ডাক্তার সাহেব পর্ব- ৫০/ শেষ পর্ব
২য় অংশ

#শারমিন আঁচল নিপা

ঠিক এমন সময় কারও হাতের স্পর্শ অনুভব করল সিঁথি। সে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখল নার্স আয়েশা দাঁড়িয়ে আছে। সিঁথি নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বলল

– কিছু বলবে আয়েশা?

– জি কিছু বলার ছিল। একটু কি এদিকে আসবেন? কথাটা আলাদা করেই বলতে চাই।

সিঁথি বুঝতে পারছে না আয়েশা কী বলবে! নিজেকে অনেকটা শান্ত করে নিল। রুবাইয়াকে ছেড়ে একটু দূরে গেল। আয়েশা কিছুটা চুপ থেকে বলল

– ম্যাডাম আপনার কি মনে আছে মেয়েটার কেবিনে একটি সিসিটিভি লাগিয়েছিলেন গোপনে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বলে । আপনি কি একটু ঐটা চেক করবেন?

সিঁথি কিছুটা ভাবান্বিত গলায় বলল

– ঐটা চেক করে কী হবে আর বলো? ঐটা তো আমি লাগিয়েছিলাম যাতে করে আমি বাইরে থাকলেও মেয়েটার খোঁজ খবর নিতে পারি। বেশ কয়েকবার নষ্ট হয়েছে। ঠিক করে নিয়েছিলাম। এখন কী ঠিক আছে কি’না কে জানে?

– ম্যাডাম আমি দেখেছি সিসিটিভিটা কাজ করছে। আর ঐ মেয়েটা যখন রেসপন্স করেছিল সে তখন গড় গড় করে কিছু একটা কাহিনি বলেছিল। আমি তো সব কাহিনি বুঝতে পারিনি। এরপর ওসি সাহেব আসলেন কোনো একটা কারণে মেয়েটার সাথে দেখা করতে এবং আমাকে বের হয়ে যেতে বললেন। আর এমনিতেও মামলাটা উনার তত্ত্বাবধানে যেহেতু, তাই মাঝে মাঝে উনি আসলে আমরা ভেতরে থাকার অনুমতি পাইনা সেটা আপনি খুব ভালো করেই জানেন। উনি চলে যাওয়ার পর পরই মেয়েটার অবস্থার অবনতি ঘটতে শুরু করে এবং আই সি ইউতে নিয়ে যাই দ্রূত। আপনি একটু সিসিটিভি ফুটেজ চেক করুন। আমার মনটা অনেক খচখচ করছে এই জায়গায়।

আয়েশার কথা শুনে সিঁথির মনে নতুন আশার আলোর বীজ বুনল। সিঁথি দ্রূত একজনকে কল দিল, যে এ ফুটেজ গুলো সুন্দর করে বের করে দিতে পারবে। সিঁথি কল দেওয়ার মিনেট বিশেকের মধ্যেই একজন অল্প বয়স্ক ভদ্রলোক চলে আসলেন। উনি আসার পর সিঁথি তাকে একটু আগের ফুটেজটা বের করে দিতে বললেন। ভদ্রলোকও সিঁথির কথামতো একটু আগের ফুটেজটা বের করলেন।

এবার সিঁথি লক্ষ্য করল, মেয়েটা প্রথমেই রেসপন্স করা শুরু করল। তারপর উঠল। তখন সেখানে কেউ ছিল না। মেয়েটা উঠেই কেবিনের পাশে রাখা কাগজে যেন কী লিখল। কাগজটা কেবিনের ড্রয়ারে রাখল। তারপর জোরে চেঁচামেচি করতে লাগল। মাথায় ধরে চিল্লাতে লাগল। এমন সময় আয়েশা সেখানে প্রবেশ করল। আয়েশার প্রবেশের পর সে মেয়েটাকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু মেয়েটা যেন কি বলছে। আরও উদ্ধত হচ্ছে একের পর এক কথা বলে। ঠিক এমন সময় ওসি সাহেব প্রবেশ করলেন। উনি সেই ওসি সাহেব যিনি এ মামলাটা প্রথম থেকেই তদারকি করছেন। বয়সটা উনার সময়ের সাথে সাথে চল্লিশের কোঠা পার হয়ে গেলেও মামলা এখনও তিনিই তদারকি করে আসছেন। ঘটনার ধারাবাহিকতায় উনার পোস্টিংটাও এ শহরে হয়। ওসি সাহেব প্রবেশের সাথে সাথে আয়েশাকে বেরিয়ে পড়তে হলো। এবার যা দেখল তা দেখে সিঁথির বুকটা কেঁপে উঠল। এত সহজে সিঁথির চোখ সব এড়িয়ে গেল কীভাবে সে শুধু এটাই ভাবছে।

ওসি সাহেব মেয়েটার হাত দুটো ধরল। মেয়েটা তখন ওসি সাহেবকে মারতে শুরু করল। মনে হচ্ছিল অনেকদিন পর কোনো অপরাধীকে সামনে পেলে চেপে যাওয়া রাগটা যেভাবে প্রকাশ পায় ওসি সাহেবেকে দেখে মেয়েটার রাগও ঠিক একইভাবে প্রকাশ পেল। এবার ওসি সাহেব নিজেকে বাঁচাতে মেয়েটাকে জোরে ধাক্কা দিল। মেয়েটা সাথে সাথে জ্ঞান হারাল। এরপর তিনি বের হয়ে গেলেন৷ আর মেয়েটা কাঁতরাতে লাগল।

এখনও সিঁথির কাছে পরিষ্কার না ওসি সাহেবের সাথে মেয়েটা কেন এমন করছে। সিঁথি উঠে দাঁড়াল। সে কেবিনে গিয়ে ড্রয়ারটা খুলল। সেখান থেকে কাগজটা বের করে পড়তে লাগল৷ তাতে লেখা ছিল

সিঁথি ম্যাডাম

আমি আপনার সব কথা শুনি। শুধু আপনার কথার উত্তর গুলো কথা বলে সাড়া দিতে পারি না। ইশারাতেও আপনাকে বুঝাতে পারিনা। যখন আমি একটু সাড়া দেওয়ার অবস্থায় থাকি সেটাও বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। দীর্ঘ ১৬ বছর আপনার যন্ত্রণার সাক্ষী আমি৷ আপনি এসে আমার সাথে কথা বলে মন হালকা করেছেন। বারবার জানতে চেয়েছেন আপনার নীল নির্দোষ কি’না সেদিন কী ঘটেছিল? সময়ের পরিক্রমায় সবকিছু আমার মস্তিষ্কে এখন নেই। কিছুটা বিলীন হয়ে গিয়েছে। তবে এটা সত্য যে আপনার নীল আমাকে কিছু করেনি। বরং আমাকে বাঁচাতে গিয়ে সেদিন তিনি নিজেই আহত হয়েছিলেন। সেদিন বাকি দুজন আমাকে রেইপ করার পর আমি যখন থানায় যাই তখন আমাকে ওসি সাহেব পর্যবেক্ষণের নাম করে আলাদা রুমে নিয়ে গিয়ে পুনরায় রেইপ করে। আর এরপর থেকে আমি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলি। হারিয়ে ফেলি শারীরিক সমস্ত শক্তি। হয়তো বিধাতা খানিকক্ষণের জন্য আমাকে সুস্থ করেছেন আপনাকে সত্যটা বলার জন্য। এখন তো আপনি নেই তাই কাগজে কলমে লিখে গেলাম৷ হাত পা আবার কখন অসাড় হয়ে যায় বলা যায় না৷ আমার এ সুস্থতা তো স্থায়ী না। আমি মরতে চাই। এ অভিশাপযুক্ত আর সচলহীন জীবনটা আমি আর নিতে পারছি না৷ আত্মহত্যা মহাপাপ নাহয় এখন করে ফেলতাম। আমাকে আপনি মরে যাওয়ার ব্যবস্থা করবেন। আমাকে আর চিকিৎসা করানোর দরকার নেই৷ এ যন্ত্রণা থেকে আমি মুক্তি চাই। দোয়া করি আপনার ভালোবাসা সফল হোক। তবে আমি মুক্তি চাই। আরেকটা কথা বলব ওসি সাহেব বেশ কয়েকবার আমার কেবিনে এসে এক গাল হেসে আমাকে উপহাস করে গেছেন এবং এটাও বলেছেন উনি আপনার বোন রিদিকেও ধর্ষণ করেছে। উনার সাথে রিদির প্রেমের সম্পর্ক ছিল। একটা সময় বাচ্চাও পেটে আসে। উনার স্ত্রী সন্তান থাকায় উনি রিদিকে অস্বীকার করেন এবং তাকে ভয় দেখানো হয় যে, সে যদি এ কথা কাউকে বলে তাহলে তার বাবা, মাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দিবে। আর ওসি সাহেব জানতেন যে, রিদি যদি কখনও তার বাচ্চার কথা বলে তাহলে নীল সাহেবকেই বলবে। কারণ নীল সাহেব রিদিকে এ বিষয়ে সাহায্য করছিলেন। আর সে সূত্র ধরেই উনি নীলকে আরও ফাঁসিয়ে দিয়েছেন। ওসি সাহেব কখনও হয়তো চিন্তা করতে পারেননি যে, আমি সুস্থ হব। তাই তিনি গড় গড় করে যখনই আসত এ কথা গুলো বলতেন এবং আমাকে উপহাস করতেন। আপনি জানেন আমার সুস্থতা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়না। এখনও কী হবে জানি না। যদি চিঠিটা পান আপনার কাছে একটাই চাওয়া আমি যদি সে সময় অসুস্থ থাকি আমাকে আর চিকিৎসা করাবেন না আমি মৃত্যু চাই। এ জীবন আমাকে অনেক কষ্ট দিচ্ছে আর একটা চাওয়া আমার সাথে করে যাওয়া প্রতিটা অন্যায়কারীকে শাস্তির আওতায় আনবেন। আমি চাই না আমার মতো আরও কারও জীবনে এমন দূর্বিষহ অধ্যায় নেমে আসুক এবং সচলহীন হয়ে বেঁচে থাকুক। আমি মুক্তি চাই,মুক্তি চাই, মুক্তি চাই।

সিঁথির চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। এ চিঠিটায় তার শেষ ভরসা। যেহেতু ওসি সাহেব এতে জড়িত উনাকে এ বিষয়ে কিছু জানানো যাবে না। অপরদিকে সিঁথির বুকের কষ্টটা আরেকটু বাড়ল মেয়েটার আর্তনাদ দেখে। মেয়েটা কথা বলতে পারত না, হাত পা নাড়াতে পারত না, কিন্তু ঠিকেই সব অনুধাবন করতে পারত। যন্ত্রণায় কাঁতরাত। আজকে মেয়েটার ইচ্ছাও পূরণ হয়েছে কারণ সে মৃত।

সিঁথির আশার প্রদীপ জ্বলে উঠল পুনরায়। একটুও সময় নষ্ট করল না। প্রথমেই তার শ্বশুড়কে কল দিয়ে সবটা বললেন। নীলের বাবা উপর মহলের সাথে কথা বললেন। সিঁথি প্রেসের লোককে ডাক দিলেন। যাতে করে কোনো ভাবেই বিষয়টা লোক চক্ষুর আড়ালে চলে না যায়।

সেদিন বিকেলেই প্রেসের সামনে সকল প্রমাণ এবং রহস্য উন্মোচন হলো। উন্মোচন হলো নীল অপরাধ না করেও দীর্ঘ ১৬ বছর শাস্তি পেয়েছে। আর ওসি সাহেব অপরাধ করেও বীরের মতো ঘুরে বেরিয়েছে। খবরটা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ল। সারা বিশ্ব জানলো নীল দোষী না। সিঁথির বিশ্বাস মিথ্যা না।

” ভালোবাসার প্রথম ধাপ বিশ্বাস। যেখানে দুনিয়ার সবাই পাল্টে গেলেও বিশ্বাস পাল্টাবে না কখনও। আর এ বিশ্বাসেই ভাঙা সম্পর্কটাও জুড়ে দিবে এক সময়”

সময়ের গতি বাড়ল। সকল তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে নীল মুক্তি পেল আর ওসি সাহেবকে আইনের আওতায় আনা হলো। নীলের প্রতি থাকা সকলের সকল ক্ষোভ দূর হয়ে গেল। সিঁথির বাবা, মায়েরও ভুল ভাঙল। বুঝতে পারল সিঁথির বিশ্বাস মিথ্যা ছিল না।

আজকে নীলের মুক্তি। নীলের বাবা নীলকে আনতে গিয়েছে। আর সিঁথি রয়েছে বাসায়। আজকে সিঁথি লাল বেনারসি পরেছে। খোঁপায় বেলি ফুলের মালা। চোখে কাজল পড়েছে। রুবাইয়া মায়ের দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে আছে। এ অল্প সাজেই তার মাকে পরীর মতো লাগছে৷ বিশেষ করে মানুষের মন প্রফুল্ল থাকলে চেহারাতেও সেটা ফুটে উঠে। এতদিনের গ্লানির রেখা সিঁথির মুখ থেকে গুচে গেছে।

কলিং বেলের আওয়াজ পড়ল। সিঁথি দৌড়ে গেল। নীলের বাবা নীলকে দরজার সামনে রেখেই ভেতরে চলে আসলেন। তাদের প্রথম দেখার অনুভূতি প্রকাশের জন্য দুজনকে সুযোগ করে দিলেন। নীলের দাঁড়ি গুলো বেশ বড় হয়েছে৷ বয়স তো চল্লিশের কোঠায় চলে গেছে। মাথার চুলগুলো হালকা পাক ধরেছে। তালুটাও বেশ ফাঁকা। সিঁথি নীলের দিকে ভারী চোখে তাকিয়ে আছে। নীল সিঁথির চোখ দুটো মুছে বলল

– কাঁদছো কেন?

– এটা কান্না নয়, দুঃস্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার আনন্দ।

– পাগলি বুড়ি আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি। আমাকে ছেড়ে কখনও যাবে না তো!

সিঁথি কাঁদতে কাঁদতে বলল

– তোমার জন্য এক জনম কেন, জনম জনম নিজের যৌবন বিসর্জন দিয়ে অপেক্ষা করতে পারব। তবুও তোমাকে ছেড়ে যাব না। যখন ছেড়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল তখনই তো যাইনি। ডাক্তার সাহেব আমি তোমাকে ভালোবাসি।

নীল ঘরে প্রবেশ করল। সিঁথিকে রুমের ভেতর নিল। সিঁথির হাতটা ধরে কাপালে ঠোঁটের আলতো স্পর্শ দিল। সিঁথি চোখটা বন্ধ করে নিল। সিঁথির মনে হচ্ছে সে এখন ত্রিশ উর্ধ্বো কোনো নারী না বরং ষোল বছর বয়সী এক তরুণী। সিঁথির চোখে মুখে লজ্জা ফুটে উঠল। নীল সিঁথির গাল টেনে বলল

– ডাক্তার সাহেবা আমিও তোমায় বড্ড ভালোবাসি।

এ মুহুর্তেই রুবাইয়ার আগমন ঘটল। রুবাইয়া তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল

– তুমি শুধু আমার বাবা নও তুমি সর্ব প্রথম আমার মায়ের #ডাক্তার সাহেব।

ভালোবাসায় পরিপূর্ণতা নিয়েই সমাপ্ত হলো ডাক্তার সাহেব গল্প। আশাকরি সবার ভালো লোগেছে। কমেন্ট করে জানাবেন আর আমার নতুন বই রহস্যজাল কেনার জন্য চাওয়া রইল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here