#একজোড়া_পায়রা
#লুৎফুন্নাহার_আজমীন(#কন্ঠ)
#পার্ট৪

গ্রামের বাড়িতে বিয়ে হবে।তাই সরাসরি গ্রামের বাড়িতেই চলে যাই।গিয়ে দেখি বিয়ের সব তোড়জোড় চলছে।বারান্দায় বসে পান চিবতে চিবতে সঙ্গীদের সাথে গল্প করছিলেন দাদি।আমায় দেখে মুহুর্তেই তার মুখের হাসি বিলীন হয়ে যায়।আমি গিয়ে দাদিকে সালাম দিই।অনেকটা জোর করেই দাদি আমার সালামের জবাব দেন।মা আমায় নিজের ঘরে নিয়ে আসে।হাতে জামা আর গামছা ধরিয়ে দিয়ে বলে গোসল করে আসতে।অনেক নাকি কাজ আছে।কিন্তু গোসল করতে গিয়ে বাজে বিপত্তি।এখানে কোনো বাথরুম নেই।দুটো টিউবওয়েল পাড় আছে।একটাতে রান্না বান্নার যাবতীয় ধোয়া মাজা করা হয়।আরেকটাতে সবাই গোসল করে কাপড় কাচে।ভরা অনুষ্ঠান বাড়িতে আমি কিভাবে টিউবওয়েল পাড়ে গোসল করি!জামা কাপড় হাতে নিয়ে বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে আছি।আমাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বড়মা এগিয়ে আসে।

-কিরে? এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?গোসল করবি না !
-বড়মা!এভাবে সবার সামনে টিউবওয়েল পাড়ে….

আমতা আমতা করে বলি আমি।বড় মা একটু ধমক দিয়ে বলে,,,

-আগে না করতি।
-আগে ছোট ছিলাম এখন বড় হইছি।
-তাই কি?আমরা করতে পারলে তুইও পারবি করতে!শহরে গিয়ে তুমি ঢং শিখেছো না!
-প্লিজ বড়মা তুমি আমায় বিছানার মোটা চাদর আর দড়ি এনে দাও।দু পাশে তো টিনের বেড়া দেওয়াই আছে।বাকী দুপাশে না হয়…!

আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই বড় মা হেসে বলেন,,,

-দাঁড়া আনছি।

কিছুক্ষণ বাদেই বড়মা মোটা চাদর আর রশি নিয়ে আসেন।আমি সেগুলো দিয়ে টিউবওয়েল পাড়টা আড়াল করে নিই।আমার এ হেন কাজে আমন্ত্রিত লোকজন মুখ টিপে হাসে।আমায় নিয়ে কানাকানি করতে লাগে।অনেকেই বলে গ্রামের মানুষ নাকি সহজ সরল।কিন্তু এরা একেকটা কি জিনিস তা
তারাই জানে যারা এদের জেরা,আলোচনা-সমালোচনার পাত্র হয়েছে।কোনো রকমে তাড়াহুড়ো করে গা ভিজিয়ে আমি মুক্তি পাই।দুপুরের খাওয়া হয়ে গেলে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে অনলাইনে ঢুকি।গ্রামে নেটওয়ার্কের প্রবলেম থাকায় সব লোডিং।শেষে বিরক্ত হয়ে অফলাইন হই।সন্ধ্যায় হলুদ।মানুষ বলে আমি নাকি আঁকাআঁকি ভালো পাই।রঙ তুলি হাতে ধরিয়ে দিয়ে অনুর মা বলে যতটুকু পাই আলপনা দিতে।অগত্যা!রঙতুলি নিয়ে বসে পড়ি উঠোনে।উঠোন পাকা থাকায় খুব একটা অসুবিধা হয় নি আলপনা দিতে।বিকালের দিকে আলপনা দেওয়া শেষ হতে না হতেই ডাক পড়ে হলুদের স্টেজ, আইটেম সাজানোর। নিজের আপন বোনের বিয়েতেও হয়তো এত করতাম না।অনু অনুর মা বিশ্বাস করে সব দায়িত্ব দিয়েছেন।না করে থাকি কিভাবে।অনু আমার দূর সম্পর্কের চাচাতো বোন।আমার দাদারা তিন ভাই ছিলেন।আমার দাদা বড়।অনুর দাদা মেঝ ছিলেন।তাই বলা যায় অনুযায়ী অনু আমার দূর সম্পর্কেরই চাচাতো বোন।হলুদের স্টেজ,আইটেম গুছিয়ে যাই অনুকে সাজাতে।অনুকে সাজিয়ে হলুদের স্টেজে বসিয়ে ঘরে গিয়ে কোনো রকমে জামা চেঞ্জ করে বের হই।মেহেদী পড়িয়ে দিয়ে দেখি সবাই এখন অনুকে নিয়ে ব্যস্ত।নেটওয়ার্কের সমস্যার জন্য অনেকক্ষণ হলো অনলাইনে যাই না। মানুষ ধান কেটে ঘরে তুলেছে।ক্ষেতে যাওয়াই যায়।তাতে যদি একটু নেটওয়ার্ক পাই।সবার চোখের আড়াল হয়ে ক্ষেতে গিয়ে ডাটা অন করি।আলহামদুলিল্লাহ নেটওয়ার্ক পেয়েছি। বিয়ে বাড়িতে এসেছি একটু শো অফ না করলে হয়!যখন অনুকে মেহেদী পড়িয়ে দিচ্ছিলাম তখন কাজিনকে দিয়ে কয়েকটা ছবি তুলি।সেগুলোর একটাই ফেসবুকে স্টোরি দিই।সাথেই দেখি নিহান সীন করেছে।কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার স্টোরির রিপ্লাই দেন তিনি,,,

-মেহেদী কে পরাচ্ছে?আপনি?
-হুম।

আমি রিপ্লাই দিই।উনি চাপা হাসির ইমুজি দেন।আমি রিপ্লাই দিই,,

-কিছু বলবেন?
-আপনি একসাথে দুইটা ভার্সিটিতে পড়েন তাই না?

তার এ হেন প্রশ্নে আমি ঘাবড়ে যাই।একটু দেরিতেই রিপ্লাই দিই,,

-মানে?
-মানে আইডিতে লেখা জাহাঙ্গীর ইউনিভার্সিটি আবার ট্রেনে বললেন জগন্নাথ!
-অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়ি হয়েছে?
-রেগে গেলেন নাকি?
-উহু।রাগ করবো কেন?রাগ করার কী আছে?
-কি করেন?
-অনলাইনে থেকে মানুষ কী করে?পিঠা বিক্রি করি স্টেশনে এসে কিনে নিয়ে যান।

নিহান আমার মেসেজে হাহা রিয়েক্ট দেয়।আর মেসেজ দেয়,,,

-আপনি অনেক মজার মানুষ তো!

আমি রিপ্লাই দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করি না।সীন করে রেখে দেই।

-আপু তুমি এখানে?ও দিকে দাদি তোমায় খুঁজছে।

শিমুলের ডাকে পেছন ফিরে তাকাই।দাদি খুঁজছে?এখনই যেতে হবে।না হলে পরে কি হুলুস্থুল কান্ড বাঁধে।আল্লাহই জানেন।ঘরে গিয়ে দেখি তসবিহ হাতে দাদি বসে আছেন।পাশে শান্ত

-আইছোত?
-হু দাদি।
-শান্ত তোরে ফোন দেয় ধরস না শুনলাম।ছেড়াডায় দেখ তোরে দেখবার লাইগা এনেই আইয়া পড়ছে।যা তোরা নিজেগো মতো কইরা সময় কাটা গা।

তোরে দেখবার লাইগা এনেই আইয়া পড়ছে!যেন আমায় উনি এখানে এসে উদ্ধার করে ফেলেছেন।আমার দূরসম্পর্কে চাচাতো বোনের বিয়ে! এখানে তার এমন করে আসতে হবে কেন বুঝলাম না।কুকুরের মতো এসেছে বিনা দাওয়াতে দাওয়াত খেতে।আমি আর কিছু না বলে চলে যাই সেখান থেকে।পেছন পেছন দেখি শান্তও বেরিয়ে আসে।গিয়ে হলুদের ওখানে একটা ফাঁকা চেয়ার দেখে বসি।ব্যাটা ওখানেও চলে আসে।মুচকী মুচকী হাসি দিয়ে বলে,,,

-দাদি আমাদের একান্ত সময় কাটাতে বলেছেন।
-আমার মুড ইচ্ছা কোনোটাই নাই আপনার সাথে সময় কাটানোর।যদি খুব বেশি একা লাগে তাহলে কোনো একটা মেয়েকে ইম্প্রেস করে নিয়ে যান।আর কোনো মেয়ে না পটলে আমার দাদিকেই নিয়ে যান। দুইজনকে মানাবেও ভালো।রোমিও জুলিয়েট।
-বউ থাকতে অন্য মেয়ে লাগে?
-বিহেভ ইউর সেল্ফ।এটা বিয়ে বাড়ি।অনেকেই আছেন এখানে।ভদ্রতা বজায় রেখে কথা বলুন।

শান্ত আর কোনো কথা বলে না।ঠাস করে আমার হাতটা ধরে নেয়।আমি হাত ছাড়াতে হাত মোচড়ামুচড়ি করতে লাগি।কিন্তু পেরে উঠি না।বাধ্য হয়ে বা হাত দিয়ে কষে একটা চড় বসিয়ে দেই।মুহুর্তেই বিয়ে বাড়ি স্তব্ধ হয়ে যায়।চড় খেয়ে শান্ত আমার হাত ছেড়ে দেয়।অনেকের কাছে হয়তো এটা সামান্য বিষয় মনে হলেও শান্তের এমন আচরণ আমার আত্মসম্মানে আঘাত করেছে।বিয়ে বাড়িতে তিনি এমন না করলেও পারতেন।ঝাপসা হয়ে আসছে চারপাশটা।কেঁদে দিই আমি।কাঁদতে কাঁদতে বলি,,,

-কতবার বলবো আপনাকে আমার ভালো লাগে না।তাও কেন বারবার আমার কাছে আসেন?আমায় ছোঁয়ার চেষ্টা করেন?

শান্ত আমায় টিনের বেড়ার সাথে চেপে ধরে।লোহার সুচালো অংশ আমার জামা বেধ করে পিঠে বিঁধে।ব্যথায় কুঁকড়ে উঠি আমি।কিন্তু সেদিকে শান্তর কোনো হুশ নেই। গাল দুটো শক্ত করে চেপে ধরে হিংস্র কন্ঠে সে বলে,,,

-নতুন পেয়েছিস না শহরে গিয়ে?আমায় তোকে ভালো লাগে কি লাগে না আমি জানতে চাইনি।আমার তোকে ভালো লাগে।আজ হোক কাল হোক আমারই সাথে তোর বিয়ে হবে।

বাবা এসে আমায় তার হাত থেকে রক্ষা করে।ভরা বিয়ে বাড়িতে এমন অপমান সহ্য করতে না পেরে আমি কাঁদতে কাঁদতে ঘরে চলে যাই।ঘরে গিয়ে দেখি ক্ষতস্থান থেকে ঝড়া রক্তে আমার সাদা জামা লাল বর্ণ ধারণ করেছে।বেশ অনেকটাই ক্ষত হয়েছে বুঝা যাচ্ছে।ছোট খাটো ব্যাথা পেলে ব্লিডিং বন্ধ হয়ে যেত।যেহেতু এখনও ব্লিডিং বন্ধ হচ্ছে না তাই আমি নিশ্চিত হই যে বেশ ভালোই ব্যথা পেয়েছি।বড্ড জ্বালা করছে ক্ষতস্থানে।খাটের পায়ার সাথে হেলান দিয়ে বসে পড়ি। দাদি কিভাবে পারে আমায় এই অমানুষটার সাথে বিয়ে দিতে। ঐ লোকটার সাথে বিয়ে হলে আর পাঁচটা নির্যাতিত মেয়ের মতো আমারও নাম কোনো একদিন খবরের কাগজের শিরোনাম হবে এই সম্পর্কে আমি নিশ্চিত। যেভাবেই হোক ঐ শান্তকে আমি বিয়ে করছি না।


দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে চোখ মেলে তাকাই।কে যেন দরজা ধাক্কাচ্ছে।কাঁদতে কাঁদতে কখন যে চোখ লেগে গিয়েছিলো খেয়ালই করিনি।

-মেঘ?এই মেঘ।
-কে?

আমি ভাঙা গলায় বলি।কাঁদতে কাঁদতে দেখা যায় গলাটাও বসে গেছে!দরজার ওপার থেকে উত্তর আসে,,,

-আমি মা।দরজা খোল।

গিয়ে দরজা খুলি।মা ঢুকেই আমার পিঠের ক্ষতস্থান দেখেন।রক্ত জমাট বেঁধে আছে।মা অশ্রুসিক্ত চোখে বলে,,

-শয়তানটার স্পর্ধা দেখে অবাক হই আমি
-শয়তান বলো কেন?তোমার মেয়ের জামাই না?মেয়ের জামাই ই বলো।দেখো মা ঐ লোকটার সাথে বিয়ে হবার পর তোমার মেয়েও নিউজ পেপারের হেডলাইন হয়ে….

আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই মা আমার মুখ চেপে ধরে।

-আজকের ঘটনার পর মনে হয় না তোর বাবা এই বিয়েতে সায় দেবে।
-দাদি?দাদির কথায়ই তো সব চলে।নাতনি মরে যাক।তাও তিনি তার বোনকে দেওয়া কথা রাখবেনই।
-বয়স্ক মানুষ। বাদ দে তুই।দে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দেই।তোর বাবা তাড়াহুড়ো করে বাজার থেকে মেডিসিন নিয়ে এসেছে।তাই দেরি হলো।

মা জামাটার চেইন খুলে ক্ষতস্থানে এন্টিসেপ্টিক দেয়।ব্যথায় আহ বলে উঠি আমি।মা ক্ষতস্থান পরিষ্কার কর‍তে করতে বলে,,

-গর্ত হয়ে গেছে একেবারে।শুকাতে কতদিন লাগে আল্লাহই জানেন।

চলবে,,,ইনশাআল্লাহ

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here