#তাহার_আগমন

পর্ব:০৪

সায়মা অফিসে ঢুকতেই দেখতে পেল,সবাই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।সবার মুখ কেমন যেন গম্ভীর।।সায়মাকে ঢুকতে দেখে,কেউ কেউ নিজেদের মধ্যে কি নিয়ে যেন ফিসফিস করছে।সায়মা বুঝতে পারছে না,এভাবে তাকিয়ে কি নিয়ে কথা বলছে?সায়মার ভেতরে একটা ভয় লাগা কাজ করতে শুরু করলো।চাকরিটা চলে যায়নি তো?গতমাসে ছোটখাটো একটা বিষয় নিয়ে সিনিয়র ফিরোজ ভাইয়ের সাথে বেশ বড় ঝামেলা হয়।উনি শাসিয়েছিল যে,এই অফিসে চাকরি কিভাবে করি দেখে নেবে?অবশ্য সায়মা তখন এই কথা পাত্তা দেয়নি।কারন উপরের অফিসারের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে সায়মার।কিন্তু তারপরও বিষয়টা যখন সবার সামনেই হয়েছিল,চাকরি যেতে কতক্ষণ?সায়মা চাকরি চলে গেছে ব্যাপারটা ধরে নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতেই হঠাৎ চোখ পড়ল,মাঝখানে একজন পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে আছে।অফিসে হঠাৎ পুলিশ দেখে সায়মা কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল,তাহলে চাকরিটা যায়নি।ব্যাপারটা তাহলে অন্যকিছু।সায়মা এগিয়ে আসতেই রিনি বলল,তুই এখন এসেছিস?এদিকে তো অনেক বড় ঘটনা ঘটে গেছে।

সায়মা অবাক হয়ে বলল,অনেক বড় ঘটনা ঘটেছে!কি হয়েছে?

-গতকাল রাতে দারোয়ান চাচাকে কে যেন নৃশংসভাবে মেরে ফেলেছে।শুধু উনার ছিন্ন হাতটাই পড়ে আছে।সকালে অফিস খুলতে এসে আজিম দেখে এই অবস্থা।লোকটা এত সরল একটা মানুষ।সবসময় “আপামনি” ছাড়া কথাই বলতো না।অথচ কি যে হয়ে গেল,আফসোস করে বলল রিনি।

রিনির কথা শুনে সায়মার গতকাল সন্ধ্যার কথা মনে পড়ে গেল।মিটিং-এ হঠাৎ রেহানার অসুস্থতা।তারপর দুজনে কেবিনে বসে আড্ডা দেয়া।হঠাৎ অন্ধকারে রেহানার সামনে এগিয়ে আসা।তারপরই গলা টিপে ধরা।হাত থেকে ফসকে তখন পালিয়ে গিয়েছিল সায়মা।সাময়া ভেবেছিল,হয়তো অসুস্থতায় এমনটা করেছিল রেহানা।কিন্তু সে যাওয়ার পর অফিসে ছিল শুধু রেহানা।তাহলে কি রেহানাই দারোয়ান চাচাকে?পরমুহূর্তে সে চিন্তা বাদ দিল সায়মা,রেহানা এত নৃশংসভাবে মারতে যাবে কেন?রিনির ডাকে চমকে উঠলো সায়মা,তোকে ডাকছে।

-এই সায়মা,খবরটা নিশ্চয়ই জানো,দারোয়ান চাচাকে কে যেন মেরে ফেলেছে,বলল ফিরোজ।

ফিরোজ ভাইয়ের কথার জবার দিতে সায়মার ইচ্ছে করছে না।কিন্তু সামনে পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে।কিছু না বললে সন্দেহ করতে পারে।সায়মা বলল,হ্যাঁ,মাত্র রিনির থেকে শুনতে পেলাম।

পুলিশ অফিসার এগিয়ে এসে বলল,আমি ইন্সপেক্টর সাদমান।অফিস রেকর্ড অনুযায়ী আপনিই তো শেষে বেরিয়েছেন অফিস থেকে।সিসিটিভি ফুটেজ অনুযায়ী আপনাকেই দৌঁড়ে বের হতে দেখা গেছে গেইটে।এই ব্যাপারে আপনার কি কিছু বলার আছে?

সায়মা অফিসারের কথায় অবাক না হয়ে পারলো না।সে আর রেহানা তো সবার শেষে ছিল।সে বের হওয়ার পরও তো রেহানা অফিসের কেবিনে থাকার কথা।কিন্তু রেহানা কি অফিস থেকে বের হয়নি?হলে তো শেষ রেকর্ড অনুযায়ী রেহানারই থাকার কথা।হিসেব তো কিছুতেই মিলছে না।

অফিসার সাদমান হঠাৎ ধমকে উঠে বলল,আপনি চুপ করে আছেন কেন?এত সময় তো আমার কাছে নেই।অন্য কাজেও তো যেতে হবে।

সায়মা বলল,আমি তো শেষে যায়নি।রেহানা ছিল তো অফিসে।রেহানার শরীর খারাপ ছিল বলে আমরা দুজনে কেবিনে বসেছিলাম।তারপরই…

-তারপরই কি,জিজ্ঞেস করলো ইন্সপেক্টর সাদমান।

সায়মা ভাবছে,কথাটা বললে সবাই হেসে উড়িয়ে দিবে।বলল,তারপরই আমি রেহানাকে বিদায় জানিয়ে বের হয়ে যাই।

-কিন্তু অফিস রেকর্ড তো বলছে,আপনি বের হওয়ার দশমিনিট আগেই রেহানা বের হয়ে যায়।তাহলে রেহানা পরে বের হয় কিভাবে?এবার সত্যিটা কি আপনি বলে ফেলুন।

-এটা কিভাবে সম্ভব?তাছাড়া আমার সাথে দারোয়ান চাচার তো কোনো ঝামেলা হয়নি।এই ব্যাপারে আমাকে কোনো যুক্তি ছাড়া সন্দেহ করার মানে কি?সায়মা একবার ফিরোজের দিকে তাকালো।লোকটা তাকে ফাঁসিয়ে দেয়নি তো?

ইন্সপেক্টর সাদমান মাথা নেড়ে বলল,আমিও তাই ভাবছি।যাই হোক,আমি তদন্ত করছি।উনার মৃত্যুর কারন খুব শীঘ্রই জানতে পারবো।সবাই যার যার কাজে যান।আমাকে আমার কাজ করতে দিন।সায়মার দিকে তাকিয়ে বলল,আপনি আপাতত কাজ করুন।পরে আপনাকে প্রয়োজন হতে পারে।

সায়মা নিজের ডেস্কে গিয়ে বসতেই খেয়াল হলো,সত্যিটা না বললে সে নিজেই ফেঁসে যাবে।সাদমান লোকটাকে সুবিধার মনে হচ্ছে না।অযথা থানায় নিয়ে হেনস্তা করবে।গতকাল সন্ধ্যার ঘটনা খুলে বলা প্রয়োজন।হাসির পাত্রী হলেও সমস্যা নেই।কিন্তু একটা বিষয় কিছুতেই বুঝতে পারছি না,রেহানা দশমিনিট আগে বের হলো কিভাবে?তখন তো দুজনে কেবিনে বসেছিলাম।তাহলে কি সেটা রেহানা ছিল না?

সায়মা দেখতে পেল,ইন্সপেক্টর জানালা দিয়ে নিচে তাকিয়ে আছে।সম্ভবত গেইটের দিকে।সায়মা উঠে এসে বলল,আমি আপনাকে একটা মিথ্যা কথা বলেছি।এখন না বললে আপনি আমাকে অযথা সন্দেহ করতে পারেন।তাই কথাটা বলে ফেলা জরুরি।

ইন্সপেক্টর সাদমান সায়মার দিকে ঘুরে ভ্রুঁ কুচকে বলল,কি মিথ্যা বলেছেন?

পাঁচ.

নিতাইপুর পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় বিকাল পার হয়ে গেল।শহর থেকে বেশ কিছুটা ভেতরে।রাস্তার অবস্থাও খুব একটা ভালো না।গ্রামের রাস্তায় আসতেই গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়া হলো।ড্রাইভার বলল,”বাকি পথ হাঁটা ছাড়া উপায় নাই।তবুও গরুর গাড়ি কপাল ভালো থাকলে পাইতে পারেন।বিকালে খুব একটা পাওয়া যায়না।”কপাল সত্যিই বড্ড খারাপ ছিল সানাউল মির্জার।অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার পরও গরুর গাড়ি পাওয়া যায়নি।বাধ্য হয়ে পুরো পথ হেঁটেই আসতে হয়েছে।সানাউল মির্জা লক্ষ্য করে দেখলেন,আশেপাশে মানুষের আনাগোনা খুবই কম।বেশ কয়েকপথ হাঁটার পর দু’একজন মানুষ চোখে পড়ে।কিন্তু কেউ তেমন কথা বলতে আগ্রহ প্রকাশ করল না সানাউল মির্জার সাথে।একপ্রকার পাশ কাটিয়ে চলে যায় সবাই।সবার আচরনে বেশ অবাক তিনি।অচেনা একটা মানুষকে সবাই সাহায্য করবে,সেটা না করে যেন পালিয়ে গেলে বাঁচে।গ্রামের অর্ধেক পথ হাঁটার পর দূরে একটা টং দোকান চোখে পড়ল উনার।অনেক আশা নিয়ে দোকানের দিকে পা বাড়ালেন তিনি।দোকানের কাঠের বেঞ্চে দুজন লোক বসে আছে।খুব আস্তে আস্তে কথা বলছে একে অপরের সাথে।দোকানে বসা লোকটির বয়স চল্লিশের উর্ধ্বে হবে আন্দাজ করলেন তিনি।পরিশ্রমের কারনে শরীর ভেঙে পড়েছে।বেশ আতঙ্কে এই গ্রামের মানুষ তা চোখের ভাষা দেখে অনুমান করে বলা যায়।

-এক কাপ চা দেয়া যাবে চিনি কম দিয়ে,কাঠের বেঞ্চে বসতে বসতে বলল সানাউল মির্জা।

সানাউল মির্জার কথা শুনে সবাই যেন ভূত দেখার মত চমকে উঠেছে।একে অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে কি যেন ইশারা করল।দোকানে বসা লোকটি জিজ্ঞেস করল,আপনি কি এই গ্রামে নতুন নাকি?আগে তো দেখিনি আপনাকে।

সানাউল মির্জা ভাবলেন,একে তো নতুন গ্রাম।আর গতকাল টিনশেড ঘরের ভেতরে গিয়ে যা দেখলেন,মনে হচ্ছে এখানে কোনো কিছুই স্বাভাবিকভাবে চলছে না।মিথ্যা বলা ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছেন না তিনি।দোকানদার লোকটির দিকে তাকিয়ে বললেন,নিতাইপুরে আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছি।

-আত্মীয়ের বাড়ি!বেশ চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন বেঞ্চে বসে থাকা এক বৃদ্ধ লোক।আপনি সব খবর নিয়ে এখানে এসেছেন তো মশাই?

-উনাদের নাম্বার তো আমার কাছে নেই।একবার আসা হয়েছিল তা বছর চার পার হয়ে যাবে।মাঝে তেমন একটা খবর নেয়া হয়নি।এখন জমি-জমার ব্যাপার নিয়ে একটু গ্রামে আসা,বললেন সানাউল মির্জা।

-তাই বলেন।নাহলে কে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনতে সশরীরে আসবে এখানে,বললেন সেই বৃদ্ধ লোকটি।

সানাউল মির্জা ব্যাপারটা উনাদের মুখ থেকে শোনার জন্যই বললেন,সর্বনাশ মানে?

দোকানে বসা লোকটি কথা ঘুরিয়ে বলল,সে কথা থাকুক না।তা আপনি কোন বাড়িতে এসেছেন?দেখি আমরা চিনতে পারি কিনা?

বেশ ঝামেলায় পড়লেন সানাউল মির্জা।অচেনা গ্রামে এখন কোন আত্মীয়ের নাম বলবেন তিনি?নাম বললে আবার ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।দোকানদারকে এখানের স্থানীয় মানুষ বলেই মনে হচ্ছে।এই গ্রামের প্রতিটা বাড়ি তার মুখস্থ।মুখ দিয়ে অ বললে সে বাড়ির ই পর্যন্ত বলে দিতে পারবে।মাথায় একটা বুদ্ধি তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে আসলো সানাউল মির্জার।আন্দাজে ঢিঁল ছোঁড়ার মত বললেন,ওইযে তাহের চাচা বলে একজন আছেন যে?আমি উনার বাড়িতেই যাবো।

– স্কুল শিক্ষক তাহের স্যার?জিজ্ঞেস করলেন বৃদ্ধ লোকটি

ভেতরে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন সানাউল মির্জা।অন্তত একজনের সাথে মিলে গেছে।জ্বি,আপনি দেখছি ঠিকই চিনতে পেরেছেন।চা খেয়েই রওনা দিবো।তা বাড়ি আগেরটাই তো?আমি আবার পথঘাট ভুলে বসে আছি।এই চারবছরে সবই পাল্টে গেছে,বললেন সানাউল মির্জা।

-তা অবশ্য ঠিকই বলেছেন।অনেক কিছুই পাল্টে গেছে।কিন্তু স্যারের পরিবারের সবাই এই গ্রাম ছেড়ে কিছুদিন আগেই চলে গিয়েছে,বলল দোকানদার লোকটি।

-হঠাৎ নিজ বাড়ি ছেড়ে সবাই চলে গেল কেন,জিজ্ঞেস করলেন সানাউল মির্জা।

-কেন চলে গেছে,কেউ বলতে পারে না।সঙ্গে শুধু কাপড়ের ব্যাগটা নিয়েছে।হঠাৎ করেই সবাই বাড়ি ছেড়ে নিতাইপুরের বাইরে চলে যাচ্ছে,আমতা আমতা করে বলল দোকানদার।

সানাউল মির্জা বললেন,তাহলে কি আর করার।আমিও শহরে ফিরতে পথ ধরি।বসে থেকে তো লাভ নেই।

-একটু পরে মাগরিবের আযান পড়বে।আমি দোকান বন্ধ করে বাড়িতে চলে যাবো।যা দিনকাল পড়েছে,বাইরে থাকলে সবসময় আতঙ্কে থাকি।আপনি আজ রাতটা আমার বাড়িতে থেকে যান।ভোরের আলো ফুটলে রওনা দিবেন।শেষে বেড়াতে এসে প্রাণটা না গেলেই হয়,বলল দোকানদার লোকটা।

পুরো বিষয়টা বের করার জন্য সানাউল মির্জা ডাকাতের প্রসঙ্গ তুলে বললেন,কিসের আতঙ্ক?এই গ্রামে ডাকাত পড়ে নাকি?আমি ওসবে ভয় পাইনা।একবার কি হয়েছে জানেন,ট্রেনে করে রাজশাহী যাচ্ছি।হঠাৎ “ডাকাত পড়েছে” বলে চিৎকার শুনতে পেলাম।তারপর…

সানাউল মির্জাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,না,ওসব কিছু না।এটা অন্যকিছুর আতঙ্ক।আপনাকে সবটা আমি বলতে পারবো না।আপনি একটু অপেক্ষা করুন।আমি দোকান বন্ধ করে তারপর বাসায় যাবো।ওই মিয়ারা,তোমরা এখন যার যার ঘরে যাও।

দোকানদার লোকটি দোকান বন্ধ করে হাতে হারিকেন আর লাঠি নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন।সানাউল মির্জা ভেবেছিলেন,উনার ট্রেনের গল্প শুনে হয়তো তাল মিলিয়ে কিছু বলতে যাবে।কিন্তু কিছুই বললো না।তিনি প্রসঙ্গটা আবার টেনে বললেন,আপনি তো তখন বললেন না কিসের আতঙ্ক?

লোকটি বিরক্ত হয়ে বলল,চুপ করে হাঁটেন তো।শব্দ করবেন না।শব্দ করলে তার কানে যাইবো।

আবিদ বারান্দায় বসে আছে।একটু আগে থানা থেকে ফোন করেছিল তাকে।রেহানাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুপুরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।তাদের অফিসে এক দারোয়ান খুন হয়েছে সে ব্যাপারে।একটু আগে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।আবিদ বুঝতে পারছে না,কি করবে সে?এক ঝামেলা শেষ না হতেই আবার অন্য ঝামেলা।রেহানাকে এই ব্যাপারে কিছুই বলা যাচ্ছে না।আবিদের টেনশনে মাথাও কাজ করছে না।মির্জা সাহেব এই বিষয়ে কতদূর এগিয়েছেন কে জানে?বড্ড অদ্ভুদ তিনি!কিছু বললে গম্ভীরভাবে উত্তর দিবে।যেন হাসতেও ভুলে গেছেন।খুব প্রয়োজন না হলে কথাও বলে না।হঠাৎ আবিদের চোখ গেল তাদের বাসার নিচের ঝোপঝাড়ে।দুটি চোখ যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে।আবিদ নিশ্চিত হতে পারছে না,মানুষ নাকি বিড়াল?কারন অনেক সময় বিড়ালও এই বিল্ডিং-এ ঢুকে খাবার চুরি করে নিয়ে যায়।কিন্তু এত রাতে বিড়াল বসে থাকবে কেন?আবিদ বুদ্ধি করে মোবাইল বের করে একটা ছবি তুলে ফেলল খুব সাবধানে।ছবিতে কাছ থেকে দেখতেই চমকে উঠলো সে।সত্যিই একজন সেখানে বসে আছে।লোকটি এই বারান্দার দিকেই তাকিয়ে আছে।আবিদ তাড়াতাড়ি উঠে সিড়ি দিয়ে নামতে শুরু করলো।ঝোপের কাছে আসতেই দেখতে পেল,সেখানে কেউ নেই।অথচ ছবিতে স্পষ্টই দেখা গেছে,কেউ বসে নজর রাখছিল।আবিদ লাইট জ্বালিয়ে আশপাশে কিছু পাওয়া যায় কিনা খুঁজতে শুরু করলো।হঠাৎ লোকটি যেখানে বসেছিল সেখানে একটি সিগারেট দেখতে পেল সে।সিগারেট থেকে এখনো ধোঁয়া বের হচ্ছে।তার মানে কেউ এখানে বসে সিগারেট খাচ্ছিল।আবিদ একটু সামনে গিয়ে দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলো,চাচা,এখান দিয়ে কাউকে যেতে দেখেছেন?

-কতজনই তো যায়।কেন বলো তো?

-না মানে,ওই ঝোপের আড়ালে কেউ বসে ছিল,তাই জিজ্ঞেস করছিলাম।

-হ্যাঁ,একটু আগে খাকি পোশাকে একজনকে দৌঁড়ে যেতে দেখলাম।মনে হচ্ছে,আর খুঁজে পাওয়া যাবেনা।পাঁচ মিনিটের মতোই হবে।

আবিদ ভাবছে,আর সামনে যেয়ে লাভ নেই।অনেক আগেই পালিয়ে গেছে।খাকি পোশাক তো পুলিশের লোকজন পড়ে।তাহলে কি রেহানার ব্যাপারে পুলিশ আমার বাসার উপর নজর রাখছে?কিন্তু রেহানার এই বিষয়ে তো বাইরের লোক জানার কথা হয়।তাহলে এই অচেনা খাকি পোশাকে নজর রাখা লোকটি কে?

সানাউল মির্জা বিছানায় শুয়ে আছেন।উনাকে পাশের এক ঘরে বিছানা করে দেয়া হয়েছে।নতুন জায়গা,সঙ্গে নতুন পরিবেশ।সাথে চারদিকে ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দে আশপাশের অবস্থা আরও ভৌতিক হয়ে উঠছে।ঘড়ি হাতে নিয়ে দেখলেন রাত প্রায় দশটা বাজতে চলেছে।গ্রামে রাত দশটা মানে অনেক।শহরের মানুষ তাই এত সকাল চোখে ঘুম আসবে না ভেবে জানালা খুলে আকাশ দেখছেন সানাউল মির্জা।তবে গ্রামের কোনো কিছুই তার কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না।বিশেষ করে এখন তিনি যেই ঘরে শুয়ে আছেন সেখানের মানুষের আচরন তারই ইঙ্গিত করছে।এই বাড়িতে আসার পর থেকে সবাইকে কেমন যেন পাথরের মত মনে হচ্ছে।চিন্তায় চিন্তায় একেকজনের চোখের মনি যেন ভেতরে ঢুকে যাবে।।দু’একটা কথা কেউ কেউ বললেও তা খুব আস্তে আস্তে যা তেমন শোনা যায় না।নিতাইপুর যেন প্রানহীন এক গ্রামে পরিণত হয়েছে।যেখানে মানুষ সবই দেখছে পাথরের মত কিন্তু মন দিয়ে অনুভব করছে না।এই বাড়ির মানুষজন এখনও মনে হয় ঘুমায়নি।গিয়ে তাদের সাথে আড্ডা দেয়ার চেষ্টা করি।আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে দু’একটা কথা বের করতে পারলে তার জন্যই ভালো হবে।সানাউল মির্জা বিছানা থেকে নেমে পাশের রুম অনুসরন করে হাঁটতে শুরু করলেন।দেখতে পেলেন,সবাই এক জায়গায় জড়ো হয়ে বসে আছে।বাড়ির নারীরা উনাকে দেখে মুখে লম্বা ঘোমটা টেনে দিল।

সানাউল মির্জা গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,আপনারা এখনও দেখি জেগে আছেন।আমার ঘুম আসছিল না।বিছানার এপাশ থেকে ওপাশে শুয়ে পায়চারি করছিলাম।শেষে বিরক্ত হয়ে একটু আড্ডা দিতে চলে আসলাম এখানে।

-আমার ছেলে রমিজ এখনও বাড়ি ফিরেনি।ওর জন্য অপেক্ষা করছি সবাই।রমিজ বাড়ি ফিরলে তারপর সবাই ঘুমাতে যাবো,বলল দোকানদার লোকটি।সামনের চেয়ার দেখিয়ে বলল,আপনি এই চেয়ারে বসুন।নতুন জায়গা তো,ঘুম সহজে আসবে না।

-আপনার ছেলে রমিজ কি আড্ডা দিয়ে বাড়িতে ফিরবে নাকি,চেয়ারে বসতে বসতে বললেন সানাউল মির্জা।

দোকানদার লোকটি কিছু বলতে যাবে সে সময়ে দরজায় জোরে জোরে বাইরে থেকে কে যেন ধাক্কা দিল।সানাউল মির্জা হাঁক ছেড়ে জিজ্ঞেস করলেন,এত জোরে দরজায় আঘাত করছে কে?আমরা তো এখানেই বসে আছি।

-বাবা,আমি রমিজ।তাড়াতাড়ি দরজা খুলেন।আজকে আরও একজন গেছে,গলার আওয়াজ শুনে বেশ আতঙ্কিত মনে হচ্ছে রমিজকে।

দোকানদার লোকটি চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই রমিজ এক প্রকার দৌঁড়ে ভেতরে ঢুকে তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দিল।পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে রমিজের।ব্যাপারটা খেয়াল করলেন সানাউল মির্জা।জিজ্ঞেস করলেন,কি হয়েছে রমিজ?তুমি এভাবে কাঁপছো কেন?

কথাটা শুনে দোকানদার বেশ থতমত খেয়ে উঠলেন।তার পাশে যে সানাউল মির্জা ছিল সেটা হয়তো খেয়াল ছিল না।বলল,কিছু না সাহেব।এই গ্রামে মাঝেমাঝে জুয়াখেলা নিয়ে মারামারি হয়।হয়তো মারামারি দেখে রমিজ ভয় পেয়েছে।

সানাউল মির্জা মাথা নেড়ে বললেন,না,আমার কাছে অন্য ব্যাপার মনে হচ্ছে।মারামারি তো সাধারন ব্যাপার।তা দেখে এভাবে ভয়ে শরীর কাঁপার কথা নয়।

-বাবা,উনি তো আমাদের গ্রামেরই মানুষ।হয়তো দীর্ঘদিন গ্রামে আসেনি।কিন্তু গ্রামের সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলছে না,সেটা উনারও জানা প্রয়োজন,বলল রমিজ।

দোকানদার লোকটি তার ছেলেকে চুপ থাকতে কিছু বলতে যাবে এমন সময়ে সানাউল মির্জা ইশারায় থামিয়ে দিয়ে বললেন,রমিজ,কি হয়েছে বলো আমাকে?তুমি এভাবে কাঁপছো কেন?

-পূর্বের আক্তার স্যারের ছেলে আজকে সন্ধ্যা থেকে নিঁখোজ।তবে ওকে আর পাওয়া যাবে না আমরা সবাই নিশ্চিত।কারন এই গ্রামে কেউ নিঁখোজ হলে তার শরীরটা খুঁজে পাওয়া যায় না।একটু আগে জমিদার বাড়ি থেকেও শোরগোলের আওয়াজ শোনা গেল।কে জানে কি হচ্ছে সেই বাড়িতে।

-তোমাদের গ্রামের চারপাশের অবস্থা দেখে আমার মনে হচ্ছে,ভয়ঙ্কর কিছু ঘটছে।গ্রামের মানুষজনও খুব একটা কথা বলছে না।তাছাড়া আমি ছদ্মবেশে ব্যাপারটা তদন্ত করতে এসেছি।আসলে আমি এই গ্রামের কেউ নই।আমি এই গ্রামের লোকদের বাঁচাতে এসেছি।আমাকে সবকিছু খুলে বলো কি হয়েছে?এমনও হতে পারে আমি এর একটা সমাধান বের করতে পারবো,বললেন সানাউল মির্জা।

রমিজ আড়চোখে একবার ওর বাবার দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলো,বেশ কিছুদিন আগে থেকেই ঘটনাগুলো ঘটছে।প্রতিদিনই কেউ না কেউ নিঁখোজ হয়ে যাচ্ছে।আর কারও লাশ পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না।প্রথম প্রথম সবাই বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবে ধরে নিলেও এখন এই ভয়ে পুরো গ্রাম জনশূন্য বলতে পারেন।এখন আমরাসহ আর মাত্র কয়েকটা পরিবার গ্রামে ভয়ে ভয়ে দিন কাটছে।এখন পর্যন্ত প্রায় কয়েকশ মানুষ নিঁখোজ হয়েছে।সংখ্যাটা হয়তো এর বেশিও হতে পারে।

সানাউল মির্জা উঠে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত হয়ে বললেন,জমিদার বাড়ির পথটা কোনদিকে?এখনই সেখানে যেতে হবে।

রমিজ পথ আগলে দাঁড়িয়ে বলল,পাগল হয়েছেন আপনি?সেখানে যদি ওই শয়তানের সামনে পড়েন বেঁচে ফিরতে পারবেন?এত সহজভাবে ব্যাপারটা নেয়া উচিত হবেনা আপনার।

সানাউল মির্জা বললেন,আমার কিছুই হবেনা।কাউকে না কাউকে তো এগিয়ে আসতে হবে।সবাই যদি এভাবে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকে তাহলে এর পেছনের কারনটা কখনো জানা যাবে না।আর না জানলে মৃত্যুর মিছিল থামবে না।

-তারপরও,আপনার এখন যাওয়া ঠিক হবেনা।দিনের আলো ফুটলে আমি নিজেই আপনাকে নিয়ে যাবো,বলল রমিজ।

-দিনের আলোতে গিয়ে আমার জন্য কিছুই পড়ে থাকবে না।তুমি আমাকে জমিদার বাড়ির পথটা বলে দাও।

রমিজ সানাউল মির্জার জেদের কাছে হেরে যেতে বাধ্য হলো।বলল,কি আর করার।আপনাকে বাধা দেয়ার সাধ্য আমার নেই।এখান থেকে বের হলে কিছুদূর যাওয়ার পর একটা তালগাছ দেখবেন।সেই গাছের পাশ দিয়ে একটা রাস্তা চলে গেছে।রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলে পূর্বদিকে আরেকটা পথ দেখবেন।সামনেই জমিদার বাড়ির সীমানা চোখে পড়বে।

সানাউল মির্জা সবাইকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়লেন বাড়ি থেকে।হাতের টর্চ লাইটের আলো কিছুটা কমিয়ে পথ চলতে শুরু করলেন।কিছুদূর যেতেই তালগাছের দেখা পেয়ে গেলেন তিনি।টর্চ লাইটের আলো বন্ধ করে দিলেন।চাঁদের আলোতে পথ চলতে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না সানাউল মির্জার।নিতাইপুর এখন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে।বাড়িঘর সব জনশূন্য।দূরে দু’একটা কুকুর কান্না করছে।মনে হয়,মৃত্যুর ভয়টা বোবা প্রানীগুলোর স্পন্দন পর্যন্ত চলে গিয়েছে।আতঙ্কে প্রাণীগুলো কাঁদছে।চারপাশ আস্তে আস্তে ঘন হতে শুরু করেছে।ধানের জমি পেরিয়ে গাছের সারি ধরে হাঁটছেন তিনি।হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন।চাঁদের আলোতে কারো ছায়া দেখা যাচ্ছে।ছায়াটি উনাকে অনুসরণ করেই পিছু নিয়েছে।সানাউল মির্জা পেছনে ফিরলেন।কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না তিনি।তাহলে ছায়াটি কার ছিল?আবার পথ চলতে শুরু করলেন।নাহ,এবার আর ভুল শুনতে পাননি।মনে হচ্ছে,কেউ পেছনে দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস ফেলছে।ঠিক রেহানাদের বাসা থেকে বের হওয়ার সময় সিড়িতে কাঁধের কাছে যেমন নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন তিনি।তাহলে কি এবার তারই মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছে?রহস্য বের করার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বেন?শয়তান পিশাচ তাহলে সানাউল মির্জার পেছনে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর নিঃশ্বাস ফেলছে?

………চলবে……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here