#গল্প
বৃষ্টি_ভেজা_অরণ্য
#পর্ব_৬
-শাতিল রাফিয়া

ইদানিং প্রচন্ড ব্যস্ততায় দিন কাটছে। অফিসে নতুন ক্লায়েন্ট আসবে। ডিলটা পেলে আমরা অনেক বড় একটা ডিল পাব। তাই দিনরাত সবাই খাটাখাটুনি করছে। ওভারটাইমও করছে। আমিও ওভারটাইম করি। তার কারণ অবশ্যই ক্লায়েন্ট আসা বা ডিল পাওয়া না।
কারণ প্রথম থেকেই দেখেছি যেই ওভারটাইম করুক না কেন অরণ্য তার জন্য পুরোটা সময় বসে সেও কাজ করে। মাঝেমধ্যে সে নিজেই ওভারটাইম করে। আর সে না করলেও অন্য যেই করুক তার জন্য সে বসে থাকে। কাজ করে। ওভারটাইমের সময় অফিসে মানুষজন কম থাকে। তখন বেশি সময় ধরে অরণ্যের রুমে কোন একটা কাজ নিয়ে থাকা যায়। তাকে বেশি করে কাছে পাওয়া যায়! তাই আজকাল ওভারটাইম করছি। আরেকটা খুব সূক্ষ্ম কারণ আছে। মা তার সেই বান্ধবীর আত্মীয়ের কোন স্বনামধন্য ছেলের সাথে আমার বিয়ের কথা চালাচ্ছেন। প্রায়ই আমাকে জিজ্ঞেস করেন আমি কবে টাইম দিতে পারব। আমি সাফ মানা করে দিয়েছি। এখন আমি বিয়ে করতে চাই না। এই নিয়ে বাসায় কয়েকদিন চরম অস্থিরতা চলেছে। আমি কান্নাকাটি করে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছিলাম। মা এরপর আর ঘাঁটাঘাঁটি করেননি আমাকে, কিন্তু তাই বলে হালও ছেড়ে দেননি। বেশি টাইম অফিসে কাটালে ওইসব কথা তোলারই সময় পাবেন না।

যাই হোক ওভারটাইমে ফিরে আসি। আজকাল ওভারটাইম করেও আগের মত ফিল পাচ্ছি না। কারণ অরণ্য ক্লায়েন্ট আসছে দেখে প্রতিটা ব্যাপার নিয়ে অত্যন্ত খুঁতখুঁত করছে। একটু থেকে একটু হলেও বিরক্তিতে চোখ কুঁচকাচ্ছে।

আজ সকালে নাস্তার টেবিলে মা আমাকে বললেন – আমার একটা কথা রাখবি?
– বিয়ে সংক্রান্ত কিছু হলে রাখব না। আর আমি ইদানিং খুব ব্যস্ত দেখতেই পাচ্ছ!
– তুই কি বিয়ে করবি না? অন্তত কথা বলে দেখ। কথা বললেই কি বিয়ে?
– মা প্লিজ!
মা বললেন – শোন বৃষ্টি ভাল করে বলছি কিন্তু তুই শুনছিস না। একদিন হুট করে ডেকে যখন সামনে নিয়ে যাব তখন মজা বুঝবি!

আমি খাওয়া বাদ দিয়ে অফিসে চলে এলাম। মেজাজটা সারাদিনের জন্য খারাপ হয়ে গেল। হুট করে ডেকে সামনে নিয়ে যাবে এটা কোন কথা হল!
আমি সেদিন একটা ফাইল দিয়ে আসার একটুপরেই অরণ্য আমাকে ডাকল।

আমাকে সে বলে- প্রতিদিন ফাইল দিয়ে জিজ্ঞেস করেন ঠিক আছে কি না! আর আজকে এত বড় দুইটা ভুল রেখে দিয়েছেন?

সে আমাকে দুইটা ভুল দেখাল। এমন কোন বড় ভুল না সেটা।

সে আবার বলে- এখন একটু ভাল করে চেক করুন।

আমার মেজাজটা তো এমনিতেই খারাপ হয়েই ছিল।

তাই বলে ফেললাম – আচ্ছা অরণ্য আপনার কি মনে হচ্ছে আমি ইচ্ছা করে ভুল রেখেছি?

অরণ্য একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল!

তারপর আবার বলে- ইচ্ছা করে কেউ ভুল করে না। আপনিও করেননি। কিন্তু ভুল যখন করেছেন সেটা স্বীকার করুন।

আমি ফাইল নিয়ে আবার ডেস্কে ফিরে এলাম। দুনিয়ার সবার ওপর রাগ উঠছে।

লাঞ্চ টাইমে আমি সোনিয়া আপুকে বললাম – আমি ক্লায়েন্ট মিটিং এ থাকব না আপু!
সোনিয়া অবাক হয়ে বলে- কেন?
– আমাকে তো থাকতে বলেনি!
– কে থাকতে বলেনি?
– মিস্টার অরণ্য!
সোনিয়া হেসে বলে- স্যার কি ডেকে ডেকে বলে দিবে নাকি? ক্লায়েন্টের সামনে সবাই থাকে। আর প্রেজেন্টেশন কে দিবে সেটাও এখনও ঠিক হয়নি!
আমি মুখ বাঁকিয়ে বললাম- আমাকে সিলেক্ট করবে না। নিশ্চিত থাকুন। আমার ভাল কাজেরই প্রশংসা পাই না! আবার প্রেজেন্টেশন!
সোনিয়া আপু হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করে – তুমি রেগে আছ কেন বল তো? তুমি কি স্যারকে পছন্দ কর?
আমি পানি খেতে গিয়ে বিষম খেয়ে বললাম – না..নো.. না তো!
– করলেও কোন সমস্যা নেই। আমাদের অফিসের অধিকাংশ মেয়ের উনার ওপর ক্রাশ আছে! স্যার কিন্তু জানেন। তবে স্যার কখনো এসব পাত্তা দেন না।
– আপনারও ক্রাশ?
– আরে না। আমার এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে! তোমার ক্রাশ?

আমি কিছু না বলে হাসলাম। অরণ্য আমার ক্রাশ না, আমার ভালবাসা!

সোনিয়া আপু বলে- তোমার ওপরেও অফিসের অনেক ছেলের ক্রাশ আছে বৃষ্টিলেখা।
– জানি। কিন্তু লাভ নেই। আমার মন অনেক আগেই অন্য কাউকে দিয়ে দিয়েছি!
– ওয়াও!

আমি আর কথা বাড়ালাম না। প্রেজেন্টেশনের দায়িত্ব দেওয়া হল শিহাব নামের আমার একজন কলিগকে। আমার মেজাজ খুব খারাপ হল! অরণ্য তাকে সবকিছু বোঝাচ্ছে। শিহাব অবশ্যই আমার থেকে ভাল প্রেজেন্টেশন দিবে, কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি তবুও আশা করে ছিলাম।

আজ রাতে অরণ্যকে ফোন দিলাম।

– নিশা!
– কেমন আছেন আপনি?
– খুব খারাপ আছি! এত ব্যস্ততায় আছি! আর ডিল পাওয়ার টেনশনে আছি! এই টেনশন আমার মেজাজটাই খারাপ করে দিচ্ছে! আমি কারণে অকারণে কলিগদের সাথে খ্যাচম্যাচ করছি।
– আহা রে! আশা করছি এই ব্যস্ততা থাকবে না। সব আগের মত হয়ে যাবে আর আপনারা ডিলটাও পাবেন। বেস্ট অফ লাক!
– থ্যাংকস। থ্যাংক ইউ সো মাচ! এই সময়ে আমার একটা বন্ধুর সাপোর্ট খুব দরকার ছিল!
– ইউ আর অলওয়েজ ওয়েলকাম!

ফোনটা রেখে মনটা একটু ভাল হল! এট লিস্ট সে আমাকে বন্ধু তো ভাবে! এটাই বা কম কিসের?

বাসায় আবার বিয়ের কথা শুনতে শুনতে আমার কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে।
বাসায় আজ মিটিং বসেছে। সেই মিটিং এ আপা আর দুলাভাইও আছে।

মা বললেন – বৃষ্টি তোর পছন্দ আছে? থাকলে বল! আমরা তার সাথে, তার ফ্যামিলির সাথে কথা বলি!

আমি চুপ করে রইলাম। পছন্দ আছে, ভালবাসা আছে। কিন্তু যেই মানুষকে আমি ভালবাসি সেই মানুষটাকে আমি এখনো আমার ভালবাসার জালে জড়াতে পারিনি! সে আমাকে বন্ধু ভাবে। তাও আমাকে না। নিশাকে। কিন্তু আমি তো ‘নিশা’ চরিত্র তার কাছাকাছি যাওয়ার জন্য তৈরি করেছিলাম! আমি কখনোই চাইনি সে নিশাকে ভালবাসুক! আমি চেয়েছি তার বৃষ্টি হতে!

ভাইয়া বলল- তোর আসলেও কি যেন হয়েছে। কয়েকদিন ধরেই দেখছি!
আপা অতি উৎসাহিত হয়ে বললেন – ইশশ! বৃষ্টির বিয়েতে কি মজা যে হবে!
বাবা এবার বললেন – তুমি কিছু বলছ না কেন?
আমি এবার কান্না চেপে বললাম – আমি বুঝতে পারছি না তোমরা সবাই মিলে আমার বিয়ের পেছনে কেন পড়েছ? পড়া শেষ হলেই কি বিয়ে করে ফেলতে হবে? জীবনের লক্ষ্য আর উদ্দেশ্য কি একমাত্র বিয়ে? আমি যে চাকরি করছি, ইনকাম করছি তোমাদের ভাল লাগছে না?
– বিয়ে করেও চাকরি করা যায়! রূপরেখা করছে না? দিয়া (ভাবী) তো এখন ম্যাটার্নিটি লীভে আছে। সেও তো করছে!

আমি চুপ করে গেলাম!

– বৃষ্টি আমি আগেই বলেছি তোর বিয়ের কথা চলছে। এখন ওরা যখন আসতে চাইছে তুই যদি এরকম বেঁকে বসিস তাহলে কি করে হবে? আমরা মুখ দেখাব কি করে?
ভাইয়া বিরক্ত হয়ে বলল- এত কথার কি আছে বুঝতে পারছি না! একবার দেখা করলে কি এমন হয়ে যাবে?
আমি কঠিন গলায় বললাম- আমি কারও সাথে দেখা করব না। নেভার!
ভাইয়া বলে- ঠিক আছে। মা-বাবা উনাদের একদিন আসতে বল। সেটা কবে বৃষ্টির জানার কোন দরকার নেই। উনারা আসলে বৃষ্টি সামনে আসলে আসবে, আর না আসলে উনাদেরই ওর ঘরে ঢুকিয়ে দেব। তারপর? তারপর তো আর বের করে দিতে পারবি না। সেই শিক্ষা তোর নেই আমি জানি!

অনেকক্ষণ ধরে কান্না আটকে রাখতে কষ্ট হচ্ছিল। এবার আর না পেরে কাঁদতে কাঁদতে রুমে ঢুকে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিলাম।

বাইরে থেকে বাবার গলা শুনলাম- এই শুরু হল! আমার দুই মেয়ের অতি সুন্দর কান্নার প্রতিভা!

একটুপর কে যেন দরজা ধাক্কাচ্ছে। নিশ্চয়ই আপা নয়তো ভাবী!

আমি চিৎকার করে বললাম – আপা বা ভাবী যেই হও আমি কথা বলব না।
দুলাভাইয়ের কণ্ঠ শুনতে পেলাম – আমার সাথে তো কথা বলবি রে পাগলী! নাকি তাও না?

আমি এবার উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম।

দুলাভাই আমাকে দেখে বলে- বাব্বাহ! তুই তো কোন অংশেই তোর আপার চেয়ে কম যাস না!

আমি এবার চোখের পানি আটকানোর কোন চেষ্টা করলাম না!

দুলাভাই নরম গলায় জিজ্ঞেস করে- কি হয়েছে বৃষ্টি? একবার দেখা করলে কি এমন ক্ষতি হয়ে যাবে?
আমি ফুঁপিয়ে উঠে বললাম – যদি আমাকে পছন্দ করে ফেলে?
– আগে করুক! তারপর দেখা যাবে। এভাবে কতদিন আটকে রাখবি? মা-বাবা কথা দিয়েছেন যে দেখাদেখি হবে! উনাদের কথাটা ভাববি না একবার? আর এভাবে কতদিন নিশা হয়ে কথা বলে যাবি? বৃষ্টিলেখা হয়ে তো অরণ্যকে বলতেও পারছিস না!

আমি কোন উত্তর দিলাম না!

– এর থেকে দেখা করার জন্য রাজি হয়ে যা। পরেরটা পরে দেখা যাবে।
আমি বললাম – অরণ্যের মনের কথা না জেনে আমি কিছুতেই দেখা করব না। দুনিয়া উল্টে গেলেও না।

সবাই চলে গেলে বসে বসে ভাবতে লাগলাম কি করব! কিছুতেই কোন উপায় পাচ্ছি না। অরণ্য নিশাকে ফ্রেন্ড ভাবে। তাই নিশা হয়ে প্রপোজ করাই যাবে না। দেখা যাবে যা ফ্রেন্ডশিপ হয়েছে তাও যাবে! তাহলে কি বৃষ্টিলেখা প্রপোজ করবে?
অফিসের সবার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলব- আই লাভ ইউ অরণ্য! উইল ইউ মেরি মি?
আমি চিন্তা করে করে কোন কূলকিনারা পেলাম না!

এতদিন যা হয়নি এখন আমার সাথে তাই হচ্ছে। আমি বাসার এই বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে এত স্ট্রেসড আছি আর এদিকে ইদানিং অফিসের কাজে একটুও ভুল হওয়া যাবে না এই দুই চিন্তা নিয়ে আমি কাজে শুধু ভুল করে ফেলছি! আর অরণ্যও তাই বিরক্ত হচ্ছে! সেটা দেখে আমি আরও ভেঙে পড়ছি! আরও ভুল হচ্ছে! কিচ্ছু ঠিক যাচ্ছে না! কিচ্ছু না!

আজ বৃহস্পতিবার। রবিবার আমাদের ক্লায়েন্ট মিটিং। আজ সব কাজ মোটামুটি গোছানো হয়ে গেছে। আজকে হেড স্যারদের সাথে আমাদের সবার মিটিং।
কিন্তু আজ আমি মারাত্মক গাধামি করে ফেললাম!

অরণ্য আমাকে এসেই বলেছে দুইটা মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট ফাইল যেন আগেই কনফারেন্স রুমে পৌঁছে দেই। আমার সকাল থেকে এত মাথা ধরেছে। আমি ফাইল পৌঁছানোর আগে এককাপ কফি মেশিন থেকে নিয়ে আমার ডেস্কে যাচ্ছিলাম। অরণ্য কি যেন করে এদিকে আসছিল। আমি খেয়াল না করে হুট করে তার সাথে ধাক্কা খেলাম আর পুরো কফি তার কোটে পড়ে গেল! আমি স্বীকার করছি যে পুরো দোষটা আমার ছিল! অরণ্য সাইডে সরে যেতে নিয়েছিল কিন্তু আমিই দেখিনি!

আমি ‘আঁউ’ করে উঠলাম!
অরণ্য প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে বলে- বৃষ্টিলেখা কি হয়েছে আপনার? এরকম সিলি আচরণ কেন করছেন?
– স্যরি! আমি এক্সট্রিমলি স্যরি।
সোনিয়া বলে- স্যার এক্ষুনি পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। দাগটা নাহলে বসে যাবে!
অরণ্য বিরক্ত হয়েই বলে- দরকার নেই। সে কোট খুলে রেখেই কনফারেন্স রুমে চলে গেল।

আমার ইচ্ছা করল হাউমাউ করে কান্না করে দেই! কিন্তু এক্ষুনি মিটিং শুরু হয়ে যাবে। তাই কাঁদতে পারছি না। আর অফিসে এভাবে কান্নাকাটি করলে মানুষজন কি ভাববে আমাকে!

সোনিয়া আপু বলে- বৃষ্টি চল।

আমি বললাম – আপনি যান। আমি আসছি।

আমি ওয়াশরুমে গিয়ে চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে বের হলাম। আমি কনফারেন্স রুমে ঢোকার আগে অরণ্যকে আমার ডেস্কের সামনে আবিষ্কার করলাম!

সে কঠিন গলায় আমাকে জিজ্ঞেস করে – বৃষ্টিলেখা দিস ইজ টোটালি নট ডান! আমি এসেই বলেছিলাম ফাইল দুটো রেখে আসতে। কোথায় সেটা?

এই সেরেছে! ফাইলের কথাটা তো এই কফি কেলেংকারির মাঝে ভুলেই গিয়েছিলাম!

অরণ্য বলল- যদি স্যারেরা এসে পড়তেন তখন না পেতাম আমাদের ডিপার্টমেন্টের ওপর কি রকম একটা বাজে ইমপ্রেশন পড়তো! আপনার মনটা ইদানিং কোথায় থাকে? প্রথমদিনই বলেছিলাম আমি যখন কিছু বলব নিজের মনকে আমার কথার মধ্যে রাখবেন। এরকম ইররেসপন্সিবল হলে তো চলবে না!

আমি কোন কথাই বলতে পারছি না। আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না সে এভাবে আমাকে বকা দিচ্ছে! সে এরকম খারাপ আচরণ করছে আমার সাথে!

অরণ্য বলল- ফাইল দুইটা দিন।
– আমি নিয়ে যাচ্ছি..
– থ্যাংকস। আমি নিতে পারব।

কথাটাই শেষ করতে দিল না!

আমি ফাইল দিলে সে নিয়ে চলে যাচ্ছিল।

আমি পেছন থেকে ডাক দিলাম- অরণ্য!
অরণ্য আমার ডাক শুনে ঘুরে পেছেনে এসে আমাকে বলে – আর বাই দ্য ওয়ে, আগেও লক্ষ করেছি আপনি আমাকে নাম ধরে ডাকছেন! বয়সে এবং পজিশনে আমি আপনার ওপরে। স্যার ডাকতে না পারলে ‘মিস্টার অরণ্য’ বলে ডাকবেন। এবার বলুন কি জন্যে ডাকলেন।

আমি তার এই কথাগুলো শুনে আর একটা কথাও বলতে পারলাম না। রাগে, দুঃখে, অপমানে আমার মরে যেতে ইচ্ছা করে! তোমাকে স্যার ডাকা তো দূরে থাক আমি তোমার সাথে আর কথাই বলব না।

সবাই কনফারেন্স রুমে চলে গিয়েছিল।

সোনিয়া আপু এসে বলে- স্যারেরা আসছেন।

আমি, অরণ্য আর সোনিয়া আপু এবার গেলাম। আমি আজকে একবিন্দু মন দিতে পারলাম না। কে কি বলল আর কি হল কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমার আজকের দিনটাই খারাপ! আমার মাথায় বারবার অরণ্যের বলা কথাগুলো ঘুরছে। আর তার ওপর প্রচন্ডরকম রাগ আর অভিমান হচ্ছে!

একসময়ে শুনলাম সবাই মিলে হাততালি দিচ্ছে।

ইমতিয়াজ হোসেন উঠে দাঁড়িয়ে হেসে বললেন – চমৎকার! অরণ্য তুমি আর তোমার টিম খুব সুন্দর কাজ করেছ। আশা করছি ক্লায়েন্ট ইমপ্রেস হবে আর ডিলটাও পাব আমরা! সবার জন্যে আরেকবার জোরে হাততালি!

আজকে সবাই একসাথে এক ক্যান্টিনে খাওয়া দাওয়া করল। আমি মুখ গোমড়া করেই রাখলাম।

সোনিয়া আপু জিজ্ঞেস করল- কি হয়েছে তোমার? স্যার বকা দিয়েছে?

আমি মুখ শক্ত করে রাখলাম।

সোনিয়া আপু বলে- স্যার রেগে গেলে একটু বকা দেয়! বাট একটুপরেই ঠিক হয়ে যাবে দেখ! টেনশনে আছেন তো!
মনে মনে বললাম- টেনশন মাই ফুট!

পাঁচটায় অফিস ছুটি হয়ে গেলেও আমি বসে রইলাম। ইদানিং বাসায় যেতেও ভয় লাগে! না জানি কবে বাসায় গিয়ে দেখব মা সেই পাত্রকে হাজির করেছেন! তবে আজ ইচ্ছা করেই কাজ করতে থাকলাম। আমি নাকি সিলি আচরণ করছি, আমি ভুল করছি, আমি ইররেসপন্সিবল। তাহলে কাজকর্ম করে সেই দূর্বলতা কাটানো উচিৎ!

আস্তে আস্তে সবাই বের হয়ে গেল। আমাকে অনেকেই জিজ্ঞেস করল। আমি দায়সারাভাবে উত্তর দিলাম।

সোনিয়া আপু যাওয়ার আগে জিজ্ঞেস করে – একি! বৃষ্টি যাবে না বাসায়?
– না।
– না মানে? তোমার কি এক্সট্রা কাজ আছে আজকে?

আমি উত্তর দেওয়ার আগেই দেখি অরণ্য আসছে।

সে আমাদের দেখে অবাক হয়ে বলে- ওমা! আপনারা যাবেন না?

কি সুন্দর করে কথা বলছে যেন কিছুই হয়নি!

আমি মুখ শক্ত করে সোনিয়াকে বললাম – আপু আপনি চলে যান। আমি একটুপরে যাব। আমি তো আবার এমনিতেও কাজকর্ম বেশি ভাল পারি না। সানডে ক্লায়েন্টের সামনে না যেন আবার কি ভুল করে বসি! আমি একটু কাজ করে যাই।

সোনিয়া আর অরণ্য আমার উত্তর শুনে অবাক হয়ে তাকাল। আমি সিধা ডেস্কটপের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

অরণ্য হেসে সোনিয়াকে বলে- আপনি যান। আমি আছি।

সোনিয়া আপু চলে গেল।

অরণ্য আমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।
সোনিয়া আপু যাওয়ার পর সে একটা চেয়ার টেনে আমার সামনে বসে বলে- স্যরি।
এরপর জিজ্ঞেস করে – অনেক বেশি রাগ করেছেন?

আমি উত্তর দিলাম না। কঠিন মুখে বসে থাকলাম।

অরণ্য হেসে বলে- আপনার চেহারায় এই কাঠিন্যতা আমার ভাল লাগছে না দেখতে! স্যরি বলেছি তো!

স্যরি বললেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়? আমি কাউকে খুন করে স্যরি বললে কি সে আবার ফিরে আসবে? আজ তো অরণ্য তার কথা দিয়ে আমাকে একপ্রকার মেরেই ফেলেছে!

আমার উত্তর না পেয়ে অরণ্য জিজ্ঞেস করে – আপনি আর কতক্ষণ কাজ করবেন? যাওয়ার সময় আমাকে বলবেন।

এরপর উঠে সে তার রুমে চলে যায়।

রুম থেকে ল্যাপটপ নিয়ে এসে আবার চেয়ারে বসে বলে- আপনার কোন ভরসা নেই। পরে আগে আগেই চলে যাবেন আমাকে না বলে! যেই রাগ করেছেন!

বুঝতে পারছি সে অনেক অনুতপ্ত। তবুও আজ আমি এত সহজে গলে যাচ্ছি না। আমার তখন যে কষ্ট লেগেছে আমি বলে প্রকাশ করতে পারব না।

সাড়ে ছয়টার দিকে আমি ডেস্কটপ বন্ধ করলাম। আর ভাল লাগছে না। সব গুছিয়ে নিচ্ছি যাওয়ার জন্য।

অরণ্য বলে- হয়ে গেছে? সেও ল্যাপটপ বন্ধ করে।

আমরা একসাথেই বের হই। আমার যে এখন কি ভাল লাগছে! কিন্তু আমি সেটা ওকে বুঝতে দিচ্ছি না।

আমি দাঁড়িয়ে উবার কল করার জন্য মোবাইল বের করতে সে বলে- আমি গাড়ি বের করে আনছি। আমি আপনাকে ড্রপ করে দিচ্ছি। একটু দাঁড়ান।

অরণ্য আমাকে ড্রপ করবে! ওয়াও! কিন্তু আমি তবুও তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে উবার দেখতে লাগলাম।

অরণ্য হতাশ হয়ে গাড়ি নিয়ে আসে। অরণ্যকেই ড্রাইভিং সিটে বসে থাকতে দেখলাম।

আমি ইচ্ছা করে তার সামনে উবার ড্রাইভারের সাথে কথা বলার নাটক করতে থাকলাম- হ্যাঁ সোজা আসেন। আর কতক্ষণ? আচ্ছা আমি পনেরো মিনিট দাঁড়াচ্ছি।
অরণ্য বলল- ক্যানসেল করে দিন। আমি নামিয়ে দিচ্ছি। আসুন।

হুহ! এত সোজা নাকি? আমাকে এত সোজা ভেবেছ?

আমি কথা না বলে হাঁটা শুরু করলাম।
অরণ্যও আমার পাশে পাশে ধীরে ধীরে গাড়ি চালাতে থাকে।

সে এবার হেসে বলে- বৃষ্টিলেখা আপনি যতক্ষণ এভাবে হাঁটবেন আমি গাড়ি নিয়ে আপনার পাশাপাশি যাব। আর উবার আসলেও তাকে ভাগিয়ে দেব। রাস্তার মানুষজন কিন্তু দেখছে!

আমি আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম আসলেই মানুষজন আমাদের দিকে তাকিয়ে আমার এই পাগলামি দেখে হাসছে!

একজন তো বলেই ফেলে- আপা দুলাভাইকে মাফ করে দেন। বেচারা কতক্ষণ ধরে ঘুরতেছে আপনের পিছে!

এটা শুনে আমি যেই পরিমাণ রাগ করলাম, অরণ্য ঠিক ততটাই হাসতে শুরু করে!
আমি আর কথা না বাড়িয়ে তার পাশের সিটে গিয়ে বসলাম।
বসার পর মনে হল পেছনের সিটে বসলেই ভাল হত!

অরণ্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে- যাক! অবশেষে! সিট বেল্টটা লাগিয়ে নিন।

আমি কথা না বাড়িয়ে বেল্ট ধরে টান দিলাম। কিন্তু সেটা বেশ শক্ত। টানলেও আসল না।

আমি এবার অরণ্যের দিকে তাকালাম।

অরণ্য হেসে বলে- এটা আসলেও শক্ত।

সে এবার নিজেই কাছে এসে বেল্টটা টান দিল!

আমার নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। অরণ্য আমার এতটা কাছে এসেছে! আমার হার্টবিট বেড়ে গেল!
অরণ্য বেল্টটা টেনে নিয়ে লাগিয়ে দেয়।

গাড়ি চালাতে চালাতে অরণ্য কথা বলতে থাকে। আমি কোন উত্তর দিলাম না।

– আপনার বাসা কোথায় আমাকে একদিন বলেছিলেন। আমার কিন্তু মনে আছে।

আমি এবারও কথা বললাম না!

অরণ্য বলে- বৃষ্টিলেখা শুনুন আপনি খুব ভাল করে জানেন আমি.. না শুধু আমি নই, আমাদের ডিপার্টমেন্টের সবাই কি পরিমাণ ব্যস্ত আর টেনশনে আছি এই কয়দিন। হেড স্যারের পছন্দ না হলে সব নতুন করে করতে হত! আপনি এত ভাল কাজ করেন কিন্তু গত কয়দিন ধরে বেশ কয়েকটা ভুল করেছেন, আজ সকালে আমার ওপর কফি ফেলে দিয়েছেন, ফাইল দিতে ভুলে গেছেন! ইমতিয়াজ স্যারের সাথে পার্সোনালি আমাকে অনেক ভাল সম্পর্ক। স্যারের আমার বয়সী একটা ছেলে ছিল। সে কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়ে সমুদ্রে ভেসে যায়! মারা গেছে! তিনি আমাকে ছেলের মতো অনেক আদর করেন। আমি তাই তার সামনে আমাদের ডিপার্টমেন্টের ইমপ্রেশন খারাপ করতে চাইনি! আর আপনি আমাকে নাম ধরে ডাকুন আমার কোন সমস্যা নেই। কিন্তু সেটা অফিসের বাইরে। সবার সামনে হুট করে আমাকে নাম ধরে ডাকলে কি ভাববে সবাই আপনাকে? আপনাকে যাতে কেউ খারাপ না ভাবে সেজন্য বলেছি। আসলে সব মিলিয়ে আপনাকে তখন বেশ কিছু কথা বলে ফেলেছি! আর আমি স্যরি সেজন্য!

আমার মনটা এতক্ষণে গলেই গেছে! তবুও সিদ্ধান্ত নিলাম আজ আর কথা বলব না তার সাথে!

আমার বাসার কাছাকাছি এসে সে বলে – আর কয়বার স্যরি বললে কথা বলবেন বলুন তো?

আমি এতক্ষণ পর এবার বললাম – এখানে রাখুন।

আমি তাকে বাসার সামনে নিতে চাচ্ছি না। কেউ বুঝতে পারলে বেশ ভাল ঝামেলা হবে! তাই না চাইতেও আমাকে কথা বলতে হল!

অরণ্য হেসে বলে- এতক্ষণ পর একটা কথা তাও আবার এটা?

সে গাড়ি থামিয়ে বলে- শুনুন বৃষ্টিলেখা এত রাগ করতে হয় না। এই যে আপনি কবে থেকে নিজের পরিচয় গোপন করে নিশা নাম নিয়ে আমার সাথে রাতেরবেলা ফোনে কথা বলেন, আমি কখনো এজন্যে রাগ করেছি? আপনাকে কিছু বলেছি?
[চলবে]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here