তুমি_আমারই_রবে
পর্ব_২৬ (অন্তিম পর্ব)
#Nishat_Jahan_Raat (ছদ্মনাম)
আমি কিছু বললাম না। শুধু নাক টেনে উনার শার্টটা খাঁমচে ধরলাম। কিছুদূর যেতেই আমার চোখে হঠাৎ ঘুম শওয়ার হলো। হিমুর বুকে মাথা রেখেই ক্ষনিকের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লাম আমি। সেই ঘুম ভাঙ্গল আমার হিমুর ঠোঁটের স্পর্শে।
আমার ডান গালটায় হিমু খুব গভীর একটা চুমো খেয়ে মাথাটা তুলতেই আমি চোখ খুলে উনার দিকে তাকালাম। উনি খানিক অপ্রস্তুত হয়ে আমতা আমতা করে বললেন,,
“উউঠো রূপা। বাবাবাড়ি পৌঁছে গেছি।”
উনার থেকে চোখ সরিয়ে আমি পিটপিট চোখে আশেপাশে তাকালাম। বুঝতে আর দেরি হলো না, আমি আমার বাড়ির সামনেই আছি। রাতের নিকষ আঁধারে চারপাশটা ঠিকভাবে দেখা যাচ্ছে না৷ তবু ও লাইটের আলোতে যতটুকু দেখা যাচ্ছে ততটুকুতেই আমার চোখ জুড়িয়ে আসছে। ছোটবেলার সেই জমকালো স্মৃতিতে মোড়ানো বাড়িটা দীর্ঘ আড়াই বছরের ব্যবধানে খুব রঙ্গচঙ্গা লাগছে। জানি না আমার চোখের ভুল কিনা। নাকি সত্যিই বাড়ির রূপ বদলেছে। অনেক দিন পর এ বাড়িতে এসেছি বলেই হয়তো নতুনত্বতা চোখে পড়ছে আমার। আশপাশ থেকে চোখ সরিয়ে আমি ম্লান চোখে হিমুর দিকে তাকালাম। হিমু হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বেশ আকুল ভঙ্গিতে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,
“It’s 10 O’clock রূপা। অনেকটাই লেইট হয়ে গেছি আমরা।”
আমি বড় একটা হামি তুলে উদাস ভাব নিয়ে উনাকে বললাম,,
“তাহলে আপনি বাড়ি চলে যান।”
“হোয়াট? আমি বাড়ি চলে যাবো মানে?”
“হুম। যাবেন ই তো। বিয়ের আগে শ্বশুড় বাড়িতে থাকা, খাওয়ার কোনো নিয়ম নেই।”
“আমাদের বিয়ে তো অনেক আগেই হয়ে গেছে রূপা! তাহলে, শ্বশুড় বাড়িতে থাকতে প্রবলেম কি?”
“এটা রিচুয়েল বুঝেছেন? মনে নেই প্রথমবার বিয়ে করে আপনি আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন? আড়াই বছর আমাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ছিলো। এই বিচ্ছেদের কারনেই আমাদের মাঝে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। তাই তো বিয়েটা আবার নতুন করে দেওয়া হচ্ছে।”
“হোয়াট? আমি তোমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলাম?”
আমি মুখটা ম্লান করে বললাম,,
“হু। দিয়েছেন ই তো।”
উনি বেশ ক্ষীপ্ত হয়ে আমাকে ব্যাক সিটের সাথে চেঁপে ধরে রক্তচক্ষু নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,
“কি বললে, আবার বলো? আমি তোমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছি?”
আমি পর পর কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বললাম,,
“নানানা। আআআমি নিজে থেকেই বের হয়েছি।”
“গুড।”
আমাকে ছেড়ে উনি গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে বেশ গম্ভীর স্বরে বললেন,,
“যাও। আর কবে দেখা হয় কি জানি।”
আমি মুখ চেঁপে হেসে সিটবেল্টটা খুলে বুকে অনেকটা দম নিয়ে একটু একটু করে উনার মুখের কাছে এগিয়ে এসে তড়িৎ বেগে উনার বাঁ গালে একটা চুমো খেয়ে হুড়মুড়িয়ে গাড়ির দরজা খুলে গাড়ি থেকে নামতেই হিমু পেছন থেকে আমার ডান হাতটা টেনে ধরলেন। বড় বড় কয়েকটা শ্বাস ফেলে আমি লাজুক চোখে পিছু ফিরে হিমুর দিকে তাকালাম। অমনি হিমু বাঁকা হেসে আমাকে হেচকা টান দিয়ে ঠিক উনার বুকের মাঝখানটায় নিয়ে ফেললেন। আমি মৌণ দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকালাম৷ খনিকের মধ্যে উনি আমার থুতনী চেঁপে ধরে ঠোঁট জোড়া দখল করে নিলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি চোখ জোড়া ডিম্বাকৃতির করে উনার দিকে তাকালাম। উনি চোখ বুজে আমাকে আরো বেশি করে আপন করে নিচ্ছেন। এক পর্যায়ে আমি তিক্ত হয়ে উনাকে খুব জোরে একটা ধাক্কা দিয়ে গাড়ি থেকে বের হয়ে এলাম। দৌঁড়ে বাড়ির ভেতর ঢুকতেই উনি পেছন থেকে আমাকে ডেকে বললেন,,
“থ্যাংকস রূপা। চুমুটা দারুন ছিলো।”
আমি রুষ্ট হয়ে পিছু ফিরে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,,
“আগামী এক সপ্তাহ্ ও আপনার মুখটা দেখতে চাই না আমি। মগজে ঢুকেছে?”
উনি ভাবলেসহীন ভাবে বললেন,,
“ওকে। বাট রূপা তো হিমুকে ছাড়া এক মুহূর্তের বেশি থাকতে পারবে না।”
“পারবে পারবে। খুব পারবে। আপনি এখন যেতে পারেন।”
এর মাঝেই আম্মু বাড়ির বাইরে বের হয়ে এলো। আম্মুকে দেখা মাএই আমি থতমত খেয়ে শুকনো ঢোক গিলে আম্মুর দিকে তাকালাম। আম্মু বেশ তিক্ত চোখে আমার দিকে তাকালেন। আম্মুর বাজখাই চাহনী দেখেই আমি বুঝতে পেরে গেছি, আম্মু নির্ঘাত আমার সমস্ত কথা শুনে নিয়েছেন। দাঁত কিড়মিড়িয়ে আম্মু আমাকে বললেন,,
“লজ্জা থাকা উচিত তোর। বাড়ির জামাইকে খালি মুখে তাড়িয়ে দিচ্ছিস? তোকে তো আমি পরে দেখে নিবো।”
আমি গজগজ করে আমাকে উপেক্ষা করে হিমুর গাড়ির সামনে দাঁড়ালেন। জোর করে আম্মু হিমুকে গাড়ি থেকে বের করে বাড়ির ভেতর নিয়ে এলেন। আমি ও উনাদের পিছু পিছু বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়লাম। হিমু কিছুক্ষন পর পর আড়োচোখে আমার দিকে তাকিয়ে অট্ট হাসছেন। আমি ভাব শূন্য হয়ে উনার দিকে তাকাচ্ছি। আম্মুর জন্য আজ আমার মুখটা ছোট হয়ে গেলো। ঐ হিমুর কাছে লজ্জিত হতে হলো। উনি বিভিন্নভাবে আমাকে ক্ষেপাচ্ছেন। খাওয়ার টেবিলে বসে উনি আমার কানে ফিসফিসিয়ে ব্যঙ্গ করে বলছেন,,
“ইট’স রিচুয়েল। বিয়ের আগে শ্বশুড় বাড়িতে থাকা খাওয়ার কোনোনোনো নিয়ম নেই।”
আমি ক্ষীপ্ত দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকালেই উনি বাঁকা হেসে আমাকে চোখ মেরে দিচ্ছেন। বিরক্ত হয়ে আমি উনার দিকে তাকানোই বন্ধ করে দিলাম। রাতের ডিনার সেরে উনি বাড়ি ফিরে গেলেন। আমি ও আমার রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গাঁ এলিয়ে দিলাম। চোখ জোড়া বুঝতেই আমার চোখে ঘুম শওয়ার হলো। গভীর নিদ্রায় তলিয়ে পড়লাম আমি।
,
,
কিভাবে যেনো চোখের পলকেই এক সপ্তাহ কেটে গেলো। হিমুর সাথে ফোনে প্রেমালাপে প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহূর্ত নদীর উত্তাল ঢেউয়ের মতো বাঁধাহীনভাবে কেটে গেছে। কখনো জোয়ার এসেছে তো, কখনো ভাটা। কখনো উনার রোমান্টিক অত্যাচার পূর্ণ কথা সহ্য করতে হয়েছে যে তো কখনো দুজন দুজনাকে কাছে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় মন খারাপের প্রখর গুনতে হয়েছে। প্রতিদিন রাতে নিয়ম করে উনি একবার আমাদের বাড়ির মেইন গেইটের সামনে এসে সোডিয়ামের ঝাপসা আলোতে আমাকে একটা পলক দেখার জন্য উতলা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। ব্যালকনীতে দাঁড়াতেই এক নজরের জন্য আমাকে দেখেই উনি চন্ঞ্চলা চোখ দুটোকে শান্ত করতেন। কি এক উতলা চাহনী উনার। হৃদয়ে দাগ কাটার মতো। দিন দিন আমি আরো বেশি করে উনাতে ডুবে যাচ্ছি৷ উনাকে কাছে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় আমি ও ভুগছি। দুজনেই সেই আকাঙ্ক্ষিত লগ্নের অপেক্ষায় আছি। যে লগ্নে আমার দুজন দুজনাতে মিশে একাকার হয়ে যাবো। একজন আরেকজনাতে পূর্ণ হবো।
আজই ধেয়ে এলো সেই কাঙ্ক্ষিত দিন। অপেক্ষার সেই চির আকাঙ্ক্ষিত লগ্ন। লাল টুকটুকে বেনারসি পড়ে আমি নব বধূর সাজে নিজেকে লাল রঙ্গে রাঙ্গিয়ে রেখেছি। খুব সেজেছি আজ। স্বামী যখন মন মতো হয়, তখন অবাধে সাজতে কোনো হেলা থাকে না। মনে হয় যে আরেকটু বেশি করে সাজি। গাঢ় সাজে হয়তো স্বামীকে আরো বেশি করে আকৃষ্ট করা যাবে। তাকে সারা জীবনের জন্য চোখ ধাঁধানো রূপে বেঁধে রাখা যাবে। আমি ও তার ব্যতিক্রম নই। তবে এক্ষেএে আমার স্বামী আমার থেকে ও বেশি সচেতন। হিমুর ইন্সট্রাকশান অনুযায়ী পার্লারের মেয়েরা এসে পুরো দমে লালা পরী বানিয়ে ছাড়ল আমায়। আজকের এই বিশেষ দিনে হিমু আমাকে অন্য রূপে দেখতে চায়। যে রূপে আগে কখনো উনি আমাকে দেখেন নি!
টুকটুকে পুতুল বউ সেজে আমি চারদিকে সুবাসিত পোলাপের পাঁপড়ি দিয়ে মোড়ানো বেডের মাঝখানটায় লজ্জারাঙ্গা মুখ নিয়ে গোল হয়ে বসে আছি। বিকেলের দিকেই বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেছে আমাদের। ঘড়িতে এখন রাত এগারোটা বাজছে। আমি এখন হিমুর বাড়িতে ফুলসজ্জার খাটে রাঙ্গা বৌ সেজে বসে আছি। বুকে অদৃশ্য এক ধুকপুকানি নিয়ে হিমুর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। সবেমাএ লামিয়া, নীলা, লোপা এবং সাবিলা আমার পাশ থেকে উঠে গেছে। আকাশ আর সাবিলাকে ও হিমু ইনভাইট করেছেন। দুজনই বিয়ের আগের দিন আমাদের বাড়িতে চলে এসেছিলেন। আজ আমার সাথে আবার হিমুর বাড়িতে ও এসেছেন।
হিমুকে দরজার বাইরে আটকে রেখে কাটায় কাটায় দশ হাজার টাকা হাসিল করেছে এই চারজন। বিয়ের গেইটে আব্বু বেশি ঝামেলা করতে দেন নি। তাই গেইট বাবদ হিমুর থেকে কোনো রকম টাকা আদায় করতে না পেরে চারজন ক্ষুদ্ধ হয়ে আমাদের ফুলসজ্জার ঘরে হানা দিয়েছে। এবার তো বাধ্য হয়ে হিমুকে টাকা দিতেই হতো। চারজনই ঝোঁপ বুঝে, ঠিক জায়গায় কোঁপ মেরেছে।
দরজা খুলে ওরা রুম থেকে বের হতেই হিমু হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকে পড়লেন। সাথে সাথেই আমার বুকের ধুকপুকানি ক্রমশ ব্লাস্টের দিকে এগিয়ে গেলো। বুকের ভেতর এক তীব্র উত্তেজনা কাজ করছে। কি হবে কি হবে তা ভেবেই গাঁ থেকে ঘাম ঝড়ছে। অস্থিরতা দ্বিগুনভাবে বেড়ে চলছে। লজ্জায় আচ্ছাদিত হয়ে আমি বড় ঘোমটার আড়াল থেকে আড় চোখে হিমুর দিকে তাকাচ্ছি। দরজাটা হালকা ভেজিয়ে হিমু লাল শেরোয়ানীর হাতা ফোল্ড করতে করতে মুখে বেশ রাগী ভাব ফুটিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে কর্কশ কন্ঠে বললেন,,
“এই। নিচে নেমে এসো!”
লজ্জারাঙ্গা মুখটা আমার মুহূর্তের মধ্যে ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। মুখ থেকে ঘোমটা টা সরিয়ে আমি বিস্মিত চোখে উনার দিকে তাকালাম। উনি রুক্ষ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বেশ ঝাঁঝালো কন্ঠে বললেন,,
“কি হলো? নিচে নামতে বলেছি৷ শুনো নি?”
ভয়ে ঈষৎ কেঁপে উঠে আমি চোখে জল নিয়ে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,,
“কি হয়েছে হিমু? আপনি এমন মিস বিহেভ করছেন কেনো?”
“উফফফ। এতো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না আমি। নিচে নামতে বলেছি। তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এসো।”
চোখের জল ছেড়ে আমি শাড়িটা দুহাতে ধরে বিছানা থেকে নিচে নামলাম। সোজা হয়ে দাঁড়াতেই হিমু ঝড়ের বেগে আমাকে এক ঝটকায় কোলে তুলে নিলেন। আমি মুখটা হা করে উনার দিকে তাকালাম। উনি হু হা করে হেসে আমার কপালে চুমো খেয়ে বললেন,,
“আ’ম জাস্ট কিডিং রূপা। তোমাকে কোলে তোলার জন্য নাটক টা করা।”
আমি খুব রেগে উনার বুকে এলোপাথারী কিল, ঘুঁষি মেরে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললাম,,
“আপনি খুব খুব খুব খারাপ হিমু। জানেন কি পরিমান ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি?”
উনি হেসে হেসে রুমের দরজা খুলে রুম থেকে বের হচ্ছেন আর বলছেন,,
“ভেবেছিলে, আবার আগের মতো বর্বর হয়ে গেছি। তাই তো?”
“হুম ঠিক তাই। ভাববই তো। আপনার আগের বর্বর রূপ এখনো আমার মনে আছে। কি সাংঘাতিক লাগত আপনাকে রাগলে! ভাবলেই গাঁ টা কাটা দিয়ে উঠে।”
উনি ক্রমাগত হেঁটে বাড়ির ছাঁদের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন আর আমার নাকে নাক ঘঁষে বলছেন,,
“এখন আর “বর্বর” না। “বর বর” রূপ দেখবে। মাথায় তুলে রাখবে এই হিমু তোমাকে। ভালোবাসায় একদম টইটম্বুর করে রাখবে।”
আমি হালকা হেসে উনার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললাম,,
“কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?”
“ছাঁদে।”
“কেনো?”
“আগে আগে দেখো হোতা হে কেয়া।”
রহস্যময়ী হাসি দিয়ে উনি ছাঁদের দরজার কাছে এসে দরজাটা কনুই দিয়ে হালকা ঠেলে আমাকে কোলে নিয়ে ছাঁদে চলে এলেন। ছাঁদের মেঝেতে পা রাখতেই মনে হলো আকাশ থেকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। আমার সমস্ত শরীর ভিজিয়ে দিচ্ছে। হিমুর গাঁ থেকে টপটপ করে বৃষ্টির ফোঁটা গড়িয়ে আমার গাঁয়ে এসে পড়ছে। দুজনই ভিজে একাকার। অথচ আকাশে বৃষ্টির কোনো আনাগোনা নেই। বিদ্যুৎ চমকানোর কোনো গর্জন ও নেই। বৈরি কোনো বাতাস ও নেই। আশেপাশে মাটির স্যাঁতস্যাতে গন্ধ ও নেই। সম্পূর্ণ রৌদোজ্জ্বল একটা দিন ছিলো আজ। আকাশে হঠাৎ মেঘ ধরার কোনো অবকাশ ই ছিলো না।
ভীষণ কৌতুহলী হয়ে আমি উপরের দিকে তাকাতেই দেখলাম ছাদের চিলিকোঠায় দাঁড়িয়ে হৃদয় ভাই আর লাবিব ভাই পাইপ লাইন দিয়ে আমাদের গাঁয়ে বৃষ্টির ফোঁটার মতোই এলোমেলো ভাবে পানি ছিটাচ্ছেন আর দাঁত কেলিয়ে নিঃশব্দে হাসছেন। ভীষণ উদ্বেলিত হয়ে আমি উনাদের থেকে চোখ সরিয়ে মুখে হাত দিয়ে হিমুর দিকে তাকালাম। হিমু ভেজাক্ত শরীরে মৃদ্যু হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,
“কৃএিম বৃষ্টি। কেমন লাগছে?”
আমি উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে উনার কোল থেকে নেমে দু হাত দু দিকে প্রসারিত করে পানির প্রতিটা ফোঁটা গাঁয়ে মাখাচ্ছি আর জোরে জোরে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে বলছি,,
“খুব ভালো লাগছে হিমু। খুব খুব খুব ভালো লাগছে। উল্লাসে শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে আমার।”
উনি ছাদের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মলিন হেসে এক ধ্যানে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। কিছুক্ষণ লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে আমি অশ্রুসিক্ত চোখে হিমুর দিকে দুহাত বাড়িয়ে বললাম,,
“ভালোবাসি হিমু। খুব খুব খুব ভালোবাসি। আজীবন ঠিক এভাবেই আপনাকে আমার পাশে চাই। আমার সমস্ত শখ, আহ্লাদ, স্বপ্ন, ইচ্ছে, আকাঙ্ক্ষা সব আপনার মাঝেই পূরণ করতে চাই। আপনার কাঁধে মাথা রেখেই আমি জীবনের অন্তিম নিশ্বাস ত্যাগ করতে চাই। পাবো তো আপনার থেকে সেই অনুমতি হিমু?”
হিমু ইশারা দিয়ে হৃদয় ভাই এবং লাবিব ভাইকে ছাঁদ থেকে যেতে বললেন। দুজনই পাইপ লাইনটা নিচে ফেলে শুড়শুড়িয়ে ছাঁদ থেকে বের হয়ে গেলেন। ছাঁদের দরজাটা লাগিয়ে হিমু দৌঁড়ে আমার কাছে ছুটে এসে আমাকে দুহাত দিয়ে ঝাপটে ধরে বললেন,,
“অনুমতির কোনো প্রয়োজনই নেই রূপা। হিমু আজীবন ছায়া সঙ্গি হয়ে তোমার আশেপাশেই থাকবে। জীবনের অন্তিম লগ্নে ও হিমু তোমার দেহের সাথেই মিশে থাকবে। তোমার প্রতিটা নিশ্বাসের সাথী হয়ে থাকবে। হিমুকে ছাড়া এই রূপা যেমন অসম্পূর্ণ। তেমনি রূপাকে ছাড়া হিমু ও অসম্পূর্ণ। অতি ক্ষুদ্র জীবনে ও তোমাকে চাওয়ার অন্ত নেই আমার। না আছে তোমাকে ঘিরে বেঁচে থাকার সমাপ্তি। তোমার মাঝেই আমার এই ক্ষুদ্র জীবনের বাঁচা মরা রূপা। আমাদের মাঝে আর কখনো কোনো ঝড় আসবে না রূপা। সুস্থ, স্বাভাবিকভাবেই বাকিটা জীবন আমাদের কেটে যাবে।”
দুজন দুজনকে আঁকড়ে ধরে খুশিতে চোখের জল ফেলছি। হিমু পারছে না আমাকে বুকে পুড়ে নিতে। মনে হচ্ছে উনার বুকটা কতো দিনকার তৃষ্ণার্ত। আমাকে বুকে নিয়েই সব তৃষ্ণা মিটিয়ে নিচ্ছে। কিছুক্ষণ এভাবেই উনি আমাকে জড়িয়ে রেখে হঠাৎ করে আমাকে আবার কোলে তুলে নিলেন। ঘোর লাগা চাহনীতে উনি আমার দিকে তাকিয়ে থেকে ছাঁদ থেকে প্রস্থান নিয়ে সোজা আমাদের ফুলসজ্জার ঘরে চলে এলেন। দরজার খিলটা আটকে উনি আমাকে সোজা বেডে শুইয়ে দিলেন। একই দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে উনি ভেজা শেরোয়ানীটা গাঁ থেকে খুলে ফ্লোরে ছুড়ে মারলেন। উনার এই ঘোর লাগা দৃষ্টি আমার চোখে, মুখে লজ্জার রেখা টেনে দিচ্ছে। আমি অন্য পাশ ফিরে চোখ জোড়া বুজে নিলাম। বুকটা টিউটিউ করছে আমার। উনার স্পর্শ পেতেই হয়তো সব জড়তা কেটে যাবে আমার।
এর মাঝেই মনে হলো হিমু আমার শাড়ির আঁচল ধরে টানছেন। চোখ খুলে আমি উনার দিকে তাকাতেই উনি এক টানে আমার শাড়িটা খুলে নিলেন। লজ্জায় আমি দু হাত দিয়ে মুখটা ঢেকে নিলাম। অমনি হিমু আমার মুখ থেকে হাত জোড়া সরিয়ে বাঁকা হেসে আমার ঘাঁড়ে মুখ ডুবিয়ে দিলেন। উন্মাদের মতো উনি আমার ঘাঁড়ে চুমো খাচ্ছেন আর বলছেন,,
“আজ কোনো বারণ শুনব না রূপা। এই রাত শুধু, তোমার আর আমার।”
কিছু বললাম না আমি। উনার ভালোবাসায় আমি ও গাঁ ভাসিয়ে দিলাম। উনাকে আষ্টেপিষ্টে আঁকড়ে ধরলাম। আমার সাড়া পেয়ে উনি আরো বেশি উদগ্রীব হয়ে উঠলেন। ভালোবাসায় আমাকে ভরিয়ে দিচ্ছেন। সারা রাত উনি রোমান্টিক অত্যাচার চালিয়ে গেলেন। ভোর বেলার দিকে উনি আমাকে ছেড়ে উল্টো পাশ হয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে পড়লেন। শাড়িটা ফ্লোর থেকে উঠিয়ে আমি গাঁয়ে পেঁচিয়ে নিলাম। হিমুর দিকে তাকাতেই দেখলাম উনার বুকের বাঁ পাশটায় একটা লাভ বাইট পড়ে আছে। লজ্জামাখা হাসি দিয়ে আমি ধীর পায়ে হেঁটে এলোমেলো ভাবে ব্যালকনীতে এসে দাঁড়ালাম। চুলগুলো খোঁপা থেকে ছুটে ছন্নছাড়া হয়ে আছে। শরীরটা ব্যাথায় ভেঙ্গেচূড়ে আসছে। এরপরে ও কোনো কষ্ট হচ্ছে না আমার। উল্টে আনন্দ হচ্ছে। ভালো লাগায় মনটা এক অজানা শিহরণ দিচ্ছে। আজ থেকে আমি একজন পরিপূর্ণ নারী। হিমুকে পেয়ে আজ আমি সত্যিই পরিপূর্ণ। অসীম ত্যাগ, তিতিক্ষার পর আবারো আমার একটা সুখের সংসার হলো। হিমু নিজেই দুই হাতে করে আমাদের ভাঙ্গা চূড়া সংসারটাকে জুড়ে দিলেন। উনি আমার ভাগ্যে ছিলেন বলেই হয়তো এতো ঝড়-ঝঞ্ঝা পেরিয়ে আমরা আবার এক হতে পারলাম। আবারো সুখে সংসার গড়তে পারলাম। উপর ওয়ালার কাছে কোটি কোটি শুকরিয়া আমার এই ভাঙ্গাচূড়া ভাগ্যে হিমুকে জুড়ে দেওয়ার জন্য।
এর মাঝেই মনে হলো আমার ঘাঁড়ে কারো গরম নিশ্বাস পড়ছে। পিছু ফিরে তাকাতেই দেখলাম হিমু আমার ঘাঁড়ে মুখ ডুবিয়ে রেখেছেন। ঘাঁড়ের তিলটায় অসংখ্য চুমো খেয়ে উনি ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললেন,,
“এখানে কি হুম?”
আমি চোখ জোড়া বুজে মাথাটা নিচু করে লজ্জায় সিক্ত হয়ে বললাম,,
“কিছু না। ঘুম আসছিলো না তাই….
আর কিছু বলতে পারলাম না। হঠাৎ এর মধ্যেই উনি আমাকে কোলে তুলে ব্যালকনি থেকে প্রস্থান নিয়ে সোজা বিছানায় শুইয়ে দিলেন। আমার বুকে মাথা রেখে উনি আমাকে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরে বললেন,,
“হিমু তোমার বুকে আছে রূপা। এবার চোখ বুজে ঘুমাও। কথা দিচ্ছি আমার হায়াত পর্যন্ত আমি ঠিক এভাবেই তোমার বুকের সাথে মিশে থাকব।”
উনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম আমি। চোখে আনন্দ অশ্রু নিয়ে কিছুক্ষনের মধ্যে গভীর ঘুমে তলিয়ে পড়লাম আমি।
,
,
হিমু, রূপা দুজনই দুজনকে পেয়ে আজ ধন্য, সিক্ত আর পরিপূর্ণ। তাদের অতি ভালোবাসায় যেনো কোনো নজর না লাগে। যুগ যুগান্তর ধরে তারা ঠিক এভাবেই একে অপরের সাথে থাকুক। এটাই আমাদের সবার একান্ত কামনা🖤
#সমাপ্ত
(শেষ হলো হিমু, রূপার প্রেমকাহিনী। গল্পের প্লট আমি যেভাবে সাজিয়েছিলাম, গল্পটা ঠিক সেভাবেই শেষ হয়েছে। কোনো রকম ব্যতিক্রম হয় নি। যারা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত গল্পটার পাশে ছিলেন তাদের জন্য অসংখ্যায়িত ভালোবাসা আর ধন্যবাদ রইল। ভালো থাকবেন সবাই। শরীরের দিকে যত্ন রাখবেন। আর গল্পটা কেমন হয়েছে আপনাদের মন্তব্যের মাধ্যমে জানাবেন।)