা রিধিমাকে কোলে তুলে নিলো। রিধিমাও খালামণিকে দেখে খিলখিল হেসে উঠল। যেন তার কত চেনা। রিধিমাকে আদর করতে করতে বলল সায়রা,

–” তুমি আসবে, আগে বললে না যে! জরুরী কোন কাজে এসেছ কি? ”

রিদ্ধি ছিটকে উঠল। আমতাআমতা করে হাসল। রিদ্ধি হুট করে আসেননি। বিশেষ এক কারণেই এসেছে। কি করে বলবে সায়রাকে, যে তার জন্য বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে এসেছে! রিদ্ধি আমতাআমতা উত্তর দিলো,

–” অনেকদিন হলো তোকে দেখি না। তাই ভাবলাম একটা রাত তোর সাথে এসে থাকি। জানিস তো সামনে সাপ্তাহে আমরা সবাই সিলেট যাচ্ছি। ফ্যামিলি ট্রিপ! তুইও কিন্তু সাথে যাচ্ছিস! ”

সায়রার ঝটপট উত্তর,

–” আমি যাবো না দি , আমার ভালোলাগেনা। তোমরা যাও!”

–” সবাই যাচ্ছে! খালা খালু আহনাফ আঙ্কল মুনতাহা আন্টিও যাচ্ছে!”

–” আমি যাবোনা রিদ্ধিদি! প্লিজ জোর করোনা আমাকে!”

বিরক্ত হলো রিদ্ধি। তেজি কন্ঠে বলল,

–” আর কতকাল সায়রা! আর কতকাল এভাবে কাটাবি ? অতীত ভুলে সামনে আগা। এটা কোন জীবন না। এটাকে জীবন বলে না। ”

–” শ্বাস নিচ্ছি, হাঁটছি চলছি, এটাই তো জীবন। আমি ভালো আছি দি। আমাকে আমার মত থাকতে দেও!”

–” এটা কেমন জীবন যেখানে কোন রঙ নেই। সাদামাটা রঙহীন!”

–” আমার এই সাদামাটা জীবন- ই সয়ে গেছে! রঙিন জীবনের কথা ভাবতেই নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।”

–” ভাগ্যকে পাল্টানো যায়না। তাই বলে কি এভাবেই একাকী কাটিয়ে দিবি সারাজীবন! তোর বয়সী অনেকে এখনো বিয়েই করেনি সায়রা। নিজের জীবনকে আরেকটা সুযোগ দে।”

–” বিয়ে কয়বার হয় দি? আমার বিয়ে হয়ে গেছে। আমার জীবনে একমাত্র পুরুষ আরসাল। উনার স্থান আমি কাউকে দিতে পারবো না দি। তাছাড়া বিয়েই কি সব? একাকী কি বাঁচা যায় না? এই দেখ আমি বেশ ভালো আছি। কি দরকার অন্যকাউকে আমার সাথে জড়িয়ে তার জীবন নষ্ট করার? যাকে আমি ভালোই বাসতে পারবো না তাকে জীবনের সাথে জড়িয়ে কি লাভ!”

চুপ রইল রিদ্ধি। সে বেশ জানে সায়রার যুক্তির সাথে পেরে উঠতে পারবেনা। তাই বলে সে ক্ষান্ত হবে না। এভাবে চোখের সামনে বোনের জীবন কি করে নষ্ট হতে দিবে সে! এটা কোন জীবন না। সায়রাকে স্বাভাবিক হতে হবে। স্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে হবে। জোর করেই সিলেটে নিয়ে যাবে। বাড়ির বড়দের সাথে কথা বলেছে রিদ্ধি। সিলেটে সায়নের বন্ধু আবিরের বাড়ি। রিদ্ধির বিয়েতে সায়রাকে দেখেছে আবির।সায়রাকে ভীষণ পছন্দ তার। আরসালের সাথে সম্বন্ধ পাকা শুনে ব্যাপারটা আর সামনে আগায়নি। সেদিন কথায় কথায় সায়ন থেকে আরসালের এক্সিডেন্টের কথা শুনে খুব আফসোস করেছে, একটা সুযোগ চাইছে। সায়রার অতীত নিয়ে তার কোন সমস্যা নেই। বড়দের সাথে কথা বলেছে রিদ্ধি। উনাদের কোন আপত্তি নেই। এখন সায়রা রাজি হলেই হয়।

চলবে………

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here