#জলছবি
#পার্ট_১৩
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
.
রাত তখন গভীরে প্রবেশের পথে। একটার কাটা পেরিয়ে দুইটাকে ছোঁয়ার তীব্র চেষ্টা। টিকটিক করে ঘড়ির কাটা ঘুরছে আর রাত বেড়ে চলছে। পুরো শহর ঘুমিয়ে পড়েছে কিন্তু মেয়েটার চোখে ঘুম নেই। হাতে বিভূতিভূষণ এর ‘অপরাজিতা’ বইটা। খুব মনযোগ সহকারেই পড়ছিলো সে। গল্পের বিশেষ জায়গায় এসে কপাল কুঁচকে এসেছে। বই শেষ না করে উঠা যাবে না, এমন পরিস্থিতি। কিন্তু তার পরিকল্পনা বাস্তবে প্রতিফলন ঘটতে পারলো না।
পরপর দুইবার ক্রিংক্রিং করে কলিংবেল বাজলো। কলিংবেলের আওয়াজে মনযোগে বিঘ্ন ঘটায় কিঞ্চিৎ বিরক্তিই হলো বোধহয়। মনে মনে ভাবে ‘এত রাতে কে এলো?’ চশমাটা ঠিক করে বিছানা থেকে নেমে বইটা ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখলো। রুম থেকে বের হতে বের হতে ভাবল, ভুল শুনলাম না তো?
ভাবনার অবসান ঘটিয়ে পুনরায় কলিংবেল বেজে উঠলো। নবনী তার মিহি কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,”কে?”
ওপাশ থেকে শুধু ভেসে আসলো,
“আপু?”
এরপর আর নবনী এক মূহুর্তও অপেক্ষা করে নি। কারণ এই কন্ঠ শোনার পরও দরজা বন্ধ রাখায় তার সাধ্যি নেই। বিস্ময় নিয়ে দ্রুত দরজা খুলে দেয়। নবনীকে কিছু বলার কিংবা করার সুযোগ না দিয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নোলক ঝাঁপিয়ে পড়ে বোনের উপর। নবনী বিস্ময়ের চূড়ায় অবস্থান করছে তখন। প্রথমত নোলকের আজ ফেরায় কথা ছিলো না। দ্বিতীয়ত এই মাঝরাতে এমন বিধ্বস্ত অবস্থায় নোলকে দেখবে বলে কল্পনাও করেনি।
বোনের মাথা পিঠে হাত বুলিয়ে ঘরের ভেতরে নিয়ে আসে আগে। সোফায় বসিয়ে পানি দেয়। নোলক পানি খায় না। হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলে,”লাগবে না।”
নবনী বুঝতে পারে, কিছু একটা খারাপ হয়েছে। তবুও নিজেকে শান্ত রেখে
জিজ্ঞেস করে,
“আজ তো তোর ফেরার কথা ছিলো না! কিছু হয়েছে বোন? তোর বাকি বন্ধুরাও কি ফিরেছে?”
নোলকের এতক্ষণ চেপে রাখা কান্না এবার বিসর্জন দেয়ার সময় এলো বুঝি। বোনকে জড়িয়ে ধরা অবস্থাতেই কেঁদে ফেলে।
নবনী খুব ভয় পেয়ে যায়। নোলক সচারচর কাঁদার মতো মেয়ে না। এই এত বছরেও সে মেয়েটাকে হাতে গোনা কয়েকবার কাঁদতে দেখেছে। খুব বেশি কষ্ট না পেলে এই মেয়ে কাঁদার মতো মেয়ে না। নবনী মনে কতশত সংশয় উঁকি দেয়। খারাপ কিছু হলো না তো? মেয়েটাকে একা যেতে দিয়ে কি ভুল করেছে সে?
নবনী ঠান্ডা মাথার বুদ্ধিমতী মেয়ে। এই ছোট জীবনে তার এই ছোট বোনটাকে নিয়ে অনেক অনেক বাঁধা পারি দিয়ে এই পর্যন্ত এসেছে। এমনকি প্রখর আত্মসম্মানকে সঙ্গী করে ছোট বোনটাকে নিয়ে বড় চাচার বাড়ি ছেড়ে আসতে পেরেছে শুধুমাত্র তার সৎসাহস এবং তুখোড় বুদ্ধিমত্তার কারনেই। এই যে এতগুলো বছরেও সে কারো দ্বারপ্রান্ত হয়নি। দুঃখ এসেছে, কষ্ট এসেছে, কতশতবার হতাশায় ঝাপটে ধরতে চেয়েছে তবুও হতাশাকে প্রশ্রয় দেয়নি। কারণ সে জানে, যেকোনো পরিস্থিতিতে অস্থির না হয়ে কি করে ঠান্ডা মাথায় সব সামাল দিতে হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। নোলকের মাথা খুব যত্নে হাত বুলাতে বুলাতে আদুরী স্বরে জিজ্ঞেস করে,
“কি হয়েছে বোন? আপুকে বল? কেউ কি কিছু বলেছে? কিছু করেছে?”
কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটার হেঁচকি উঠে যায়। নাক টেনে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। কান্নামাখা কন্ঠে বলে,
“আপু, শ্রেয়া বাবা মারা গিয়েছে। মেয়েটা খুব কাঁদছিল। আমি তো মা-বাবার আদর পাই নি, তবুও এত কষ্ট হচ্ছে। আর ওর তো ওর বাবার সাথে কত স্মৃতি! কি করে ভুলবে মেয়েটা? মরে যাবে আপু! আমার অনেক বেশি কষ্ট লাগছে আপু।”
“কখন হয়েছে এমন?”
একটু একটু করে থেমে থেমে নোলক সবটা বলে।
নবনী চুপটি করে সবটা শোনে। তারপর বোনের গালে হাত রেখে নরম গলায় বলে,
“সবাইকেই একদিন চলে যেতে হবে, যেতে হয় বোন। এটাই তো অপ্রিয় সত্য। মানতে হবে, মেনে নিতেই হবে। না মেনে উপায় নেই বোন। আর কাঁদিস না তো বোকা।”
তারপর কিছুক্ষণ দুই বোনের নিরবতা। একটা দুঃখি নিশ্বাঃস ছেড়ে সেই নিরবতা ভাঙে নবনী। বোনের দিকে চেয়ে মুখে মেকি হাসে এঁকে জিজ্ঞেস করে,
“কিছু খেয়েছিস?”
নোলক মাথা নাড়ায়। যার অর্থ ‘না’। নবনী
ঠোঁট উল্টে বলে,
“আমিও খাইনি। তোকে ছাড়া খেতে ইচ্ছে করে না।”
নোলক দুহাতে তার চোখ মুছতে মুছতে বলে,
“আমাকে তো খুব ইমম্যাচিউর বলো। এখন নিজেই তো ইমম্যাচিউর দের মতো কাজ করো।”
নোলককে তার নিজের ফর্মে একটু ফিরে যেতে দেখে নবনী খুশি হয়। মিষ্টি করে হাসে। তারপর কিছু একটা চিন্তা করার মতো ভাব করে বলে,
“উমম, ইউটিউবে নতুন একটা রেসেপি দেখেছিলাম। আয় চল এখন দুজন মিলে বানিয়ে তারপর খেয়ে নেই। রাত দুপুরে রান্নার মিশনে নামি, চল? মজা হবে।”
নোলক বোনের দিকে চায়। সাহসী সুন্দর মুখটা দেখে তৃপ্তিময় হাসে। তারপর নবনীকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে। খুব মায়া মায়া করে বলে,
“তোমার কাছে থাকলে আমার কোনো দুঃখ থাকে না, থাকতে পারে না, আপু। তুমি আমার সুখে থাকার সম্বল, তুমি আমার সুখ। আই লাভ ইউ আপু, আই লাভ ইউ!”
নবনীর আবেগে গলা ধরে আসে। এই বোন ছাড়া আর কে আছে তার? আর কে আছে ভালোবাসার বোনের কপালে গাঢ় এক চুমু এঁকে বলে “পাগলী!”
.
ভোরের আলো ফোটার আগে আগেই শ্রেয়ার বাবার দাহ করা হয়। শ্রেয়া তখনও সেন্সলেস। কেউ গুন গুন করে কাঁদছে আর কেউ মূর্তির মতো নিরব হয়ে বসে আছে।
লুবনা শ্রেয়ার পাশে রইলো সার্বক্ষণিক। সৃজন তার শৎকারের কাজে এগিয়ে গেলো। শ্রেয়া দাদাদের শান্তনা দিলো।
আদ্র শান্তনা দিতে জানে না। এমন সময়ে কি বলা উচিত তাও জানে না। সে কেবল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখে। তারপর সেখান থেকে চলে আসে।
শ্রেয়াদের বাড়ির পেছন দিকে একটা বড় দীঘির মতো আছে। আদ্র সেখানে গিয়ে বসলো। তার দম বন্ধ লাগছে। যেই ঘাসগুলোর উপর বসে ছিলো এবার সেই ঘাসের উপর শুয়ে আকাশের পাণে চেয়ে রইলো। ভোরে সূর্য উঠার ঠিক আগ মূহর্ত অর্থাৎ গভীর কালো আকাশ নয়। আদ্রর ফোন বেজে উঠলো। পকেট থেকে বের করে চোখের সামনে ধরতেই জ্বলজ্বল করলো ‘আবরার হোসাইন’ নামটি। আদ্র কেটে দিতে গিয়েও কিসের যেন একটা বাধা অনুভব করলো। শ্রেয়ার বাবা হারানো অশ্রুসিক্ত মুখটা ভেসে উঠলো। নোলকের বলা, ‘আপনার তো মা-বাবা আছে, তাই তাদের না থাকার মর্ম বোঝেন না’ কথাটি প্রতিধ্বনি হতে থাকে। কাটতে পারে না ফোনটি। ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে,
“বাবা? কই আছিস তুই? ঢাকা ফিরেছিস?”
অন্যসময় হলে হয়তো কিছুই বলতো না। কিন্তু আজ ব্যতিক্রম হলো। কাটখোট্টা কন্ঠেই বলে,
“হ্যাঁ, ফিরেছি।”
“বাবা আমার সঙ্গে একটু দেখা করতে পারবি?”
“কখন?”
“আজ কিংবা কাল। তোর যখন ইচ্ছে হয়।”
“আমার কখনও ইচ্ছে হয় না। আমার সকল ইচ্ছেরা বহুকাল আগেই মারা গিয়েছে। এখন কোনো ইচ্ছে আর অবশিষ্ট নেই।”
আদ্র ফোন কেটে দেয়। মিথ্যে একেবারেই বলতে পারে না ছেলেটা। তবুও আজকাল প্রায়শই এই দুইটা মানুষের সঙ্গে মিথ্যে বলতে হচ্ছে। এই যে এখন বলল, তার ইচ্ছে হয় না। আদতে কথাটা সত্য নয়। তার ইচ্ছে হয়। খুব ইচ্ছে হয়। এই এত বড় হয়ে যাওয়ার পরও মা আর বাবাকে নিয়ে এক সঙ্গে থাকতে। অথচ তা আর সম্ভব নয়। দুজনেরই আলাদা সংসার আছে। তাদের ছেলে-মেয়ে আছে। পরিবার আছে। সংসার আছে। নেই শুধু ও নিজে।
নিজের মা-বাবা একান্ত নিজের নেই। একান্ত নিজের কিছু না হলে সেখানে ইচ্ছে খাটানো যায় না, উচিত না।
সেই তেরো বছর বয়স থেকে হোস্টেলে হোস্টেলে থেকে থেকেই পড়াশোনা করে আসছে। আগে সে তার ইচ্ছের কথা জানাতো। কিন্তু তার আলাদা হয়ে যাওয়া ব্যস্ত মা-বাবা সময়-সুযোগ খুঁজে পেত না। মাকে মাঝে মধ্যে ফোন করে বলতো,’তোমায় খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে মা। একটু আসবা?’ তিনি ইতস্তত করে বলতেন,’তোমার নতুন বাবাকে বলে দেখি, বাবা। সুযোগ পেলে আসবো।’
তারপর বাবাকে ফোন করে বলতো,’বাবা একটু আমার হোস্টেলে আসবা? মিস করছি।’ তিনিও তার ব্যস্ততা দেখাতেন। কখনো কারো পারমিশন না লাগা বাপেরও নতুন মায়ের পারমিশন লাগতো!
ইন্ট্রোভার্ট আদ্র আরো ইন্ট্রোভার্ট হয়ে উঠলো। নিজের ইচ্ছে মাটি চাপা দিতে শিখে গেলো। ইচ্ছের চাপায় জন্ম নিলো চাপা রাগ, ক্ষোভ আর অভিমান। একাকীত্বের সঙ্গী হিসেবে আঁকড়ে নিলো বই। স্যার ম্যামদের মধ্যমনি হয়ে উঠলো খুব দ্রুতই। ভালো রেজাল্ট এর জন্য বৃত্তি পেতে শুরু করলো প্রতি ক্লাসেই। সেই বৃত্তির টাকাতেই নিজেই নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতে শিখে গেলো। মা-বাবার কাছে মুখ ফুটে আবদার করা ভুলে গেলো। সে ভুলে গিয়েছে শেষ কবে এই মা-বাবার কাছে মুখ ফুটে কি চেয়েছে!
হুট করেই যেন এই দুইটা মানুষের কাছ থেকে অনেক অনেক দূরে সরিয়ে নিলো নিজেকে। নিজের চারপাশে অদৃশ্য এক দেয়াল গড়ে তুললো। আজ আর তার ইচ্ছে হয় না। কোনো কিছু চাওয়া পাওয়া কিংবা দেখার তীব্র ইচ্ছেতে জ্বলেপুড়ে মরে না। ইচ্ছে জাগলেও সেই ইচ্ছে ছুড়ে ফেলে দিতে জানে। মা-বাবা থেকেও মা-বাবার আদর বিহীন কঠিন এক আদ্র গড়ে উঠলো।
“তুই এখানে?”
আদ্র চোখ মেলে চাইলো। কিছু দেখে না চশমা ছাড়া। চোখ কচলে হাতের মুঠোয় থাকা চশমাটা চোখে পড়লো। ইশানকে দেখে খানিক চমকালো বোধহয়। চারদিকে আলো ফুটতে শুরু করছে টতক্ষণে। আদ্র উঠে বসল। জিজ্ঞেস করলো,
“কখন এলি?”
“একটু আগে।”
“লোকেশন জানলি কি করে?”
“সৃজনের কাছ থেকে। ভাল্লাগছিল না তাই চলে এলাম।”
আদ্র কিছু বলল না। দুজন উঠে বাড়ির ভেতরে চলে এলো। একজন বট বৃক্ষ হারানোর বেদনায় বাড়িটা তখন অস্বাভাবিক নিরব। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই যেন বিষাদময় হাহাকার। এই বিষাদ ছুঁয়ে দিচ্ছে বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষকে।
এরপর দশটা নাগাত আদ্র আর ইশান বিদায় নিয়ে চলে এলো। মূলত আদ্রই জানায় সে বাসায় ফিরতে চায়। ভালো লাগছে না তার। ইশানও বোধহয় আদ্র’র মন খারাপটা ধরতে পারে। তাই সে বন্ধুর সাথেই বিদায় জানায়।
গাড়ি যখন কুমিল্লা ক্রস করলো তখন ইশান ‘জিজ্ঞেস করবে না, করবে না’ করেও জিজ্ঞেস করেই ফেলে,
“এই? নোলককে দেখলাম না যে? ও কি ভেতরেই ছিলো?”
আদ্র মৃদু হাসলো। একটু ত্যাড়া ভাবে জিজ্ঞেস করে,
“কেন? খুঁজেছিলি নাকি?”
ইশান বাচ্চাবাচ্চা হেসে বলে,
“না-আ! খুঁজিনি। কিন্তু দেখিনি তো, তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
“ও আসেনি।” কথাটা বলে সিটের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসে আদ্র। ইশান আদ্র’র দিকে বাঁকা হয়ে ঘুরে জিজ্ঞেস করে,
“আসেনি মানে?”
“আসেনি মানে আসেনি। হসপিটাল থেকেই না বলে চলে গিয়েছে।”
ইশান অবিশ্বাস নিয়ে বলে,
“স্ট্রেঞ্জ! না বলে চলে গেল? মেয়েটা অন্যরকম।”
“প্রেমে পড়েছিস?” আদ্র খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্নটা করে। ইশানও চটজলদি ধাক্কাটা সামলে নিয়ে ইতস্তত করে বলে,
“আরে নাহ! কি যে বলিস!”
আদ্র হাসে।
“মিথ্যে বলছিস আমাকে?”
ইশান জোর দিয়ে বলে,
“আরে বাবা না, সত্যি। যেই ডেঞ্জারাস মেয়ে! অগ্নিশর্মারে তো আমি ভয় পাই!”
আদ্র খিটখিট করে হাসে। এমন অদ্ভুত কথা শুনে, না হেসে পারা যায়?…….(চলবে)