তুমি_আমারই_রবে
পর্ব_৬
#Nishat_Jahan_Raat (ছদ্মনাম)

নিবার্ক হয়ে আমি উনার দিকে তাকালাম। আমার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জল গুলো উনার চোখে এসে পড়ছে। কোনো কথা না বলে আমি লোকজনের থেকে হেল্প নিয়ে কিছুক্ষনের মধ্যে হিমুকে নিয়ে আগের হসপিটালটায় চলে এলাম। যে হসপিটালটায় নাবিলা আছে।

প্রথম তলার দুই নম্বর কেবিনটাতে উনাকে এডমিট করানো হলো। শরীরের সর্বাঙ্গ থেকে উনার প্রচুর ব্লাডিং হচ্ছে। রক্তে মাখা লাল শাড়ি গাঁয়ে জড়িয়ে আমি কেবিনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বুক ফাটিয়ে চিৎকার করছি। আমি চাই হিমু ভালো হয়ে যাক, খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুক, উনার শরীরে কোনো ক্ষতি না হোক, উনার মনে যে ক্ষতটা আছে সেই ক্ষতটা শরীরে না পড়ুক। উপর ওয়ালার কাছে করুন আকুতিভরা কন্ঠে আমি মনে মনে উনার জন্য দো’আ চাইছি। কাঁদতে কাঁদতে আমি এতোটাই বিচলিত হয়ে পড়েছি যে শ্বাশুড়ী মাকে খবরটা জানানোর ব্যাপারটা আমার মাথাতেই এলো না।

এর মাঝেই ডক্টররা হিমুকে ও.টি.তে এডমিট করার জন্য আমাকে ইনফর্ম করতে এলো। সাথে টাকার এমাউন্ট আর কিছু ফর্মালিটিসের কথা ও বলে গেলো। আর চুপ করে না থেকে আমি পার্স থেকে ফোনটা বের করে আমার শ্বাশুড়ী মায়ের নম্বরে কল করে হিমুর এক্সিডেন্টের কথাটা জানিয়ে দিলাম। তবে ডিটেলসে সব বলি নি। শুধু বলেছি হিমু এক্সিডেন্ট করেছে। এখন হসপিটালে ভর্তি আছে। হসপিটালের নামটা ও বলে দিলাম। জানি না কি হলো হসপিটালের নামটা শোনার সাথে সাথেই আমার শ্বাশুড়ী মা ক্রন্দন অবস্থাতে ভীষণ রেগে আমাকে বলল,,,

—“হিমুকে এক্ষনি ঐ হসপিটাল থেকে বের কর রূপা। আমি আমার ছেলেকে কিছুতেই ঐ হসপিটালে ট্রিটমেন্ট করাব না। আমি এই মুহূর্তে রাহাত আর তোর বাবাকে পাঠাচ্ছি। এই সময়টাতে তুই আমার ছেলেটার পাশে থাক, এক্টু ভালো করে ওর খেয়াল রাখ।”

আমি নিবার্ক হয়ে মাকে বললাম,,

—“এসব আপনি কি বলছেন মা? আপনার মাথা ঠিক আছে তো?”

—“আমার মাথা সম্পূর্ণ ঠিক আছে রূপা। টাকা নিয়ে আমরা এক্ষনি আসছি। ডক্টরকে বলে দে আমরা হিমুকে অন্য হসপিটালে এডমিট করাব। উনারা যেনো আগ বাড়িয়ে কিছু করতে না আসে।”

কথা গুলো বলেই মা ফোনটা কেটে দিলো। আমি এখনো কানে ফোন গুজে দাঁড়িয়ে আছি। মা এসব কি বলল সব আমার মাথার উপর দিয়ে গেলো। মানুষ এতোটা নিষ্ঠুর হয় কি করে? কি করে এতোটা স্বার্থপর হতে পারে? আমি এতক্ষনে বুঝে গেছি মা কেনো এই অযৌক্তিত সিদ্ধান্তটা নিয়েছে। যখনই মা হসপিটালের নামটা শুনেছে ঠিক তখনই মা হুট করে এমন অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মা জানে নাবিলা এই হসপিটালেই আছে তাই উনি উনার ছেলেকে এই হসপিটালে রাখতে চাইছে না। অন্য হসপিটালে শিফট করাতে চাইছে।

নিরুপায় হয়ে আমি হিমুর কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ডক্টররা কিছুক্ষণ পর পর এসে হিমুর ক্রিটিক্যাল অবস্থার কথা আমাকে জানাচ্ছে। আমি কেবল নিচের দিকে তাকিয়ে চোখের জল ছাড়ছি। ভিতরটা ক্ষনে ক্ষনে হু হা করে কেঁদে উঠছে। এই অবস্থায় আমার কি করা উচিত কিছুই আমার মাথায় আসছে না। মাথাটা পুরো ফাঁকা হয়ে আছে। অপেক্ষার প্রহর যেনো কাটছেই না। হিমুর এই সাংঘাতিক অবস্থা ও চোখের সামনে নিতে পারছি না। এই মুহূর্তে আমাকে বুঝার মতো কেউ নেই। কেউ নেই যে এসে আমার মনের ক্ষতটা বুঝে আমাকে এক্টু শান্তনা দিবে! মনে পুষে রাখা কষ্টগুলো এক্টু ভাগাভাগি করে নিবে।

প্রায় আধঘন্টার মধ্যে আমার শ্বাশুড়ী মা, শ্বশুড় আব্বু আর রাহাত ভাই চলে এলো। স্বস্তির শ্বাস ফেলে আমি দৌঁড়ে গেলাম উনাদের কাছে৷ হিমুর কেবিনটা উনাদের দেখিয়ে দিতেই উনারা হিমুর কেবিনে ঢুকে পড়ল। মা হিমুকে জড়িয়ে ধরে হু হা করে কাঁদছে। শ্বশুড় আব্বু আর রাহাত ভাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে হিমুকে এই হসপিটাল থেকে ট্রান্সফার করতে। তবে রাহাত ভাইকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে উনার আপত্তি আছে বাবা মায়ের নেওয়া সিদ্ধান্তে। এই মুহূর্তে আমার চুপ করে থাকাটা সমিচীন মনে হচ্ছে না। নিজেকে কিছুটা শান্ত করে আমি মায়ের কাছে এগিয়ে এসে বললাম,,,

—“মা। আমি আপনাদের নেওয়া সিদ্ধান্তে একমত নই। আমি চাই না হিমুকে এই হসপিটাল থেকে ট্রান্সফার করা হোক।”

মা অশ্রুসিক্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,,,

—“হিমু আমার ছেলে রূপা। আমি যা সিদ্ধান্ত নিবো তাই হবে। আমাদের মাঝখানে এসে তোকে নাক গলাতে হবে না।”

—“প্লিজ মা বুঝার চেষ্টা করুন। এতে হিমুর ই ক্ষতি হবে। এখন এক এক্টা মুহূর্ত হিমুর জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। ডক্টর বলেছে হিমুকে এক্ষনি ও.টি তে নিতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ট্রিটমেন্ট করতে না পারলে আপনার ছেলের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে মা।”

—“তুই চিন্তা করিস না রূপা। হিমুকে আমরা আরো ভালো হসপিটালে এডমিট করাব। যেখানে প্রোপার্লি হিমুর ট্রিটমেন্টটা হবে। আমরা সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। ঐ হসপিটালের ডক্টরদের সাথে কথা বলে রেখেছি। এবার শুধু হিমুকে নিয়ে যাওয়ার পালা। এই এক্ষনি আমরা এ হসপিটাল থেকে বের হয়ে যাবো। তুই চিন্তা করিস না রূপা।”

কান্না থামিয়ে আমি কিছুটা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,,

—“নাবিলা এই হসপিটালে আছে বলেই আপনি হিমুকে এই হসপিটালে রাখতে চাইছেন না, তাই না মা?”

মা চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকালো। চোখে, মুখে উনার উদ্বিগ্নতার ছাপ। আমি মলিন হেসে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,,,

—“আমি নাবিলা সম্পর্কে সব জেনে গেছি মা। এখন আমার কাছে সবকিছু জলের মতো পরিষ্কার। তবে আপনার থেকে আরো অনেক কিছু জানার আছে আমার। অনেক কিছু করার ও আছে! হিমু এক্টু সুস্থ হয়ে নিক তারপর আমি আপনার মুখোমুখি হবো।”

মা তেজী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,,,

—“তুই যা জেনেছিস সবই মিথ্যে রূপা। এসব কথা বিশ্বাস করে দয়া করে নিজেই নিজের কপালে কুড়োল মারিস না।”

—“এ সম্পর্কে আমরা পরে কথা বলব মা। সত্যটা না হয় আপনার মুখ থেকেই জেনে নিবো! আর রইল কুড়োল মারার কথা? কুড়োল তো আপনিই আমার মাথায় মেরেছেন মা। এখন না, প্রায় পাঁচ মাস আগে। যখন আপনি জোর করে আপনার ছেলেকে আমার সাথে বিয়ে দিলেন!”

কথা গুলো বলেই আমি নিথর অবস্থায় পড়ে থাকা হিমুর দিকে একবার তাকিয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে এলাম। নিস্তব্ধ হয়ে আমি বারান্দার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে আছি। বুকের ভেতর জমে থাকা কম্পন গুলো বার বার বুক ফাঁটা দীর্ঘশ্বাস হয়ে বের হচ্ছে। একদিকে নাবিলা, অন্যদিকে হিমু। দুজনের মাঝখানে আমি দাঁড়িয়ে। সামনে আমার আরো অনেক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। মনে মনে যা ভাবছি তাই হয়তো আমাকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে। আমার মন যা বলছে আমি ঠিক তাই করব। জীবন কখনো আমাকে চায় নি! না আমি জীবন থেকে ভালো কিছু চেয়েছি! শুধু এক্টু ভালো থাকতে চেয়েছিলাম। তা ও উপর ওয়ালা আমার ভাগ্য থেকে মুছে নিলো। এখন আমি নিজেই আমার মর্জির মালিক। লাইফে যতোই যন্ত্রণা বা বাধা বিপত্তি আসুক না কেনো আমি ঠিক মানিয়ে নিবো!

মিনিট কয়েকের মধ্যে আমার শ্বাশুড়ী মা, শ্বশুড় আব্বু আর রাহাত ভাই এসে হম্বতম্বি হয়ে হিমুকে স্ট্রেচারে করে কেবিন থেকে বের করে হসপিটালের বাইরে থাকা এম্বুলেন্সে পুড়ে নিলো। আমি ও উনাদের পিছু পিছু এ্যাম্বুলেন্সে ঢুকে পড়লাম। হিমুর রক্তাক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আমি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে আছি। বুঝছি না আপাতত উনার দিকে আমার প্রেম নজরে তাকানোটা ঠিক হচ্ছে কিনা! উনি তো নাবিলার আমানত, নাবিলার ভালো লাগা, ভালোবাসা। উনার দিকে তাকানোটা হয়তো আমার পাপ হবে!

হিমুর মুখে অক্সিজেন লাগানো হলো। এর মধ্যেই এ্যাম্বুলেন্স ছেড়ে দিলো। প্রায় আধ ঘন্টার মধ্যে আমরা অন্য এক্টা হসপিটালে এসে পৌঁছে গেলাম। হসপিটালের ডক্টররা হিমুকে ও.টি.তে পুড়ে নিলো। ও.টি.র দরজার সামনে পরিবারের সবাই দাঁড়িয়ে আছি। মা হাউ মাউ করে কাঁদছে। শ্বশুড় আব্বু চোখে জল নিয়ে মাকে শান্তনা দিচ্ছে। রাহাত ভাই কপালে হাত দিয়ে বারান্দার গ্রীলে ড্যাশ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ধীর পায়ে হেঁটে এসে রাহাত ভাইয়ের পাশে দাঁড়ালাম। অমনি রাহাত ভাই কপাল থেকে হাত সরিয়ে আমার দিকে তাকালো। চোখে জল নিয়ে আমি রাহাত ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,,

—“আপনি নাবিলা সম্পর্কে সব জানতেন তাই না রাহাত ভাই?”

রাহাত ভাই থতমত খেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,,,

—“তুতুতুমি কি করে জানলে রূপা? নাবিলার কথা তো তোমার জানার কথা না!”

—“আমি সব জেনে গেছি রাহাত ভাই। আপনার থেকে আমার আরো অনেক কিছু জানার আছে। প্লিজ আমাকে হিমু আর নাবিলা সম্পর্কে সব খুলে বলুন। আমি আপনার কাছে হাত জোর করছি রাহাত ভাইয়া প্লিজ বলুন।”

উনি ছলছল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,,,

—“এখন বলে আর কি লাভ রূপা? যা অনর্থ হওয়ার তা তো হয়েই গেছে!”

আমি কাঁদতে কাঁদতে রাহাত ভাইয়ের হাত চেঁপে ধরে বললাম,,,

—“এখনো কিছু অনর্থ হয় নি রাহাত ভাই। আপনি প্লিজ ফার্স্ট টু লাস্ট আমাকে সব খুলে বলুন।”

আমার করুন আকুতি দেখে রাহাত ভাই চোখে জমে থাকা জল গুলো মুছে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,,,

—“তাহলে শুনো!……. নাবিলা হিমুর দুঃসম্পর্কের খালাতো বোন। পাঁচ বছরের সম্পর্ক ওদের। দুজন দুজনকে পাগলের মতো ভালোবাসত। এমনকি দুই পরিবারের সবাই নাবিলা আর হিমুর ভালোবাসার ব্যাপারটা জানত। উভয় পরিবারই রাজি ছিলো ওদের বিয়ে দিতে। কিন্তু এর মাঝেই নাবিলার হঠাৎ ক্যান্সার ধরা পড়ল। এরপরই সব এলো মেলো হয়ে গেলো৷ নাবিলা হিমুকে এক্টু এক্টু করে ইগনোর করতে শুরু করলো। হিমুর সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলো। হিমু তখন পাগল প্রায় হয়ে যাচ্ছিলো৷ হিমু নানা ভাবে নাবিলার সাথে কন্ট্রাক্ট করার চেষ্টা করত তবে নাবিলা প্রতিবারই হিমুর সব চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিতো। কিছুতেই হিমুর সাথে দেখা করতে চাইত না, কথা বলতে চাইত না। তারপর কি হলো জানি না,,, নাবিলার ক্যান্সার ধরা পড়ার প্রায় দু মাস পর হিমুর আম্মু তোমার সাথে হিমুর বিয়ে ঠিক করে নিলো। খুব অবাক হচ্ছিলাম তখন। হুট করে হিমুর আম্মুর এমন সিদ্ধান্তে আমরা সবাই চমকে গেছিলাম৷ কিছুদিন পর দেখলাম হিমু ও বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলো। তোমাদের বিয়ের প্রায় দু দিন আগেই জানতে পারলাম,,, নাবিলার চিকিৎসার খরচ চালানোর জন্য হিমু তোমাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিলো। নাবিলা খুব মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। এই রোগের খরচ চালানো ওদের জন্য দুঃসাধ্য। হিমুর মা ও হয়তো তখন তাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিজের ছেলের জীবন গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো! যার ফল ভোগ করতে হলো বেচারী নাবিলা আর হিমুকে!”

উনি খানিক থেমে আবার বলল,,,

—“তোমাদের বিয়ের রাতেই নাবিলার পরিবার নাবিলাকে নিয়ে ইন্ডিয়ায় চলে যায়। প্রায় পাঁচ মাস চিকিৎসার পরই উনারা দুই দিন আগে ঢাকায় ব্যাক করে। খবরটা পেয়েই হিমু পাগল হয়ে উঠে। নাবিলার সাথে যোগাযোগ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। কোনো ভাবে হিমু জেনে গেছিলো নাবিলা ঐ হসপিটালে ভর্তি হয়েছে। যে হসপিটাল থেকে এক্টু আগেই আমরা বেরিয়ে এলাম।”

একটুকু বলেই রাহাত ভাই থেমে গেলো৷ আমি মুখে আঁচল চেঁপে অনবরত কেঁদে চলছি৷ বুকটা ভারী হয়ে আসছে আমার। মনে হচ্ছে একশ কেজি ওজনের পাথরটা কেউ আমার বুকে রেখে গেছে। এতোদিন নিজেকে পৃথিবীর সবচে দুঃখি মানুষটা ভাবতাম৷ আর এখন এসে দেখছলাম আমার চেয়ে ও পৃথিবীতে অনেক দুঃখি মানুষ আছে!

ঢুকড়ে কেঁদে আমি রাহাত ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,,

—“সব দোষ আমার রাহাত ভাই। আমি কেনো বিয়ের আগে হিমু সম্পর্কে সব জেনে নিলাম না। কেনো না বুঝেই উনাদের মাঝখানে ঢুকে পড়লাম। কেনো বিয়ের পরে ও আমার থেকে দূরে দূরে থাকার কারণটা জিগ্যেস করলাম না। কেনো হিমুর কষ্টটা বুঝার চেষ্টা করলাম না। আমার ভেতরটায় খুব কষ্ট হচ্ছে রাহাত ভাই। নাবিলার প্রতি উনার আসক্তি আমাকে বড্ড পোড়াচ্ছে!”

রাহাত ভাই শান্তনার স্বরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,,,

—“আমি জানি রূপা। তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে। কষ্ট তো হওয়ার ই কথা। তুমি তো হিমুর ওয়াইফ। ওয়াইফ হয়ে স্বামীর প্রাক্তন সম্পর্কে এতো চুল ছেড়া বিশ্লেষণ তুমি নিতে পারছ না। তবে এতে তোমার কোনো দোষ নেই রূপা। তুমি তো জেনে শুনে হিমুকে বিয়ে করো নি। তুমি না জেনেই হিমুকে বিয়েটা করেছিলো। বলতে পারো হিমুর পরিবার জোর করে হিমুর লাইফে তোমাকে ঢুকিয়ে দিয়েছে। এসবে আমি অন্তত মনে করি না তুমি দোষী!”

উনি কিছুটা থেমে আবারো বলল,,,

—“তবে রূপা… হিমুর বন্ধু হিসেবে তোমাকে আমি এক্টা কথাই বলতে পারি। তোমার হয়তো এই মুহূর্তে হিমু আর নাবিলার মাঝখান থেকে সরে যাওয়া উচিত। হিমু আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। তাই চোখের সামনে ওর কষ্টটা আমি সহ্য করতে পারছি না। নাবিলাকে ও আমি অনেক বছর ধরে চিনি। খুব ভালো মেয়ে নাবিলা। অপরদিকে, ওর কষ্টটা ও আমার সহ্য হচ্ছে না। মেয়েটা বাঁচবেই বা আর কতোদিন বলো?”

নিবার্ক দৃষ্টিতে আমি চোখ তুলে রাহাত ভাইয়ের দিকে তাকালাম। রাহাত ভাই সাথে সাথে আমার থেকে চোখ নামিয়ে মাথাটা নিচু করে ফেলল। অপরাধ বোধ কাজ করছে উনার চোখে, মুখে। নিজেকে হয়তো কিছুটা স্বার্থপর ও ভাবছে। উনার কাছ থেকে সরে এসে আমি বারান্দায় পাতানো চেয়ারে বসে পড়লাম। চেয়ারের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বুজে আমি নিজের সাথে বোঝা পড়া করছি। বিবেককে কিছুক্ষন পর পর নানা ধরনের প্রশ্ন করছি। প্রশ্ন গুলো ঘোলাটে হলে ও উত্তরটা কিন্তু একই জায়গাতে এসে দাঁড়াচ্ছে!

দুপুর থেকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। হিমুর অপারেশন অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। উনাকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে। ডক্টররা বলছে কিছুক্ষন পরেই হিমুর জ্ঞান ফিরবে। এক এক করে সবাই হিমুকে দেখে আসছে। শুধু আমিই এখনো হিমুর মুখোমুখি হতে পারলাম না। হিমুকে ফেইস করার দুঃসাধ্য এই মুহূর্তে আমার নেই। উনার থেকে যতোটা দূরে থাকা যায় ততোটাই হয়তো ভালো।

এর মাঝেই মা, বাবা বাড়ি চলে গেলো ফ্রেশ হতে। উনারা বড্ড ক্লান্ত হয়ে আছে। আসার পথে বাড়ি থেকে আমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসবে। আমি আর রাহাত ভাই কেবিনের সামনে গোল হয়ে বসে আছি। তখনই কেবিনের ভেতর থেকে হিমুর গোঙ্গানীর আওয়াজ আমাদের কানে এলো। বসা থেকে উঠে আমি দৌঁড়ে কেবিনে ঢুকে পড়লাম। আমার পিছনে পিছনে রাহাত ভাই ও কেবিনে ঢুকে পড়ল। হিমুর হাত, পা, মাথা সব জায়গায় ব্যান্ডেজ করা। কপালের ক্ষতটা থেকে ব্যান্ডেজ ভেদ করে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। উনাকে এই অবস্থায় দেখে আমার বুকের ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। হাতে থাকা স্যালাইনের নলটা উনি ছেঁড়ার চেষ্টা করছে আর উষ্ণ আওয়াজে বলছে,,,

—“আমি নাবিলার কাছে যেতে চাই। কেউ প্লিজ আমাকে সাহায্য করো। যে করেই হোক কেউ আমাকে নাবিলার কাছে নিয়ে যাও।”

রাহাত ভাই আমার আগেই হিমুর কাছে ছুটে গিয়ে হিমুর হাত চেঁপে ধরে বলল,,,

—“এই অবস্থায় তুই নাবিলার কাছে যেতে পারবি না হিমু। প্লিজ শান্ত হ।”

রাহাত ভাই এতোটা জোরেই হিমুর হাতটা চেঁপে ধরেছে যে হিমু চোখ, মুখ খিঁচে ব্যাথায় ছটফট করছে। আমি তখনই দৌঁড়ে গিয়ে রাহাত ভাইকে হিমুর কাছ থেকে সরিয়ে হিমুর হাতটা আলতো করে ধরে কান্নাজড়িত কন্ঠে বললাম,,,

—“হিমু ব্যাথা পেয়েছে রাহাত ভাই। উনার হাতটা এতো টাইট করে ধরা আপনার ঠিক হয় নি।”

আমাকে দেখা মাএই হিমু মুহূর্তের মধ্যে চোখ, মুখ লাল করে এক ঝটকায় আমার হাতটা সরিয়ে দিয়ে রাহাত ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে জোরে চেঁচিয়ে বলল,,,

—“এই মেয়েটা এখানে কি করছে রাহাত? তুই এক্ষনি এই মেয়েটাকে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে বল।”

আমি শান্ত চোখে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,,,

—“আমি বেরিয়ে গেলেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে হিমু?”

উনি আরো দ্বিগুন রেগে বলে উঠল,,,,

—“হ্যাঁ হবে। তোমাকে দেখলেই আমার ভেঙ্গে যাওয়া “এই আমার” কথা মনে পড়ে যায়। আমার অসহায়ত্বের কথা মনে পড়ে যায়। আমার দুর্ভাগ্যের কথা মনে পড়ে যায়। সো প্লিজ তুমি আমার চোখের সামনে থেকে দূরে সরে যাও।”

হিমু আবারো রাহাত ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,,,

—“রাহাত প্লিজ এই মেয়েটাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে আমার কেবিন থেকে বের কর।”

রাহাত ভাই অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। আমি উনার কাছ থেকে সরে এসে কেবিনের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে হিমুকে উদ্দেশ্য করে চোখের জল ছেড়ে বললাম,,,

—“আমি আপনার পায়ের কাছে হলে ও থাকতে চাই হিমু। আপনি হয়তো চাইলেই আমাকে লাথ মেরে সরিয়ে দিতে পারেন। তবে মনে রাখবেন, এই রূপা থাকতে আপনার কোনো ইচ্ছেই অপূর্ণ থাকবে না। এবার সে আপনার জীবনে থাকুক বা না থাকুক।”

আমার কথার বিপরীতে হিমু কেনো জানি না খুব রেগে গেলো। স্যালাইনের নলটা এক টানে খুলে উনি কেবিন থেকে উঠেই দরজা থেকে আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে কেবিনে থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে আর চেঁচিয়ে বলছে,,,

—“তোমার ফালতু কথা শোনার সময় নেই আমার কাছে৷ এবার অন্তত কেউ আমাকে নাবিলার থেকে আলাদা করতে পারবে না।”

উনার পাগলামী দেখে আমি পেছন থেকে উনাকে ঝাপটে ধরে চেঁচিয়ে বলে উঠলাম,,,

—“আমি আপনাকে নাবিলার কাছে নিয়ে যাবো হিমু। প্লিজ আপনি শান্ত হোন। শান্ত হয়ে বসুন। আমার কথাটা বুঝার চেষ্টা করুন।”

#চলবে,,,,,?

(সবার থেকে গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি🙂)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here