বাসন্তী
পর্ব-০১
লিমু

– ” একটা অর্ধনগ্ন যুবতী মেয়ের দেহ পড়ে আছে রাস্তার পাশে,আর চারপাশে উৎসুক মানুষ সেটা দেখছে বিশেষ কৌতূহল নিয়ে।
কিন্তুু দুঃখজনক হলেও সত্য কেউ মেয়েটার কাছে যাচ্ছে না,হয়তো ভয়ে কারন কেউই নিজে যেচে গিয়ে বিপদে পড়তে চায়না। অথচ বিপদ যখন আসার তখন না চাইতেও আসবেই,এটাই সত্য।

-” মেয়েটার গায়ে পেটিকোট আর ব্লাইজ ছাড়া কোন কাপড় নেই। শাড়িটার কিছু অংশ মেয়েটার পাশে পড়ে আছে কারন আর কিছু অংশ দিয়ে মেয়েটার হাত, পা আর চোখ বাঁধা। তাই মেয়েটা কোন সাড়াশব্দও করতে পারছেনা,একদম নেতিয়ে পড়ে আছে মেয়েটা। আর মানুষ মজা দেখছে,কিছু কিছু বিকৃত মস্তিষ্কের
পুরুষ মেয়েটাকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে,যাদের মনমানসিকতা কুৎসিত,কদাকার। ময়লা আবর্জনার মতো পঁচা যাদের মস্তিষ্ক। অথচ বাইরে থেকে দেখলে এদের বুঝার উপায় নেই,কারন এরা মুখোশধারী। ভদ্রতার আড়ালে এদের ভিতরে লুকিয়ে থাকে কুৎসিত একটা চেহারা,যেটা কখনো না কখনো ঠিকই বেরিয়ে আসে। আর এই ভদ্রবেশী পশুগুলোই সবচেয়ে ভয়ংকর,কারন এদের উপরের ভালোমানুষি রূপটা মানুষকে কাবু করে রাখে।

-” মেইন রোড থেকে গলির ঠিক প্রবেশপথেই মেয়েটার দেহটা পড়ে আছে।
হঠাৎ করেই রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট এর আলোটা বন্ধ হয়ে গেল ঠিক মেয়েটা যেখানে পড়ে আছে সেখানে।
মানুষ নামের পশুরা একটা মেয়ের লজ্জা কেড়ে নিতে যেখানে দ্বিধাবোধ করে না,সেখানে প্রকৃতিও চাইছে একটা মেয়ের লজ্জা নিবারণ করতে।
-” আচ্ছা একটা বিকৃত মস্তিষ্কের পুরুষ জোর করে ছুঁয়ে দিলেই কি একটা মেয়ে নষ্ট হয়ে যায়,এতই ঠুনকো!
অথচ আমাদের সমাজ সবসময় মেয়েটাকেই নীচু করে দেখে,কি অদ্ভুত না!
যে অপরাধ করে সে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
-” ধিক্কার সেসব নরপশুদের!”

-” মেয়েটা জীবিত আছে কারন একটু নড়াচড়া করছে আর তারচেয়ে বড় বিষয় হলো গাঁয়ে কোন আঘাতের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না,বা রক্তও দেখা যাচ্ছেনা।
কিন্তুু এভাবে হাত, পা আর মুখ বেঁধে কে ফেলে গেল?
আজকাল তো রেপ করলে একেবারে মেরে গুম করে দেয় বা দূরে কোথাও ফেলে রাখে।
-” তাহলে এই মেয়েটাকে এখানে এভাবে ফেলে রাখার মানে কি?
নাকি যে কাজটা করেছে সে অনেক পাওয়ারফুল কেউ।
-” কিছু লোক বলাবলি করছিল সন্ধ্যার দিকে একটা কালো মার্সিডিজ গাড়ির ভেতর থেকে মেয়েটাকে রাস্তার পাশে ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়। ফেলে রেখেই দ্রুত গাড়ি টেনে চলে যায়,তাই কেউ বলতেও পারবেনা সেটা কে ছিল।
-” কার ঘরের লক্ষী ছিল মেয়েটা কে জানে। মেয়েদের জন্য তো আজকাল নিরাপদে চলাফেরা করাটাই মুশকিল হয়ে গেছে। সমাজটা ভরে গেছে কিছু মানুষ নামের কীট দ্বারা। যাদের কাছে মেয়ে মানেই মাল।আচ্ছা ওদের জন্মটাও তো কোন মেয়ের গর্ভেই হয়েছে তাই না?

-” আফসোস যদি সেই মা বুঝতে পারতো তার সন্তান মানুষ না হয়ে মানুষ নামের পশু হবে,তাহলে হয়তো হওয়ার সাথে সাথেই মেরে ফেলতো। একজন নারীর গর্ভ থেকে জন্ম নিয়ে নারীদেরকেই যদি সম্মান করতে না পারে,তাহলে কোন মুখে সে নিজেকে মানুষ দাবি করে?
মানুষ হওয়া এতই সহজ!
হাত, পা,চোখ, কান,মুখ থাকলেই সে মানুষ?
কখনোই না!”
যার মাঝে বিবেকবোধ নেই,মনু্ষত্ব্যনেই, তাকে আর যাই হোক মানুষ বলা যায় না।
কারন হাত,পা,চোখ,মুখ অন্য প্রাণীদেরও আছে,কিন্তুু বিবেকটা শুধু মানুষেরই আছে।

-” তবে আজকাল কিছু কিছু বিষয় দেখলে মনে হয় মানুষের চেয়েও পশুর মধ্যেও বিবেক আছে,মনুষত্ব্য আছে,মায়া মমতা আছে।

-“অথচ আমরা মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব।”

-” কিছুক্ষণ পর একজন মধ্যবয়সী মহিলা হুড়মুড়িয়ে এসে মেয়েটার কাছে গেল,কান্নায় ভেংগে পড়লেন তিনি।

মেয়েটার হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিলেন,আর ছেড়া শাড়িটুকু দিয়ে শরীরটা ঢেকে দিলেন।
-” মুখের বাঁধনটাও খুলে দিলেন,কিন্তুু মেয়েটা কোন কথা বলছেনা। শুধু অনবরত গাল বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে,যেটা দেখে ঐ মহিলাও একনাগাড়ে কেঁদে যাচ্ছেন।

-” মহিলাটা মেয়েটার মা মনে হয়,একজন মায়ের জন্য কতটা কষ্টের এভাবে নিজের মেয়ের সম্মান নষ্ট হতে দেখা!

-” কিন্তুু ঐ মানুষ নামের পশুগুলোর তাতে কি আসে যায়,তারা তো তাদের কার্য হাসিল করতে পারলেই হলো,কুৎসিত চাহিদা মিটাতে পারলেই হলো,এরা নিজেদেরকে মানুষ দাবি করে কোন সাহসে!

-” মাঝে মাঝে মনে হয়,এদের ফাঁসি দিতে হবে না,যদিও এদের শাস্তি খুব কমই হয়।
কিন্তুু এরা বেঁচে থাকুক,এবং এতটা ঘৃণা নিয়ে বেঁচে থাকুক যে নিজেই প্রতিনিয়ত মরতে চাইবে। এদের কোন শাস্তি না দিয়ে এদের কপালে সিল মেরে বা ট্যাটু একে লিখে দেওয়া হোক’ধর্ষক। যেন সেটা কোনভাবেই মুছে না যায়,এটা নিয়েই যেন প্রতিনিয়ত চলাফেরা করে।
নিজের বোনের সামনে যখন পড়বে তখন লজ্জায় মরবে,মায়ের সামনে যখন পড়বে তখন মরবে, এভাবে প্রতিনিয়ত মরবে,এরচেয়ে বড় শাস্তি আর হতে পারে না।

-” একবারে মরার চেয়ে যেন, বারবার প্রতিনিয়ত লজ্জায়,ঘৃণায় মরে।”
-” মেয়েটার মা একটা রিকশা ডেকে মেয়েটাকে উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল,মেয়েটার কোন সাড়াশব্দ নেই।”

____তিনমাস আগে…….

-” আজকে পহেলা ফাল্গুন। পহেলা বৈশাখের মতো পহেলা ফাল্গুনও বাঙালি বেশ উৎসাহ নিয়ে পালন করে।

-” শীতের রুক্ষতা ভুলে গাছে গজায় নতুন কিশলয়,চারদিক ছেয়ে যায় রং বেরংয়ের ফুলে। শীতের রিক্ততা ভুলে প্রকৃতি যেন নিজেকে নতুন করে সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে,অথবা এটাই নিয়ম।
-” রিক্ত হলেই পূর্ণ হবে,বা পূর্ণ হলে রিক্ত!”
-” তরুনীরা বাসন্তী রংয়ের শাড়ি পড়ে বেড়িয়ে পড়েছে রাস্তায়,উদ্দেশ্য বকুলতলায় বসন্ত বরণ। দেশের প্রায় সব ভার্সিটি কলেজে এই উৎসব পালন করা হয়। বাঙালি উৎসব প্রিয় জাতি বলে কথা,বারোমাসে তেরো পার্বণ।

-” তেমনি এক কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী পুষ্প। বাংলাতে অনার্স করছে সে,তাই বাংলা ভাষা নিয়ে তার আবেগের শেষ নেই। তার সামনে কেউ বাংলা বানান ভুল করলেই হলো ব্যাস!
সে তাকে একেবারে সঠিক বানান শিখিয়ে তবে ছাড়বে,একেবারে ব্যাকরণের নিয়ম সহ বুঝিয়ে দিবে। কেউ উচ্চারণ ভুল করলেও তাকে সঠিক উচ্চারণ শিখিয়ে দিবে,যদিও এটাতে অনেকে বিরক্ত হয়।
কারন অনেকের কাছে এটা অপমানজনক লাগে,আবার অনেকে ভুল ধরিয়ে দেয়ার জন্য খুশিই হয়।
-” পুষ্পর কথা হলো আরে ভুল হতেই পারে,আমার নিজেরও ভুল হয় কিন্তুু তাই বলে কি সঠিকটা জানা উচিত নয়?
আর কেউ ভুল ধরিয়ে দিলে তাতে অপমানবোধ করার কি আছে,বিষয়টা সহজভাবে নিলেই হয়।
-” এত কষ্টে অর্জিত ভাষা রক্তের বিনিময়ে আর আমরা আজকাল যেভাবে বাংলিশে কথা বলি। আর হিন্দি, ইংলিশ তো আছেই। অনেকে মনে করে হিন্দি,ইংলিশ জানা মানেই সে স্মার্ট।
আরে যে নিজের মাতৃভাষায় ঠিকভাবে কথা বলতে পারে না সে আবার স্মার্ট হয় কি করে। বিষয়টা এমন গাছের মূল রেখে লতাপাতা নিয়ে নাচানাচি। অথচ মূল না থাকলে লতাপাতার কোন অস্তিত্বই থাকবেনা।”

-” কলেজের উদ্দেশ্যেই যাচ্ছিল পুষ্প আর ওর ফ্রেন্ড তন্নি। তন্নির সাথে বের হলে বকবক করে মাথা খারাপ করে ফেলে,তবুও পুষ্প তন্নির সাথে রাগ করতে পারে না। মেয়েটা একটু গলুমলু,আর বেশ কিউট। আর সবচেয়ে বেশি ও পুষ্পকে বেশ ভালোভাবে বুঝতে পারে। পুষ্পর মনে কখন কি চলে সেটা সহজেই কিভাবে যেন বুঝে যায়। অথচ ওর সাথে পরিচয় মাত্র একবছর,মানে অনার্সে ভর্তি হয়েই ওর সাথে পরিচয় হয়েছে পুষ্পর। তবে এরমধ্যেই ওদের বন্ধুত্ব বেশ গাঢ় হয়ে গেছে।
-” তন্নি বকবক করতে করতে কলেজের কাছাকাছিই এসে গিয়েছিল,হঠাৎ পুষ্প চুলে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।
ওর খোঁপায় পরা বেলীফুলের গাজরাটা ছিড়ে নিচে পড়ে যায়,যেটা দেখে পুষ্প করুণ মুখ করে সামনে তাকায়।
-” সামনে তাকিয়ে দেখে একটা ছেলে একহাতে কানে হাত ধরে সরি বলার ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে।
-” কিন্তুু পুষ্প যেই ছেলেটার দিকে ঘুরে -” তাকালো ছেলেটা অদ্ভুত চাহনি নিয়ে পুষ্পর দিকে তাকিয়ে রইলো। মনে হচ্ছিল একেই যেন খুঁজছিল জনম জনম ধরে।

-” এতটা মায়াবী কারো চেহারা হয়।
সেটা তার জানা নেই,তবে ঐ গভীর কালো মায়াবী চোখে কেউ একপলক তাকালেই ডুবে যাবে,হুঁশ হারাবে।

-” পুষ্প ফর্সা নয়,আবার একদম কালোও নয়। ফর্সা কালোর মাঝামাঝি,এরকম শ্যাম বর্ণের মেয়েরা সাধারনত খুব মায়াবী চেহারার অধিকারী হয়। আর এদের সবচেয়ে ভয়ংকর সুন্দর জিনিস হলো এদের চোখ,অসম্ভব নেশা লাগানো।
ঘোর লেগে যাওয়ার মতো,যে ঘোরে এই মুহুর্তে আটকে আছে সামনের ছেলেটা।

-” আর ঐ ছেলের গিটারের কোনায় খুঁচা লেগে পুষ্পর মাথার গাজরাটা ছিড়ে গেছে,পুষ্প কি করবে বুঝতে পারছেনা
রাগে ঐ ছেলেকে বললো,” যে জিনিস সামলাতে পারেন না, সেটা সাথে রাখেন কেন?”
-” পুষ্পর রাগী কন্ঠ শুনে ছেলেটা বোধহয় একটু ভড়কে গেল,কারন সে সাথে সাথেই একহাতে কানে ধরে সরি বলেছিল কিন্তুু তাতে বিশেষ কাজ হয় নি।
-” পুষ্প আরো রেগে রেগে কি যেন বলতে চাইছিল তখন তন্নি ওকে থামিয়ে দিল।
তন্নি ঐ ছেলেটার সামনে গিয়ে বললো,” আপনাকে চেনা চেনা লাগছে কোথায় দেখেছি যেন।
-” হ্যা মনে পড়েছে আপনি ব্যান্ড এর গান করেন না,আপনার ব্যান্ড দলের নাম কি জানি….হ্যা মনে পড়েছে ‘থ্রিপল পি। আচ্ছা নামটা অদ্ভুত না,শুনলে মনে হয় বুয়েটের সাবজেক্টের নাম মানে ত্রিপলি।
এটা বলে তন্নি হেসে দিল,তবে হাসিটা বেশি বিস্তৃত করলোনা,কারন ছেলেটা ওর দিকে কেমন করে জানি তাকিয়ে আছে।
-” পুষ্প রাগে রাগে কথা বলছিল দেখে ছেলেটা বললো,” আরে সামান্য একটা ফুলের গাজরাই তো ছিড়েছে, আপনার তো কোন ক্ষতি হয় নি,তাই না।
-” এটা শুনে পুষ্প আরো রেগে গেল,আর ওর পার্সে কি যেন খুঁজতে লাগলো,তন্নি আর ঐ ছেলে দুজনেই অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।
হঠাৎ পুষ্প ওর পার্স থেকে একটা ছোট ক্যাচি বের করে,ঐ ছেলের গিটারের একটা তার কেটে দিল।
ঘটনার আকস্মিকতায় কেউ কিছুই বুঝতে পারলনা,পুষ্প তন্নিকে টেনে নিয়ে চলে গেল।
-” একবার গিটারের দিকে আরেকবার পুষ্পর যাওয়ার দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলো ছেলেটা। আর মনে মনে বললো, মায়াবীনির এ আবার কোন রনচন্ডী রূপ!
-” ছেলেটা কাউকে কল করে বললো,” আজকের প্রোগ্রাম ক্যান্সেল। এটা বলার সাথে সাথেই দেখলো ওর প্রোগ্রামটা যে কলেজে পুষ্প সেই কলেজেই ঢুকছে। তাই পরক্ষণেই ওপাশের ব্যাক্তিকে বললো, তাড়াতাড়ি একটা গিটার ম্যানেজ করে নিয়ে আসো,আজকের প্রোগ্রাম ডেফিনেটলি হবে,হারি আপ।
-” একটা ফুলের গাজরার জন্য গিটারের তারটা কেটে দিল,তাকে তো আরেকবার দেখতেই হচ্ছে,কি বলেন মিস্টার প্রণয় মেহবুব। এটা বলে কলেজের দিকে গেল প্রণয়,সেই মায়াচন্ডীকে আরেকবার দেখার জন্য। প্রণয় নিজে এই নামটা দিল মায়াবতী+রনচন্ডী=মায়াচন্ডী,এটা বলে প্রণয় নিজেই হাসলো। তারপর মাথা চুলকাতে চুলকাতে কলেজের ভিতর ঢুকলো।

#চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here