#ছত্রিশ_ঝামেলা
#পর্ব_১৩

সন্ধ্যা থেকেই লায়লা ঘরের বাতি নিভিয়ে শুয়ে আছে। তার কিচ্ছু ভালো লাগছে না৷ মাথার যন্ত্রণাটা কোনে ঔষধেই থামছে না। বমি পাচ্ছে। লায়লা উঠে গিয়ে আবার বমি করলো। এই নিয়ে সে পঞ্চমবারের মতো বমি করলো। সকাল থেকেই সে খালিপেটে আছে। তাও এত বমি কোথা থেকে হচ্ছে, কে জানে?

শাকিব দরজায় নক করে ডাকলো।
-“ভাবী আসবো?”
লায়লা কড়া স্বরে জবাব দিলো।
-“না।”
-“ভাবী, তোমার সাথে আমার কথা আছে। প্লিজ ভাবী। ফর গড সেইক। আই বেগ টু ইউ ভাবী।”
লায়লা বিছানায় উঠে বসলো।
-“এসো। দরজা খোলা আছে।”
শাকিব ভেতরে গিয়ে বসলো। লায়লা ভাবীকে ভীষণ বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে চোখ কোটরে চলে গেছে। শাকিবের বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠলো৷ অন্তত মিমির জন্য হলেও লায়লা ভাবীর সুস্থ থাকাটা জরুরি।
-“বাড়িতে একটা বিরাট মাপের চুরি হয়েছে। এই ঘটনাটা ছাড়া কি তোমার আর কিছু বলার আছে শাকিব?”
-“কলিকেও তো পাওয়া যাচ্ছে না৷”
-“কলি বাড়িতেই আছে৷ লুকিয়ে আছে৷”
-“লুকিয়ে আছে কেন?”
-“আমার বলতে ইচ্ছে করছে না শাকিব।”
-“তোমার শরীর এখন কেমন?”
লায়লা জবাব দিলো না। সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গ দিয়ে কথা শুরু করলো
-“তোমার ফ্লাইট কবে? কবে যাচ্ছো তোমার স্বপ্নের ব্রুকলিনে?”
শাকিব দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আপাতত সে তার যাওয়া ক্যানসেল করেছে। এই ব্যাপারটা সে এখনো কাউকে জানায়নি। লায়লাকেও বলতে ইচ্ছে করছে না।
-“তোমার ভাইয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে, এবার তোমার হবে। তোমার জীবনেও হয়তো একজন মার্লিনা মেট্রিন আসবে। তবে দুঃখের ব্যাপার হলো, তোমার হয়তো মিসেস লায়লার মতো কেউ থাকবে না যাকে মার্লিনা ফোন করতে পারবে।”
লায়লা ভীষণ শব্দ করে হাসলো। বেশ অনেকটা সময় পর সে হাসি থামিয়ে দম টানলো।
শাকিবের মনে হলো লায়লার এই হাসিটা ভীষণ অস্বাভাবিক। এই হাসিটা কান্নারই একটা রূপ। যে হাসিতে বারবার সামনের জনকে বলা হয়, আমাকে সাহায্য করো, আমি ভয়াবহ বিপদে আছি।

-“একটা মানুষকে আমি দিনের পর দিন এত ভালোবেসে গেলাম আর সে কিনা একদিন মদ খেয়ে অন্যের হয়ে গেল। ভাবা যায়? সিনেমার গল্প কেন আমার জীবনেই সত্যি হবে বলোতো?”
শাকিব ঝট করে প্রসঙ্গ বদলালো।
-“ভাবী আমি তোমার সাথে মোট তিনটা টপিকে কথা বলবো। তারপর চলে যাবো। মাই আর্নেস্ট রিকোয়েস্ট তুমি কথাগুলোর কাউন্টার এখনি দেবে না।”
লায়লা মলিন করে হাসলো।
-“তোমার কি মনে হয় আমি কাউন্টার না দিলেই তোমার ভাই বেঁচে যাবে?”
-“আমি ভাইয়ার ব্যাপারে কিচ্ছু তোমাকে বলছি না। মিমির তোমার কাছে থাকা জরুরি। মিমিকে তুমি নিজের কাছে রাখো ভাবী। প্লিজ।”
-“এটা কি তোমার প্রথম টপিক?”
-“হু।”
-“সেকেন্ড টপিক কী?”
-“ভাইয়া যে অপরাধটা করেছে, তার জন্য তুমি যেকোনো ডিসিশানে যেতে পারো। কিন্তু আমাকে আর মা’কে তুমি কখনো তোমার দল থেকে বের করে দিও না প্লিজ।”
-“আমি তো কোনো দলই করছিনা শাকিব। বরং সবাইকে নিয়ে একটা দল হয়ে আমি সবসময় থাকবার চেষ্টা করেছি৷ তোমার ভাইয়াই বরং দলছুট হয়ে বেরিয়ে গেছে। তার হয়তো আমার দলে থাকাটা সহ্য হয়নি।
তোমার কি মনে হয়, মার্লিনা যা বলেছে বা যেভাবে বলেছে সেভাবে দেখলে তোমার ভাইয়ার কোনো দোষ নেই?”
-“ভাইয়াকে তুমি অন্ধের মতো ভালোবেসেছো, এক্ষেত্রে ভাইয়ার কোনটা দোষ, কোনটা দোষ নয়, তোমাদের সম্পর্কে একমাত্র তুমিই সবথেকে ভালো ঠিক করতে পারবে! আমি নই।”
-“এজ এ সিবলিং; তোমারও তো কোনো মতামত থাকতে পারে তাই না?”
-“আমার মতামত যদি বলো, একজন মানুষ হিসেবে আমি এই মুহূর্তে খুব স্ট্রংলি ভাইয়ার বিপক্ষে দাঁড়াচ্ছি। অন্তত সম্পর্কের হিসেবে গেলে, ভাইয়ার কোনো ঠাঁই-ই নেই তোমার কাছে। থাকতেই পারে না।”
-“এত বিরোধিতাও করো না শাকিব। তোমার ভাইয়া কিন্তু আমায় খুব ভালোবাসে। হয়তো আমার থেকেও বেশি বাসে। তোমার ভাইয়ার সেই খুব ভালোবাসার একটা ছোট্ট উদাহরণ কি তুমি শুনতে চাও?”
-“বলো শুনি।”
-“আমাদের বিয়ের পর আমরা একবার কলকাতা বেড়াতে গিয়েছিলাম মনে আছে? তোমার ভাইয়ার টার্গেট সবধরনের বাঙালি খাবার সে টেস্ট করবে।
আমরা প্রায় দু-সপ্তাহ কলকাতার সব অলিগলি ঘুরে ঘুরে খাবার খেলাম। সেখানে একটা রেস্টুরেন্ট পাওয়া গেল, যে রেস্টুরেন্টের প্রায় সব খাবারই আমার এত পছন্দ হলো যে, আমি ঠিক করে ফেললাম ওদের সব প্রিপারেশন আমি লিখে নিয়ে আসবো। ওরা ওদের রান্নার স্পেশাল ট্রিক এমনি আমাদের দিতে চাইলো না। তোমার ভাইয়া করলো কি জানো? বাংলাদেশে ফিরে এসে একজন বাবুর্চি খুঁজে বের করলো। তাকে ওই রেস্টুরেন্টের সাথে কথা বলে একটা বিশাল এমাউন্টের টাকা ব্যয় করে রান্না শিখতে পাঠালো। শুধু আমার জন্য তোমার ভাইয়া ওদের সব রান্না একজন বাবুর্চিকে শিখিয়ে নিয়ে এলো।”
-“তোমার অফিসের আব্বাস কি সেই বাবুর্চি?”
-“তোমাকে একশোতে একশো নম্বর দেওয়া হলো।”
-“এক্ষুণি নাম্বার দিও না ভাবী। আব্বাস সংক্রান্ত আরও কথা বাকি আছে।”
-“মানে?”
লায়লা আহত দৃষ্টিতে তাকালো। তার ভেতর ভেঙে যাচ্ছে, অপ্রিয় সত্যের মুখোমুখি হয়ে৷ একটা মানুষকে ভালোবেসেছিল বলেই কি তার এই পৃথিবীর সবটুকু দুঃখ পাওনা হয়ে গেল? শুধু সুখের জন্য একজন সাথীর উপর নির্ভর করতে হয়েছিল বলেই কি সে এত বড় ট্র্যাপে পড়ে গেল?
-“আমার ধারণা যদি খুব ভুল না হয় আব্বাসকে ভাইয়া তোমার খাবার দাবারের নয় বরং অফিসে ভাইয়ার স্পাই হিসেবে রেখেছে। অফিসে সর্বক্ষণ তুমি কী করছো, কী কথা বলছো, কার সাথে দেখা করছো, তোমার অফিস কলিগদের সাথে কেমন সম্পর্ক তা়র সব খবর আব্বাসই ভাইয়াকে দেয়। অথচ তোমাকে বুঝানো হলো, শুধু তুমি খেতে ভালোবাসো বলে, আব্বাস তোমার খাবার তৈরি করবে। ভালোবাসার আদলে নিয়ন্ত্রণের কী সুন্দর একটা ট্রিক! তুমি হয়তো খেয়াল করোনি ভাবী, আমি তোমার অফিসে গেলেই আব্বাসের জন্য কিছু একটা উপহার নিয়ে যেতাম। শুধু গিফটের প্যাকেট খোলবার অযুহাতে সে যাতে আমাদের মাঝে বলা কথাগুলো শুনতে না পায়!”
-“আমি ভেবেছিলাম তোমার ভাইয়া আমাকে বেশি ভালোবেসে ইনসিকিউরিটিতে ভুগে। ধরে নিয়েছি ভালোবাসা বেশি বলেই যত্ন বেশি।”
-“একজনকে শুধু ভালোবাসবে বলেই যদি দিনের পর দিন তার শাসনে শোষিত হতে হয় তাহলে সেটা কি আর ভালোবাসার পর্যায়ে থাকে? অন্তত এমন ভালোবাসাকে আমি ভালোবাসা মনে করি না।”
-“তোমাকে বলেছিলাম না শাকিব, মানুষ হিসেবে আমি এক নম্বর না হলেও প্রেমিকা হিসেবে আমি কিন্তু সবসময় এক নম্বর হবার চেষ্টা করেছি। সেই চেষ্টার অংশ হিসেবে আমি সবসময় সব পরীক্ষায় ফুল মার্কস পেতে চেষ্টা করেছি।”
-“ফুল মার্কস কেন পেতেই হবে?”
-“সেই তো। কেন পেতে হবে? তাই এবার আর ফুল মার্কস পাবার চেষ্টা করিনি শাকিব। মার্লিনা যেদিন ফোন করলো আমায়, সেদিন আমি তোমার ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, ওর মার্লিনা নামে কোনো বন্ধু আছে কিনা। ও অনেকক্ষণ ভেবে বললো নেই। আমি মেয়েটির সমস্ত ডিটেল নিলাম। মার্লিনা তার নাম বদলে ফোন করেছে। মার্লিনার আসল নাম লিডিয়া। তার মানে মার্লিনা জানতো, আমি ওর কথা হাসিবকে জিজ্ঞেস করবো। আরেকটা মজার ব্যাপার কি জানো?”
-“কী?”
লায়লা ওর বিছানার পাশে রাখা পানির গ্লাসটা শাকিবের দিকে বাড়িয়ে দিলো।
-“এক চুমুকে গলাটা ভিজিয়ে নাও শাকিব। এরপর আমি যে কথাটা বলবো, হয়তো তোমার গলা শুকিয়ে দম আটকে যাবে।”
শাকিব পানির গ্লাসটা হাতে নিলো।
-“এই যে মার্লিনার আমাকে ফোন করা, রেয়’কে নিয়ে দেশে আসা, হাসিবের অসুস্থতার কথাটা আমায় জানানো, এই পুরো ব্যাপারটা মানে এই সিন ক্রিয়েশনটার পেছনে কে আছে জানো? তোমার ভাইয়া।”
শাকিব বেশ অনেকক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। কিছুক্ষণের জন্য তার মাথার ভেতরটা একদম ফাঁকা হয়ে গেল।
-“তোমার তৃতীয় কথাটা কি বলা হয়ে গেছে শাকিব?”
শাকিবের হুঁশ এলো তখনি।
-“আমি ডক্টর আদিত্যকে বাসায় ডেকেছি। তিনি নিচে বসে অপেক্ষা করছেন, তুমি প্লিজ একটু ডাক্তারের সাথে কথা বলো ভাবী। তোমার শরীর ভীষণ খারাপ করে গেছে। প্লিজ!”
লায়লা চোখ মুছলো।
-“তুমি ডাক্তার সাহেবকে বরং এখানে পাঠিয়ে দাও আমি কথা বলছি। আর হ্যাঁ মিমিকে বাড়ি আনার ব্যবস্থা করো।”
-“থ্যাংক ইউ ভাবী।”
শাকিব দরজায় আসতে আসতে লায়লা পিছু ডাকলো৷
-“শাকিব, হাসিবের অসুখটা সারাতে একটা মেজর সার্জারি করতে হবে। ফুসফুস ট্রান্সপ্লান্টের একটা ব্যাপার আছে। আমি ওর ডক্টরের সাথে কথা বলেছি। ওদের মেডিকেল টিম সব রেডী করছে৷ আমার প্রেমিক হিসেবে বাঁচবার অধিকার আমি হাসিবকে হয়তো আর দিবো না, কিন্তু একজন মানুষ হিসেবে ওর বেঁচে থাকার পূর্ণ অধিকার আছে। সেই পূর্ণ অধিকার টুকু নিশ্চিত করতে আশা করি তুমি আন্তরিকভাবে সাহায্য করবে।
আরেকটা কথা কলি আমায় ফোন করেছিল, সে রফিককে বিয়ে করে নিয়েছে। মা সেই ঘটনাটা এখনো জানেননি।”
-“বলো কী?”
-“দুজনে হাসপাতাল থেকে ফিরেছে বিয়ে করে। তুমি মায়ের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলো। মা ঘটনাটা কিভাবে নেন। কে জানে?”

লায়লার ঘর থেকে বেরিয়ে শাকিব মায়ের ঘরে এলো। মায়ের সাথে কলির ব্যাপারটা আলোচনা করা জরুরি।
মায়ের ঘরে যাবার আগে শাকিবের কলির সাথে দেখা হলো। সে দরজায় ওৎ পেতে ছিল। শাকিবকে দেখা মাত্রই সে শাকিবের পায়ের উপর ঝাপিয়ে পরলো। তার পরনে লাল শাড়ি। মাথায় বউদের মতো করে ওড়না। এই কিছুক্ষণের মাঝে সে বিয়ের শাড়ি যোগাড় করলো কী করে?
-“মামাগো, ক্ষমা দেন। এমন ভুল আর হইবো না।রফিক ভাইয়ের এমন জীবন মরণ অবস্থা, বিয়া না কইরা তো আমার হাতে উপায় ছিল না। বাড়িতে এত বড় চুরি হইছে, এইজন্য আপনাদের জানাই নাই। ও মামা ক্ষমা দেন।”
-“পা ছাড় কলি। আমি মায়ের সাথে কথা বলি আগে।”
-“মামা গো মানুষটা বিছানায় পড়া। গা পুইড়া যাইতেছে জ্বরে, সেবা করবো সেইজন্য রাইতে পাশে থাকা লাগবো। বিয়া শাদি ছাড়া আমি জোয়ান মেয়ে তো তার ঘরে থাকতে পারি না। এখন যদি বিয়ার জন্য চাকরিই না থাকে কি খাইয়া বাঁচবো মামা?”
কলি বিলাপের স্বরে কা়ঁদতে লাগলো।
-“তোর চাকরি যাবে না কলি। আমি কথা বলছি তো মায়ের সাথে৷”
-“ওয়াদা করেন মামা!”
-“ওয়াদা করতে হবে না কলি।”
-“আপনে ওয়াদা না করলে আমি পা ছাড়ুম না।”
-“ওয়াদা করলাম!”
কলি উঠে দাঁড়ালো। চোখ মুছে আবার বসলো৷ শাকিবের পা ছুঁয়ে কদমবুসি করলো।
-“মামা গো, মানুষটার থুতায় সাতটা সিলাই লাগছে।
থুতার জন্য মুখ খুইলা কথা পর্যন্ত বলতে পারে নাই। কবুল বলছে ইশারায়। দুঃখ একটাই বিয়ার দিনেও মানুষটা পাঞ্জাবি পায়জামা পরে নাই৷ ব্যান্ডেজ নিয়া শোয়া।”

শাকিব মায়ের ঘরে এসে চমকে গেল। এইটুকু সময়ের মধ্যে মায়ের শরীর আরও খারাপ করেছে। তাঁর শ্বাসকষ্ট উঠে আছে। তিনি অক্সিজেন মাস্ক মুখে দিয়ে শুয়ে আছেন। শাকিবকে দেখে তিনি হাত ইশারায় কাছে ডাকলেন। শাকিব পাশে গিয়ে বসলো। এই মুহূর্তে কলির কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। শাকিব নিজের মনে ছক কষতে লাগলো। কলির ব্যাপারটা সে আপাতত নিজেই সামলাবে।
সুলতানা মুখ থেকে অক্সিজেন মাস্ক খুলে উঠে বসলেন। তার চোখ লাল হয়ে আছে। তিনি শ্বাস নিচ্ছেন প্রচন্ড যুদ্ধ করে৷ প্রতিবার নিঃশ্বাস নেওয়ার সময়ে তার চোখ বড় হয়ে যাচ্ছে।
-“মা তুমি অক্সিজেন মাস্কটা খুললে কেন? প্লিজ এটা পরো। তোমার কষ্ট হচ্ছে।”
শাকিব অক্সিজেন মাস্কটা হাতে নিতেই সুলতানা সেটা সরিয়ে দিলেন।
-“তুই নাকি ফটোগ্রাফি পড়তে দেশের বাইরে যাচ্ছিস?”
শাকিব চমকে উঠলো।
-“কে বললো তোমায়?”
-“তোর বন্ধু তফাজ্জল ফোন করেছিল, ওই বললো।”
-“আপাতত যাওয়ার কথা ভাবছি না মা। ভাবীর শরীর খারাপ। ভাবীর শরীর আগে ঠিক হোক। তারপর দেখি।”
-“একটু পরপর কলির কান্নাকাটির আওয়াজ পাচ্ছি। কী হয়েছে?”
-“বেচারি রফিককে বিয়ে করে নিয়েছে। বিকেলে রফিকের একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়। হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে বিয়ে করেছে। এখন দু’জনেই চাকরি খোয়ানোর ভয়ে আছে।”
-“বলিস কী? আমার তো মনে হচ্ছো দু’টো অনেক আগে থেকেই এই পরিকল্পনা করেছে।”
সুলতানা বিড়বিড় করতে লাগলেন।
-“আমার বাড়িতে থেকে আমাকে না জানিয়ে বিয়ে৷ এত সাহস!”
-“মা আমি কিন্তু ওদের বিয়ের কোনো খারাপ দিক দেখছি না। দুটো মানুষ ঠিক করেছে বিয়ে করবে। ব্যস করে নিয়েছে।”
-“তোর কাছে বিয়ে এত সোজা?”
-“আমার কাছে বিয়ে এর থেকেও অনেক বেশি সোজা মা।”
সুলতানা রেগে গেলেন।
-“কী রকম সোজা শুনি, ব্যাখ্যা কর। পরিবার পরিজনকে না জানিয়ে, আত্নীয়স্বজনের দোয়া না নিয়ে একা একা বিয়ে করা। সারাজীবনের জন্য একজনকে বেছে নিয়ে নেওয়া। এত বড় দুঃসাহস!”
“এতে দুঃসাহসের কিচ্ছু নেই। শুধু দরকার মনের সায়। ওদের বিয়ে নিয়ে এত আপসেট হবে না প্লিজ৷ এটা খুবই ছোট্ট একটা ব্যাপার।”
শাকিব যত্ন করে অক্সিজেন মাস্কটা মা’কে পরিয়ে দিলো। বালিশ ঠিক করে বিছানায় শুইয়ে দিলো।
-“এই মুহূর্তে তুমি কিচ্ছু নিয়ে ভেবো না। চুপ করে বিশ্রাম নাও। আমি যাই মা।”
যাই বলেও শাকিব মায়ের বিছানার পাশেই বসে রইলো। আলতো করে হাত বুলাতে লাগলো মায়ের মাথায়। মায়ের কপালে চুমু খেতে ইচ্ছে করছে তার। জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে করছে, মা আমি তোমার পেটের ভেতরে আবার ঢুকে যেতে চাই মা। বাইরের পৃথিবীতে আমার দম আটকে আসছে মা।
সুলতানা অক্সিজেন মাস্ক সরিয়ে কথা বললেন,
-“তুই কি আমায় কিছু বলতে এসেছিলি শাকিব?”
শাকিব চোখ মুছলো। মিমির মুখটা বারবার মনে পড়ছে। লায়লা ভাবীর জীবনের এত বড় ঝড় কি মিমিকেও ছুঁয়ে যাবে? মিমিও কি কষ্ট পাবে? আর রেয়? রেয়’র কী হবে? একটা মানুষ এতগুলো মানুষের জীবনে কী করে এত বড় একটা ঝড় তুলে দিলো। কী করে?
-“না মা, এমনি এসেছিলাম।”
সুলতানা শাকিবের মাথায় হাত রাখলেন।
-“আমায় সব বলতে তোর এত দ্বিধা কিসের, বলতো শাকিব?”
-“কোনো দ্বিধা নেই মা। যখন বলার সময় হবে আমি সব তোমাকে বলবো।”
সুলতানা অক্সিজেন মাস্ক খুলে আবারও উঠে বসলেন। শাকিবের মাথাটা এগিয়ে এনে গভীর স্নেহে চুমু খেলেন।
-“লায়লার ঘরে গিয়েছিলি?”
-“হু।”
-“বউমা ডাক্তারের সাথে কথা বলতে রাজি হয়েছে?”
-“হু।”
সুলতানা আরাম করে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। চোখ বন্ধ করে বললেন,
-“মানুষ হত্যা মহাপাপ না হলে তোর ভাইকে আমি নিজের হাতে জবাই দিতাম। বউমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা! জবাই যেহেতু দিতে পারবো না, তাই অন্য ব্যবস্থা করবো। এই কুপুত্র আমি চাই না৷ সে মরে যাক।”
শাকিব হা করে তাকিয়ে রইলো মায়ের দিকে। মা জানে সব!
-“এত বড় অন্যায়! এত বড় অন্যায় করে সে বেঁচে আছে কী করে? তার পাপ পৃথিবী সইছে কী করে?”
-“ভাইয়া অসুস্থ মা। অসুখটা চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় দুরারোগ্য। ভাইয়ার চিকিৎসা চলছে। লায়লা ভাবী সবটা দেখছেন।”
শাকিব কথা শেষ করতে পারলো না। সুলতানা এর আগেই ভয়ানক ভাবে হাঁপাতে লাগলেন।
-“তুই ওই ছেলের কোনো সংবাদ আমায় দিবি না। আমার কোনো বড় ছেলে নেই। আমার কোনো বড় ছেলে নেই। আমার একটা বড় মেয়ে আছে। আমার বড় মেয়ের নাম লায়লা। আমার একমাত্র নাতনীর নাম মিমি। মিমি আমার সব…”
সুলতানা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। কান্নার হেঁচকিতে তার আবার প্রবল শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেল।
শাকিব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মা’কে।
-“মা তুমি শান্ত হও মা৷ শান্ত হও।”

কলি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে শাকিবের ঘরে। তার হাতে বাজারের থলে। থলে ভর্তি বাজার।
-“মামা আপনাদের জামাই বাজার কইরা আনছে।”
-“জামাইটা কে?”
-“আপনেরা তো আমারে এই বাড়ির মেয়ে বইলাই স্বীকার করেন। করেন না মামা? সেই হিসাবে গেলে মানুষটা তো এইবাড়ির জামাই। নতুন জামাই তো শ্বশুরবাড়িতে বাজার না কইরা পারে না। এইটা হইলো জামাই বাজার। মামা আজকে একটু পোলাও মাংস রান্ধি। হাজার হোক, বিয়ার বাড়ি। লোকজন নাই, আয়োজন নাই, তাই বইলা কি দুইটা ভালো মন্দ কিছু খাবো না? মামা আপনে চাইলে আপনার দুই চাইরজন বন্ধু বান্ধব নিয়া আসতে পারেন। বিয়ার দিনে দাওয়াত খাইলো।”
-“কলি তোর যা খুশি কর। এখন আমার সামনে থেকে যা। বিরক্ত লাগছে৷”
কলি ভীষণ আহত হয়ে রান্নাঘরে এলো। আজ তার বিয়ের দিন। অথচ এই বাড়িতে সবার মন আন্ধাইর। মানুষটা শখ কইরা এতগুলা বাজার সদাই করলো।
সে ভেবেছিলে আর কেউ না হোক, অন্তত ছোট মামা আগ্রহ করে বাজার দেখতে চাইবে। রান্না খাবে।
মানুষটা এত বড় একটা কাতলা মাছ আনলো, কেউ দেখলো না। কলি মন খারাপ করে রান্না শুরু করলো। কেউ না খেলে না খাক, আজ তার জীবনের এত বড় দিন, আজ তো সে ভালো আয়োজন না করে পারে না।
রফিক দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে।
-“কী করো কলি? এখনো রান্ধা বসাও নাই। ক্ষিধায় তো আমার মরণদশা।”
-“বসাইতেছি! আমার তো আর মিশিংয়ের হাত না। যে মিশিং টিপ দিবো আর সব রেডী। মাছ মাংসের মসলার যোগাড় যন্ত্র আছে। আগে যোগাড় যন্ত্র শেষ করি।”
-“কলি কোনো বাজার কিন্তু ফিরিজে তুইল্লা রাখবা না। সব রাইন্ধা ফেলবা। জামাই বাজার বাসি করতে নাই। এতে বিয়ার সুখ কইম্মা যায়।”
-“যা আনছেন সবই রানবো৷ রাইন্ধা আপনের মাথায় দিবো। আপনে তো রাইক্ষস।”
-“এত রাগ করো কেন কলি? আমারে কী করতে হইবো কও? তোমারে সাহাইয্য করি।”
-“আমারে সাহাইয্য করতে হইবো না। এমনিতেই থুতা কাইট্টা আমারে বিরাট সাহাইয্য করছেন। আর লাগবো না। যান তো চোখের সামনে থাইকা যান। আপনেরে দেখতে থুতাকাডা বান্দরের মতো লাগতেছে। থুতাকাডা বান্দর নিয়া এখন জীবন কেমনে কাডামু সেই চিন্তায় জীবন শেষ।”
-“ও কলি বাইরে তো তুমুল বৃষ্টি নামছে। বিয়ার রাইতে বৃষ্টি হইলে কী হয়, জানো?”
-“কী হয়?”
-“এখন বলবো না, আগে রান্ধাবাড়া শেষ করো, তারপর বলবো।”
কলি বিরক্ত স্বরে বললো,
-“আপনের ঢং দেখলে বাঁচি না। থুতাকাডা বান্দরে ঢং! যান সামনে থাইকা যান।”
রফিক সামনে থেকল গেল না। সে কলির পেছন পেছন ঘুরতে লাগলো রান্নাঘরেই৷

ডক্টর আদিত্য ফোন করেছেন।
-“হ্যালো শাকিব সাহেব।”
-“জি বলুন।”
-“মিসেস লায়লার সাথে কথা বলে আমি ভীষণ চিন্তিত বোধ করছি৷ উনি মানসিকভাবে প্রচন্ড ভেঙ্গে পড়েছেন।উনার মধ্যে আমি সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি দেখতে পাচ্ছি প্রবলভাবে। উনার খুব দ্রুত কিছু সেশন করা উচিত৷ হ্যালো শাকিব সাহেব… আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন? হ্যালো…”
শাকিব দ্রুত বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। কিছুক্ষণ বাড়ির বাইরে থাকা দরকার। বাড়িতে কেমন দম বন্ধ হয়ে আসছে। বাইরে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পরছে। শাকিব বাইক স্টার্ট দিলো। বৃষ্টির তোড় ক্রমেই বাড়ছে। শাকিব হ্যালমেটটা মাথা থেকে খুলে রাখলো। প্রবল বৃষ্টিতে তার চোখের পাতা বারবার বন্ধ হয়ে আসছে, তবু সে স্বস্তি পাচ্ছে। আচ্ছা, এমন এক পশলা সুখের বৃষ্টি এসে কি লায়লা ভাবীকে ভিজিয়ে দিতে পারে না?

চলবে

#তৃধাআনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here