#ধারাবাহিকগল্প
#সামাজিক থ্রিলার
#চোরাবালি
পর্ব-তিন
মাহবুবা বিথী
বনানীতে সায়ান চৌধুরীদের ডুপ্লেক্স বাড়ি। বেশ আলিশান আধুনিক কায়দায় তৈরী। বাড়ির নাম জিন্নাতমহল। সামনে বাগান আর তাতে নানা রঙের ফুল গাছ লাগানো হয়েছে।একপাশে গোলাপ বাগান। বাগানের মাঝখান দিয়ে টাইলস বিছানো রাস্তা। বাড়ির গেটের কাছে রাস্তা দুভাগ হয়ে মাঝখানে ছোটো একটা জলের ফোয়ারা। রাস্তা থেকে বাড়িটা দেখতে দারুণ লাগে।জলের কলকল শব্দটাও চমৎকার।সায়ান এয়ারপোর্ট থেকে রুবিকে নিয়ে বাড়ি পৌছাতে রাত একটা বেজে গেলো। বাসায় পৌছে সায়ান সোজা দোতলায় স্টাডি রুমে ঢুকে দরজাটা সশব্দে লাগিয়ে দিলো। রুবি অবাক হয়ে সায়ানকে দেখতে লাগলো। ছ,মাস পর রুবি দেশে ফিরেছে। ওর যেন কোনো ফিলিংস নেই। বাচ্চারা সাথে থাকলে সায়ান তাও একটু রুবির সাথে লোকদেখানো কথাবার্তা বলে। আর ওরা না থাকলে এমন ভাব করে রুবিকে যেন চিনেই না। রুবি বেড রুমে গিয়ে পোশাক চেঞ্জ করে ফ্রেস হয়ে সায়ানের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। রহিমা খালা এসে রুবিকে বললো,
—-ম্যাডাম টেবিলে খাবার দিবো?
—-না রাতে কিছু খাবো না।
রহিমার মা চলে যাওয়ার পর রুমি দরজা লক করে শুয়ে পড়লো।
রুবি জানে ওর এই অপেক্ষা করার কোনো মানে নেই। সায়ান আজ সারারাত স্টাডিরুমে কাটিয়ে দিবে। রুবি এটাও জানে ফোনে যে প্রেমের বন্যা বইয়ে দিয়েছিলো তখন নিশ্চয় ওর কোনো গার্লফ্রেন্ড ওর পাশে ছিলো। লোক দেখানো সম্পর্কটা সায়ান ভালই মেইনটেন করতে পারে। রুবি বুঝে পায় না ওর মধ্যে কিসের ঘাটতি রয়েছে। ও ডাকসাইটে সুন্দরী ছিলো। অল্প বয়সে মডেলিং করেছে। ঢাকা ইউনির্ভাসিটি থেকে সোসিওলজিতে মাস্টার্স করেছে। রুবির মাঝে মাঝে মনে হয় সায়ান ওকে নিয়ে কমপ্লেক্সে ভোগে। কারণ সায়ান কোনরকমে ডিগ্রী পাশ করেছে। টাকা থাকলে যা হয়। বন্ধু বান্ধব ক্লাব পার্টি এসব নিয়ে সায়ান খুব ব্যস্ত থাকতো। যার কারনে পড়াশোনা ঠিকমতো হয়নি। সবাই আবার এক রকম হয় না। সায়ানের ভাই রায়ান বুয়েট থেকে মেকানিক্যাল ইন্জিনিয়ার পাশ করে আমেরিকার ইলিনয় ইউনির্ভাসিটিতে পিএইচডি কমপ্লিট করে ওখানেই প্রফেসর হিসাবে জয়েন করেছে। রুবিকে ওর শাশুড়ী মা পছন্দ করে ছেলের বউ করেছেন। রুবির মা সায়ানের মায়ের বাল্যকালের বান্ধবী। ভেবেছিলো সুন্দরী বউ আনলে সায়ান ঘর মুখো হবে। কিন্তু যার হাজার ফুলের মধু খেয়ে অভ্যাস নির্দিষ্ট এক ফুলেতে তার তৃপ্তি মিটে না। কারণ ওর ঐ বোধ বহু আগেই নষ্ট হয়ে গেছে। তেত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবনে ওকে যে কত গার্লফ্রেন্ড বদলাতে দেখেছে তার হিসাব নাই। এজন্য এটা নিয়ে রুবি কোনো প্যারা নিতো না। ও ওর ছেলেমেয়েদের মাঝে নিজের শান্তি খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করে। সায়ানকে এসব পথ থেকে ফেরানোর চেষ্টা যে করেনি তা ঠিক নয়। এসব নিয়ে যখনি রুবি সায়ানকে কিছু বলে, তখন সায়ান খুব ক্রিটিসাইজ করে বলে,
—–তুমি মিডিলক্লাস মেন্টালিটি থেকে এখনও বের হতে পারোনি। হাইসোসাইটিতে এটা কোনো ব্যাপার না।
রুবি আসলেই মধ্যবিত্ত ঘরের মানুষ। তাই সায়ানের এই বাজে অভ্যাসগুলোকে এলাউ করতে পারে না। নীতিতে বাঁধে। আবার সংসার ভেঙ্গেও ছেলেমেয়েদের জন্য বের হয়ে যেতে পারে না। আবার ওর মা বলে মানিয়ে নিতে। এতো প্যারা আর নিতে ভাল লাগে না। তাই এসব নিয়ে মাথা ঘামানো বন্ধ করে দিয়েছিলো। কিন্তু সেদিন ফেসবুকে ওর অফিসের পার্সোনাল সেক্রেটারীর সাথে খুব ঘনিষ্টভাবে থাকা অবস্থায় একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছিলো। মেয়েটার নাম জুলি। যদিও সাথে সাথে ওটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কিন্তু রুবির চোখ এড়াতে পারেনি। পরে খবর নিয়ে জেনেছে এই মেয়ের সাথে সায়ান দশ বছর ধরে সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে। এটাই রুবির এখন মাথা ব্যথার কারণ। এইজন্য রুবি এবার একাই এসেছে। ছেলেমেয়েদের সামনে বাবার কুকীর্তি নিয়ে রুবি কথা বলতে চায় না। এবার শাশুড়ী মা আর সায়ানের সাথে ওর একটা বোঝাপড়া করতে হবে।
সকালের মিষ্টি রোদ পাখির কিচিরমিচির শব্দ ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়ায় রুবির ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সকাল আটটা বাজে। আজকে রাতে দেরী করে ঘুমাতে গিয়ে ফজরের নামাজ ক্বাজা হয়ে গেলো। দরজায় নক করছে। রুবি দরজা খুলে দেখে রহিমার মা কফির মগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। কফির মগটা রুবির হাতে দিয়ে রহিমার মা বললো,
—–বড় ম্যাডাম আপনারে ডাকছে।
—–তুমি টেবিলে ব্রেকফাস্ট দাও। আমি আসছি
রহিমার মা নীচে চলে যাবার পর রুবি ফ্রেস হয়ে টেবিলে আসলো।
শাশুড়ী জিনাতুন্নেছার বয়স সত্তুরের উর্ধে। ইংরেজী সাহিত্যে ঢাকা ভার্সিটি থেকে মাস্টার্স কমপ্লিট করেছেন। এইচএসসি পাশ করে উনার বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পরে ঘর সংসার সামলিয়ে পড়াশোনা শেষ করেছেন। স্বামী রিয়াদ চৌধুরী মারা যাবার পর দশ বছর ধরে ব্যবসার দেখাশোনা করছেন। যদিও কাগজে কলমে সায়ান দায়িত্বে আছে কিন্তু প্রধানত জিনাতুন্নেছাই ব্যবসার দেখভাল করেন। সায়ানের দিকেও উনার নজর রাখতে হয়। বাপের আহ্লাদের ছেলেটাকে উনি ঠিকমত মানুষ করতে পারেননি। এটা নিয়ে উনি অনেক যন্ত্রণায় থাকেন। ব্রেকফাস্ট করে রুবি লিভিংরুমে গিয়ে শাশুড়ীমাকে বললো,
— মা আমাকে ডেকেছেন?
—-হ্যা,কাল রাত্রিতে আসতে তোমাদের অনেক রাত হয়েছিলো?
—-তা একটু হয়েছিলো।
—–আমার দাদুভাইরা কেমন আছে।
—–ভাল আছে মা। ওদের পরীক্ষা চলছে। মা আপনাকে আমার কিছু বলার আছে।
—–আমি জানি তুমি আমাকে কি বলতে চাও। ঐ ব্যাপারটা তুমি আমার হাতে ছেড়ে দাও।
—–মা আমি আর সায়ানের এসব কার্যকলাপ নিতে পারছি না। ছেলে মেয়েরা এখন বড় হচ্ছে। সায়ান এখনও এসব নোংরামি চালিয়ে যায়। বিয়ের পর থেকে সায়ানের এসব ফেস করতে করতে আমি ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি। মা টাকা কি জীবনের সব। আরও অনেকের মতো আমার তো ইচ্ছে হয় স্বামীর ভালবাসা পেতে। বিয়ের পর কিছুদিন ও ঘরমুখো ছিলো। রিয়ার জন্মের পর থেকে ওর কাছে আমার গুরুত্ব নেই। আমার চাওয়া পাওয়ার কোনো মুল্য নেই। কিছু বললেই বলে টাকা দিয়ে তোমায় মুড়িয়ে রেখেছি আর কি চাও? অথচ অফিসের ঐ মেয়েটার সাথে নাকি দশ বছর ধরে রিলেশনে আছে।
——আমি তো বললাম তুমি এই বিষয়টা আমার উপর ছেড়ে দাও। ঐ মেয়েকে আমি দেখে নিবো।
—–মা তার আগে আপনার ছেলেকে শোধরান। পরের মেয়ের দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমার স্কুল মাস্টার বাবা বলতেন আগে নিজের ঘরকে ঠিক কর।
—-তুমি মাথা গরম কর না রুবি। জীবনে কিছু জিনিস খুব বুদ্ধি সহকারে হ্যান্ডেল করতে হয়। যাতে সাপও মরে লাটিও না ভাঙ্গে।
বিকাল চারটার দিকে জিনাতুন্নেছা অফিসের পথে পা বাড়ালেন।
চলবে