#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-১০)
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

বাহিরে ভারি বর্ষণ হচ্ছে তার সাথে মেহজার চোখেও নোনতা পানির জোয়ার বইছে। ইরফানকে নিয়ে কত কিছুই না সে ভেবে ফেলে কিন্তু পরমুহূর্তেই তাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করে ইরফান সব নষ্ট করে দেয়। এমন অযাচিত সম্পর্ক কয়জনের পক্ষে বহন করা সম্ভব! ইরফান যেমন সুদর্শন, তেমনি উচ্চশিক্ষিত, নাম করা ব্যবসায়ী এবং বড় পর্যায়ের রাজনীতিবীদ। তার মতো মানুষের মেট্রিক পাশ আর তার থেকেও ছোট একটা বউয়ের সাথে যায় নাকি! একদমই না। আহামরি সৌন্দর্য বলতে গায়ের রং আর লম্বা দেহের গঠন। এছাড়া তার কী আছে? রূপ কোনো ব্যাপার না আজকাল। এখন তোমার শিক্ষাগত যোগ্যতা আর তোমার স্টাইল, ফ্যাশনের উপর তোমাকে বিচার বিবেচনা করা হয়। রূপটা এখন অবশনাল বলা চলে। রূপ দিয়ে চোখের সাধই পূরণ হয় এটা দিয়ে আর কিছুই করা যায়না। গুণ আর যোগ্যতাটাই আসল। যা মেহজার নেই।

মেহজা বৃষ্টির পানে চেয়ে গান ধরে

ভেজা সন্ধ্যা, অঝোর বৃষ্টি
দূর আকাশে মেঘের প্রতিধ্বনি,
বাদলে ঘিরেছে আকাশ
বইছে বাতাস!

আড়ালে দাঁড়িয়ে তুমি আর আমি,
হয়নি বলা কোনো কথা
শুধু হয়েছে অনুভূতি
হয়নি বলা কোনো কথা শুধু হয়েছে অনুভূতি!

“কেমন অনুভূতি হয়েছে তোমার মেহজা?”

হঠাৎ একটি গম্ভীর পুরুষালী কন্ঠে গানটি গলায় আটকে যায়। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটির দিকে তাঁকাতেও তার ঘৃণা হচ্ছে। এমন লোকের সাথে সে কখনোই কথা বলতে চাইবেনা যারা অনুভূতিদের মজা উঁড়ায়। এরা নিজে তো কখনো প্রেমের দহনে পুঁড়েনি তাই অন্যদের দহনে এদের হাসি পায়, এরা মজা নেয়। এমন মানুষকে দেখলে অবশ্যই অনুভূতির প্রকাশ করা যাবেনা। একদমই যাবেনা। অনুভূতি গুলো লাভার মতো গড়িয়ে পড়তে চাইলে গিলে নিতে হবে। তাদের স্পষ্ট করে জানিয়ে দিতে হবে,
“খবরদার! যদি গড়িয়ে পড়িস তো একদম গিলে নিব। আর এমন ভাবে গিলবো যে কখনো বের হতেই পারবিনা। তখন বের হতে না পেরে যন্ত্রণায় ভুগবি। আর বলবি! ক্ষ্যামা কর গো! আমায় ক্ষ্যামা কর! আর কখনোই ইরফান নামক দূষিত পুরুষের সামনে আমি উগলে পড়বো না। এই আমি কথা দিলুম।” তার কাঠিন্য কথা গুলো শুনে তখন সত্যিই অনুভূতির দল এমনটাই প্রার্থনা করবে।
এমন উদ্ভট চিন্তা গুলো করে নিজেই হেসে উঠে মেহজা। তাতে ইরফান ঈষৎ অবাক হয়। ইরফান এবার মেহজার পাশে এসে দাঁড়ায় তারপর বলে,

“বললেনা তো, কেমন অনুভূতি হয়?”

“চরম থেকে চরম বাজে, বিশ্রী! ছিঃ এমন অনুভূতি মাথায় আসলেই গা ঘিন ঘিন করে।”

“তাই নাকি? তাহলে তো বেশ হয়! শোনো মেয়ে, এই বিশ্রী অনুভূতি গুলো কী আমায় নিয়ে হয়?”

“একদম না! আপনাকে নিয়ে আমার কিছুই হয়না। আপনাকে দেখলেও আমার আপনার প্রতি রাগ হয় আর ঘৃণা হয়।”

“রাগ করবে ভালো কথা। ঘৃণা করবে কী কারণে? আমি কী কোনো মহা অপরাধ করেছি নাকি!”

“না আপনি তো রাজ কার্য করেছেন।”

“দেখো! রাজকার্যের মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে সন্তান জন্ম দেওয়া মানে রাজ্যকে তাদের উত্তরসরী দেওয়া। আর সেই পক্রিয়াটা সম্পন্ন করতে হয় শারীরিক মিলনের মাধ্যমে। যেটি ছাড়া তা অসম্ভব। তাই আমিও সেই কার্য সম্পাদন করে আহনাফ মজিদ মানে আমার পিতা মহোদয়ের সুযোগ্য নাতি অথবা নাতনির জন্ম দিতে চাইছি। যে তার লাঠি হবে।”

মেহজার প্রচন্ড লজ্জা লাগছে। সেই কখন থেকে এই মিলন নামক জিনিসটি তাকে লজ্জায় ফেলে চলেছে। ছিঃ মেহজা সেখান থেকে চলে আসতে নিলে ইরফান তার হাত ধরে নেয়। নিজের বাম হাতের মুঠোয় হাতটি শক্ত করে ধরে মেহজার কোমরে হালকা চাপ দেয় তারপর মেহজার কপালে গাঢ় চুম্বন করে। মেহজাকে উদ্দেশ্য করে বলে

“বয়সে ছোট হলেও তুমি আমার বউ আর তার চেয়ে বড় কথা পার্ফেক্ট একটা বউ। তোমাকে আদর করতে আমার খুব ভালোই লাগে। গুলুমুলু বউ আমার! কচি বউ! এক্কেরে সেই রকম বউ! তুমি আস্ত একটা বউ বুঝলে।”

ইরফানের পাগলামি কথাতে মেহজা বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে পারেনা। ইরফানের মতোন গম্ভীর মানুষ এমন কথা বলতে পারে! ইয়া আল্লাহ্! এই লোক এসবও বলতে পারে? পারবে না-ই বা কেন? সে সবই পারে!

মেহজা কোনোরকমে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় ইরফানের বাহুডোর থেকে। রুমে আসতেই ইমার আগমন। মেহজাকে একবার ভালো করে দেখে একপ্রকার চেঁচিয়েই বলে উঠে,

“সামনে যে ক্লাস টেস্ট তা কি মনে আছে? টইটই করে ঘুরে বেড়ালে হবে? তোমার এখনও সংসারের বয়স হয়নি। এখন খাবার খেয়ে বাসায় যাবে। আজকে তো কলেজও যাওনি। নোটস কালেক্ট করেছো? তা কেন করবে! তোমার তো এখন শুধু সংসার করতে ইচ্ছে করছে। গিন্নি সাজা বের করবো আমি তোমার। আজ আমার রুমেই থাকবে। বাচ্চারা কেউ আসেনি তারা বাবার কাছেই আছে তাদের বাড়িতে। তাই আজ রাতে তোমাকে পড়াতে পারবো। খাবার খেয়ে বই নিয়ে আসতে আসতে দেরী হয়ে যাবে অনেক। না! এখনি যাও আর বই খাতা আর দরকারি সব নিয়ে আসো।”

এক দমে একটা মানুষ এত কথা কীভাবে বলতে পারে ভেবে পায়না মেহজা। ইমাকে দেখে যতটা না প্রফুল্লিত হয়েছিল ঠিক ততটাই আহত হয় তার কথা শুনে। এখন পড়তে হবে তাকে, এখন! সিরিয়াসলি! কিছু বলবে তার আগেই ইমার কঠিন মুখ দেখে সে সোজা তার বাসার উদ্দেশ্য যেতে থাকে। মেহজার প্রস্থান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল ইরফান। ইমা চোখের চশমাটা একটু মুছে নিয়ে আবার চোখে দিয়ে বলে

“পলক ফেল বাবু। চোখে জ্বালা করবে নয়তো।”

ইরফান বিব্রত বোধ করে। এই বোনটির সাথেই সে একদম ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে থাকে। গুণে গুণে আট বছরের বড় তার। তারউপর সবচেয়ে রাগী ও কঠিন মানুষ ইমা। তবে কাঠিন্য ভাবটা শুধুই মুখে থাকে মনের দিক দিয়ে তার ইমা আপু সবচেয়ে সরল। এই বোনটির সাথে ইরফান উঁচু গলায় কথা বলেনা, সে যা বলে চুপচাপ শুনে এবং পালন করে। যথেষ্ট সম্মান করে। অবশ্য সে সবাইকেই সম্মান দিয়ে কথা বলে শুধু ইকরা ছাড়া। ইকরা আর আর বয়সের পার্থক্য টেনে টুনে এক বছর। ইকরা হতে না হতেই সে তার মায়ের পেটে আসে। শেষ বারের মতো তার মা আর বাবা আশার আলো দেখে। সত্যিই একটি পুত্র হয়ে সে তাদের ধন্য করে। তাই বলে মেয়েরা যে তাদের কাছে কম তা নয়। ইকরা ইরফানের বড় হলেও সর্বকনিষ্ঠের বিশেষ আদরটি সে পায়। বাকিরাও নিজ নিজ জায়গায় সমান আদর, স্নেহ, ভালোবাসা পায়।

“কখন এসেছো তুমি?”

“আমি এসেছি ত্রিশ মিনিট ছাপ্পান্ন সেকেন্ড হয়েছে।”
ঘড়ির দিকে তাঁকিয়ে বলে ইমা। ইরফান হেসে বলে

“বাহ! সেকেন্ডের হিসেব ও করেছো দেখছি।”

“করবোনা কেন? আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত খুবই জরুরী। এক একটি সেকেন্ডও খুব বেশি দামী। সেকেন্ড বলে হেলাফেলা করলে হবে না ভাই।”

“বুঝেছি প্রফেসর ম্যাম!”

“বাবু! মায়ের সাথে নাকি এখনো কথা বলিস না?”

“ইচ্ছে করেনা।”

“কেন? এখন যখন মেহজার সাথে মানিয়ে নিচ্ছিস তাহলে আর জেদ ধরে রাখছিস কেন? মায়ের সাথে এমন অশোভন আচরণ তোকে আগে কখনো করতে দেখিনি আমি।”

“আগে মা আমাকে বিশ্বাস করতো। দুনিয়া উল্টে গেলেও আমার প্রতি তার বিশ্বাস থাকবে এমন ছিল আগে। কিন্তু সেদিন! ঐ নিকৃষ্ট হাসনার কথাতে নিজের ছেলেকে অবিশ্বাস করেছে! আমার কথা একটিবারও শুনেনি। বাবার কথা নাহয় বাদ দিলাম তিনি চাপে পড়ে আমাকে সেদিন শাস্তি দিয়েছে। সেখানেও হাসনাই মেহজার মাকে জানিয়ে বিষয়টা আরো ঘেটে দিয়েছিল তাই। মায়ের বুঝি তার ইয়াজিদকে সেদিন বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হয়েছে! নিয়তি বলেই মেহজাকে মেনে নিয়েছি। তবে সেটা এখন আগে নয়। সেদিনও মেহজা আমার কাছে ছোট বাচ্চা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। পরে যা হয়েছে তাতে আমিও ওকে….

“ওকে কী বাবু?”

“কিছুনা।”

ইরফানের দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাঁকায় ইমা। আপাতত তার ভাইটাকে যে করেই হোক মায়ের সাথে কথা বলাতে হবে। সেই চিন্তায় তার মাথা ব্যাথা হয়ে যাচ্ছে।

———————

“মেহজা হোস্টেলে থাকবি মানে? বাসা ছেড়ে হোস্টেলে থাকবি কেন?”

“আমার যাতায়াত সমস্যা হয়।”

“ও এই কথা! আচ্ছা এখন থেকে আমিই নাহয় অফিস যাওয়ার সময় তোকে আগে দিয়ে আসবো কলেজে।”

“না। আসলে আমি চাইছিনা এই খানে থাকতে।”

“কারণ কী?”

“ভাইয়া প্লিজ! আমার সমস্যা আছে তাই তো বলছি। তুমি যদি আমাকে এ ব্যাপারে সহায়তা না কর আমি সত্যিই দাদুর কাছে চলে যাবো। সেখান থেকে আমার কলেজের দুরুত্ব মাত্র দেড় মিনিটের তুমি জানো!”

“সত্যিই কী তুই ………..

“মিথ্যে হবে কেন? ভাইয়া আমি কিন্ত এবার রেগে যাচ্ছি।”

রেগে গিয়ে কান্না করে দেয় মেহজা। আনিতা শরাব মেয়ের দিকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। আজ তিনদিন হলো মেহজা ঘর থেকে বের হয়না, খাবার খায়না নিজের শরীরের বেহাল দশা করে ফেলেছে। মেয়ের এমন কান্ডে সবাই হতভম্ব। আনিতা শরাব কেঁদে কুটে কয়েক দফা করেছে। ইরফান নাকি গতকাল তার নিজস্ব বসুন্ধরার ফ্ল্যাটে চলে গেছে। সে থাকলে হয়তো একটু বোঝাতো মেহজাকে। তার স্বামীও গেছে চট্টগ্রামে জরুরী কাজে। এমন সময় মেহজা এসব করবে কে জানতো!

গার্লস হোস্টেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে রাদিফ। বোনটা মাত্রই হোস্টেলে চলে গেছে। নিজের উপরেই তার রাগ লাগছে। ছোট্ট বোনটি কতোটা কষ্ট পেয়েই না ঘর ছেড়েছে! রাদিফ খেয়াল করলো তার চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। আর কেউ তা দেখে ফেলার আগেই সে গাড়িতে গিয়ে বসে তারপর চোখটা মুছে নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে।

পেছনে কালো রঙের একটি বি এম ডব্লিউ ছিল। যার মধ্যে বসে নিকটিনের ধোঁয়া ছাড়ছিল ইরফান। মেহজা নামক নেশাটি খুব বেশিই জোরালো হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। কি করলে তা থেকে মুক্তি মিলবে!

#চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here