#ডাক্তার সাহেব পর্ব-২৮
#শারমিন আঁচল নিপা

তবে মনে হচ্ছে এ বেঁচে থাকার সীমাটা আর বেশিক্ষণ স্থায়ী হবে না।

চারপাশ চুপচাপ। বাইরে ঝুপ ঝুপ বৃষ্টি বাতাসটা আরও প্রবল বেগে আসছে। নীল বসে আছে চেয়ারে। চুপচাপ,নীরব হয়ে গেছে একদম। নীলের মুখের কথা আর বের হচ্ছে না। চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু চিকচিক করছে। বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছে প্রখর ভাবে। চোখের পলকও ফেলছে না। চোখের পলক ফেললেই চোখের জলও বাইরের মতো বৃষ্টি হয়ে নামবে। নীরব নিস্তব চারপাশ। আমি কেবিনের খোলা দরজা দিয়ে তাকাতেই নীলের দিকে চোখ গেল। আমার এক হাতে স্যালাইন লাগানো। শরীরটাতে একদম শক্তি নেই। খোলা দরজায় তাকিয়ে শুধু নীলকে দেখছিলাম। ঝাঁপসা হয়ে যাচ্ছে তার অবয়ব। তাহলে কী এটা আমার ভ্রম। ভাবতেই চোখটা বন্ধ হয়ে আসলো।

কতক্ষণ চোখ বন্ধ ছিলাম জানা নেই। চোখ খুলতেই নীলকে পুনরায় দেখতে পেলাম। হালকা হেসে তাকে বললাম

– তুমি আমাকে দেখতে এসেছো বুঝি!

বলার পরপরই সমস্ত শক্তি নিস্তেজ হতে লাগল। চোখটা পুনরায় বন্ধ হয়ে গেল। চোখ বন্ধ করে যেন নীলকেই অনুভব করছি। মাঝে মাঝে তাকে ভীষণ মনে পড়ছে তবে চোখ মেলে তাকিয়ে তাকে দেখতে পারছি না। মনে হচ্ছে এই তো আমার পাশেই বসা। খলখল করে হাসছে, আমার দিকে তাকাচ্ছে। তার নেশামিশ্রিত চোখে তাকিয়ে শুধু ডুব দিতে পারছি না। শরীরটা কেন যে ঝিমঝিম করছে জানি না! অনেক যুদ্ধ করে তাকালাম। পাশে নীল বসে। ভাবতে লাগলাম আমি কী বেঁচে আছি আর সত্যিই কী নীল আমার পাশে বসে আছে। ধূসর অনুভূতির সমাবেশ বিচরণ করে যাচ্ছে শুধু। মাথাটা আরও ভার হয়ে যাচ্ছে। চোখটা বন্ধ করে ফেললাম আবার।

শুঁশুঁ করে বাতাসের শব্দ বইছে। চারপাশ শুনশান নীরবতা। কেউ একজন আমাকে ডাকছে। মাথায় হাত বুলাচ্ছে। চোখটা টেনে টেনে দেখছে। কিছু একটা জিজ্ঞেস করছে তবে আমি চোখ টেনে খুলে দেখার কোনো অবকাশ পাচ্ছি না। খানিক পর পর কিছু অনুভূতির বিকাশ ঘটছে। তবে সেটা প্রকাশ করতে পারছি না।

চুপচাপ সব। শরীরটায় বেশ শক্তি পাচ্ছি। চোখ মেলে তাকাতেও কষ্ট হচ্ছে না। চোখটা মেলে তাকিয়ে দেখলাম নীল আমার পাশে বসা। আমি কিছুটা অনিশ্চিত গলায় জিজ্ঞেস করলাম

– তুমি কী সত্যিই এখানে?

নীল আমার হাতটা ধরে কেঁদে দিল। নীলের স্পর্শ পেয়ে বুঝলাম আমি বেঁচে আছি আর এখন যা ঘটছে সেটা আমার কল্পনা বা ভ্রম না সেটা আমার বাস্তবতা। আমি ঠোঁটটা নাড়িয়ে হালকা গলায় বললাম

– আমি তোমায় বড্ড ভালোবাসি।

নীল আমার হাতটা ধরে কেঁদে দিল। কান্না সুরেই বলল

– সেদিন ফোনটা তো আমি কেটে দিয়েছিলাম এজন্য যে তোমার মা তোমার পাশে ছিল এই ভেবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে একটু সময় দরকার ছিল। ভেবেছিলাম পরদিন মিহুকে সবটা বুঝিয়ে বলব। আর সে তোমাকে বলে দিবে। আমি তো চেয়েছিলাম তোমার সাথে আমার অন্য উপায়ে যোগাযোগ হোক। এর মধ্যে তোমার বাবা, মাকে এবং আমার মা, বাবাকে আমি মানিয়ে নিতাম। বাসায় তোমার কথা বলার পর তারাও অমত করেছে। দুই পরিবার মানানোর জন্য একটু সময় দরকার ছিল। আর তুমি কী না এ কাজ করে বসলে। এমনটা করার আগে একটা বারও আমাকে বিশ্বাস করতে পারলে না? ভুলে গেলে আমার দেওয়া প্রতিজ্ঞা গুলো। কেন এমন অবুঝের মতো কাজ করলে বলো। আমার কথা একটাবারও ভাবলে না আমি কীভাবে থাকব তোমাকে ছাড়া।

বলেই নীল কাঁদতে লাগল। নীলের হাতটা ধরার জন্য আমার নিজের হাতটা উপরে তুললাম। আমার হাতটা উপরে তুলতেই বেশ ব্যথা অনুভব করলাম। তবুও সাহস করে ব্যথা নিয়েই নীলের হাতটা ধরে হালকা গলায় বললাম

– আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না। তোমাকে ছাড়া আমার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে যায়। মনে হয় বুকের ভেতর কিছু একটা ধলা পাকিয়ে শক্তভাবে চেপে ধরে রেখেছে। নিজের কাছেই কেমন জানি অস্থিরতা কাজ করে। শত চেষ্টা করলেও আমি নিজেকে সামলাতে পারি না। মাথাটা ভনভন করে। তোমাকে বিহীন এ জীবন আমার অস্তিত্বহীন মনে হয়।

– আমি বুঝতেছি তোমার ব্যপারটা। তবে আমাদের একসাথে হতে হলে অনেকটা সময় পারি দিতে হবে। ২ টা বছর আমাদের কষ্ট করতে হবে। সে জন্য হলেও তো বাঁচতে হবে। তোমার এ অবস্থা জানার সাথে সাথে আমি ছুটে এসেছি। তোমার মা আমাকে দেখেই বলেছে তোমার আশপাশে যেন না আসি। কারণ উনার ধারণা আমার জন্যই তুমি এমন করেছো। এখন দুটো পরিবারেই সমস্যা চলছে। এটা আগে সামাল দিতে হবে। যোগাযোগ বন্ধ, তার মানে এই না যে সম্পর্ক শেষ। তোমার মা জানেও না আমি এখানে।

তোমার মা পাশের কেবিনেই আছে। উনার অবস্থাও ভালো না। সে তো তোমায় জন্ম দিয়েছে এত ভালোবেসেছে। মায়ের ভালোবাসা তোমার কাছে এত ছোট হয়ে গেল? জীবনটা কী ফেলনা? কেউ কারও জন্য থেমে থাকে না। মরেও যায় না। একটা বারও চিন্তা করলে না তুমি মারা গেলে তোমার মা,বাবা কী নিয়ে বাঁচবে। তাদের একমাত্র অবলম্বন তো তুমি। নিজেকে একটু সামলে নেওয়া কী দরকার ছিল না? সবুর করতে তো পারতে। পরদিন কী হয় সে সময় পর্যন্ত তো অপেক্ষা করতে পারতে। তোমার কী অবস্থা হয়েছে তুমি কী জানো? তোমাকে বাঁচানোটায় কষ্ট হয়ে যেত। সময় মতো রক্ত না দিতে পারলে কী যে হত সেটা আল্লাহ ভালো জানেন। টানা তিনদিন পর তোমার জ্ঞান ফিরেছে। ভাগ্যিস এখন তোমার পাশে এসে বসেছি আর তোমার জ্ঞান ফিরেছে। এ তিনদিন কতটা দৌঁড়ের উপর ছিলাম জানো? সারাদিন হাসপাতালে ডিউটি সন্ধ্যার পর এখানে আসা। সব মিলিয়ে চাপ আমিও নিতে পারছিলাম না।

তোমাকে আমি কথা দিচ্ছি ছেড়ে যাব না। সাময়িক যোগাযোগ বন্ধ কখনও সম্পর্ক নষ্ট করে না। বরং ভালোবাসা বাড়িয়ে দেয়। যাইহোক তোমার বাবাও বিষয়টা জেনে সম্পূর্ণ দোষ আমার উপর চাপিয়েছে। আমি এবার উঠলাম। তারা এসে দেখতে পারলে বিষয়টা আরও খারাপ দিকে মোর নিবে। তুমি আমাকে কথা দাও এমন আর করবে না। আমার জন্য হলেও নিজেকে সামলে নিবে। আত্মহত্যার মতো এমন স্টেপ আর নিবে না।

নীলের কথায় আমার বুদ্ধি কাজ করলো। সত্যিই তো আমি যা করতেছিলাম সেটা তো একদম ঠিক না। নিজের মধ্যেই একটা তীব্র অনুসূচণা কাজ করছে। নিজেকে একটু সান্ত্বণা দিয়ে ভাঙা কন্ঠে বললাম

– আচ্ছা যাও। আমি নিজেকে সামলে নিব।

নীল আমার কপালে তার ঠোঁটের আলতু স্পর্শ দিয়ে ঝটপট হাসপাতাল থেকে প্রস্থান নিল। আমি চোখটা বন্ধ করে রাখলাম। কেবিনে কেউ নেই। চোখ বন্ধ করে নিজের করে যাওয়া ভুলটার কথা চিন্তা করে অনুতপ্ত হচ্ছিলাম। এর মধ্যেই কপালে কারও স্পর্শ অনুভব করলাম। চোখ খুলে দেখলাম বাবা। বাবাকে দেখেই নম্র গলায় জিজ্ঞেস করলাম

– মা কেমন আছে?

– ভলো। তুমি এমন কাজটা করার আগে আমাদের কথা ভাবলে না মা।

বলেই বাবা হুহু করে কেঁদে দিল। বাবার কান্না দেখে বুঝতে পারছিলাম আমার এ ভুল পদক্ষেপ কতটা শাস্তি দিয়েছে আমার পরিবারকে। আমি বাবার হাতটা ধরে বললাম

– বাবা আমি নীলকে অনেক ভালোবাসি। প্লিজ মাকে বুঝাও।

বাবা আস্তে গলায় বলল

– তোমার মায়ের সাথে এ বিষয়ে পরামর্শ করেছি। নীলের ব্যাপারটা আমরা মেনে নিব তবে একটা শর্তে।

আমি উৎকন্ঠা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম।

– কী শর্ত বাবা…

চলবে?

(কপি করা নিষেধ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here