তোমাকে
শেষ পর্ব প্রথম অংশ
আজ অনিমার রেজাল্ট হবে I সকাল থেকে খুব টেনশনে ছিল I কিন্তু রেজাল্ট দেখে শুধু খুশি নয় ভীষণ অবাক হয়ে গেল I এতটা ও আশা করেনি I সেঁজুতি জন্মের পরে ওর স্টাডি গ্যাপ হয়েছে I ছোট্ট সেজুতিকে সামলে পড়াশোনা করাটা কঠিন ছিল I তবুও চেষ্টা করেছে I আর শুধু তো সেঁজুতি নয় সংসারের সমস্ত কাজ, রান্না-বান্না সব একা হাতে করতে হতো I আশিক অবশ্য বাইরে থেকে খাবার এনে খেতে চাইতো কিন্তু অনিমার ভালো লাগেনা I ও নিজেই খুঁজে খুঁজে দেশি দোকান থেকে মাছ, সবজি ,তরিতরকারি কিনে নিয়ে আসে I রেসিপি বুক দেখে রান্না করে I প্রথমদিকে খারাপ হলেও ধীরে ধীরে অনিমার হাতে স্বাদ আসতে শুরু করে I আশিক কখনো খায় , কখনো বা বাইরে থেকে খেয়ে ফেরে I পড়াশোনা, বাগান, রান্নাবান্না সেজুতিকে নিয়ে অনিমার সময় কেটে যায় I এককালের এলোমেলো অগোছালো অনিমা এখন পুরোদস্তুর সংসারী I
বিয়ের আগে আশিক অনিমাকে দেখে যতটা মুগ্ধ হয়েছিল বিয়ের পর মুগ্ধ হলো তার চেয়েও বেশি I সবাই বলেছিল বিয়ে করেছিস এবার তো স্বাধীনতা শেষ I কিন্তু আশিক অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো ওর লাগামহীন জীবন নিয়ে অনিমার কোনো আপত্তি নেই I ছুটির দিনগুলোতে আশিক বন্ধুদের নিয়ে পিকনিকে, ফিশিং করতে কিংবা লংড্রাইভে চলে যেত I অনিমা কে যে একেবারে বলতো না তা নয় I অনিমা আগ্রহ দেখাতো না I ছেলে বন্ধুর পাশাপাশি আশিকের অনেক মেয়ে বন্ধু আছে I প্রায়ই ও তাদের নিয়ে কফিশপে রেস্টুরেন্টে কিংবা লংড্রাইভে চলে যায় I প্রথমদিকে অনিমা ও যেতI কিন্তু সেঁজুতির জন্মের পর আর যায় না I অনিমা ও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে I ওই পরিবেশ ওর একেবারেই ভাল লাগেনা I
বন্ধুমহলে সবাই আশিক কে নিয়ে ঈর্ষান্বিত I এত উদার বউ I আশিক যেমন খুশি তেমনি গর্বিত I এত সুন্দরী বউ , সেই রকম ভালো গান গায় তার উপর এত উদার I কিন্তু খুব ধীরে ধীরে আশিক টের পায় এটা আসলে উদারতা নয় উদাসীনতা I আশিকের জীবনযাপন নিয়ে অনিমার কোনো মাথা ব্যথা নেই কারণ অনিমা কখনো ওকে ভালোই বাসিনি I আশিক অবশ্য হালকা ধরনের ছেলে I এসব ভালোবাসা ফাসা নিয়ে ওর তেমন কোনো আগ্রহ নেই I অনিমা ওর প্রতি অনেস্ট, সংসারের প্রতি ডেডিকেটেড এতেই খুশি ও I তবে আশিক কেন যেন অনিমার প্রতি জোর পায় না I অনিমা ওকে এতটাই ছাড় দিয়েছে যে ওকে জোর দিয়ে কিছু বলতে পারেনা I বারবার ওর শীতল ব্যক্তিত্বের কাছে পরাজিত হয়ে যায় I
ডিপার্টমেন্ট থেকে বের হয়ে অনিমা বাইরে তাকালো I মেইন গেটের উল্টোদিকে অনেকটা ফাঁকা জায়গা I সবুজ গাছে ঘেরা I এরমধ্যে অনিমার সবচেয়ে প্রিয় গাছটা হলো একটা বিশাল উইলো ট্রি I গাছটার মধ্যে একটা অদ্ভুত বিষন্নতা আছে I ও প্রায়ই এই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে এর বিষন্ন শব্দ শোনে I এজন্যই কি এর নাম উইপিং উইলো ? আসলে এই গাছের ডাল আর পাতা বেয়ে যখন বৃষ্টির জল ঝরে তখন সেটা দেখতে অশ্রুবিন্দুর মতো মনে হয় তাই এই নাম I
কিন্তু আজ এই গাছটার দিকে তাকিয়ে অনিমার মন ভাল হয়ে গেল I গাছের নিচে মুনির দাঁড়িয়ে আছে I দূর থেকে অনিমাকে দেখে হাসলো I অনিমা দৌড়ে গিয়ে বলল
– কখন এসেছ ?
– এইতো I বলেছিলাম না রেজাল্ট ভালো হবে
– বাঁচা গেল I আমি তো 3RD PAPER টা নিয়ে খুব চিন্তায় ছিলাম I চলো যাওয়া যাক
– কফি নেবে না ?
– ও হ্যাঁ তাইতো I দাড়াও আনছি
অনিমা কফি শপে ঢুকে বড় এক কাপ কফি নিল I তারপর দুজনে রাস্তা ধরে হাটতে লাগল I অনিমা বলল
– চলো লেকের ধারে গিয়ে বসি
– আজ না I আজ তোমার সেজুতিকে তাড়াতাড়ি পিক করতে হবে ডে-কেয়ার থেকে I মনে নেই ?
– ও হ্যাঁ ভুলেই গিয়েছিলাম
– আমি না থাকলে তোমার কি যে হতো
– সো নাইস অফ ইউ
বলতে বলতে অনিমা হাসিমুখে পাশে তাকালো I একটা সোনালী চুলের অল্প বয়সী ছেলে পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো কথা শুনে হাসতে হাসতে HAVE A NICE DAY বলে চলে গেল I
অনিমা একটু থমকে গেল I ছেলেটা ওকে পাগল ভাবল নাতো একা একা কথা বলতে বলতে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে বলে ?
*********
মনিরের স্মৃতিশক্তি অস্বাভাবিক রকমের ভালো I এই ভালো স্মৃতিশক্তি মাঝে মাঝে ওর অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায় I এই যেমন আজ ক্লাস শেষে বেরোনোর পর ও টের পেল একটা মেয়ে ওর পেছনে পেছনে আসছে I মুনির পেছন ফিরে বলল
– কিছু বলবে নীলাঞ্জনা ?
মেয়েটা কেমন যেন কেঁপে উঠলো I বোধহয় ওর নাম ধরে ডাকায় I মেয়েটা কিছু বলছে না মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে I মুনির আবারো জিজ্ঞেস করল
-কিছু বলবে ?
মেয়েটা এবার পেছনে লুকিয়ে রাখা ওর হাত থেকে একটা ছোট বক্স এগিয়ে দিল I মুনির অবাক হলো না I মুনির ডিপার্টমেন্টে জয়েন করেছে দু’বছর I এর মধ্যে অসংখ্য মেয়ে ওর প্রেমে পড়েছে I এই মেয়েটা কে ও এখন কিছুতেই বোঝাতে পারবে না যে ওর নাম মনে রাখাটা কোন বিশেষ ঘটনা নয় I মুনির ওদের ক্লাসের প্রত্যেকটা ছেলেমেয়ের নাম জানে I শুধু নাম নয় প্রত্যেকের রোল নাম্বার ও ওর জানা I এই যেমন এই মেয়েটার রোল নাম্বার 38 I এখন যদি এটা এ মেয়েটা কে বলা হয় তাহলে বোধহয় অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে I
মুনির বলল
– আমি আমার স্টুডেন্টের থেকে কোন গিফট নেই না I ভালো করে পড়াশোনা করো I ভালো রেজাল্ট করলেই আমি খুশি হব I
আজকালকার ছেলেমেয়েদের ব্যাপার-স্যাপার মুনির কিছুই বুঝতে পারেনা I এখন ক্রাশ খাওয়া বলে একটা কথা প্রচলিত আছে I এর মানে কি মুনির জানেনা I দুদিন পর পর এরা কাউকে দেখে ক্রাশ খায় I ওদের সময় প্রেম ছিল, ভালোলাগা ছিল, ভালোবাসা ছিল কিন্তু এসব ক্রাশ ফ্রেশ ছিল না I আজ একজনকে দেখে ক্রাশ খাচ্ছে তো কাল অন্য কাউকে I এই ক্রাশ খাওয়া বা পড়া যাইহোক এই ব্যাপারটা মুনির এর মাথায় ঢোকে না Iএক জীবনে একজনকে ভালবেসেই কুলিয়ে উঠতে পারল না তার আবার অন্য কাউকে ভালো লাগবে I মুনির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘড়ির দিকে তাকালো I মাত্র সাড়ে এগারোটা বাজে I আরো একটা দীর্ঘ ক্লান্তিকর দিন I মুনির আস্তে আস্তে হেঁটে ওর রিসার্চ ল্যাবে ঢুকে গেল I
***********
সেজুতিকে আজ প্রথম মিডিল স্কুলে যাবে I সকাল থেকেই অনিমা বেশ চিন্তিত I কি জানি কেমন টিচার হবে I অন্যান্য ছেলেমেয়েরা ওকে কতটুকু কাছে টেনে নিতে পারবে I আশিকের অবশ্য এগুলো নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই I ও পুরোটাই অনিমার ওপর ছেড়ে বসে আছে I শুধু টাকা দেয়া ছাড়া আর কোন দায়িত্বের মধ্যে নেই I আজও সকাল হতেই বেরিয়ে গেছে বন্ধুদের সঙ্গে বারবিকিউ করতে I মাঝে মাঝে অনিমার মনে হয় ওর মেয়েটা বোধহয় ওর চাইতেও দুঃখী I
মজার ব্যাপার হলো স্কুলে যাওয়ার পর অনিমার মনটাই ভালো হয়ে গেল I এত চমৎকার টিচার আর সেই রকম চমৎকার বন্ধুরা I সেঁজুতি ও খুব খুশি I অনিমা নিশ্চিন্ত মনে বাড়ী ফিরে এলো I আসার পথে কয়েকটা দেশি মরিচ টমেটো আর ক্যাপসিকামের চারা কিনে আনলো I অনেকক্ষণ ধরে যত্ন করে বাগানে গাছগুলো লাগানোর পর বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়ল I কোণের দিকে চেরি গাছটাতে এবার অনেক ফুল ধরেছে I অনিমা ওড়না দিয়ে কপালের ঘাম মুছে গাছটার নিচে গিয়ে বসলো I টুপটাপ করে দুই একটা গোলাপি ফুলের পাপড়ি ওর উপর ঝরে পড়ল I হঠাৎ করেই অনেক বছর আগের কথা মনে পড়ে গেল I এদেশে শিউলি ফুটে না, না হলে ও একটা শিউলি গাছ লাগাতে I হঠাৎ করেই দমকা বাতাসে অনেকগুলি ফুলের পাপড়ি ওর উপরে এসে পড়ল I অনিমা পাশ ফিরে বলল
– কি করছো ?
– কেন ? এটা তো তোমার খুব প্রিয় ছিল
– আর প্রিয় I আচ্ছা শিউলি গাছ টা কি এখনো আছে ?
– আছে মনে হয়
অনিমা বিষন্ন হয়ে গেল I অন্যমনস্ক হয়ে গাছের নিচে বসে রইল অনেক্ষণ I আবার যদি সেই আগের দিন গুলিতে ফিরে যাওয়া যেত I কি যেন বলেছিল মুনির আমাদের আশেপাশে অনেক ছোট ছোট সৌন্দর্য আছে যেগুলো খুঁজে নিতে হয় যা আমাদের অনেক বড় বড় দুঃখ ভুলে থাকতে সাহায্য করে , এ রকমই কিছু একটাI অনিমা তাই করে I ছোট ছোট সৌন্দর্য গুলো নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখে I
*******
আজ ডিপার্টমেন্ট এর পিকনিক I মুনির এইসব অনুষ্ঠানগুলো সযত্নে এড়িয়ে চলে I আজ পারল না I হাসিব জোর করে ধরে নিয়ে গেল I পাস করে হাসিব ওর বাবার একটা কোম্পানিতে ম্যানেজিং ডাইরেক্টর হিসেবে জয়েন করেছে I ডিপার্টমেন্টের যেকোনো অনুষ্ঠানে উদার হস্তে ডোনেট করে I তাই প্রায়ই ছেলেমেয়েরা ওকে চিফ গেস্ট করে নিয়ে যায় I হাসিবের জোরাজুরিতে মুনিরকে যেতেই হলো I
খাওয়া-দাওয়া শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে I সূচনা বক্তব্য, কবিতা আবৃত্তি পর গান শুরু হল I কিছু আধুনিক গানের পর একজন নজরুল গীতি আরম্ভ করলো I গানটা শুরু হতেই মুনির উঠে গেল I একটু দুরেই একটা ছোট ব্রিজের উপর গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল I পুষ্পদাম এর এই স্পটটা একটু ছোট হলেও হাসিবের বেশ পছন্দের I মনিরের উঠে যাওয়ার কারণটা ও ঠিকই বুঝল I কিছুক্ষণ পর নিজে উঠে গিয়ে ওর পেছনে দাঁড়ালো I কাঁধে হাত রেখে বলল
– এখনো ওকে ভুলতে পারিস নি
– চেষ্টা করিনি কখনো
– এবার কর I আর কতদিন
– কি করে চেষ্টা করব ?
– দেখা করেছিস কখনো?
– না
– জানিস কোথায় আছে?
– জানি
– একবার দেখা কর I দেখবি দেখা করলে এই যে স্মৃতি আঁকড়ে ধরে আছিস এটা ঝাপসা হয়ে যাবে
– যদি না হয় ?
– ট্রাই করে দেখ I তোর না সামনে কনফারেন্স আছে একটা
– হ্যাঁ আছে
– ওখানেই তো তাইনা ?
– হু
– এবার ফোন করে কথা বলI সারোয়ার ভাই আছে ওখানে I আমি নাম্বার দিয়ে দেবো I কথা বলে ওর নাম্বারটা নিয়ে নিস
– আচ্ছা
********
আজকে সকাল থেকে অনিমার খুব অস্থির লাগছে I কি জানি কি হয়েছে I সেঁজুতি বেশ এডজাস্ট করে গেছে স্কুলে I সকাল হলেই খুশিমনে স্কুলে চলে যায় I ভালোই লাগে অনিমার I আশিক তো সকাল সকাল ই বেরিয়ে যায় I ফেরে ও রাত করে I এই সময়টা অনিমার খুব একা লাগে I ব্রেকফাস্ট শেষে রান্না করে ও এক কাপ চা নিয়ে বাগানে বসে I আজ দু’কাপ চা নিল I তারপর বারান্দার সিঁড়িতে বসে কাপ দুটো পাশে রাখল I একটা কাপ হাতে নিয়ে পাশে তাকিয়ে বলল
– সব সময় তো বলো আমি এক কাপ চা নিয়ে বসি I আজ তোমার জন্য ও নিলাম I
– ভালো করেছো আমার চা খেতে ইচ্ছা করছিল
– সঙ্গে আর কিছু খাবে ?
– কি খাওয়াবে ?
– দাঁড়াও এক মিনিট , মনে হয় আমার ফোন বাজছে
অনিমা উঠে গিয়ে ফোনটা ধরল
– হ্যালো অনিমা
– কে ?
অনিমা রীতিমতো কেঁপে উঠলো I মুনির ! এত বছর পর I কি আশ্চর্য I এখনো একমুহূর্তেই পর কণ্ঠস্বর চিনে ফেলে অনিমা I এতোটুকু ভুল হয় না I
– মুনির
– কেমন আছো মুনির ?
-তোমার শহরে এসেছি………………
চলবে …..
লেখনীতে
অনিমা হাসান
(শেষের পর্বটা একটু বড় হয়ে যাওয়ায় দুটো অংশে দিতে হল I শেষ অংশটা আগামীকাল পোস্ট করা হবে I যারা এতদিন ধরে মুনির আর অনিমার সঙ্গে আছেন তাদের সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ )