#ছত্রিশ_ঝামেলা
#পর্ব_৪

লায়লা দরজায় নক করছে।
শাকিব দরজা না খুলেই বললো,
—ভাবী। প্লিজ বিরক্ত করবে না।
—মিমি তোমাকে গুডনাইট বলতে এসেছে। একমাত্র ভাতিজিকে একটা গুড নাইট কিস দেবে না বুঝি? আমরা তো তোমার জন্যই এত রাত করে ফিরলাম।
বলো মিমি মা, তুমি চাচার জন্য ফিরোনি?

শাকিব উঠে গিয়ে দরজা খুললো।।
দরজায় উঁকি দিয়ে লায়লা মিষ্টি করে হাসলো।তার পরনে হাসিবের পায়জামা পাঞ্জাবি।যখনি সে হাসিবকে মিস করে তখনি সে হাসিবের কাপড় পরে ঘুরে বেড়ায়।
—ভাইয়াকে মিস করছো আবার?
—তোমার ভাইকে আমি সবসময়ই মিস করি। আজ পরিমাণটা একটু বেশি।
—মিমি কোথায়?
— ঘুমিয়ে পড়েছে।
—এরপর থেকে আমি কিন্তু আর সত্যিই তোমাকে আমার স্টুডিওতে এলাউ করবো না।
—ওহ আমার সুদর্শন চিত্রকর দেবর! আমি কি তোমার এই চিত্র নির্মানের কর্মশালায় একটু বসতে পারি?

শাকিব দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো।
লায়লা মোড়া টেনে আরাম করে বসলো।
শাকিবের স্টুডিওতে এলেই তাঁর মন ভালো হয়ে যায়। কী সুন্দর সুন্দর সব ছবি টাঙানো! অদ্ভুত একটা মন স্নিগ্ধ করা আবেশ।

—-পাঁচমিনিটের বেশি কিন্তু আমি তোমায় সময় দিতে পারবো না।
—পাঁচ মিনিটই এনাফ। তোমার দেয়া এই পাঁচমিনিট নিয়ে আমি বেঁচে থাকবো অনন্তকাল।
—একদম টিজ করবে না ভাবী।প্লিজ। আই লাভ মাই ওয়ার্ক!
—এমনিতেও সামনে কয়েকদিন তোমায় জ্বালাবো না। আগামী মাসে আমি ব্যাংকক যাচ্ছি।।

লায়লা কয়েকটা ছবি হাতে নিয়ে ভালো করে মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলো।
—মায়ের ঝারি খেলে আবার? ব্যবসায় বসতে বলছেন?
—হুঁ।
—তুমি মাকে বলোনি, যেটা মন থেকে আসে না সেটা করতে গেলে মনের মৃত্যু হয়। মন হলো আত্মার ধারক।
—তোমার শাশুড়ী এসব ফিলসফিকে দিনে দশবার খুন করে।
লায়লা হাসলো।
—উফ! শাকিব তোমার ছবি তোলা দেখলে তো আমারই ফটোগ্রাফি শিখতে মন চায়। এত সুন্দর!
এটা কিসের ছবি বলতো?
—এটা একটা চিকন সুতার ছবি। এই যে ঝকঝকে ফোঁটাগুলো দেখছো, ওগুলো সুতার উপরে জমে থাকা পানির ফোঁটা!
—সো প্রিটি.. এত ডিটেইলিং ছবিতে।
তোমার কনটেস্টে যাবে বুঝি?
–হুঁ।
—সবগুলোই যাবে? এত ছবি কেন?
—কনটেস্টে আমি দুটো ক্যাটাগরিতে পার্টিসিপেট করছি। স্ট্রিট ফটোগ্রাফিটা মেইন। একবার সিলেক্ট হয়ে গেলে আমার পুরো এক্সিবিশনটা ওরা স্পন্সর করবে।
—আমি তো নিশ্চিত তোমার ছবিগুলোই সেরা হবে।
এটা কি ধরের ছবি। পোটের্ট?
—উঁহু। ল্যান্ডস্কেপ।কতবার বলেছি পোটের্টে ব্যক্তি অবয়বটা মেইন। ভাবী তোমার কি ছবি নিয়ে প্রশ্ন করা শেষ হয়েছে? তাহলে প্লিজ যাও। আমার কাজ করতে ডিসটার্ব হচ্ছে।
—তুমি বলেছিলে পাঁচমিনিট গল্প করবে।
—পাঁচমিনিট হয়ে গেছে কিন্তু।
—উঁহু এভাবে নয়। একদম কাজ ফেলে আমার দিকে তাকিয়ে গল্প করবে তাহলেই…
শাকিব ল্যাপটপ একপাশে সরিয়ে লায়লার মুখোমুখি হয়ে বসলো। জায়ান্ট স্ক্রিনে একটা দোয়েল পাখির ঠোঁটের খড়কুটো দেখা যাচ্ছে। লায়লা একমনে তাকিয়ে দেখতে লাগলো ছবিটা।
—এই পাখি তুমি পেলে কোথায়? ঢাকা,শহরে তো এসব স্বপ্ন!
— আমি সব স্বপ্নই তো খুঁজে বেড়াই ভাবি। এই যে আরেকটা স্বপ্ন তোমারও দেখলাম।।
লায়লা কৌতূহলী চোখে তাকালো।
—আগামী মাসে তুমি ব্যাংকক যাচ্ছো না ভাবী, আসলে তুমি যাচ্ছো সিডনিতে। ভাইয়ার জন্মদিনে ভাইয়াকে সারপ্রাইজ দিতে তাই না?
লায়লা মন খারাপ করা গলায় বললো,
—তোমার সাথে এইজন্যই কথা বলতে ভালো লাগে না শাকিব। সব আগে থেকে জেনে যাও।
—উপহার কি নিয়ে যাচ্ছো?
—সেটাই তো বুঝতে পারছি না। কি নেওয়া যায় বলোতো?
—এক কাজ করো দুটো বিড়াল ছানা আর এক বাটি দুধ সাথে করে নিয়ে যাও।তোমার বর তো খুব বিড়াল ভালোবাসে।জন্মদিনে বিড়াল ছানার সাথে বাটিতে চুকচুক করে দুধ খাবে। পাশে বসে তুমি গাইবে হ্যাপি বার্থডে টু ইউ….
— একদম রসিকতা করবে না শাকিব। ফ্লাইটে আমি বিড়াল নিয়ে যাবো কি করে? বিড়াল নিতে গেলে আবার এপ্লিকেশন করার ঝামেলা আছে!
—তুমি ক্লোরোফর্ম দিয়ে বেঁহুশ করে নিয়ে যাবে। বেঁহুশ বিড়াল স্যূটকেসে থাকবে। কেউ টেরই পাবে না।
লায়লা চিন্তিত কণ্ঠে বললো,
—এখন বিড়াল ছানা পাবো কোথায়? ধুররর! অন্যকিছু বলো…
—কিনে নিয়ে আসো। বিড়ালছানা দুটো ভাইয়ার কোলে দিয়ে বলবে, আগামী জন্মদিন আসার আগে আমারও এমন দুটো ছানা চাই। মিমি ওর খেলার সঙ্গী চায়।
লায়লা লজ্জা পেয়ে অন্যদিকে তাকালো।
—ভাবী তুমি কি সত্যিই বিড়ালছানা নিয়ে যাবার কথা ভাবছো?
লায়লা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।
শাকিব মুগ্ধ কণ্ঠে বললো,
—ভাইয়ার মত একটা বদমেজাজি বিড়ালটাইপ লোককে তোমার মত শার্প একটা মেয়ে যে কি করে এত ভালেবাসে আমার তো মাথাতেই ঢোকে না।
আচ্ছা ভাবী, ইকোনোমিকস তুমি পড়ে পাশ করেছো তো? না দেখে দেখে লিখে?
—তোমার ভাইয়া আমায় বেশি ভালোবাসে। ও প্রতিদিন ফোন রাখবার আগে এত মন খারাপ করে। গতকাল বললো মায়ের হাতের শুটকি তরকারি খেতে ইচ্ছে করছে। মানুষটা ওখানে খাওয়াদাওয়ায় কোনো স্বাদ পায় না বুঝলে?
শাকিব শব্দ করে হেসে উঠলো।
—কি ব্যাপার হাসছো কেন?
–ভাবী তুমি কি জানো, ভাইয়ার কথা বলতে গেলেই তুমি ষোলো বছরের বোকা আর ন্যাকা কিশোরীর মত হয়ে যাও!
—তো?এই বোকা কিশোরীর ভালোবাসা কি খারাপ?
—অবশ্যই খারাপ। আমায় কেউ এমন করে ভালোবাসলে আমি মেরে তার হাড়গোড় ভেঙে ফেলবো।
—ভালোবাসা ব্যাপারটাই কিন্তু বোকা।
শাকিব চেয়ার ঘুরিয়ে আবার ল্যাপটপ খুলে বসলো।
—বরং উল্টো করে বলো, বোকারাই ভালেবাসে।
লায়লা বসা থেকে উঠে এসে শাকিবের কাছাকাছি দাঁড়ালো।
—আর কখনো তুমি যদি কাউকে ভালেবাসো?
শাকিব লায়লায় প্রশ্নটার জবাব দিলো না। সে মনোযোগ দিয়ে জায়ান্ট স্ক্রিনে ছবির স্লাইড পাল্টাতে থাকলো।
লায়লা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বললো,
—বিড়াল ছাড়া অন্য কিছু আর কি নেওয়া যায় বলোতো?
—ভাইয়ার ছোট বেলাকার একটা স্পর্শকাতর ছবি আছে। মা’কে বললেই বের করে দেবে। ওই ছবিটা বড় করে বাঁধাই করে নিয়ে যাও।
—স্পর্শকাতর ছবি বলতে?
তোমার ভাইয়ার প্যান্ট না পরা ছবি?
—সেটা হলেও চলতো। ছবিতে ভাইয়া দাঁড়িয়ে হিসু করছে আর ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদছে।ছোটমামা তুলেছিল ছবিটা।
—ও মাই গড!বলছো কি?
—হুঁ। পিঁপড়া কামড়ে দিয়েছিল ভাইয়াকে। বেচারা ইনজুরড হয়ে হিসু করতে খুব ভয় পাচ্ছিলো।
—তাহলে আমি বরং ওই ছবিটাই খুঁজে দেখি.. কি বলো?

লায়লা দারুণ খুশি হয়ে বেরিয়ে গেলো। লায়লা বেরিয়ে যেতেই শাকিব তাঁর ল্যাপটপের গোপন ফাইলটা খুললো। এখানে তাঁর জীবনের সব বিশেষ ছবিগুলো রাখা আছে।কিছুদিন আগে তাঁর জীবনের অতি বিশেষ একটি ছবি সেই ফাইলে যোগ হয়েছে। ছবিটা তাঁর ছাত্রী নিশাত তাসনিমের। ছবিতে নিশাত দুটো কোকের ক্যান হাতে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে আছে।
শাকিব ছবির স্লাইডটা ফিক্স করে আরাম করে বসলো। আজ আর কাজ করবে না সে। সারারাত এই ছবি দেখে কাটাবে।
লায়লা আবার এসেছে।
—শাকিব!এই শাকিব! দরজাটা খুলোতো।মা তোমার ভাইয়ার ছবিটা খুঁজে পাচ্ছেন না। কি করি বলোতো?
শাকিব ঠান্ডা স্বরে বললো,
— একদম বিরক্ত করবে না ভাবী। আমি ভীষণ জরুরি একটা কাজ করছি।
লায়লা কথা শুনলো না। একাধারে দরজায় নক করতেই থাকলো।
শাকিব স্ক্রিন অফ করে দরজা খুললো।
—কি চাই?
লায়লা হাসিমুখে ছবি বাড়িয়ে দিলো।
—এটা বড় করে এক্ষুনি প্রিন্ট করে দাও।
শাকিব বিরক্ত হাতে ছবিটা নিলো।
—ভাবী তোমার কি মনে হয় না, ইদানিং তুমি খুব বেশিই মিথ্যে বলছো?
—প্রেমিকা নারী আমি। মিথ্যে বলায় কি দোষ বলোতো?
—যাও.. এক ঘন্টা পর এসে ছবি নিয়ে যেও।
—উঁহু। আমি বসে বসে ছবি প্রিন্ট করা দেখবো। এবং তোমার সাথে গল্প করবো।
শাকিব চট করে জায়ান্ট স্ক্রিনের স্লাইডডা বদলে ফেললো।
—আমি তোমার ভাইয়ার হাত প্রথম কবে ধরেছিলাম জানো? ষোলো সালে।তিনই এপ্রিল। বিকেল চারটা পয়তাল্লিশে। হাত ধরা নিয়ে আমাদের কিন্তু একটা মজার ঘটনা আছে। তখনো আমাদের মধ্যে ভালোবাসাবাসি বলা হয়নি বুঝলে? আমরা শুধু এমনি দেখা করি, চটপটি খাই এই আর কি।ধানমন্ডি লেকের ধারে আমরা একবার দেখা করতে গেছি। হাটতে হাটতে হঠাৎ তোমার ভাইয়ার পা ফসকে গেলো। আমি হাত ধরে বেচারাকে সামলালাম। ব্যস… সেই হাত ধরাই আমাদের কাল হলো। ভালোবাসা ছড়িয়ে গেলো মোর প্রাণে…..
লায়লা গুণগুণিয়ে উঠলো।
“তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে… সে আগুন ছড়িয়ে গেলো সবখানে… সবখানে….
শাকিব লায়লার দিকে তাকিয়ে হাসলো৷ ক্যামেরা হাতে নিয়ে বেশ কয়েকটা ছবি তুললো৷
—উফ আমার ছবি তুলছো কেন?
—শতাব্দীর সেরা প্রেমিকার ছবি তুলে রাখছি। ইতিহাসের পাতায় একদিন এসবের দরকার হবে।
লায়লা ফিসফিস করে বললো,
—আমি শুধু এই শতাব্দীর নয় শাকিব, তোমার ভাইয়ার জন্য শতশত শতাব্দীর সেরা প্রেমিকা হতে চাই।
শাকিব ক্যামেরায় চোখ রেখেই বললো,
–ভাবী, ভাইয়া যদি কখনো তোমার কাছে কোনো মহা অপরাধ করে তুমি কি ভাইয়াকে ক্ষমা করে দেবে?

লায়লা শঙ্কিত চোখে তাকালো।
—মানে?
—এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই ভাবী। তোমার চোখেমুখে ভয়ের এক্সপ্রেশন দরকার ছিলো। সেটা আনতেই প্রশ্নটা করলাম।

লায়লা ছলছল চোখে বললো,
–তোমার ভাইয়ার কোনো মহা অপরাধ আমি ক্ষমা করবো না শাকিব। কখনোই না। ক্ষমা করার প্রশ্নই উঠে না।
শাকিব হাসলো।
—এই প্রেমিকাটিকে আমার ভালো লাগছে ভাবী।এই প্রেমিকা একদম বোকা আর ন্যাকা কিশোরী নয়। দ্যাটস প্রিটি গুড!

-চলবে-

#তৃধাআনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here