তোমার প্রণয় নগরে

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব- ২৫

(কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )

বাড়ি ফিরে আরমিনকে কিছু জিজ্ঞাস করার সাহস বা সুযোগ হলো না সায়রার। বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করবে করবে করে আর করা হয়নি। দরজার সামনের থেকে ফিরে এসেছে। সেদিনের পর থেকে আরমিনও বেশ চুপচাপ হয়ে গেছে। কোন সাড়াশব্দ নেই! বাড়ির কারো সাথে তেমন কথাবার্তাও বলে না। সারাক্ষণ নিজের ঘরে শুয়ে বসে কাটায়। দুদিন পর সায়রার ফাস্ট ইয়ার ফাইনাল। পড়াশোনা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত সে। তাই আরমিনকে নিয়ে খুব একটা ঘাঁটতে যায়নি। কি দরকার ঘাঁটাঘাঁটি করার? যদি আরসাল রিজেক্টও করে থাকে, তা একান্তই আরসালের নিজেস্ব সিদ্ধান্ত! সেই সিদ্ধান্তকে পাল্টানোর মত অধিকার বা সাহস কোনটাই সায়রার নেই।

.
সকাল আটটা মেইন রোডে দাঁড়িয়ে আছে সায়রা। আশেপাশে কোন রিক্সা গাড়ি কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। শুনেছে সামনের রাস্তায় আজ বিরাট সমাবেশ। তাই রাস্তাঘাট সব সকাল থেকে সারাদিন বন্ধ থাকবে। তার উপর পরিক্ষার কেন্দ্র পড়েছে সাভারের শেষ মাথা ধামরাই । যার নাম শুনলেও কোনদিন যাওয়া হয়নি সায়রার। সেখানে রাস্তা চেনা- জানাত অনেকদূর!
সময় মত পরিক্ষার হলে পৌঁছাতে পারবে তো? ভাবতেই ভয়ে চোখ মুখ চুপসে গেলো সায়রার। অশ্রুভারাক্রান্ত চোখ। নাক লাল টকটকে। বারংবার ঘড়ি দেখছে আর চোখের জল মুছছে। পাশ থেকে সিন্থিয়া বেগম মেয়েকে দেখছে। অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিলেন তিনি। ভেবেছিল, সায়রাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে তিনি অফিসে চলে যাবেন। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে মেয়েকে বিপদে দেখে ফেলে যাওয়া উচিত মনে হলো না। মনে মনে ভেবে নিলেন আজ অফিস কামাই দিবে। সায়রার মাথায় হাত রেখে আশ্বস্ত স্বরে বললেন সিন্থিয়া,

–” চিন্তা করিস না মা! হাতে এখনো একঘণ্টা সময় আছে ঠিক পোঁছে যাবি।”

মায়ের কথা কানে আসতেই আরেকবার ঘড়ি দেখে নিলো সায়রা। ‘আটটা নয়’। ঠিক সময় কেন্দ্রে পৌঁছাতে না পারলে এত কষ্ট, এত পরিশ্রম সব শেষ! ভয়ে কেঁদে উঠল সায়রা। কোন দিশা না পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে সামনের দিকে হাঁটা শুরু করল সে। পিছুপিছু সিন্থিয়াও গেল। কিছুদূর যেতেই আরসালকে দেখল। গাড়ি করে বাড়ির দিকে ফিরছে। সায়রাদের দেখে থামল। আরসাল গাড়ি থেকে নেমে মুখোমুখি হলো । এক পলক সায়রার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে নিলো । চিন্তিত স্বরে সিন্থিয়া বেগমকে প্রশ্ন করল আরসাল,

–” কোথায় যাচ্ছ ছোট মা?”

–” বলোনা বাবা! অফিসের জন্য বেরিয়েছিলাম, নয়টা থেকে সায়রার পরিক্ষা শুরু ধামরাই কলেজে সিট পড়েছে। ভেবেছিলাম ওকে গাড়িতে তুলে দিয়ে অফিসে যাবো । কিন্তু এদিকে রাস্তাঘাট সব বন্ধ! তার উপর ঐদিকের রাস্তাঘাট চিনেনা সায়রা , ওর বান্ধবীরা সবাই অনেক আগেই চলে গেছে। শুধু সায়রাই রয়ে গেছে!”
ক্লান্ত চিন্তিত সুরে উত্তর দিলেন সিন্থিয়া বেগম। কিছু একটা ভেবে আরসালের ততক্ষণাত উত্তর,
–” তুমি বাড়ি ফিরে যাও। আমি পেছন দিকের শাখা রাস্তা দিয়ে সায়রাকে পৌঁছে দেব!”

–” তোমার সমস্যা হবে না? খামাখা ঝামেলা হবে তোমার! ”

–“আমি আজ সারাদিন ফ্রি। ”

সিন্থিয়া আর কথা বাড়াল না এমনিতেই অনেক দেরী হয়ে গেছে। সায়রার নাকচ করার মত বিকল্প নাই। পরিক্ষায় ঠিক সময় উপস্থিত থাকতে হলে তাকে এক্ষুণি আরসালের সাথে বেড় হতে হবে! তার উপর মায়ের মুখের উপর না করার সাধ্যি কই? দ্রুত পায়ে আরসালের পাশের সিটে বসল সায়রা। গাড়ি চলছে নিজ গতিতে। শক্ত হাতে ফাইল চেপে ধরেছে সায়রা। শরীরের কাঁপুনি তখনো থামেনি তার, চোখ বেয়ে ঝরছে অঝোর ধারা! বড় বড় নিশ্বাস ছেড়ে নিজেকে শান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু হচ্ছে না। মাথায় শুধু পরিক্ষার চিন্তা ঘুরঘুর করছে। আরসাল সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তা লক্ষ করল। সামনের টিস্যুর বক্সটা সায়রার দিকে এগিয়ে দিয়ে গম্ভীর আওয়াজ করল,

–” মাথা ধরছে আমার। কান্না বন্ধ কর!”

ঝটপট দুইটা টিস্যু হাতে নিয়ে চোখমুখে চেপে ধরল সায়রা। সাইড ব্যাগ থেকে পানির বোতল হাতে নিয়ে ঢকঢক করে কয়েক ঢোক পানি গিলে নিজেকে শান্ত করল। আজ কতদিন পর মানুষটার এত কাছাকাছি সে। কতদিন পর সেই চিরচেনা মাতাল ঘ্রাণটাকে কাছ থেকে অনুভব করছে। পরিক্ষার আগে উনার সাথে দেখা হওয়াটা কি খুব জরুরী ছিল? যা পড়েছে সবটা তো আউলে গেল! এইতো মাথাটা ফাঁকা। একেবারে ফাঁকা! আড়চোখে একবার আরসালকে দেখে নিলো সায়রা। ফরমাল ড্রেসে আরসাল। অফিসের উদ্দেশ্যে বেড়িয়েছিল বোধহয়। উনিও নিশ্চয়ই তার- ই মত ভুক্তভোগী! এসব ভেবে গভীর ভাবনায় ডুব দিলো সায়রা।
মেইন রোড ছেড়ে শাখা রাস্তার দিকে গাড়ি ফিরতেই ভ্রু কুঁচকে এলো সায়রার। ঝটপট প্রশ্ন করে উঠল আরসালকে,

–” এটা কোথায়! কোথায় যাচ্ছি আমরা?”

আরসাল বিরক্তির মুখ করে কয়েক পলক সায়রার দিকে তাকিয়ে বাহিরের সাইনবোর্ডের দিকে ইশারা করল। হলুদ বোর্ডে গোটাগোটা কালো অক্ষরে লিখা ‘ধামরাই থানারোড’ । টনক নড়ল সায়রার। এটাই তো তার গন্তব্য। এখান থেকে রিক্সা নিয়ে ধামরাই কলেজ। যেখানে সায়রার সিট পড়েছে। আশেপাশে আরেকবার খেয়াল করল সায়রা। একদম শুনশান নিরিবিলি জায়গা। আশেপাশে দুএকটা টংয়ের দোকান। হাতে গুনা তিন চারটা রিক্সা। এটা কি করে থানা রোড হতে পারে? কোথাও এমন নিরিবিলি জনশূন্য থানা রোড আছে জানা ছিল না সায়রার।
আরসাল ড্রাইভ করতে করতে তাচ্ছিল্য হেসে বলল,

–” চেনা নাই, জানা নাই একা একা ড্যাং ড্যাং বেড়িয়েছিলি! তোকে একা ছাড়লে দেখা যেত, তুই গেটে পা রেখেছিস! আর এদিকে সবার পরিক্ষা শেষ! ঘন্টা বাজছে! ”

কোনো উত্তর দিলো না সায়রা, লজ্জায় গুটিয়ে নিলো। ভার্সিটির সামনে গাড়ি থামতেই ফাইল হাতে নিয়ে খিঁচে এক দৌড় দিলো। কিছু পথ গিয়ে থেমে গেল সায়রা। পিছন ফিরে বড় বড় নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে জোর আওয়াজে বলল,

–” ধন্যবাদ আরসাল ভাই!”

উত্তর দিলো না আরসাল। চেহারায় গম্ভীর ভাব এঁটে চোখ ফিরিয়ে নিলো। সায়রা চলে গেল। পরিক্ষা শেষে গেটের বাহিরে আরসালের গাড়ি থেমে থাকতে দেখে বেশ চমকাল সায়রা। কাছে যেয়ে গাড়ি কালো কাঁচে ঝুঁকল। ভেতরে আরসাল আছে কিনা দেখার চেষ্টা করল। পারল না। কালো কাঁচের জানালা ভেদ করে সায়রার দৃষ্টি ভিতরে পৌঁছাতে পারল না। পেছন থেকে আরসালের ভারী আওয়াজ ভেসে এলো,

–” পরিক্ষা শেষ!”

সায়রা ভড়কে গেল। পিছন ফিরল। মুচকি হেসে বেশ স্বাভাবিক স্বরে বলল,

–” আপনি যাননি আরসাল ভাই? এতক্ষণ এখানেই ছিলেন?”

উত্তর দিলো না আরসাল। ধমকে বলল,

–” গাড়িতে উঠ!”

সায়রা বিনাবাক্যে গাড়ি চড়ে বসল। সিটে হেলান দিয়ে জানালার কাছে মাথা ঠেকাল। চার ঘন্টা পরিক্ষা দিয়ে ভীষণ ক্লান্ত সে। শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। গত দুই রাত ভালো ঘুম হয়নি। চোখের পাতা জ্বলছে। ঘুমে ঢলঢল করছে দুচোখ। কখন যে চোখ লেগে গেল, স্বরণে নেই সায়রার।
ঘুম ভাঙল ঘন্টা দুএক পর। পিটপিট দৃষ্টি মেলে সামনে তাকাতেই ছিটকে গেল সায়রা। ড্রাইভিং সিটে হেলান দিয়ে নিমিষ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আরসাল। কেমন জানো অদ্ভুত, মাতাল দৃষ্টি। চোখে গভীর কোন ভাষা ভাসছে। কিন্তু সেই ভাষা বুঝার ক্ষমতা বা সাহস কোনটাই নেই সায়রার। আরসালের গাঢ় দৃষ্টি সায়রার গলার ছোট তিলটায়। ধর ফরিয়ে উঠল সায়রা। ওড়না ঠিক করতে করতে মুখ বেঁকিয়ে বলল,

–” এমন শকুন দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন কেন আরসাল ভাই?”

–” শিকার করবো তাই!”

সায়রা ভ্রু কুঁচকে একবার আরসালের দিকে তাকাল। যেন ভীষণ বিরক্ত সে। ঘড়ির দিকে চোখ বুলিয়ে দ্বিগুণ বিরক্তি নিয়ে বলল সায়রা,

–” আরসাল ভাই এখানে গাড়ি থেমে কেন? বাড়ি ফিরব কখন? সন্ধ্যা নামল প্রায়! ”

আরসালের আগের মতই গম্ভীর আওয়াজ,

–” ফিরবো না বাড়ি। এই গাড়িতে তুই আমি এই ভাবেই বন্ধী থাকব সারাজীবন। কি ভালো হবে না?”

এবার সায়রা আগের চেয়ে আরো বেশি বিরক্ত নিয়ে বলল,

–” আবার! আবারো, আপনি পাগলামো শুরু করেছেন? আমারই ভুল আমি আপনার সাথে এসেছি। থাকবো না আমি। আমি একাই চলে যাবো! ”

গাড়ি থেকে নামার জন্য দরজার দিকে হাত বাড়াতেই পেছন থেকে টান পড়ল। পিছন ফিরতেই নিজের কাছে টেনে নিলো আরসাল। বুকে যেয়ে পড়ল সায়রা। সে বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিলো আরসাল। দিনের শেষ কোমল আলো সায়রার মুখে পড়ছে। ঝলঝল করছে ঘুমঘুম চোখ। অবাধ্য চুল গুলো বারংবার কপাল ছুঁচ্ছে। বেশ আবেশে তা সরিয়ে দিলো আরসাল। যেন এই মুহূর্তে অবাধ্য চুল গুলোকে গুছিয়ে দেওয়া অত্যন্ত জরুরী। না করলেই নয়। মনোযোগ সেদিকে রেখে বেশ আবেগী স্বরে বলল আরসাল,

–” এত নিখুঁত অভিনয় কি করে করিস তুই? বিরক্ত হয় না?”

হুট করে আরসালের এমন প্রশ্নে ভড়কে উঠল সায়রা। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করে,

–” কিসের অভিনয়! কি বলছেন আপনি!”

স্মিত হেসে সায়রার দিকে তাকাল আরসাল। কপালের টুপ করে চুমু এঁকে নাকের সাথে নাক ঘষতে ঘষতে বলল,

–” কতদিন আমার থেকে সত্য লুকাবি তুই? তুই চলিস ডালে ডালে, আমি চলি পাতায় পাতায়!”

সায়রা চোখ মুখ খিঁচে বলল,

–” হেঁয়ালি বন্ধ করে। সোজাসুজি বলুন কি করেছি আমি!”

–” সোজাসুজি বলব?”

সায়রা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। আরসাল সায়রাকে ছেড়ে স্ট্রেইট বসল। সায়রার দিকে কঠোর দৃষ্টি মেলে গম্ভীর আওয়াজে বলল,

–” তোর বোন আমাকে পছন্দ করে তুই তা আগে থেকে জানতি? ওর জন্যই কি আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছিস?”

সায়রা চুপ। থতমত খেয়ে গেছে। এভাবে আরসালের কাছে একদম ধরা পড়ে যাবে বুঝেনি সে। প্রচণ্ড উত্তেজনায় শরীর থরথর কাঁপছে তার। কি রেখে কি বলবে? বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে ইনিয়েবিনিয়ে আমতা আমতা জবাব দেয় সায়রা,

–” কই, আমি তো কিছু জানি না! আরমিন আপু আপনাকে পছন্দ করে নাকি?”

হো হো করে গা কাঁপিয়ে হাসল আরসাল। তার যা বুঝার জানার, সে তা বুঝে গেছে! পাশ থেকে সায়রা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। হাসছে কেন আরসাল ভাই। উনি কি কিছু টের পেয়েছে! সে কি ঠিকঠাক গুছিয়ে মিথ্যা বলতে পারেনি!

সন্ধ্যা নেমেছে। চারিদিক অন্ধকার। গাড়ি বাড়ির সামনে থামতেই সায়রা নেমে গেল। পেছন থেকে ডাকল আরসাল। সায়রা থামল, পিছন ফিরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। আরসাল বেশ স্বাভাবিক স্বরে বলল,

–” সাবধান সুন্দরী! এই শকুনের নজর পড়ছে, মনে ধরেছে তোকে! বলা তো যায় না কখন আবার উড়িয়ে নিয়ে যাই!”

সায়রা বেশ কিছুক্ষণ থম মেরে চেয়ে রইল। আরসালের কথার আগাগোড়া বুঝল না। বেশ কিছুক্ষণ পর বিরবির করল,

–” আপনি পাগল হয়েছেন। বড্ড পাগল! ”

চলবে…..❣️

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here