ডাক্তার সাহেব পর্ব-২৭
#শারমিন আঁচল নিপা
অদৃষ্ট কোথায় কাহিনি নিয়ে ঠেকাবে জানি না। মা নীলের দিকে তাকিয়ে আছে আর নীল নীচের দিকে। মায়ের কথা কানে আসলো। মা বেশ ধীর গতিতে বলল
– তুমি কী সিঁথিকে ভালোবাসো?
নীল মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। নীলের এ হ্যাঁ বলাটায় কতটা শান্তি পাচ্ছিলাম বর্ণণা করা দুষ্কর। মা এবার নীলের দিকে তীব্র কথা ছুড়ে দিল।
– তোমার বয়স নিশ্চয় সিঁথির থেকে অনেক বেশি৷ আর সিঁথি ছোট একটা মেয়ে সে নাহয় বুঝে না তুমি তো অবুঝ না। তুমি কেন সিঁথিকে আস্কারা দিলে? কেনই বা এমন অসম প্রেমে জড়ালে। তোমার পরিবারের সাথে আমাদের পরিবার মিলবে না। দুই পরিবারের ফারাক কতটুকু সেটা জানো তো?
নম্র গলায় নীলের উত্তর আসলো।
– আন্টি আমি বুঝতে পারছি আমরা যা করেছি সেটা অন্যায়। তবে কিছু বিষয় না চাইতেও হয়ে যায়। আপনি আর আংকেল অনুমতি দিলে আমি সিঁথিকে বিয়ে করে নিব। এতে সিঁথিও ভালো থাকবে আর আমিও৷
মায়ের গলা আরও উচ্চ হলো। তীব্র গতিতে বলল
– এ সস্পর্ক আমি কখনই মেনে নিব না। সিঁথির এখন আবেগের বয়স। এ বয়সে সে যা সিদ্ধান্ত নিবে সেটা আবেগে। আর তুমিও আবেগে ডুবে আছো। প্রতিটা সম্পর্কের একটা মাপ কাঠি থাকে। এ অসম সম্পর্ক আমি মেনে নিব না। আমি খুশি হব তুমি সিঁথির সাথে কোনো যোগাযোগের চেষ্টা না করলে। আর যদি যোগাযোগের চেষ্টা করো তাহলে তোমার বিরুদ্ধে আমি স্টেপ নিব। উপর মহলে তোমার নামে অভিযোগ দিয়ে আসব। সিঁথির বয়স কম। সিঁথি এখন নাবালিকা। সুতরাং সিঁথির মত এখানে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।
মায়ের কথা শুনে নীল চুপসে গেল। এক দিকে আমি অন্যদিকে চাকুরি। নীল কোনটা বেছে নিবে। আমি সে জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলে নীলকেই বেছে নিতাম। কিন্তু নীল করলো ভিন্ন কাজ। সে মাকে জবাব দিল
– আন্টি আমি চেষ্টা করব সিঁথির সাথে যোগাযোগ না করার। তবুও যদি এর মধ্যে আপনার মন পরিবর্তন হয় আমাকে বলবেন,আমি আমার পরিবার নিয়ে এসে সিঁথিকে যোগ্য মর্যাদা দিয়ে নিয়ে যাব। আপনার যদি আমার উপর একটু ভরসা থাকে বিষয় টা ভেবে দেখবেন।
– এটা নিয়ে নতুন করে ভাবার কিছু নেই। সিঁথির এখন প্রেম বা বিয়ে করার বয়স না। ওর ক্যারিয়ার গড়ার সময়। বিয়ে বা প্রেম করার সঠিক বা উপযোগী সময় হতে আরও ঢের দেরি৷ তুমি আসতে পারো।
নীল বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। আমি নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি দরজার সামনে। নীলের কাছে এমন উত্তর আমি আশা করিনি। তাহলে কী নীল আমাকে ভালোবাসে না! শরীরে শক্তি পাচ্ছি না একদম। নীল বের হওয়ার আগে আমার চোখের দিকে একবার তাকাল। আমার চোখ দিয়ে তখন অজোরে পানি পড়ছে৷ নীলের তাতে তেমন কোনো অনুভূতি প্রকাশ পেল না। মাথাটা নুইয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেল। এতটা কঠিন কী করে হতে পারল সে। একটা বার তো আমাকে কিছু বলে যেতে পারত। এ অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি কীভাবে পাব আমি। গা গুলাচ্ছে ভীষণ। বাথরুমে গিয়ে গড়গড় করে বমি করতে লাগলাম। শরীরটা একদম চলছে না। বাথরুম থেকে এসে বিছানায় শুয়ে কাঁদতে লাগলাম। নীলকে আমি হারিয়ে ফেললাম এটা ভেবে বুকটা কেঁপে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। সামান্য একটা চাকুরির কাছে আমার ভালোবাসা হেরে গেল। কিছুতেই যেন আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। জীবন এত যে রঙ বদলায় জানা ছিল না।
ঘুমানোর অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু ঘুমুতে পারলাম না। মাথাটা ঝিমঝিম করছে, নীলের মুখটা বারবার চোখে ভাসছে। বাস্তবতা এত কঠিন কেন। নীল তো প্রতিজ্ঞা করেছিল আমার পাশে থাকবে এখন কেন চলে গেল। তার মানে এসব নীলের নাটক ছিল। ভেবেই যেন চিন্তা আর করতে পারছি না বরং দমটা আটকে যেতে লাগল। শরীরটা ভার হয়ে গেল। এ বিস্ফোরণ কেউ দেখে না।
একদিন হাতে একটু গরম তেল লেগেছিল সেজন্য মা কত অস্থির হয়ে গেছিল আমার হাতে গরম তেলের ক্ষত পড়েছে তাই। অথচ মনের ক্ষতটা যদি মা দেখত তাহলে আমার কাছ থেকে নীলকে আলাদা করার কথা ভাবতে পারত না। বুকে ব্যথা করছে প্রচন্ড। বাথরুমে গিয়ে আবার বমি করলাম।
রাত বাজে ৩ টা আমার চোখে এখনও ঘুম নেই। কী করব বুঝতে পারছি না। শরীরটা ভীষণ কাঁপছে। দিনটা কত ভালো গেল আর রাত হতেই সব এলোমেলো হয়ে গেল। অদৃষ্ট এত কঠিন কেন সেটাই ভাবছি। নীলকে ছাড়া থাকার কথা চিন্তাও করতে পারছি না। পাশ ফিরেই দেখলাম নানু শুয়ে আছে। নানুর মোবাইলটা বালিশের নীচে রাখা। মনে মনে ভাবলাম নীলকে অবশ্যই তার প্রতিজ্ঞার কথা মনে করিয়ে দিতে হবে। প্রতিজ্ঞা করা সত্ত্বেও সে কেন মায়ের কথা মেনে নিল সেটাই তাকে জিজ্ঞেস করব। বেশ সাবধানতার সহিত নানুর মোবাইলটা বালিশের নীচ থেকে নিয়ে বাথরুমে গেলাম। নীলকে কল দিলাম। দুবার রিং হলো নীল কল ধরল না। তৃতীয়বার কল দেওয়ার পর নীল কল ধরল। আমি হ্যালো বলতেই আমার কন্ঠ শুনে কেটে দিল। তারপর বেশ কয়েকবার কল দিলাম ধরল না। এবার লক্ষ্য করলাম মোবাইলটা বন্ধ।
পুরোপুরি ভেঙে গেলাম আমি। কী করব বুঝতে পারছি না। কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে দম ভারী হয়ে যাচ্ছে। নীলকে ছাড়া আমি কোনোভাবেই থাকতে পারব না।
বাথরুম থেকে বের হলাম। বের হয়ে রান্না ঘরে গেলাম। ডেস্কে একটা ছুরি রাখা আছে সেটা আমার চক্ষুগোচর হলো। ছুরিটা দেখতেই মাথাটা বিগরে গেল। নিজেকে সামলানোর চেষ্টাও করলাম না। ছুরিটা নিয়ে ঘরে এসে চেয়ারটা টেনে বসলাম। তারপর একটা কাগজ নিলাম সেখানে লিখলাম।
“প্রিয় মা”
তুমি আমার ভেতরের ক্ষতটা দেখলে না। তুমি নীলকে না, আমার বেঁচে থাকার নিঃশ্বাসটাকেই কেড়ে নিয়েছো। তুমি জানো না তোমার মেয়ে নীলকে কত ভালোবাসে। কেন মা এমন করলে? ওকে এভাবে দূরে সরিয়ে দিলে? এ দূরত্বের মতো মরণ ব্যথা আমি সহ্য করতে পারছি না। এ জীবনটা বেশ মূল্যহীন মনে হচ্ছে। অস্থিরতা আমাকে গ্রাস করছে। আমি নিজেকে সামলে উঠতে পারছি না। আমাকে ক্ষমা করে দিও। তুমি আমার ভালো চাইতে গিয়ে আমাকে হারালে। তবুও তুমি আমার মা তোমাকে আমি ভালোবাসি।
“তোমার মেয়ে সিঁথি”
আরেকটা কাগজ নিয়ে নীলকে লিখা শুরু করলাম
“প্রিয় নীল”
ভালোবাসা কী আমি বুঝতাম না। তোমার সান্নিধ্যে এসেই ভালোবাসা বুঝেছি। নিজের পুরোটা অস্তিত্বে তোমায় আমি মিশিয়ে নিয়েছি। তোমাকে বিহীন আমার অস্তিত্বটায় যেন বিলীন হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। অস্তিত্ব ছাড়া মানুষ বাঁচবে কী করে বলো? তুমি প্রতিজ্ঞা করেছিলে আমাকে ছাড়বে না। তবুও কেন চলে গেলে এত দূরে। তোমাকে ভালোবেসে বেঁচে ছিলাম৷ বাঁচার স্বপ্ন দেখতাম। এখন সে স্বপ্ন আমার ধুলোয় মিশে গেছে। তোমাকে ভালোবাসি বলেই ঘৃনা করে আর বাঁচতে চাই না। তুমি ভালো থেকো। আমার অস্তিত্বে তোমাকে মিশিয়ে নিয়ে চলে গেলাম।
“সিঁথি(তোমার পাগলি বুড়ি)”
কাগজ দুটো টেবিলের উপর রেখে পানির মগ উপরে দিয়ে চেপে দিলাম। তারপর ছুরিটা নিয়ে লম্বা নিঃশ্বাস টানলাম। অতঃপর হাতে তিন থেকে চারটা দাগ টানলাম। গড়গড়িয়ে রক্ত পড়ছে। ব্যথাও করছে ভীষণ। তবুও চিল্লাচ্ছি না। রক্তের প্রবাহ আরও বাড়তে লাগল। শরীরটা নিস্তেজ লাগছে খুব। চেয়ার থেকে মেঝেতে পড়ে গেলাম। মেঝেতে শুয়ে কুঁকরাচ্ছি ৷ দম বন্ধ হয়ে শরীর পুরোপুরি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। শরীর নড়াতে পারছি না জিহ্বাও না। নীলের মুখটা চোখে ভেসে আসলো। কখন যে চোখটা বন্ধ হয়ে গেল জানি না। এখনও একটু একটু টের পাচ্ছি আমি বেঁচে আছি। তবে মনে হচ্ছে এ বেঁচে থাকার সীমাটা আর বেশিক্ষণ স্থায়ী হবে না।
চলবে?
(কপি করা নিষেধ)