ডাক্তার সাহেব পর্ব- ৩
#শারমিন আঁচল নিপা
ঠিক এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। ভেবেছিলাম সে কিন্তু কল আসলো এয়ারটেল কোম্পানি থেকে। মেজাজটা আরও চড়ে গেল। কোম্পানিগুলোও রাত বিরাতেও মশকরা করে। এদের কাজেই কাজের সময় অকাজ করা। আবেগে পানি ঢেলে দেওয়া। বিরক্ত নিয়ে কলটা কাটলাম। কলটা কেটে চোখ বন্ধ করে নীলের হাসি মুখ কল্পনা করতে লাগলাম। চারপাশে বাতাসে ধূলো উড়তেছে। নীল এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। আমি আস্তে করে নীলের সামনে দাঁড়ালাম। তার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকালাম। তার চোখের নেশায় যখন ডুবতে যাব ঠিক তখনই অপরিচিত একটা নম্বর থেকে কল আসলো। কিছুটা রেগে কেটে দিলাম। পুনরায় কল আসলো পুনরায় কেটে দিলাম। পরপর তিনবার কল আসার পর কলটা ধরে বেশ রাগী গলায় বলে উঠলাম
– ফাজলামি করছেন কেন? বারবার ফোন কাটার পরও ফোন দিচ্ছেন কেন? কে আপনি? এত রাতে কল দিচ্ছেন। খেয়ে কাজ নেই কোনো?
ওপাশ থেকে হাসির শব্দ ভেসে আসলো। হাসিটার বিস্তৃতি বেশ প্রশস্ত ছিল। কখনও উচ্চ কখনও মৃদু কখনও বা নিঃশব্দ। এ হাসির শব্দটা বড্ড চেনা। গিটারের তারের সুর গুলো যেমন উঠা নামা করে ঠিক তেমনি এ হাসির প্রাণচঞ্চল সুর গুলো উঠা নামা করছে। কখনও বুকের স্পন্দন বাড়ছে আবার কখনও সেটা কমে স্থিত হচ্ছে। তারগুলো টেনে ছেড়ে দিলে যেমন শেষ সুরের মূর্ছনার ক্লাইমেক্স থেকে যায় ঠিক তেমনি এ হাসির ক্লাইমেক্স অব্যহত রেখে জবাব আসলো
– সিঁথি রাণী তোমার প্রেমিক নীল। তুমিই তো একটু আগে কল দিলে। এখন নিজেই ঝাড়ি দিচ্ছ। আচ্ছা পাগলি মেয়ে তো…
আমি অবাক হয়ে আমতা আমতা করতে লাগলাম। তার মানে এটা নীল ছিল। তাই বুঝি এতক্ষণ আমার মনে এমন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। আমতা আমতা করেই জবাব দিলাম
– কিন্তু এটা কার নম্বর? এটা তো তোমার নম্বর না। আমি ভেবেছি অন্য কেউ।
– হাসপাতালের ইমারজেন্সি নম্বর। আমার ফোনে টাকা নেই তাই এটা দিয়ে কল দিয়েছি। তা বলো কল কেন করেছিলে?
কী জানি মাথায় চেপেছিল ঠুস করে বলে উঠলাম
– দেখা করবে?
– এখন!!!!
বিস্ময় কন্ঠ সুরে জবাব আসলো। আমি তার স্তব্ধতা কাটিয়ে তুলে বললাম
– কেন আসতে সমস্যা?
– মাথা ঠিক আছে তোমার? রাত কয়টা বাজে লক্ষ্য করেছো? আড়াইটা বাজে।
আমি নীলের কথায় আমার প্রতি দুর্বলতা লক্ষ্য করেছিলাম। তার এ দুর্বলতায় যেন আমাকে আরও সাহসী প্রেমিকা করে তুলল। খুব মোলায়েম সাবলীল কন্ঠ সুরে বললাম
– এর আগে কি কখনও প্রেম করেছো?
– নাহ, ক্যারিয়ার গুছাতে গুছাতে সময় পার করেছি। আর সবচেয়ে বড় বিষয় তুমি হয়তো লক্ষ্য করেছো আবার করোনি, আমার কথায় অনেক জড়তা আছে। মানে আমি তুতলা একটু। তাই আমাকে পছন্দ করার মতো ঐরকম কেউ ছিল না। আর ঐরকমভাবে কোনো মেয়েকে কখনও ভালো লাগে নি। আর ভালোলাগা কারও প্রতি থাকলেও বলতে পারেনি। তাই প্রেম করা হয়ে উঠেনি। হঠাৎ এ প্রশ্ন?
– এজন্যই তো বুঝো না কিছু। প্রেম করলে এরকম রাত বিরাতে লুকিয়ে দেখা করতে হয়। যতই ফেক প্রেম হোক আমরা তো এখন প্রেমিক প্রেমিকা।
হাসির শব্দটা প্রখর হলো। অনেকটা সাইরেনের মতো। হুট করে সাইরেন বেজে উঠে যেমন আস্তে আস্তে মৃদু হয়। নীলের হাসির শব্দটাও তেমন উচ্চ হয়ে ধীরে ধীরে মৃদু হলো। সে পুনরায় উচ্চাকন্ঠে তীব্র স্বরে বলে বসল
– এত সাহস তো আমার নেই।
– এ সাহস নিয়ে প্রেম করতে চাও সিঁথির সাথে?
– আমি কোথায় করতে চাইলাম তুমিই তো বললে।
নিজের জিহ্বায় নিজে কামড় দিয়ে বললাম
– সে যাইহোক এখন তুমি আমার প্রেমিক। আমি তোমাকে যা বলব তাই করবে। এখনই আসো হাসপাতালের মোড়ে, ঐখানে আসলেই আমার বাসার ছাদ থেকে তোমাকে দেখা যাবে। তুমি আসো আমি একটু দেখি তোমায়। প্রেমিকার জন্য একটু রিস্ক নেওয়ায় যায়। অন্যায় আবদার করিনি কিন্তু। সুতরাং আসতে হবে।
– এখন সম্ভব না সিঁথি। তুমি বেশ নাছোরবান্দা আর পাগলাটে স্বভাবের। এ রাত বিরাতে এসে দেখা করলে আশে পাশের মানুষ কী বলবে। মফস্বলের মানুষ তিল থেকে তাল বানায় এটা তোমার অজানা না। সাহস ভালো তবে দুঃসাহস দেখানোটা মোটেও কম্য না৷
কেন জানি না কথাটা শোনার পর প্রবল অভিমান জমে গেল। ফোনটা কেটে দিলাম। মনেই হচ্ছে না মানুষটার সাথে আজকে আমার প্রথম পরিচয়। মনে হচ্ছে তার সাথে প্রেমটা আমার অনেক দিনের। আচ্ছা! আমি পাগলামি গুলো করছি সে রাগ করছে না কেন! তাহলে সে কী আমায় ভালোবাসে? অল্প পরিচয়ে এমন বায়না ধরাটা কী ঠিক হচ্ছে! সে আমায় বাজে মেয়ে ভেবে ফেলবে না তো! কেন জানি না ভয় হতে লাগল। এখনও তো তাকে চিনি না জানি না তাহলে হারানোর ভয় কেন পাচ্ছি? আমি কী তাকে ভালোবেসে ফেললাম? লাভ এট ফার্স্ট সাইড কী এটাকেই বলে! নাকি এটা আমার নিতান্তই আবেগ। এ আবেগে সায় দিতে গেলে সামনে মহাবিপদে পড়তে হবে। একজন মানুষ আমাকে সাহায্য করতেই পারে। তাই বলে তো তার উপর অধিকার খাটাতে পারি না। এটা আমার বোকামি ছাড়া কিছু না। একদিনের অল্প পরিচয়ে আমি ভীষণ বাড়াবাড়ি করে ফেলছি। আমাকে এত দু্র্বল হলে চলবে না। ভালোবাসা কোনো ঠুনকো অধ্যায় না যে একদিনের আবেগে ভালোবাসা হয়ে যাবে। এটা নিতান্তই আমার আবেগ। তাকে একটা সরি বলা উচিত।
বেশ চটপটে হয়ে মোবাইলটা হাতে নিলাম। হাতে নিয়ে কল দিতে যাব এমন সময় নীলের কল আসলো। আমি কলটা ধরতেই বলে উঠল
– ছাদে উঠো। আমি তো তোমাদের বাসা চিনি না। আমি হাসপাতালের মোড়েই দাঁড়িয়ে আছি। যতই হোক ফেক প্রেমিকা তো। আমি মোটেও হ্যাবলাকান্ত প্রেমিক না। গার্ল ফ্রেন্ডের এমন আবদার পূরণ করা ব্যপার না আমার জন্য। সাহস আমারও আছে। নিশ্চয় গাল ফুলিয়ে আছো। গাল না ফুলিয়ে গালের ভেতর যে বাতাস রাখা আছে তা ফুস করে বের করে দ্রূত ছাদে উঠো। এখানে অনেক মশা। এত মশার কামড় খেতে হচ্ছে কী বলব। ডেঙ্গু,ম্যালেরিয়া হওয়ার সম্ভবনা আছে। হলে এর জন্য দায়ী তুমি। তখন নাহয় ফলমূল নিয়ে দেখা করতে যেও।
আমি শুয়া থেকে লাফিয়ে উঠলাম। চিল্লাতে নিয়েও মুখ চেপে ধরলাম। মনে হচ্ছিল বোমাবাজির এক পাশ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে জোরে বিস্ফোরণ হওয়ার জন্য আর অন্য পাশে পানি ঢালছে আস্তে শব্দ হওয়ার জন্য। আমার অবস্থাটাও ঠিক একই রকম। নিজেকে স্থির করলাম। হালকা গলায় বললাম
– আমি তো মজা করে বলেছিলাম। আচ্ছা চলেই যখন এসেছো দাঁড়াও ছাদে উঠছি আমি।
আস্তে করে রুম থেকে বের হলাম। বেশ সাবধান হয়ে পা ফেলছিলাম যাতে করে মা বুঝতে না পারে আমি এখনও জেগে আছি। বাবা মায়ের একটা মেয়ে আমি তাই নজরও বেশি আমার প্রতি। যদিও তাদের থেকে আমি সব দিক দিয়ে এক ধাপ এগিয়ে তাই এত আকাম করার পরও ধরা পড়ি না। ছাদে উঠেই নীচে তাকালাম। ডাক্তার মহাশয় দাঁড়িয়ে আছে লাল একটা টি শার্ট পরে। মাথা ভর্তি চুল নেই তার, কপালটা বেশ ফাঁকা। হিরোদের মতো দেখতে ৬ ফিটও না। আনুমানিক ৫ ফিট ৮-৯ হবে। বডিতে সিক্স প্যাক হবে না সেটা তার পাতলা গড়নেই বলে দিচ্ছে। গালে হালকা খুঁচা দাঁড়ির সমাবেশ রয়েছে। হাসপাতালের লাইট দিয়ে বেশ ভালোভাবেই তাকে পর্যবেক্ষণ করা যাচ্ছে। তার উপর বাসাটাও হাসপাতালের মোড়েই। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে টানছেন। সিগারেট দেখে বেশ রাগ লাগছে। ছাদের এক কার্ণিশে রাখা পাত্র ভর্তি পানি হুট করে তার উপর ছাদ থেকে ঢেলে দিলাম। সে আচমকা সরে গেল। উপর দিকে তাকাল। নীচ থেকে হয়তো উপরটা এত স্পষ্ট না বা তার চশমার দৃষ্টি উপর পর্যন্ত আসতে আসতে ঘোলা হয়ে গেছে। তাই আমি পর্যন্ত তার দৃষ্টি আসতে আসতে চোখটা অস্পষ্ট হয়ে গেল। এমন সময় কল আসলো। আমি ধরে হাসতে লাগলাম। আমার হাসি হয়তো তার রাগের পরিমাণটা বাড়িয়েছে। হালকা ধমক দিয়ে বলল
– বোকার মতো হাসছো কেন? এমনিই মেজাজ গরম। এ রাতে কে জানি ছাদ থেকে পানি ফেলেছে। যাইহোক তোমার বাসা কোনটা? তোমাকে তো দেখতে পারছি না।
আমার হাসির মাত্রাটা আরও প্রখর হলো। তীব্র গতিতে হেসে জবাব দিলাম
– সিগারেট খাচ্ছিলে তাই আমিই পানি ঢেলে দিয়েছি। রেগে গেলে সরি। তবে রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন।
বলেই উচ্চকন্ঠে আমার হাসি প্রস্ফুটিত হলো। কন্ঠেসুরে চাপা অভিমান তার। চুপ হয়ে স্তবির হয়ে রইল। স্বাভাবিক সুরেই জবাব আসলো
– সিগারেট খাই মাঝে মাঝে। অভ্যাস হয়ে গেছে। মেডিকেলে পড়ার সময় খেতাম বন্ধুদের সাথে। এখনও ছাড়তে পারেনি।
– খাও ভালো কথা সবার সামনে কেন খেতে হবে? যাইহোক তোমাকে আমি দেখেছি। তুমি এবার যাও। আমাকে চাইলেও দেখতে পারবে না। নীচ থেকে ছাদটা দেখা যায় না। আর একদিন আমি তোমার সাথে সিগারেট খাব। আমারও অনেক ইচ্ছা সিগারেট খাওয়ার।
– এ পাগল মেয়ে কী বলে। তুমি সিগারেট খাবা কেন?
– ছ্যাকা খেয়ে খাব। একমাস পর তো এ প্রেমের সমাপ্তি। তখন ব্রেকআপের জন্য সিগারেট খওয়া জরুরি। আর খাইতে না শিখলে খাব কী করে। তাই তেমার কাছ থেকে আগেই শিখে নিব। সবচেয়ে ভালো সিগারেটটা আমার জন্য রাখবে। আর আমার জন্য মাঝে মাঝে সাহসী সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে। নাহয় প্রেম জমবে না। আমি গেলাম রুমে, সকালে দেখা হবে।
– আচ্ছা সাবধানে যাও। ফোন রাখলাম। সবসময় এরকম হাসিখুশি থাকো। মাথা থেকে আজগুবি ভূত গুলো নামাও।
– আচ্ছা তোমার রাগ হচ্ছে না একটা মেয়ে একদিনের পরিচয়ে এত জ্বালাচ্ছে তোমায়, এত পাগলামি করছে?
– মাঝে মাঝে কিছু বিষয় রাগের থেকে বেশি ভালো লাগা দেয়। এখানে আসার পর থেকে অনেক একা ছিলাম, তোমার সাথে পরিচয় হয়ে খারাপ লাগছে না বরং আরও ভালো লাগছে। একটু ভালো লাগার জন্য এমন পাগলামি সহ্য করা যায়। তাতে তেমন কোনো ক্ষতি নেই।
– কেন তোমার কলিগরা তোমার সাথে কথা বলে না?
– এক মাস হলো আসলাম। সবাই তো ফরমাল। কথা হয় তবে কাজের খাতিরেই।
– ওহ!তাই বলো। আমি গেলাম। রাত হয়েছে অনেক। তুমিও যাও।
– সাবধানে যাও। লাফালাফি করো না এত।
– লাফালাফি করি তুমি বুঝলে কী করে?
– তোমাকে দেখে সবাই বুঝবে।
– হয়েছে আর ব্যাখা দিতে হবে না। ফোন রাখলাম।
বলেই কলটা কাটলাম। আস্তে পায়ে রুমে এসে শুয়ে পড়লাম। রুমে আসার পরও তেমন ঘুম হচ্ছিল না। কেমন এক অদ্ভুত অনুভূতি। এ অনুভূতি গুলো কোথায় ছিল! কোথায় ছিল এ মায়া, এ চিন্তা, এ আবেগ। চোখটা বন্ধ করলেই তার মুখটা ভেসে আসছে। তার কন্ঠস্বর কানে বাজছে। আমি কী সত্যিই তাকে ভালোবেসে ফেললাম। নাহ! ভালোবাসা এত সোজা না। এটা নিশ্চয় আমার নেশা। ফোনটা হাতে নিয়ে মেসেজ লিখলাম “আচ্ছা লাভ আর এট্রাকশন কী সেইম?”
মেসেজটা লিখেও কেটে দিলাম। চোখ বন্ধ করেই বলতে লাগলাম লাভ নাকি এট্রাকশন! বলতে বলতেই ঘুমিয়ে গেলাম। সকালে আম্মুর কান্নায় ঘুম ভাঙলো। উঠে লক্ষ্য করলাম ৫ টা ৩০ বাজে। আমি ভীত হয়ে ভাবতে লাগলাম আম্মু কাঁদছে কেন। দৌড়ে আম্মুর রুমে গেলাম।
নোট- পরবর্তী পর্ব কাল রাত আটটায় দিব।
(কপি করা নিষেধ)