ডাক্তার সাহেব পর্ব- ৪
#শারমিন আঁচল নিপা
আম্মুর কাছে যেতেই লক্ষ্য করলাম আম্মু ব্যথায় কাঁতরাচ্ছে । আম্মুকে কখনও এভাবে কাঁতরাতে দেখিনি। ভয়ও হলো হালকা। অস্থিরতা বাড়তে লাগল। আম্মুকে জড়িয়ে ধরলাম। আম্মুও আমাকে আরও জোরে চেপে ধরে কাঁদতে লাগল। আম্মুর এক হাত আমার এক হাত চেপে ধরেছে আর অন্য হাত আম্মুর পেটের ডানপাশ চেপে রেখেছে। বুঝতে পারছিলাম না কী হয়েছে। চাকুরির সুবাদে আব্বু ঢাকায় থাকে। আমি উনাদের একমাত্র মেয়ে হওয়ায় মা আর আমার ছোট্ট সুখের নীড় এ বাসাটা। মায়ের কান্নাটায় আমার বুক কাঁপতে লাগল। মাকে কখনও এভাবে কাঁদতে দেখিনি। আজকে কী এমন হলো মা এভাবে কাঁদছে। মায়ের কান্না যত প্রখর হচ্ছিল ততই আমার হাত পা কাঁপছিল। বুকের স্পন্দর দ্রূতগতিতে উঠানামা করছিল। বাবাকে কী কল দিব! হাজার প্রশ্ন আর অস্থিরতা বিরাজ করছে। মাকে চেপে ধরে বললাম
– তোমার কী হয়েছে? এভাবে কাঁদছো কেন? কষ্ট কী বেশি হচ্ছে!
মা হুহু করে বাচ্চাদের মতো কেঁদে দিল। কান্নাটা কোনোরকম থামিয়ে বলল
– পেটের ব্যথা ভীষণ। একটা রিকশা নিয়ে আয়। হাসপাতালে যেতে হবে।
মায়ের এ কষ্টের হাহাকারে আমি আরও বিমূর্ত হয়ে গেলাম। বাবাকে কল দেওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গেলাম। মাকে ঘরে রেখে বাইরে বের হলাম। কিন্তু আশেপাশে কোনো রিকশা পেলাম না। মফস্বলে এত সকাল বেলা লোক সমাগম থাকলেও যানবাহনের সমাগম হতে হতেই বেলা ৭ টার উপর বাজে। মসজিদ থেকে কেউ কেউ নামাজ পড়ে বের হচ্ছে। বাইরে আলো ফুটতে লাগল। আমার চেতনা যেন নির্জীব হয়ে যেতে লাগল। অস্থিরতায় স্বাভাবিক বোধটাও হারিয়ে ফেলছিলাম। এর মধ্যেই কলটা বেজে উঠল। আমি ফোনটা হাতে নিয়েই দেখলাম নীল কল দিয়েছে। তাড়াহুড়ো করে কল ধরতেই তার পাশ থেকে কথা আসলো
– কোথায় তুমি? বের হব কখন বলো? আর কোথায় থাকবে তুমি? মেসেজের পাল্টা রিপ্লাইও দিলে না।
আমি তার কথা শুনে কোনো ভাবান্তর ঘটার পূর্বেই কেঁদে দিলাম। আমার কান্নাটা একটু তীব্র আকার ধারণ করতেই সে বলে উঠল
– সমস্যা কী? কাঁদছো কেন? আমি কী কোনো ভুল মেসেজ করেছি বা তোমাকে হার্ট করেছি?
আমার কান্না আরও বেড়ে গেল। কেঁদে ফুপাতে ফুপাতে বললাম
– মায়ের যেন কী হয়েছে। অনেক কান্না করছে। মাকে অসুস্থ হতে দেখলেও কখনও এভাবে কাঁদতে দেখেনি। হয়তো মায়ের কষ্ট হচ্ছে অনেক। বাইরে বের হলাম রিকশা নিতে একটা রিকশাও নেই। বাবাও বাসায় নেই। বড় কোনো ভাইও নেই আমার। কী করব আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। মাকে কীভাবে হাসপাতালে নিব?
আমার কান্না আরও বেড়ে গেল। কান্নার আওয়াজও আরও তীব্র আকার ধারণ করল। দম ভারী হয়ে শ্বাসকষ্টের উপক্রম শুরু হলো। বেশ হেঁচকি তুলে তুলেই কাঁদতেছিলাম।
– তুমি কান্না থামাও। দৌড়ে তোমার মায়ের কাছে যাও। বাসার ঠিকানাটা আমাকে বলো আমি হাসপাতাল থেকে এম্বুলেন্সে পাঠাচ্ছি। তোমার মায়ের কিছু হবে না। চিন্তা করো না। আর ভেঙে পড়ো না।
নীলের কথায় ভরসা খুঁজে পেলাম। স্বস্তি লাগছিল হালকা। গড় গড় করে বাসার ঠিকানাটা বলতে লাগলাম আর বাসার দিকে এগুতে লাগলাম। ঠিকানা বলেই কলটা কেটে দিলাম। অস্থিরতা নিয়ে আম্মুর পাশে গিয়ে বসলাম। আম্মুর ব্যথা মনে হয় আরও বাড়ল। আম্মুর কষ্টের মাত্রা যে প্রখর হয়েছে সেটা উনার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। আম্মুর কষ্ট দেখে আমার বুক ধরফর করতে লাগল। কলিজা শুকিয়ে যেতে লাগল। দিশা না পেয়ে বাবাকে কল দিলাম। পরপর তিনবার কল দেওয়ার পরও বাবা কলটা ধরল না। হয়তো বাবা কোনো কাজ করছে নাহয় কিছু নিয়ে ব্যস্ত। শরীরটা কেমন জানি লাগছে। মায়ের কান্না সুরে ঘরটা কেঁপে উঠছে মনে হচ্ছিল। বাইরে থেকে এম্বুলেন্সের সাইরেন বাজছে। তার মানে এম্বুলেন্স চলে এসেছে। তাড়াহুড়ো করে দরজা খুললাম। একজন মধ্যবয়স্ক লোক আমাকে দেখে বললেন
– আপনার জন্য ডাক্তার অনীল সাহেব এম্বুলেন্স পাঠিয়েছেন। রোগী কোথায়?
চোখ দিয়ে জল ছলছল করছে আমার। বিপদে ভরসার ঢাল হয়ে যেন সে এসেছে এখন। চোখের জলটা মুছিনি। অবাধে গড়িয়ে যেতে দিয়েছি। নিঃশব্দ ঘনঘন কয়েকটা দম নিয়ে বললাম
– ঘরে আসুন।
দুজন লোক এসে মাকে ধরে এম্বুলেন্সে উঠাল। আমিও সাথে উঠলাম। দুই মিনিটের মধ্যে এম্বুলেন্স হাসপাতালে পৌঁছাল। এম্বুলেন্স থেকে নামতেই নীলকে লক্ষ্য করলাম। তাড়াহুড়ো করে বেশ দায়িত্ব নিয়ে মাকে নামাল। আমি শুধু চেয়ে দেখছিলাম। কত যত্ন নিয়ে যেন মায়ের চিকিৎসা করছে। এদিকে মা কাঁদতে লাগল। মায়ের চিৎকার বাড়তে লাগল। মায়ের কান্না দেখে আমিও চেঁচিয়ে কেঁদে দিলাম। আরও দুজন সিনিয়র ডাক্তার এসে মাকে পর্যবেক্ষণ করছে৷ আমি এক কোণে বসে চেয়ে চেয়ে দেখছি আর চোখের জল ফেলছি। এর মধ্যেই একজন বলে উঠল মায়ের অ্যাপেন্ডিক্স এর ব্যথা দ্রূত সদর হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে অপারেশন করাতে হবে। কথাটা শুনেই আমার ভেতরটা কেঁপে উঠল। ফোনটা বেজে উঠল। লক্ষ্য করলাম বাবা কল দিয়েছে। কলটা ধরেই সজোরে কেঁদে দিলাম। বাবাকে মায়ের অবস্থা জানালাম। বাবাও বেশ চিন্তিত। চিন্তিত গলায় বলল
– তুমি তোমার মাকে নিয়ে যাও। আমি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে আসতেছি। তোমার তো কোনো ভাই নেই আজকে নাহয় তুমি তোমার ভাইয়ের দায়িত্বটা পালন করো। বয়স কম যদিও তবে পরিস্থিতি সামাল দাও আমিও আসতেছি। একদম ভেঙে পড়বে না।
কলটা কেটে গেল। প্রতিউত্তর না দিয়েই চুপ হয়ে বসে আছি। চোখ দিয়ে গড়িয়ে আপনাআপনি পানি পড়ছে। পুরো দায়িত্ব টা নিতে বেশ ভয় লাগছে। যদি মায়ের কোনো ব্যতিক্রম কিছু হয় তাহলে নিজেকে অপরাধী মনে হবে। আমার নীরবতার অবসান ঘটে কোমল হাতের স্পর্শ পেয়ে। পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখলাম নীল দাঁড়িয়ে আছে আমার কাঁধে হাত রেখে। চোখদুটো রক্তজবার মতো লাল হয়ে আছে আমার। শ্রাবণের মেঘ চোখ দিয়ে অজোরে ঝরে যাচ্ছে। নীলের দিকে তাকিয়ে ফুপাতে ফুপাতে বললাম
– বাবা নেই আমি একা কীভাবে মাকে সামলাব।
সে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ গুলো বন্ধ করে পরক্ষণে খুলে আশ্বস্তের একটা সংকেত দিল। তারপর মুখ দিয়ে জড়তা কন্ঠে বলল
– আমি আমার ইমারজেন্সি ডিউটি আরেকজনকে বুঝিয়ে দিয়েছি। তোমার সাথে আমি যাব চিন্তা করো না। আপাতত আন্টিকে একটা ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে বাকিটা সেখানে গেলে ব্যবস্থা করা হবে।
আমি অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালাম। ভরসা খুঁজে পেলাম সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে। থরথর করে কাঁপা কন্ঠে বললাম
– ধন্যবাদ।
মায়ের চেঁচানো আগের চেয়ে একটু কমেছে। মাকে এম্বুলেন্সে করে সরাসরি সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। এর মধ্যে বাবা কল দিয়েছে কয়েকবার। বাবার আসতে আরও সময় লাগবে তিন চার ঘন্টা। মাকে সরাসরি ওটিতে নিয়ে গেল। এ মুহুর্তে মা ওটিতে আর আমি বাইরের করিডোরে দাঁড়িয়ে আছি। খারাপ লাগছে অনেক। নিজেকে সামলাতে পারছি না। নিজের অজান্তেই হুহু করে কেঁদে উঠছি বারবার। করিডোরের এক কোণে দাঁড়িয়ে কান্না দমানোর প্রতিযোগিতা করছিলাম। নীল এসে কোমল কন্ঠে আমাকে বলল
– কাঁদবে না সব ঠিক হয়ে যাবে।
কথাটা শুনে তার দিকে তাকালাম। শত অশান্তির মধ্যেও যেন স্বস্তি পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল কেউ একজন ভরসার প্রাচীর হয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে৷ মনের অজান্তেই তার এক হাত আমার দুহাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে কান্না করে দিলাম। অনিশ্চয়তা নিয়ে বলে উঠলাম
– মায়ের কিছু হবে না তো?
উনি আমার দুটো হাত তার অপর হাত দিয়ে মুষ্টি করে ধরে আমার দিকে তাকাল। চাতক পাখি যেমন করে তাকায় ঠিক তেমন করে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে সে। ঠোঁট গুলো হালকা নেড়ে বলল
– কিছুই হবে না। এই তো ৩০ মিনিটের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে। একদম চিন্তা করো না।
কথাটা শোনার সাথে সাথে আমার কান্না থেমে গেল। বিদ্যুৎ চমকিয়ে যেমন বৃষ্টি পড়ে পরিবেশ শান্ত হয় ঠিক তেমনি আমিও একদম শীতলতা অনুভব করলাম। তার দিকে তাকালাম। কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর চোখটা নামিয়ে নিলাম। যখন বুঝতে পারলাম আমার হাত দুটো তার হাত গুলো স্পর্শ করে আছে তখনই লজ্জা পেয়ে গেলাম । বেশ দ্রূত হাত দুটো সরিয়ে নিয়ে করিডোরের এক কোণে বসে মায়ের জন্য দোয়া করতে লাগলাম।
প্রায় ৪৫ মিনিট পর একজন এসে জানাল মা এর অপারেশন সাকসেস ফুল। খুব দ্রূত সিটে দেওয়া হবে। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস টেনে নিলাম। বাবাকে ছাড়া মায়ের এত বড় দায়িত্ব হয়তো অনীল ছাড়া নিতে পারতাম না। মনে হচ্ছিল কোনো ফেরেশতা এসে আমার মাকে বাঁচাতে সাহায্য করেছে। উৎকন্ঠা কন্ঠে মায়ের সাথে দেখা করতে যেতে চাইতে বললে তারা জানায় এখন দেখা করা যাবে না। মাকে দেখতে পারব না এ মুহুর্তে এটা ভেবে হালকা খারাপ লাগলেও মা ভালো আছে এটা ভেবে বেশ স্বস্তি পাচ্ছি। নীল পাশেই চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার দিকে লাজুক চোখে তাকিয়ে মোলায়েম কন্ঠে বলল
– এতক্ষণ বেশ চিন্তিত ছিলে তাই একটা কথা বলতে পারিনি। তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
সারপ্রাইজের কথাটা শুনতেই যেন আমার বুকের হার্টিবিট বেড়ে গেল। তাহলে কী সে আমাকে ভালোবাসি বলবে। চারপাশটায় কোনো বাতাস না থাকা সত্ত্বেও যেন কোথায় থেকে এক ঝাঁপটা বাতাস গায়ে লেপ্টে বসেছে এমন অনুভূত হচ্ছে। আমি দৃঢ় কন্ঠে জবাব দিলাম
– কী সারপ্রাইজ বলুন।
উনি মুচকি হেসে বলল
– একটু পর বলছি। তোমার বাবা আসবে কখন? আর কোথায় আছে?
– বাবার আরও এক ঘন্টার মতো সময় লাগবে। রাস্তায় জ্যামে আটকে আছে।
– হুম….
শব্দটা উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথে নীল চুপ হয়ে গেল।
ঘন্টাখানেক বাইরেই বসে আছি। বাবা আসতেই শুধু সারপ্রাইজ না ভীষণ বড় একটা ধাক্কাও খেলাম।
( কপি করা নিষেধ)