#ইস্ক
#সাদিয়া

১২
লোকটা তার সামনে এলেই হৃদপিন্ডের স্পন্দন বেড়ে যায় কেমন। কাঁপন ধরে শরীরে। ভেতরে সহস্র অনুভূতি গুলি এলোমেলো হয়ে খেলতে শুরু করে। ইয়াদ কে বিছানায় আধোশোয়া অবস্থায় দেখে আবারো শুকনো ঢোক গিলে নিল তিতিল। ভেতরটা পানির পিপাসায় চৌচির হয়ে আছে। কথায় আছে “যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়।”
তিতিল কে অবাক করা চোখে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইয়াদ মুচকি হাসল। কপাল কুঁচকে এসেছে এতে।
“আপনি এখানে কেন?”

“তুমি এখানে তাই।”

“….

“চলো।”

“কোথায়?”

“গেলেই দেখতে পাবে।”

“দেখার দরকার নেই আমার কিছু। আপনি যান।”

“….

“কি হলো যান?”

“তুমি যেমন টা বলবে।”

ইয়াদ চুপচাপ দরজার কাছে এসে খুলল। একপা দরজার ভেতরে অন্য পা বাহিরে ফেলতেই তিতিল দরজা লাগাতে গেল। তিতিলের দুর্ভাগ্য দরজা লাগানোর আগে আবার ইয়াদ হাত দিয়ে আটকাল তা। তার দিকে খানিক ঝুঁকে বলল,
“আমি কি একা যাবো?”

ইয়াদকে বেশ পছন্দ হলেও তার হেলাফেলা ভাব তিতিল কেন যেন নিতে পারে না। চোখ মুখ শক্ত করে বলল,
“একাই যাবেন আর যান।”

ইয়াদ আবার ভেতরে ঢুকল। কোমর পেঁচিয়ে তিতিল কে নিজের সাথে চেঁপে ধরল। তিতিল নিজেকে ছাড়াতে নাড়াচাড়া শুরু করে দিয়েছে।
“পাখির বাচ্চার মতো ছটফট না করে একটু শান্ত হও না প্রিয়।”

“ছাড়ুন আমাকে।”

“ওয়েট।”

তিতিল কে ছেড়ে দিল সে। তিতিল পা পিছিয়ে যেতে চাইলে তার আগে ইয়াদ তাকে কোলে তুলে নিল। এবার তিতিল গলা কাটা মুরগির মতো দাপাতে লাগল। ইয়াদ মুচকি হেসে বলল,
“মেয়ে বেশি ছটফট করবে তো ধপাস করে নিচে ফেলে দিব।”

“দিন না করেছে কে? ছাড়ুন আমাকে।”

“এই তুমি কি পুতুল?”

লাফানো রেখে তিতিল অবাক হয়ে তাকাল ইয়াদের দিকে।
“নাকি তুলো দিয়ে গড়া? এত পাতলা কেন তুমি? কিছু নিয়েছি কিনা সেটাই তো বুঝতে পারছি না। যাক এখন থেকে তোমাকে কোলে নিয়ে এক্সারসাইজ করা যাবে। আচ্ছা ৪০ কেজি হবে তো?”

তিতিলের রাগ হলো। দাঁত কিটে হাত পা ছুড়তে লাগল আবার ছুটার জন্যে।

ইয়াদ একদম নিজের রুমে গিয়ে থামল। তিতিল কে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে গিয়ে দরজা লক করল। রাগে তিতিল বলল,
“আপনি আমাকে এখানে আনলেন কেন?”

“….

“চুপ করে থাকবেন না বলুন।”

“থাকার জন্যে এনেছি।”

“আমি এখানে থাকতে চাই না।”

“কারণ জানতে চাই।”

“কোনো কারন নেই। আমাকে যেতে দিন।”

“সবকিছুরই কারণ থাকে। সো বলো।”

“আপনি সবটাই জানেন।”

“কি জানি বলো?”

তিতিলের এবার খুব রাগ হতে লাগল। জোর গলায় চোখ বন্ধ করে বলল,
“আমাকে এখান থেকে যেতে দিন।”

কিছুক্ষণ ঘরটা শুনশান নীরব ছিল। তিতিল যখন বুঝতে পারল এতটাও জোরে কথা বলা ঠিক নয় তখন নিস্তেজ গলায় বলল,
“দেখুন আপনি..”

তিতিল কে থামিয়ে দিয়ে ইয়াদ শান্ত গলায় বলল,
“তিতিল এই ঘরে থাকতে তোমার প্রবলেম কি?”

“প্রবলেম আছে। যেতে দিন।”

ইয়াদ ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে তিতিলের দিকে। ইয়াদ কে এভাবে দেখে তিতিলের বড্ড কষ্ট লাগছে। নিজেকে সামলাতে পারছে না। কি করা উচিৎ তাও বুঝতে পারছে না। মন আর বিবেক দ্বিধাধন্ধে আছে। দাঁত চেঁপে তিতিল নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করল।

“আমরা এক ঘরে থাকলে মা খুশি হবে। আর…”

তিতিল এবার তাচ্ছিল্যের সুরে হাসল। বলল,
“আম্মার খুশি?”

“….

“কোথায় ছিল আপনার মায়ের খুশি তখন যখন নিজের পছন্দে ছেলে কে বিয়ে করাল অথচ ছেলে দুই দিন যেতে না যেতেই বিদেশ চলে গিয়েছিল বউ রেখে?”

“….

“কোথায় ছিল তখন খুশি? এখন কথা বলুন। আপনি তো আমার মুখটাও না দেখে চলে গিয়েছিলেন। দুই বছর পর ডিভোর্সের জন্যে ফিরে কেন এমন করছেন আমার সাথে?”

ইয়াদ শান্ত গলায় বলল,
“আমি এখানে ডিভোর্সের জন্যে আসি না।”

“অথচ ঠিকি ওখানে দুই বছর আরাম আয়েশ থেকেছেন। যাকে বিয়ে করে গিয়েছিলেন একবার তার খুঁজ নিয়েছিলেন? আরে আপনার তো মনেই ছিল না বিয়ের কথা। ঠিক বলছি না?”

ইয়াদের বলার মতো কিছু নেই। মাথা নুয়ে অপরাধী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তিতিলের সামনে।

“আমি যা বলছি ঠিকি বলছি। আপনি তো ওখানে মেয়েদের সাথে ভালোই করে সময় কাটিয়েছেন। আর এখানে বিয়ের নামে একটা মেয়েকে যে বেঁধে রেখেছিলেন তার কথা তো মনে ছিল না।”

“আমি ওরকম ছেলে নই তিতিল।”

“জানি আপনি ওরকম নয়। কিন্তু আমার কি দোষ ছিল? কেন দুইটা বছর অপেক্ষা করালেন আমায়?”

ইয়াদ তিতিলের চোখের দিকে তাকাল। তিতিলের চোখ গুলি তখন লাল হয়ে আছে। পানি গাল বেয়ে গলায় এসে পড়ছে। ভেতরটা কেঁপে উঠল তার। গলায় শক্ত কিছু অনুভব করছে সে। কষ্ট কি তার গলায় এসে কান্না হয়ে চেঁপেছে?

“আমাকে আপনি দুইটা বছর কষ্ট দিয়েছেন প্রতিটা সময় প্রতিটা মুহূর্ত। সদ্য বিয়ে হওয়া একটা কিশোরী কে বিরহের চাদরে আপনি মুড়িয়ে দিয়েছেন যেখান ভালোবাসার সাগরে ভাসার কথা ছিল আমার।”

“….
ইয়াদের বড্ড অপরাধী বোধ লাগছে। এভাবে আগে কখনো না ভাবলেও তিতিলের কথা গুলি বুকে বাণের মতো লাগছিল। বুকটায় কেমন ওজন পাথর চেঁপে বসেছে। ঢোক গিলতেও বাঁধাপ্রাপ্ত হচ্ছে ইয়াদ। চোখ গুলি লাল হয়ে উঠেছে তার।

“দুই বছর পর কেন আমার প্রতি এতটা দরদ বেড়ে গেল আপনার? আমার সৌন্দর্য দেখে নাকি দেহের জন্যে?”

দুনিয়ার সবচেয়ে নিচু মানুষ মনে হচ্ছে নিজের কাছে ইয়াদের এই মুহূর্তে। চোখ বন্ধ করে নিয়েছে সে। যেন কেউ এক দলা থুথু ছিটিয়ে দিয়েছে তার উপর। তাকাতে পর্যন্ত পারছে না ছেলেটা। ঘৃণায় দলা পাকিয়ে গেছে একদম।

“আজ আমাকে যদি অসুন্দর দেখতেন, কালো দেখতেন তখন কি করতেন আপনি? ছেড়ে দিতেন না? এক মুহূর্ত সহ্য করতেন আমাকে?”

ইয়াদ তাকাল তিতিলের দিকে। চোখের পাতা কাঁপছে তার।

“চুপ করে আছেন কেন? বলুন আমি সত্যি বলছি কিনা।”

ইয়াদ লাল লাল চোখ নিয়ে তিতিলের বাহু চেঁপে নিজের কাছে আনল। তিতিল তাকাল তার দিকে। টকটকে লাল চোখ গুলি দেখে আতকে উঠল তিতিল। কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে চোখগুলির দিকে। সরু লাল লাল রগ গুলিও যেন ভেসে উঠেছে ইয়াদের। ঠোঁট কাঁপতে লাগল ইয়াদের। এলোমেলো চোখে তিতিলের দিকে তাকাল। কাঁপা ঠোঁট আর ঘোর লাগানো কন্ঠে বলল,
“আমরা সবাই সৌন্দর্যের পাগল। তবে কারো চোখের সৌন্দর্য ভিন্ন রকম হয়। একেক জনের চোখে একেক ধরনের মানুষের সৌন্দর্যের মুগ্ধতা থাকে। সত্য এটাই ৯৮% মানুষই সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে একটা মানুষের দিকে ঝুঁকে পড়ে। তাই বলে এই নয় যে সৌন্দর্যের কারণেই এমনটা হয় কিংবা দেহের। ভালোলাগা থেকেই শুরু হয়ে ভালোবাসা হয় এতে অস্বীকার করার বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। কেউ যদি বলে আমি সৌন্দর্য নয় মানুষ দেখে ভালোবাসি তবে ওটা নিহাতি তার মুখোশের আড়ালে ভালো মানুষি কিংবা বোকামি। এই ভালোলাগা একসময় সমুদ্রের গভীরের চেয়েও বিশাল অনুভূতি সৃষ্টি করে একটা মানুষের অন্য একটা মানুষের প্রতি। আর সেই অনুভূতি গুলি তখন তাকে জানান দেয় হ্যাঁ ওই মানুষটাই তোমার। তুমি ওকেই চাও। তখন ওটাকেই মানুষ ভালোবাসা বলে দাবী করে। তবে শুরু ওই মুগ্ধতা থেকে হয়। অনুভূতির ঘরে তখন ভালোবাসা ঠাই মেরে বসে তিতিল।”

কাঁপা ঠোঁট গুলি নিয়ে ইয়াদ এখন তিতিলের দুই গালের পাশে হাত রাখল। তিতিল তখনো মুগ্ধতা নিয়ে মানুষটাকে দেখছে। এই মানুষটাকে নিয়ে অনুভূতির কি শেষ আছে তার? একদিনও তো বাদ নেই যে সে এই লোকের আশা স্বপ্ন করেনি। একটা বার লোকটার আলিঙ্গন পাওয়া প্রয়াস করা হয়নি। এমন তো একটা দিনও নেই তিতিলের। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে তার।

“তিতিল তোমাকে আমি পছন্দ করি এটা সত্যি। তাই বলে যে..”
ইয়াদে গলা ধরে আসছে এবার। লাল লাল চোখ গুলি দিয়ে এবার টুপ করে পানি পড়েই গেল। বুকটা একদম কেঁপে উঠেছে তিতিলের ওই একবিন্দু চোখের পানি দেখে।
ইয়াদ সাথে সাথে তিতিল কে ছেড়ে দিয়ে উল্টো পিঠে দাঁড়াল। নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করে বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে চোখের পানিটা মুছে নিল। কান্নাভরা কন্ঠ নিয়ে ধীরেধীরে বলল,
“বেডে গিয়ে শুয়ে পড়ো। আমি না সোফায় থাকব। তাতেও তোমার প্রবলেম হলে ব্যালকুনিতে কাটিয়ে দিতে পারব। রাত জেগো না শুয়ে পড়ো।”

কথাটা শেষ করে এক সেকেন্ড ইয়াদ ওখানে দাঁড়ায় নি। যতদ্রুত সম্ভব সে জায়গা ত্যাগ করে ব্যালকুনিতে স্থান নিল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here