#জলছবি
#পার্ট_৩১
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
.
এরপরের একমাস কাটতে লাগলো নোলকের যথেচ্ছা কর্মকান্ডে। আদ্র’র কোনোরূপ বারনের ধার ধারলো না সে। রোজ একবার আদ্রর কাছে আসতে লাগলো। একটা সময় কলেজ শেষে আদ্র’র কাছে আসা রোজকার রুটিন হয়ে দাঁড়াল। একজন স্বতঃস্ফূর্ত চঞ্চল মেয়ের পাল্লায় পড়ে আদ্র’রও বাধা দেয়ার সাধ্য নেই!
ডাক্তারের কাছে চেকাপ করাতে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বও ইশানের থেকে নিয়ে নিলো নোলক। সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই এক প্রকার জোড় করেই হসপিটাল নিয়ে যায়। আদ্র বিরক্ত থেকে মহাবিরক্ত হওয়ার ভান করেও রেহাই পায় না। হাল ছেড়ে দিয়ে বলে,”এমন কেন করো নোলক! আমার কোনো কথাই শুনছো না! আশ্চর্য!”
ইশান অন্যরকম হেসে বলে,
“আমি এখন ঝাড়া-হাত-পা অগ্নিশর্মা। অগ্নিকন্যার হাতে যখন আদ্র পড়েছে, এখন আমার আর কোনো চিন্তা নাই। বাছাধন এবার টাইট হয়ে যাবে একদম! হা হা হা!”
আদ্র তবুও কঠিন, গম্ভীর।
রোজ দেখা করতে এসে নোলক প্রথমে যেই কাজটি করতো তা হলো, আদ্র’র কপালে হাত রাখা। চোখ না মেলেই আদ্র বলতো,
“এমন কেন করছো, নোলক? রোজ রোজ কেন আসো?”
খামখেয়ালি নোলক আদ্র’র চাইতেও দ্বিগুণ বিতৃষ্ণা প্রকাশ করার মতন করে বলতো,
“আমার ইচ্ছে। চুপচাপ শুয়ে থাকুন তো! আপনাকে চুপ থাকলেই বেশি ভাল্লাগে। কথা বলবেন না। কথা বললে রাগী টিচার দেখায়!”
বলেই শরীর দুলিয়ে হাসতে লেগে যেত।
আদ্র পেরে উঠে না। হাল ছেড়ে দিয়ে উঠে বসে। পুরোনো অভ্যাস মতোই বলে,
“চশমাটা একটু খুঁজে দাও তো নোলকরানী! পাচ্ছি না। কোথায় যে রাখলাম!”
নোলক আদ্র’র বালিশের পাশ থেকে চশমাটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে।
“পারবো না খুঁজে দিতে। অযথা চশমার কি কাজ? চশমা পড়লে আপনাকে ক্যাবলাকান্ত লাগে।”
আদ্র হাসে। চশমাটা তার কোনো কাজেই লাগে না। শুধু নোলকের মুখ থেকে এই কথাটা শোনার জন্যই বলে। কি যে ভালো লাগে তার!
নোলক ততক্ষণে আদ্রর চশমা নিজের চোখে পড়ে। চারদিক ঝাপসা দেখে। উফ! এত পাওয়ার! কি ভেবে যেন তৃপ্তির হাসি হাসে। হাতের ওই দু’চারটে চুড়ি সমেত হাত দু’খানা নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলে,
“এইযে শুনুন? আমার একটা বুদ্ধি এসেছে।”
“কী বুদ্ধি শুনি?”
“আপনার চশমাটা আমি পড়বো। তারপর আমি আর আপনি দূরে, অনেক দূরের অচিনপুরে চলে যাবো। এরপর দুজন দুজনার কাউকেই দেখতে পাবো না। শুধুই অনুভব করবো। কেমন হবে বলুন তো? সুন্দর না বুদ্ধিটা?”
আদ্র আওয়াজ করে হাসে। বলে,
“পাগল তুমি নোলক! কেমন পাগলীদের মতো কথা বলো!”
আদ্র’র মুখের হাসি দেখলেই নোলকের দুনিয়াটা শান্তি শান্তি লগে। অমন হাসি দেখতে হলে, পাগল হতেও দোষ নেই।
দুটি মানুষ কথা কয়, কত স্বপ্ন বুনে। যদিও সেই স্বপ্নের বেশিরভাগই নোলকের দখলে।
কখনো কখনো চুড়ি, নূপুর এনে তাড়া দিয়ে বলে,
“দিন তো দিন, এগুলো আমায় পরিয়ে দিন। এক্ষুনি চলে যেতে হবে, সামনে এক্সাম, আমার এখন অনেক তাড়া! জলদি করুন।”
হতভম্ব আদ্র বাধ্য বালক হয়ে, চঞ্চল মেয়েটার কথা মানে। ঝুনঝুন শব্দে চুড়ি পরায়, নূপুর পড়ায়। পরাতে পরাতেই বলে,
“কেন যে এসব পড় নোলক! সারাক্ষণ মাথায় বাজতে থাকে। আমায় তুমি শান্তি দাও না। কি মজা পাও বলো তো।”
মুগ্ধ হয়ে নোলক সেদিকে তাকিয়ে থাকে। কথায় আছে, যারে ভালো লাগে তার সব কিছুই ভালো লাগে, ভালো লাগতেই হয়। একপ্রকার বাধ্যবাধকতা যেন! এই যে যেমন আদ্রর অমন অভিযোগও নোলকের কাছে শ্রুতিমধুর লাগলো! আনমনে বলে,
“ভাগ্যিস আপনি দেখতে পাচ্ছেন না, লেখক সাহেব! নয়তো আমি এমন করে চাইতাম কি করে? কি না কি ভেবে বসতেন!”
আদ্র বিনিময়ে মুখ ফুটে কিছু না বললেও মনে মনে বলে, তোমায় আমি অনুভবে দেখি যে মেয়ে! তোমার চোখের মুগ্ধতা সব আমার চোখের স্নিগ্ধতা। শুধু মুখ ফুটে কইতে পারি না। উফফ, দহন!
এরপর টানা দু’দিন এলো না নোলক। আদ্রর এতে খুব একটা ভাবান্তর না হলেও নোলকের খুব উশখুশ লেগেছে, তবুও আসেনি আজ আসবে বলে।
সন্ধ্যা আগে আগে নোলক এলো। আজ সে কলেজ থেকে আসেনি। বাসা থেকে এসেছে। খুব মিষ্টি করে সাজল। আদ্র দেখতে পাবেনা যেনেও। গোলাপি রঙের একটা শাড়ি, হাত ভর্তি চুড়ি, চোখে মাখামাখি কাজল। কি চমৎকার দেখাচ্ছে নোলককে!
আজ একটা স্পেশাল দিন। নোলকের জন্মদিন। এই দিনে তার সাথে দেখা না করলে দিনটা সত্যিকার অর্থে স্পেশাল হবে কি করে?
বাহিরে তখন মেঘলা আকাশ। এই এক্ষুনি বৃষ্টি নামবে নামবে ভাব। দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই আদ্র বলল,
“নোলক এসেছো?”
নোলক এগিয়ে গিয়ে বলে,
“হু! কেমন আছেন?”
নোলকের এই কেমন আছেন এর বিপরীতে আদ্র বলল,
“শুভ জন্মদিন চঞ্চলাবতী। শুভ হোক তোমার জন্মজীবন নোলকরানী। বসো নোলক, কিন্তু আমার তরফ থেকে তোমার জন্য কোনো গিফট নেই যে! আমার তোমায় দেয়ার মতো কিছুই নেই।”
নোলকের চোখ ভিজে উঠে। মনে করার চেষ্টা করে, এত খুশি, এত খুশি সে শেষ কবে হয়েছিল?
বাহিরে বিদ্যুৎ চমকানোর আওয়াজ হয়। অজানা আতংকে ভ্রু কুঁচকে আসে আদ্র’র। হঠাৎ-ই খুব কঠিন হয়ে বলে,
“এই অসময়ে কেন এসেছো? সন্ধ্যে হয়ে যাচ্ছে, বৃষ্টি হবে। চলে যাও নোলক। পরে যেতে অসুবিধে হবে।”
নোলকের কি হয় কে জানে! বলে,
“বৃষ্টি হলে হোক, যাব না আমি।”
“অযথা জেদ করবে না। যাও।”
“যদি না যাই?”
আদ্র খানিক রুক্ষ স্বরে বলে,
“যাবে না কেন? অদ্ভুত কথা বলবে না নোলক। বাসায় যাও।”
একটু আগের খুশি খুশি মনটা এবার বিষাদে রূপ নিলো। কি ভীষণ অভিমান খেলে গেলো অবুঝ মনটাতে।
“আমি কী আপনাকে জ্বালাচ্ছি? এমন কেন করছেন?”
“যদি বলি জ্বালাচ্ছো! যাবে তুমি? সময় নষ্ট কোরো না। যাও নোলক। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। জ্বালাও কেন এতো?”
এই এবারের মতো রাগ আর অভিমান আর কখনো হয়নি নোলকের। কাজল কালো চোখ টলমল করে উঠলো। বাহিরে বৃষ্টি শুরু হলো সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বৃষ্টি নামলো একজোড়া অভিমানী চোখজুড়ে!
তারপর? তারপর নোলক তার পায়ের নূপুরটা খুলে ছুড়ে মারলো, হাতের চুড়িগুলো খুলে ছুড়ে ফেললো। ভেঙে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল রুম জুড়ে, কিছু ভাঙলো হাতে। ভাঙা চুড়ির কিছু অংশ হাতে ঢুকে রক্ত গড়াল, তাতেও কিছু গেলো আসলো না। অশ্রুসিক্ত চোখ দুটো মুছতে মুছতেই বেড়িয়ে এলো হোস্টেল থেকে। বৃষ্টির তোয়াক্কা না করে নেমে এলো রাস্তায়। কি তুমুল বৃষ্টি! সেই বৃষ্টিতেই ভিজে একাকার হয়ে গেলো অভিমানী মেয়েটি।
আদ্রর বাড়ি থেকে নোলকের বাসার দূরত্ব দের ঘন্টার। এই দের ঘন্টার পুরোটা পথ নোলক বৃষ্টিতে ভিজে ভিজেই গেলো। ভয়ানক রাগ আর অভিমানে যেন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে মেয়েটা। রিকশাওয়ালা বারবার করে বলতে লাগলো,
পলিথিনটা প্যাঁচাইয়া লন আফা। হুড ফালায় রাখছেন ক্যান। আরে আফা ভিজ্জা যাইতাছেন তো। এই সময়ের জ্বর কিন্তুক মেলা খারাপ হয়। তাত্তারি পলিথিনটা প্যাঁচাইয়া লন।”
এসব কোনো কথাই নোলকের কর্নপাত হলো না। তার শুধু মনে হচ্ছিল, এক্ষুনি তার মরে যাওয়া উচিত! এই নিষ্ঠুর মানুষটার সামনে আর দ্বিতীয়বার পড়া উচিত নয় কিছুতেই নয়, কোনো পরিস্থিতেই নয়! নোলকের চোখের পানি, বৃষ্টির পানি একাকার হয়ে যায়।
কি আশ্চর্য মানুষের আবেক-অনুভূতি।
উৎফুল্ল মন নিয়ে বের হওয়া নোলক যখন ভেজা চুপচুপে শরীর আর অস্বাভাবিক বিষন্ন মন নিয়ে বাড়ি ফিরলো তখন নবনী অবাক না হয়ে পারলো না। অবাক চোখে বোনের দিকে চেয়ে রইলো।
অমন অদ্ভুত শরীর মন নিয়েই নোলক মৃদু হাসলো। কি আশ্চর্য গুন মেয়েটির!
নবনীকে কিচ্ছুটি বলার সুযোগ না দিয়েই ডিরেক্ট ওয়াশরুমে চলে গেলো। খুব শান্তভাবেই ফ্রেস হয়ে বেড়িয়ে নামাজ পড়লো। তারপর নবনীকে ডেকে নরম আওয়াজে বলল,
“আপু আমি ঘুমাচ্ছি, প্লিজ ডেকো না।”
.
নোলক চলে যাওয়া বেশকিছুক্ষন পর ইশান এলো।
আদ্র তখনও চোখ বুজেই ছিল। নোলকের কথা, নোলকের আবদার সব কেমন তীরের মতন বিঁধে অন্তরে। উহ! দুর্বিষহ! মেয়েটা কি বৃষ্টিতে ভিজেই চলে গেলো? চলে যেতে বলে কি ভুল করেছে? কত ভাবনার আনাগোনা আদ্র’র মন জুড়ে!
রুম জুড়ে ভাঙা চুড়ির বিস্তর আনাগোনা দেখে ইশান প্রথমেই জিজ্ঞেস করলো,
“নোলক এসেছিলো?”
আদ্র গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“হুম।”
“কখন গেলো?”
“একটু আগে।”
“ওহ!”
ইশান হাতের কাগজপত্র গুলো টেবিলে রাখে। হাত মুখ ধোয়। ক্লান্তি ঝাড়তে এক গ্লাস পানি খায়। শার্ট চেঞ্জ করে টিশার্ট পরে।
এই পুরো সময়টায় আদ্র চুপ থেকে হঠাৎ-ই বলে,
“এত রাগ, এত জেদ, এত অভিমান! কিচ্ছু বুঝতে চায়না মেয়েটা! কি করি বল তো?”
ইশান হাসে। তারপর বলে,
“ও যা চায় তাই কর না। কেন অভিমান বাড়াস মেয়েটার। ওর মতো করে যত্ন তোরে কেউ করতে পারবে না। ভালোবাসলে এত পিছুটান নিয়ে ভাবতে হয় না। তুই এবার ভাবা বন্ধ করে দে তো।”
“নোলকের মতো ইম্যাচিউর টাইপ কথা বলিস না ইশু। ওর অনিশ্চিত জীবন চাই না আমি। ও খুব ইনোসেন্ট দোস্ত। জটিলতার মারপ্যাঁচে পড়ে গেলে পাগল হয়ে যাবে মেয়েটা। ও জাস্ট একটা ফ্যান্টাসির মাঝে আছে। ভাবছে সব কিছু খুব সহজ। কিন্তু এটা ভাবতে চাচ্ছে না, সব কিছু এত্তো সহজ নয়। অনেক বেশি কমপ্লিকেটিভ। মেয়েটা কী সুন্দর একটা জীবন ডিজার্ভ করে না, বল?”
ইশান এক এক করে ফ্লোরে পরে থাকা ভাঙা চুড়িগুলো তুলতে তুলতে বলে,
“জোর করে এতো বিজ্ঞদের মতো ভাবা বন্ধ কর। ফ্যান্টাসিটাকেই রিয়ালিটিতে রূপ দে। তোর চোখের দ্যুতি হতে চাওয়া মেয়েটাকে আর জ্বালাসনে। তোর মতো এত জোশ মানুষ পাশে থাকলে ওর জীবন অটোমেটিক সুন্দর হয়ে যাবে। এত কেন জটিল ভাবিস সব কিছু?”
“তোদের মতো সব সহজ ভাবতে পারি না আমি।”
“চাস না বলে পারিস না। একবার চেয়ে দেখ।”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আদ্র বলে,
“আজ নোলক খুব কষ্ট পেয়েছে দোস্ত। বাট ট্রাস্ট মি, আমি ওকে হার্ট করতে চাইনি। কিন্তু ও এতো জেদ করে যে….!”
“কষ্ট দিয়ে কষ্ট পাচ্ছিস?”
আদ্র কিছু প্রতিক্রিয়া করে না। ইশান বুঝতে পারে অনুভূতি। খুব করুন করে চায়। করুনা হয় নিজের প্রতিও। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতেই উঠে এসে আদ্রর বাহুতে হাত রেখে বলে,
“বাদ দে এখন এসব। কাল একবার স্যরি বলে দিস। অগ্নিশর্মার সব রাগ গলে পানি হয়ে যাবে দেখিস।”
আদ্র মনে মনে বলে, কিছু ঠিক হওয়া লাগবে না, কিচ্ছু না। চোখ বুজে দীর্ঘশ্বাঃস ফেলে। এই দীর্ঘশ্বাঃসকেই তার খুব আপন লাগে।
.
রাত একটা পঞ্চাশ। নবনীর ঘুম ঘুম পেলো। বুকশেল্ফে বইটা রেখে পানি খেলো। শুতে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বাতি নিভাতে গিয়ে চোখ পড়লো নোলকের উপর। দেখলো নোলক কেমন করছে! মৃদু কাঁপছে। পাতলা কাঁথাটা আঁকড়ে ধরছে।
নবনী দ্রুত কাছে এসে নোলকের গায়ে হাত রাখতেই চমকে উঠলো। এত গরম, এত গরম শরীর! নবনী আর্তনাদ করে ডাকলো,
“বোন? এই বোন? আল্লাহ্! শরীর পুড়ে যাচ্ছে!”
নোলক আধো আধো স্বরে বলল,
“আপু, শোন? তাকে বলে দিস, আমি তাকে নিজ থেকে আর কখনোই জ্বালাবো না!”……(চলবে)