এক পা দুপা
সিজনঃ ২
পর্বঃ ১৪

অনেক সময় নিয়ে বসে আছে শিল্প। সবাই চুপচাপ, সবার চোখে প্রশ্ন, মহিলা একাই কথা বলছেন। মহিলাটি মৃত মেয়েটির মা। পাশে একজন পুরুষ উপস্থিত আছেন। তিনি মৃত মেয়েটির বাবা।

“আপনাদের সাহায্য আমাদের খুব প্রয়োজন মি…”
“ইউসুফ। ”
“ওরা সবাই আমার মেয়ের ক্লাসমেট ছিল। যদিও ছেলেরা আলাদা কলেজে পড়ে। তবে তাদের সাথে থাকা মেয়েটি আমার মেয়ের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল। দুজনে একই কলেজে পড়তো। নিজের বন্ধুর হাতে এভাবে মারা পড়তে হবে কে জানতো।” মহিলা কাঁদতে আরম্ভ করলেন। ভদ্রলোক নিজের হাতের ভাঁজে নিয়ে নিলো তাঁকে। স্বান্তনার পরশ পাথর ছুঁয়ে দিলো তাঁর মাথায়।
“আমার সোনাটা কই? আমার কোল খালি হয়ে গেছে গো।” ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বললেন মহিলা।
“কেঁদ না, ওদের শাস্তি হবে খুব তাড়াতাড়ি। যেভাবেই হোক ওদের শাস্তি নিশ্চিত করবো।”

রুম জুড়ে মহিলাটির কান্নার শব্দ শুধু, বাকিরা সবাই প্রত্যক্ষদর্ষী। শিল্প রাকাকে চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করলো তনু কোথায়? সেও ইশারায় প্রকাশ করলো ঘুমাচ্ছে। মেয়েটা খুব ঘুমায় এখন। হয়তো দুর্বলতার জন্য। শিল্প অতিরিক্ত মাথা ঘামালো না সেদিকে, আগে এদিক সামলানো দরকার।
ভদ্রলোক নিজে থেকে কথা শুরু করলেন। ততক্ষণে ভদ্রমহিলার কান্না থেকে গেছে।

“আমি উপল দাশ, ও বিন্দু।” ভদ্রমহিলাকে দেখিয়ে বললেন তিনি। ভদ্রমহিলা হালকা ফোঁপাচ্ছে।
“তৃষ্ণা আমাদের একমাত্র মেয়ে। বয়স খুব বেশি না কেবলমাত্র কলেজে পড়ছে।” বলার ফাঁকে বুজে এলো উপল দাসের গলা।
“নিধি সেন, আমারই এক বন্ধুর মেয়ে সেখান থেকেই আমার মেয়ের সাথে পরিচয়। নিধি মেয়েটাকে আমি ভদ্র সভ্য বলে জানতাম। ওরা দুজন খুব সহজেই মিশে গিয়েছিল। সব ঠিকঠাক ছিল। ভগবান জানে পরে কি হলো। কেন এমন হলো? তবে আমি ওদের শাস্তি চাই। আপনারা প্লিজ আমাদের হেল্প করুন।” শিল্পের দিকে আকুতি ভরা চোখে তাকিয়ে আছেন উপল দাস। বিন্দু দেবীর চোখও শিল্পের দিকে৷ শিল্প কি বলবে নিজেই বুঝতে পারছে না। কি বলবে তনু কিছু জানে না, নাকি বলবে তনুর কিছুই মনে নেই। তার কি বলা উচিৎ। সোহান হয়তো শিল্পের মনের অবস্থা বুঝতে পারলো। তাই নিজে কথা বলা শুরু করলো।
“পুলিশ তো তাদের ধরেছেই সেখানে আমরা কি করতে পারি?”
“তৃষ্ণার ফোনে লাস্ট কল নিধির ছিল। বাড়িতেও নিধির সাথে দেখা করার কথা বলে বেরিয়েছিল। এসবের উপর বেস করে নিধিকে ধরা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসায় ছেলেগুলোর নাম বলে সে।”
“তাহলে তো ভালোই। নিজেরাই স্বীকার করেছে।”
“না ভালো না। ওরা সবাই অপ্রাপ্তবয়স্, অন্তত সার্টিফিকেট তাই বলে। এই অবস্থায় তারা কি শাস্তি পাবে তা চিন্তা যোগ্য। তাদের কটোর শাস্তি নিশ্চিত করতেই এখানে আসা।”

“দেখুন আমরা এখনো নিশ্চিত জানি না তনু কিছু জানে কিনা। তাছাড়া তনু অসুস্থ, সবচেয়ে বড় কথা তার অসুখ সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। মেয়েটা কিছু মনে রাখতে পারছে না। ব্যপারটা এমন হঠাৎ করে তার কিছু মনে পড়ছে, সেটা হতে পারে অতীত তখন সে বাকিটুকু ভুলে যাচ্ছে। মানে হয়তো আমি বোঝাতে পারছি না। ডাক্তার দেখানো হয়েছে, রিপোর্ট হাতে এলেই সব জানা যাবে।” সোহান থামলো খানিক। দুজন অসহায় বাবা-মা তার দিকে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এদের ভরসায় ফাটল ধরাতে মন শায় দিচ্ছে না। তবুও কিছু করার নেই। সোহান শিল্প একে অপরের দিকে একবার তাকালো। দুজনেরই দীর্ঘশ্বাস মিলে গেলো বাতাসে।

“আমরা আপনাদের কোনো আশ্বাসবাণী দিতে পারছি না। দুঃখিত।” কথা এটুকুই ছিল কিন্তু দুজন মানুষকে যেন ভেতর থেকে শেষ করে দিলো। এসব ঝামেলায় জড়ানোর কোনো ইচ্ছে ছিল না শিল্পের কিন্তু তারা জড়িয়ে গেছে না চাইতেও। তবে এখন তার মন এই অসহায় বাবা-মাকে সাহায্য করতে চাইছে। এটা অবশ্যই তাদের জন্য ভালো হবে না। সবচেয়ে বড় কথা তনুর কিছু স্মরণ নেই।

“আপনারা ভয় পাচ্ছেন তাইনা। আপনারা ওই নেতাদের ভয় পাচ্ছেন। আপনারা বুঝতে পারছেন না কতোটা জরুরি তনুকে আমাদের। মেয়েটাকে ডাকুন আমরা কথা বলবো। প্রয়োজন হলে তার পা ধরবো। তবুও ডাকুন।”
“কি বলছেন এসব আপনি! আপনি আমাদের যথেষ্ট বড়, দয়া করে এসব বলবেন না।” শিল্প বলে উঠলো। তাঁদের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আবারো বলতে শুরু করলো।
“তনুর সত্যি কিছু মনে নেই। তবে হ্যাঁ আমি আপনাদের সাহায্য করবো। তনুকে মনে করানোর চেষ্টা করবো সেদিনের কথা। সেদিন কি হয়েছিল জানার চেষ্টা করবো। মোদ্দা কথা আমি আপনাদের সাহায্য করার চেষ্টা করবো।” শিল্পের কথা শেষ হতেই বিন্দু দেবী শিল্পের কাছে এসে তার দু-হাত আঁকড়ে ধরে।

“সত্যি বলছেন!” শিল্প হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। মহিলা শিল্পের হাতে মাথা রেখে কাঁদতে শুরু করে। এ কোনো সাধারণ জল নয়, কৃতজ্ঞতার জল।

__________________

দাশ দম্পতি বেরিয়ে যেতেই সোহান শিল্পের দিকে কঠোর চোখে তাকালো।
“তুই কি ভেবে এসব করছিস? তনু অসুস্থ তুই ভুলে গেছিস।”
“না ভুলিনি, আমরা তো একটা চেষ্টা করতেই পারি।”
“তুই পাগল হয়ে গেছিস। কেউ বিপদ নিজে ডেকে ডেকে আনে নাকি।”
“আমরা বিপদে ছিলাম না কখন। আমরা বিপদে ছিলাম, আছি এবং থাকবো। আমি যদি তাদের সাহায্য নাও করি তবুও বিপদেই থাকবো। তোর কি মনে হয় মন্ত্রী সাহেব এতো সহজে ছেড়ে দিবেন আমাদের। উনি অবশ্যই চাইবেন না কোনো প্রমাণ খোলা ঘুরতে দিতে। তবে কেনো সাহায্য করবো না? আমি সবাই যদি নিজের চিন্তা করে অন্যকে সাহায্য করা থামিয়ে দেই তবে যখন আমরা বিপদে পরবো, সমস্যা আমাদের দোরগোড়ায় কড়া নাড়বে তখন… তখন কে সাহায্য করবে আমাদের। তারাও তো বলবে শুধু শুধু ঝামেলাই পড়ে লাভ কি….. জীবন একটাই, মরতে তো হবেই তবে কিছু ভালো কাজ যুক্ত হলে ক্ষতি কি।”
“আমি বুঝতে পারছি তোর কথা কিন্তু তনু… তনু কি কিছু বুঝবে? পরে দেখা গেলো সত্যিকার অর্থে তনু কিছু জানেই না।”
“আমরা দুইয়ের মাঝে ঝুলছি। এখন আমি কিছুই বলতে পারবো না।”
“তা বলবি কেনো, এখন তো সমাজসেবক হবার ভূত মাথায় চেপেছে। আমার জীবনের বড় ভুল কি জানিস তনুর মতো মেয়েকে তোর জীবনে আনা। তোর জন্য আজ মেয়েটি অস্বাভাবিক জীবন যাপন করছে…. ওর না সেদিন মরে যাওয়া উচিৎ….. ”

“চুপ আর একটা কথাও না, চুপ।” শিল্প আচমকা গলা চেপে ধরে সোহানের। কন্ঠ রোধ করে আঘাতে। করিম এগিয়ে আসে, সরিয়ে নেয় শিল্পকে।
“পাগল হয়েছ তোমরা দুজন? কি শুরু করলে কি? কি হয়েছে কিছু কি আমাদের জানানোর প্রয়োজন বোধ হয়না তোমাদের। নাকি সেই অধিকারও বয়সের সঙ্গে হারিয়েছি।”
শিল্প মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে সোফায়। সোহান ক্রোধে পাগল হয়ে চেঁচিয়ে উঠে।
“ওকে জিজ্ঞেস করুন, ওকে। কি শুরু করেছে কি। নিজে নিজে সব করে কাউকে জানানোর প্রয়োজন মনে করে না। নিজেকে খুব বীর ভাবে।”
“হ্যাঁ বীর ভাবি, বীর। শান্তি।” ক্ষ্যাপা বাঘের মতো তেড়ে ওঠে শিল্প। তার ব্যবহারে প্রত্যেকে বিস্মিত। করিম ধীর কন্ঠে বলে, “কি হয়েছে তোমাদের? এ কি অবস্থা? কি ঘটছে সব? কি হয়েছে শিল্প?”

শিল্প একবার বাবার দিকে তাকায় ফের সোহানের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে নিজের রুমের দিকে চলে যায়।
“কি হয়েছে ওর? এমন করছে কেনো? কি ঘটেছে সোহান ওর?”
“আপনার ছেলে পাগল হয়ে গেছে।”

______________

ঘরে তনু ঘুমিয়ে আছে। বাইরের প্রকৃতির আভাস ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি। শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে তনু, কোনো দুঃশ্চিতার পরত পরতে পারেনি তার চোখেমুখে। কিন্তু শিল্পের চোখে ঘুম নেই, আছে ক্লান্তি। সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, নাকি সেই এলোমেলো করে ফেলছে, কে জানে?
তনুর মাথার কাছে বসতে গিয়েও বসলো না সে, চলে গেলো জানালার পাশে। আকাশে আজ চাঁদ উঠেছে। নিয়ন আলোয় চাঁদের আলো ম্লান, তবুও নীল আকাশে গুচ্ছ তারকার মাঝে ওই একটি চাঁদ কতোটা প্রিয়। আজ আকাশে সাদা মেঘ নেই, পরিষ্কার আকাশ, ফুটফুটে চাঁদ, ঝলমলে গুচ্ছাকার তারকা। জানালার উড়ন্ত পর্দা, আকাশে চাঁদ, আবছা আঁধারে দাঁড়িয়ে থাকা বেদনা দীপ্ত পুরুষ।

আঁধার আমায় নিলো না তার গহীনে, দিলো না লুকাতে সব বেদনা।
আলো আমায় রাঙালো না তার রঙে, দিলো না শুকাতে একটু মনের ঘা।
আমি তারহীন গিটারের নেয়, ঘরের এককোণে পড়ে থাকা অকেজো প্রাণ।
আমি দ্বিধায় বাঁচা তনুজ, অগভীর সমুদ্রে পতিত নন্দন সমান।

______________

কেটে গেলো কয়েকটা দিন। দিনগুলো সহজ ছিল না। পরেরদিন সকালে মন্ত্রী সাহেব শিল্পদের বাড়ি ঘুরে গিয়েছেন। ভদ্র ভাষায় হালকা শাসন করে গিয়েছেন। বাইরে সর্বক্ষণ তাঁর লোক পাহারায় থাকে। মাঝে মাঝে রাত বিরাতে জানালা মধ্যে ইটের টুকরো মারে। শিল্প ব্যতিত কেউ তেমন বের হয়না। রক্তিমকে বাইরে খেলতে বা কোনো কারণে বের হতে দেওয়া হয়না। ঘরবন্দি জীবন চলছে তাদের। এতোকিছুর মাঝেও আটকে থাকেনি কেস। আদালতে উঠে গিয়েছে, পরের ডেটে তনুর ডাক পড়বে। পুলিশি পাহারাও আছে শিল্পদের বাড়ির বাহিরে। তাই খুব সুবিধে করতে পারছে না মন্ত্রী সাহেব বা তাঁর লোকজন। ওসি শাহেদ বড়ো কড়া কিছিমের মানুষ। এর মাঝে শিল্প অনেকবার তনুকে সেইদিনের কথা স্মরণ করাতে চেষ্টা করেছে। শাহেদ কয়েকবার ঘুরে গিয়েছে। কিন্তু তনুর কিছুই মনে পড়েনি। বরং সে আরো এগ্রেসিভ হয়ে উঠছে। তার আচরণ প্রতি মূহুর্তে পরিবর্তিত হয়। প্রচন্ড চিন্তায় দিন কাটে সবার।

তনুর রিপোর্ট হাতে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে এসেছে শিল্প। একসপ্তাহ পর আসতে বলা হয়েছিল। আজ অনেক সমস্যার সমাধান হতে চলেছে। ডাক্তারের চেম্বারে ডাক পড়তেই সেখানে গেলো সে। রিপোর্ট এগিয়ে দিলো ডাক্তারের দিকে। মনোযোগ সহকারে রিপোর্টের আদ্যপ্রান্ত দেখলেন ডাক্তার। খুব স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞেস করলেন,
“রোগী আপনার কে হয়?”
“আমার ওয়াইফ।”
“উনাকে কি এনেছেন?”
“জ্বি না।” ডাক্তার রিপোর্টের দিকে তাকালেন।

শিল্প নিজের উত্তেজনা চাপতে না পেরে বললো, “রিপোর্টে কি আছে? খারাপ কিছু?”
ডাক্তার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “খারাপই বলা চলে। আপনার নিজেকে শক্ত করা জরুরি।”
“আপনি বলুন।”
“আপনার স্ত্রী ডিমেনশিয়া রোগে আক্রান্ত।”
“ডিমেনশিয়া?”
“জ্বি ডিমেনশিয়া, ওয়ান কাইন্ড অফ মেন্টাল ডিসঅর্ডার। বাংলায় একে স্মৃতিভংশ বলে। স্মৃতি, বুদ্ধি, ব্যক্তিত্ব লোপ পায় এতে। এবং রোগ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। রোগী নিজের বর্তমানে ঘটা বা অতীতে ঘটা ঘটনা মনে রাখতে পারে না। একটা সময় রোগী নিজেকেই ভুলে যায়। আপনার ওয়াইফ একদিন হয়তো সব ভুলে যাবে। মাঝে মাঝে কিছু অংশ তার খেয়ালে আসবে তবে তা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। শেষমেশ এমন হতে পারে যে কয়েক সেকেন্ডের অধিক সে কিছুই মনে রাখতে পারবে না।”

চলবে..
মেহবুবা তানজীম

দেরি হবার জন্য দুঃখিত।এক পা দুপা
সিজনঃ ২
পর্বঃ ১৪

অনেক সময় নিয়ে বসে আছে শিল্প। সবাই চুপচাপ, সবার চোখে প্রশ্ন, মহিলা একাই কথা বলছেন। মহিলাটি মৃত মেয়েটির মা। পাশে একজন পুরুষ উপস্থিত আছেন। তিনি মৃত মেয়েটির বাবা।

“আপনাদের সাহায্য আমাদের খুব প্রয়োজন মি…”
“ইউসুফ। ”
“ওরা সবাই আমার মেয়ের ক্লাসমেট ছিল। যদিও ছেলেরা আলাদা কলেজে পড়ে। তবে তাদের সাথে থাকা মেয়েটি আমার মেয়ের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল। দুজনে একই কলেজে পড়তো। নিজের বন্ধুর হাতে এভাবে মারা পড়তে হবে কে জানতো।” মহিলা কাঁদতে আরম্ভ করলেন। ভদ্রলোক নিজের হাতের ভাঁজে নিয়ে নিলো তাঁকে। স্বান্তনার পরশ পাথর ছুঁয়ে দিলো তাঁর মাথায়।
“আমার সোনাটা কই? আমার কোল খালি হয়ে গেছে গো।” ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বললেন মহিলা।
“কেঁদ না, ওদের শাস্তি হবে খুব তাড়াতাড়ি। যেভাবেই হোক ওদের শাস্তি নিশ্চিত করবো।”

রুম জুড়ে মহিলাটির কান্নার শব্দ শুধু, বাকিরা সবাই প্রত্যক্ষদর্ষী। শিল্প রাকাকে চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করলো তনু কোথায়? সেও ইশারায় প্রকাশ করলো ঘুমাচ্ছে। মেয়েটা খুব ঘুমায় এখন। হয়তো দুর্বলতার জন্য। শিল্প অতিরিক্ত মাথা ঘামালো না সেদিকে, আগে এদিক সামলানো দরকার।
ভদ্রলোক নিজে থেকে কথা শুরু করলেন। ততক্ষণে ভদ্রমহিলার কান্না থেকে গেছে।

“আমি উপল দাশ, ও বিন্দু।” ভদ্রমহিলাকে দেখিয়ে বললেন তিনি। ভদ্রমহিলা হালকা ফোঁপাচ্ছে।
“তৃষ্ণা আমাদের একমাত্র মেয়ে। বয়স খুব বেশি না কেবলমাত্র কলেজে পড়ছে।” বলার ফাঁকে বুজে এলো উপল দাসের গলা।
“নিধি সেন, আমারই এক বন্ধুর মেয়ে সেখান থেকেই আমার মেয়ের সাথে পরিচয়। নিধি মেয়েটাকে আমি ভদ্র সভ্য বলে জানতাম। ওরা দুজন খুব সহজেই মিশে গিয়েছিল। সব ঠিকঠাক ছিল। ভগবান জানে পরে কি হলো। কেন এমন হলো? তবে আমি ওদের শাস্তি চাই। আপনারা প্লিজ আমাদের হেল্প করুন।” শিল্পের দিকে আকুতি ভরা চোখে তাকিয়ে আছেন উপল দাস। বিন্দু দেবীর চোখও শিল্পের দিকে৷ শিল্প কি বলবে নিজেই বুঝতে পারছে না। কি বলবে তনু কিছু জানে না, নাকি বলবে তনুর কিছুই মনে নেই। তার কি বলা উচিৎ। সোহান হয়তো শিল্পের মনের অবস্থা বুঝতে পারলো। তাই নিজে কথা বলা শুরু করলো।
“পুলিশ তো তাদের ধরেছেই সেখানে আমরা কি করতে পারি?”
“তৃষ্ণার ফোনে লাস্ট কল নিধির ছিল। বাড়িতেও নিধির সাথে দেখা করার কথা বলে বেরিয়েছিল। এসবের উপর বেস করে নিধিকে ধরা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসায় ছেলেগুলোর নাম বলে সে।”
“তাহলে তো ভালোই। নিজেরাই স্বীকার করেছে।”
“না ভালো না। ওরা সবাই অপ্রাপ্তবয়স্, অন্তত সার্টিফিকেট তাই বলে। এই অবস্থায় তারা কি শাস্তি পাবে তা চিন্তা যোগ্য। তাদের কটোর শাস্তি নিশ্চিত করতেই এখানে আসা।”

“দেখুন আমরা এখনো নিশ্চিত জানি না তনু কিছু জানে কিনা। তাছাড়া তনু অসুস্থ, সবচেয়ে বড় কথা তার অসুখ সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। মেয়েটা কিছু মনে রাখতে পারছে না। ব্যপারটা এমন হঠাৎ করে তার কিছু মনে পড়ছে, সেটা হতে পারে অতীত তখন সে বাকিটুকু ভুলে যাচ্ছে। মানে হয়তো আমি বোঝাতে পারছি না। ডাক্তার দেখানো হয়েছে, রিপোর্ট হাতে এলেই সব জানা যাবে।” সোহান থামলো খানিক। দুজন অসহায় বাবা-মা তার দিকে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এদের ভরসায় ফাটল ধরাতে মন শায় দিচ্ছে না। তবুও কিছু করার নেই। সোহান শিল্প একে অপরের দিকে একবার তাকালো। দুজনেরই দীর্ঘশ্বাস মিলে গেলো বাতাসে।

“আমরা আপনাদের কোনো আশ্বাসবাণী দিতে পারছি না। দুঃখিত।” কথা এটুকুই ছিল কিন্তু দুজন মানুষকে যেন ভেতর থেকে শেষ করে দিলো। এসব ঝামেলায় জড়ানোর কোনো ইচ্ছে ছিল না শিল্পের কিন্তু তারা জড়িয়ে গেছে না চাইতেও। তবে এখন তার মন এই অসহায় বাবা-মাকে সাহায্য করতে চাইছে। এটা অবশ্যই তাদের জন্য ভালো হবে না। সবচেয়ে বড় কথা তনুর কিছু স্মরণ নেই।

“আপনারা ভয় পাচ্ছেন তাইনা। আপনারা ওই নেতাদের ভয় পাচ্ছেন। আপনারা বুঝতে পারছেন না কতোটা জরুরি তনুকে আমাদের। মেয়েটাকে ডাকুন আমরা কথা বলবো। প্রয়োজন হলে তার পা ধরবো। তবুও ডাকুন।”
“কি বলছেন এসব আপনি! আপনি আমাদের যথেষ্ট বড়, দয়া করে এসব বলবেন না।” শিল্প বলে উঠলো। তাঁদের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আবারো বলতে শুরু করলো।
“তনুর সত্যি কিছু মনে নেই। তবে হ্যাঁ আমি আপনাদের সাহায্য করবো। তনুকে মনে করানোর চেষ্টা করবো সেদিনের কথা। সেদিন কি হয়েছিল জানার চেষ্টা করবো। মোদ্দা কথা আমি আপনাদের সাহায্য করার চেষ্টা করবো।” শিল্পের কথা শেষ হতেই বিন্দু দেবী শিল্পের কাছে এসে তার দু-হাত আঁকড়ে ধরে।

“সত্যি বলছেন!” শিল্প হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। মহিলা শিল্পের হাতে মাথা রেখে কাঁদতে শুরু করে। এ কোনো সাধারণ জল নয়, কৃতজ্ঞতার জল।

__________________

দাশ দম্পতি বেরিয়ে যেতেই সোহান শিল্পের দিকে কঠোর চোখে তাকালো।
“তুই কি ভেবে এসব করছিস? তনু অসুস্থ তুই ভুলে গেছিস।”
“না ভুলিনি, আমরা তো একটা চেষ্টা করতেই পারি।”
“তুই পাগল হয়ে গেছিস। কেউ বিপদ নিজে ডেকে ডেকে আনে নাকি।”
“আমরা বিপদে ছিলাম না কখন। আমরা বিপদে ছিলাম, আছি এবং থাকবো। আমি যদি তাদের সাহায্য নাও করি তবুও বিপদেই থাকবো। তোর কি মনে হয় মন্ত্রী সাহেব এতো সহজে ছেড়ে দিবেন আমাদের। উনি অবশ্যই চাইবেন না কোনো প্রমাণ খোলা ঘুরতে দিতে। তবে কেনো সাহায্য করবো না? আমি সবাই যদি নিজের চিন্তা করে অন্যকে সাহায্য করা থামিয়ে দেই তবে যখন আমরা বিপদে পরবো, সমস্যা আমাদের দোরগোড়ায় কড়া নাড়বে তখন… তখন কে সাহায্য করবে আমাদের। তারাও তো বলবে শুধু শুধু ঝামেলাই পড়ে লাভ কি….. জীবন একটাই, মরতে তো হবেই তবে কিছু ভালো কাজ যুক্ত হলে ক্ষতি কি।”
“আমি বুঝতে পারছি তোর কথা কিন্তু তনু… তনু কি কিছু বুঝবে? পরে দেখা গেলো সত্যিকার অর্থে তনু কিছু জানেই না।”
“আমরা দুইয়ের মাঝে ঝুলছি। এখন আমি কিছুই বলতে পারবো না।”
“তা বলবি কেনো, এখন তো সমাজসেবক হবার ভূত মাথায় চেপেছে। আমার জীবনের বড় ভুল কি জানিস তনুর মতো মেয়েকে তোর জীবনে আনা। তোর জন্য আজ মেয়েটি অস্বাভাবিক জীবন যাপন করছে…. ওর না সেদিন মরে যাওয়া উচিৎ….. ”

“চুপ আর একটা কথাও না, চুপ।” শিল্প আচমকা গলা চেপে ধরে সোহানের। কন্ঠ রোধ করে আঘাতে। করিম এগিয়ে আসে, সরিয়ে নেয় শিল্পকে।
“পাগল হয়েছ তোমরা দুজন? কি শুরু করলে কি? কি হয়েছে কিছু কি আমাদের জানানোর প্রয়োজন বোধ হয়না তোমাদের। নাকি সেই অধিকারও বয়সের সঙ্গে হারিয়েছি।”
শিল্প মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে সোফায়। সোহান ক্রোধে পাগল হয়ে চেঁচিয়ে উঠে।
“ওকে জিজ্ঞেস করুন, ওকে। কি শুরু করেছে কি। নিজে নিজে সব করে কাউকে জানানোর প্রয়োজন মনে করে না। নিজেকে খুব বীর ভাবে।”
“হ্যাঁ বীর ভাবি, বীর। শান্তি।” ক্ষ্যাপা বাঘের মতো তেড়ে ওঠে শিল্প। তার ব্যবহারে প্রত্যেকে বিস্মিত। করিম ধীর কন্ঠে বলে, “কি হয়েছে তোমাদের? এ কি অবস্থা? কি ঘটছে সব? কি হয়েছে শিল্প?”

শিল্প একবার বাবার দিকে তাকায় ফের সোহানের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে নিজের রুমের দিকে চলে যায়।
“কি হয়েছে ওর? এমন করছে কেনো? কি ঘটেছে সোহান ওর?”
“আপনার ছেলে পাগল হয়ে গেছে।”

______________

ঘরে তনু ঘুমিয়ে আছে। বাইরের প্রকৃতির আভাস ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি। শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে তনু, কোনো দুঃশ্চিতার পরত পরতে পারেনি তার চোখেমুখে। কিন্তু শিল্পের চোখে ঘুম নেই, আছে ক্লান্তি। সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, নাকি সেই এলোমেলো করে ফেলছে, কে জানে?
তনুর মাথার কাছে বসতে গিয়েও বসলো না সে, চলে গেলো জানালার পাশে। আকাশে আজ চাঁদ উঠেছে। নিয়ন আলোয় চাঁদের আলো ম্লান, তবুও নীল আকাশে গুচ্ছ তারকার মাঝে ওই একটি চাঁদ কতোটা প্রিয়। আজ আকাশে সাদা মেঘ নেই, পরিষ্কার আকাশ, ফুটফুটে চাঁদ, ঝলমলে গুচ্ছাকার তারকা। জানালার উড়ন্ত পর্দা, আকাশে চাঁদ, আবছা আঁধারে দাঁড়িয়ে থাকা বেদনা দীপ্ত পুরুষ।

আঁধার আমায় নিলো না তার গহীনে, দিলো না লুকাতে সব বেদনা।
আলো আমায় রাঙালো না তার রঙে, দিলো না শুকাতে একটু মনের ঘা।
আমি তারহীন গিটারের নেয়, ঘরের এককোণে পড়ে থাকা অকেজো প্রাণ।
আমি দ্বিধায় বাঁচা তনুজ, অগভীর সমুদ্রে পতিত নন্দন সমান।

______________

কেটে গেলো কয়েকটা দিন। দিনগুলো সহজ ছিল না। পরেরদিন সকালে মন্ত্রী সাহেব শিল্পদের বাড়ি ঘুরে গিয়েছেন। ভদ্র ভাষায় হালকা শাসন করে গিয়েছেন। বাইরে সর্বক্ষণ তাঁর লোক পাহারায় থাকে। মাঝে মাঝে রাত বিরাতে জানালা মধ্যে ইটের টুকরো মারে। শিল্প ব্যতিত কেউ তেমন বের হয়না। রক্তিমকে বাইরে খেলতে বা কোনো কারণে বের হতে দেওয়া হয়না। ঘরবন্দি জীবন চলছে তাদের। এতোকিছুর মাঝেও আটকে থাকেনি কেস। আদালতে উঠে গিয়েছে, পরের ডেটে তনুর ডাক পড়বে। পুলিশি পাহারাও আছে শিল্পদের বাড়ির বাহিরে। তাই খুব সুবিধে করতে পারছে না মন্ত্রী সাহেব বা তাঁর লোকজন। ওসি শাহেদ বড়ো কড়া কিছিমের মানুষ। এর মাঝে শিল্প অনেকবার তনুকে সেইদিনের কথা স্মরণ করাতে চেষ্টা করেছে। শাহেদ কয়েকবার ঘুরে গিয়েছে। কিন্তু তনুর কিছুই মনে পড়েনি। বরং সে আরো এগ্রেসিভ হয়ে উঠছে। তার আচরণ প্রতি মূহুর্তে পরিবর্তিত হয়। প্রচন্ড চিন্তায় দিন কাটে সবার।

তনুর রিপোর্ট হাতে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে এসেছে শিল্প। একসপ্তাহ পর আসতে বলা হয়েছিল। আজ অনেক সমস্যার সমাধান হতে চলেছে। ডাক্তারের চেম্বারে ডাক পড়তেই সেখানে গেলো সে। রিপোর্ট এগিয়ে দিলো ডাক্তারের দিকে। মনোযোগ সহকারে রিপোর্টের আদ্যপ্রান্ত দেখলেন ডাক্তার। খুব স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞেস করলেন,
“রোগী আপনার কে হয়?”
“আমার ওয়াইফ।”
“উনাকে কি এনেছেন?”
“জ্বি না।” ডাক্তার রিপোর্টের দিকে তাকালেন।

শিল্প নিজের উত্তেজনা চাপতে না পেরে বললো, “রিপোর্টে কি আছে? খারাপ কিছু?”
ডাক্তার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “খারাপই বলা চলে। আপনার নিজেকে শক্ত করা জরুরি।”
“আপনি বলুন।”
“আপনার স্ত্রী ডিমেনশিয়া রোগে আক্রান্ত।”
“ডিমেনশিয়া?”
“জ্বি ডিমেনশিয়া, ওয়ান কাইন্ড অফ মেন্টাল ডিসঅর্ডার। বাংলায় একে স্মৃতিভংশ বলে। স্মৃতি, বুদ্ধি, ব্যক্তিত্ব লোপ পায় এতে। এবং রোগ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। রোগী নিজের বর্তমানে ঘটা বা অতীতে ঘটা ঘটনা মনে রাখতে পারে না। একটা সময় রোগী নিজেকেই ভুলে যায়। আপনার ওয়াইফ একদিন হয়তো সব ভুলে যাবে। মাঝে মাঝে কিছু অংশ তার খেয়ালে আসবে তবে তা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। শেষমেশ এমন হতে পারে যে কয়েক সেকেন্ডের অধিক সে কিছুই মনে রাখতে পারবে না।”

চলবে..
মেহবুবা তানজীম

দেরি হবার জন্য দুঃখিত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here