#ইসলামিক_গল্প
#ফেরা :
দুই বোনের ইসলাম গ্রহণের গল্প
পর্ব-৪ ও শেষ
বাসায় সিহিন্তার ইসলামিক বই গুলো সব খুঁজে বের করলাম। আরো বেশি জ্ঞান অর্জনের দিকে মনোযোগ দিলাম। নিজেকে অনেকটাই বদলে ফেললাম। আর তখনই আমার জীবনের আরেকটি বড় ঘটনার সূচনা হলো! আমার ফেন্ড লিস্টে একজন ছিলেন, যাকে ইসলামিক পোস্টের জন্য এ্যাড করেছিলাম আরো আগে। তবে কথা হতোনা তার সাথে। সেই ছেলে আমার স্ট্যাটাস পড়ে যখন জানতে পারলো আমি রিভার্টেড মুসলিম, সে আমাকে ম্যাসেজে একজন বয়ষ্ক মহিলার id দিলো এ্যাড করার জন্য। এবং বললো যে আমার ইসলাম পালনে সমস্যা হলে ওই মহিলার সাথে আলাপ করতে। এ্যাড করলাম উনাকে। উনার নাম ফয়জুন নাহার। খুব ভালো লাগতো উনার সাথে কথা বলতে। উনার কাছ থেকেই জানতে পারলাম উনি সৌদি আরবে থাকেন। যদিও তিনি ইউসুফের আপন মা না তবে ইউসুফ তাকে আপন মার মতোই দেখেন। তিনিও ইউসুফকে তার ছেলের মতো দেখেন। তিনি আমার থেকে আমার বাসার অবস্থা, আমার অবস্থা ইত্যাদি জেনে নিলেন ও বললেন যে তিনি আমার জন্য ছেলে দেখবেন। প্রায়ই উনার সাথে চ্যাটে কথা হতে লাগলো। আমিও আপন ভেবে উনার সাথে আমার সকল সমস্যা নিয়ে আলাপ করতাম। একদিন উনি আমার জন্য একটি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসলেন….
ফয়জুন নাহার আন্টির সাথে আমার সম্পর্ক খুব ভালো ছিলো। অনেক কথাই তার সাথে শেয়ার করতাম। তো একদিন উনি আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসলেন। উনি ছেলের বর্ণনা দিতে লাগলেন। কী রকম ইসলামিক মাইন্ডের, পরিবার কেমন ইত্যাদি। কিন্তু যতবার প্রশ্ন করতাম ছেলে কী করে, নাম কি, উনি কথা এড়িয়ে যেতেন। তখনই আমি সন্দেহ করি উনি ইউসুফ হোসেনের কথাই বলছে। কারণ উনি কী করেন আমি জানি। আমি উনার কথা শুনছিলাম আর হাসছিলাম মনে মনে। ইউসুফ হোসেন কেন আমাকে উনাকে এ্যাড করার জন্য ম্যাসেজ দিয়েছিলেন তা পরিষ্কার হয়ে গেলো। সেদিন উনার pc তে সমস্যা থাকায় বেশি কথা হয়নি। পরেরদিন উনি জানান যে তিনি ইউসুফের কথাই বলছিলেন।
আমি আমার বিয়ের পাত্র খোঁজার দ্বায়িত্ব অপু ভাইয়াকে দিয়েছিলাম। সুতরাং আমি উনাকে বললাম ইউসুফকে বলতে উনি যেনো অপু ভাইয়ার সাথে কথা বলেন। ভাইয়ার পছন্দ হলে এরপর আমি কথা বলবো। ইউসুফ জানতোনা শরীফ আবু হায়াত আমার দুলাভাই, জানার পর তো উনি মহা খুশি। ভাইয়ার ফোন নাম্বার দিয়েছিলাম আমি ফয়জুন নাহার আন্টির কাছে। ইউসুফ ভাইয়ার সাথে কথা বলে দেখা করলেন। ভাইয়া উনাকে খুব পছন্দ করলেন। কথায় কথায় বের হয়ে গেলো উনার ছোট বেলার বন্ধু আমার চাচাতো বোনের হাসবেন্ড। ভাইয়া আমাদের সামনাসামনি দেখা করতে বললেন। এক সপ্তাহ পর ভাইয়ার বাসায় দেখা করবো ঠিক হলো। এই এক সপ্তাহে আমি ফয়জুন নাহার আন্টির কাছ থেকে উনার সম্পর্কে মোটামুটি যা জানার জেনে নিলাম। উনার মা আর বোনও আমার ছবি ও বায়োডাটা দেখে পছন্দ করলেন।
এক সপ্তাহ পর শুক্রবার জুম্মার সালাতের পর উনি আসলেন আপুর বাসায়। সাথে আমার চাচাতো বোন ও তার হাসবেন্ডও আসলো। আমার জন্য একটা বই “আদর্শ নারী” ও চকলেট নিয়ে এসেছিলেন। যখন সামনে গেলাম কথা বলতে, উনি আমাকে প্রথম প্রশ্ন করেছিলো যে আমার দৃষ্টিতে বিয়ে মানে কী! আমার মাথা তখন পুরাই ব্ল্যাঙ্ক। কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে ছিলাম।
আমি অনেক বেশি ইমোশনাল তা উনি আন্টির থেকে জানতে পেরেছিলেন। এরপর আমাকে ইমোশন নিয়ে কিছু লেকচার দিলেন। আমি মাথা নাড়ানো ছাড়া আর কিছুই বলিনি। এমনকি উনাকে একটা প্রশ্নও করিনি। আমার যা জানার ছিলো তা তো আগেই আন্টির থেকে জেনে নিয়েছিলাম, তাছাড় া কেনো জানি মুখে কোনো প্রশ্নও আসছিলোনা। যাই হোক আমি প্রশ্ন না করাতে উনি মনে কষ্ট পেলেন। উনার ধারণা হলো যে আমার উনাকে পছন্দ হয়নি। মন খারাপ হয়ে গেছিলো উনার। দুপুরে সিহিন্তার বাসায় খেয়ে উনারা চলে গেলেন। বিকালে অপু ভাইয়া আমাদের দুজনকেই কল করে জানতে চাইলেন আমাদের কী মত। আমরা জানালাম যে আমরা রাজি আছি। এপর্যন্ত সব ঠিক মতোই এগিয়েছে।
এখন আসল পরীক্ষা শুরু। তা হলো আমার মাকে রাজি করানো! মাকে জানানোর দায়িত্য অপু ভাইয়া আর সিহিন্তা নিলো। টেনশনে আমার খাওয়া দাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গেলো। মুসলিম হবার পর থেকে যে পরীক্ষা দেয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম সেই পরীক্ষার দিন এখন সামনেই। দুআ করতে লাগলাম মা বাবা যেন রাজি হয়ে যায় আর আমার বিয়েতে যেন হাসি মুখে উপস্থিত থাকেন। ইউসুফ আর আমি রাজি, ওর পরিবার রাজি, এখন আমার বাসায় জানানোর পালা।
অপু ভাইয়া একদিন উনার বাসায় মা আর বাবাকে যেতে বললেন। মা বাবা যাওয়ার পর সন্ধ্যায় সিহিন্তা আর ভাইয়া উনাদের জানালেন ইউসুফের কথা। মা তো শুনেই না করে দিলো। মুসলাম ছেলের সাথে উনি কিছুতেই আমার বিয়ে দিবেন না। রাগ করেই সিহিন্তার বাসা থেকে চলে আসলো। এদিকে আমি মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছি। মা বাবা যে রাজি হবেনা তা তো ভালো মতোই জানতাম। এখন বাসায় এসে আমাকে ইসলাম গ্রহনের কথা জিজ্ঞেস করলে কি বলবো, কি করবো এসব ভাবছিলাম। আর দুআ করছিলাম বার বার আল্লাহ যেন সব সহজ করে দেন। আমি চাই মা বাবা বিয়েতে রাজি হয়ে খুশি মনে উপস্থিত থাকুক। তাদের না জানিয়ে বিয়ে করতে চাইনি কখনোই।
মা বাসায় আসার পর প্রথমে শান্ত ছিলেন। আমাকে ডেকে বললেন ভাইয়া আমার জন্য উনার মতো ইসলামিক দাড়িআলা ছেলে ঠিক করেছেন। আমিও কি দাড়ি আলা ছেলে বিয়ে করতে চাই? আমি শুধু বলেছি যে ভাইয়া যদি ঠিক করেন তবে ভালো ছেলেই হবে। তখন আর মার বুঝতে বাকি নাই আমিও মুসলিম হয়ে গেছি। এরপরের প্রতিক্রিয়া হলো ভয়ংকর। অনেক রাগারাগি করলেন, কান্নাকাট ি করলেন, বারবার ইমোশনাল্লি বুঝাতে লাগলেন। আমি পাথর হয়ে দাড়িয়ে ছিলাম। একটা টু শব্দও আর করিনি। এক ফোঁটা চোখের পানি ফেলিনি। মার কোন প্রশ্নের জবাব দেইনি। মাথা নীচু করে শুনে যাচ্ছিলাম সব। মা পাগলের মতো করছিলেন। একটু পর পর আমার রুমে এসে বকে যেতেন।
একবার এসে মোবাইল নিয়ে গেলেন, হাতে যা টাকা ছিলো নিয়ে গেলেন। পরে আবার এসে মোবাইল ফেরত দিয়ে গেলেন। রুমের দরজা আটকাতে নিষেধ করে গেলেন। কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ ফুলে গিয়েছিলো মার্। মা যখন কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেলেন তখন আমি এতোক্ষনে প্রথম কাঁদলাম। আমার জন্য না, মার জন্য। দুআ করতে লাগলাম আল্লাহ যেন মাকে হেদায়েত দেন, এই কষ্ট কমিয়ে দেন আর মাকে আমার বিয়ের জন্য রাজি করে দেন। আমি কাওকে কষ্ট দিতে চাইনি। কিন্তু তাই বলে আন ইসলামিক বা আধুনিক মুসলিম ছেলে তো বিয়ে করতে পারিনা।
fb তে ম্যাসেজ দিয়ে ফয়জুন নাহার আন্টিকে সব জানিয়ে রাখলাম। সব শুনে উনি, ইউসুফ, ইউসুফের মা, বোন সবাই আমার জন্য টেনশন করতে লাগলো। ইউসুফের মা আমাকে তখনই নিয়ে আসতে চাচ্ছিলেন। আরেকটু হলে ইউসুফ আমাকে নিয়ে যেতে ফার্মগেট চলে আসতে চেয়েছিলেন। আমি মানা করলাম। অপেক্ষা করতে চাইলাম কিছুদিন। মার প্রতিক্রিয়া ভয়াবহ ছিলো, তবুও মনের কোথাও না কোথাও একটু আশা রয়ে গিয়েছিলো। হয়তো মা রাজি হবে,মেনে নিবেন সব. অপু ভাইয়াও বললেন তারাহুরা করতে না। মা বিয়ের জন্য রাজি না। বাসায় অনেক সমস্যা হচ্ছে। আমি খাওয়া দাওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছি বাসায়। সিহিন্তার বাসায় যেতে বা কথা বলতে মা নিষেধ করে দিয়েছিলো। তাই ফোনে ওর সাথে যোগাযোগ ছিলো। ও আমাকে সাহস দিত অনেক। ফয়জুন নাহার আন্টিও রেগুলাম যোগাযোগ রাখতেন। ইউসুফ জানালো যেহেতু মা রাজি না তাই ওরা এক সপ্তাহ পর শুক্রবার বিয়েটা করিয়ে ফেলতে চায়। মাকে ছাড়া বিএ করার ইচ্ছা ছিলোনা। কিন্তু আর উপায়ও নাই। তাই ভাবলাম এটাই ভালো হবে।
তবে দুআ করে যাচ্ছিলাম মা যেন রাজি হয়ে যায়। এপ্রিলের ১ তারিখ, ২০১৩ তে সিহিন্তা কল করে জানালো ইউসুফ নাকি ভাইয়ার সাথে দেখা করতে এসেছিলো। ওর মা হটাত বিয়ের জন্য রাজি না। কোনো কথাই মানতে চাচ্ছেন না। ছেলেকে বিয়ে করতে দিবেন না। কেনো এমন করছেন ইউসুফও জানেনা। কষ্ট পেয়েছিলাম। অনেক খারাপ লেগেছিলো। সারাদিন কেঁদেছি। মাকে কষ্ট দিলাম, আল্লাহর পথে তাও যা চলতে পারতাম তার পথ বন্ধ করলাম, সালাত পড়তে পারছিনা, ইসলামিক বই পড়তে পারছিনা, আবার কবে পারবো জানিনা। হতাশায় ডুবে থাকলাম পুরা একদিন। পরের দিন আমার অবস্থা দেখে মা পাপা ভয় পেয়ে গেলো। কাঁদতে কাঁদতে আমার অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে গেছিলো। পাপা অনেক কষ্ট পেয়েছিলো আমাকে দেখে। মা আমাকে ডেকে বললেন যে আমি চাইলে মুসলিম ছেলের সাথেই বিয়ে দিবেন। তবে দাড়ি ছাড়া একটু মডার্ন হলে ভালো হয়। আমি কিছু বলিনি।
এর মাঝে একদিন বড়মামি আসলো বাসায়। জানতে চাইলো আমি কি ইউসুফকেই বিয়ে করবো কিনা। মা রাজি না হলেও কি ওকেই বিয়ে করবো? মানে সে জানতে চাচ্ছিলো সিহিন্তার মতো পালিয়ে বিয়ে করবো কিনা। আমি বলেছিলাম যে আমি তো জানতাম মা রাজী হবেনা, তাও মাকে জানিয়েছি। মাকে ছাড়া আমি বিয়ে করতে চাইনা। আমি চাইলে পালিয়ে যেতে পারতাম কিন্তু মা যাতে আমার বিয়েতে থাকে এজন্যেই আমি মাকে জানিয়েই বিয়ে করবো। মামি যখন বুঝলো আমি অন্য কোথাও বিয়ে করবোনা তখন মামি আমার নানি আর বড়মামাকে বুঝিয়ে রাজী করালো। কারণ তারা রাজী থাকলে আমার বাকি আত্মিয়রাও আর কিছু বলবেনা।
এরপর থেকে মার সামনেই ওজু করতাম, যদিও রুমে দরজা আটকে সালাত পড়তাম, মা বুঝতো কিন্তু কিছুই বলতো না। বাসায়ই ইসলামিক বই পড়তাম। মার সাথে বাইরে গেলে মাথায় কাপর দিতাম না কিন্তু এমনিতে মাথায় কাপর দিয়েই বাইরে যেতাম। আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ সব অনেক সহজ করে দিলেন। এভাবে হটাত সব ঠিক হয়ে যাওয়া আল্লাহর দয়া ও রহমত ছাড়া আর কিছুই না। কল্পনাও করিনি এভাবে মা মেনে নিবেন! ইউসুফের তখন গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট হয়েছে মাত্র। ও চাকরির জন্য খোঁজ করতে লাগলো। চাকরি পেলে সে আবার আমাকে বিয়ের কথা বাসায় জানাবে বলেছে। আমাদের বিয়ের কোনো লক্ষনই ছিলোনা। তাও কেনো জানি মনে হচ্ছিলো বিয়েটা হবেই। দুজনই ইশ্তেখারা পরেছিলাম আর পজেটিভ ফল পেয়েছিলাম আলহামদুলিল্লাহ। সবর করতে লাগলাম।
ওর মা রাজি না, কিন্তু এতে লাভ হলো আমার মা আমার মুসলিম হবার ব্যপারটা মেনে নিলেন। সিহিন্তার বাসায় যেতেও আর বাঁধা নাই। বিয়ে হওয়ার থাকলে হবেই ইন শা আল্লাহ। আমি সবর করতে লাগলাম ও নিজের ইসলামিক জ্ঞানবৃদ্ধি, চর্চা বৃদ্ধি করার দিকে মনোযোগ দিলাম। কোনো ভাবেই মুমিন না হয়ে পাপের বোঝা নিয়ে আমি আল্লাহর সামনে যেতে চাইনি। আমার সব সময় ও সুযোগ কাজে লাগাবো ঠিক করলাম। আমি দেখেছি যখনই আমি আল্লাহর পথে চলতে চেষ্টা করেছি। আল্লাহ কোনো না কোনো ভাবে আমার জন্য সাহায্য পাঠিয়ে দিয়েছেন আলহামদুলিল্লাহ। তেমনই কয়েকটা ছোট ছোট ঘটনাআজ উল্লেখ করবো। আমি সিহিন্তার বিয়ের পর ওর থেকে শিখে অনেকটা সুদ্ধ্য করে নিয়েছিলাম আমার সালাত। তবুও কিছু ছোট খাট ব্যাপারে মাঝে মাঝে কনফিউশনে ভুগতাম যে ঠিক হচ্ছে কিনা। টিউশনি ও পড়ার জন্য সিহিন্তার বাসায়ও আগের মতো যাওয়া হচ্ছিলোনা।
এমন সময় সিহিন্তার থেকে জানলাম ICD তে বুশরা আপু সালাতের ক্লাস নিচ্ছেন। ৩/৪টা ক্লাসে যাওয়ার সুযোগ করে নিতে পারি। আলহামদুলিল্লাহ ওই ৩/৪টা ক্লাস করেই অনেক উপকার পাই। সালাতের কিছু ভুল ঠিক করে নিতে পারি। আমি বাংলা কুরআন পড়তাম, কিছু হাদিসের বই পড়তাম কিন্তু রাসূল (সা:) এর জীবনী সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনা ছিলোনা। মনে মনে ভাবছিলাম উনার জীবনি নিয়ে পড়াশোনা করতে হবে। এমনি সময় একদিন আমার চাচাতো বোন কল করে বলে ইউসুফ নাকি ওর হাসবেন্ডের হাতে আমার জন্য একটা বই পাঠিয়েছে। আমি গেলাম ওর থেকে বইটা আনতে। দেখি ইউসুফ আর-রাহীকুল মাখতুম পাঠিয়েছে আমার জন্য। আলহামদুলিল্লাহ বইটা এতোই ভালো যে যতোই পড়ি মন ভরেনা। এখনো মনে আছে রাসূল (সা:) ইসলাম প্রচার শুরু করার অংশে আসার পর আর পড়তে পারতাম না। মনেহতো আরো পড়লেই তো রাসূল (সা:) এর মৃত্যুর কথা পড়তে হবে একদিন। রাসূল (সা:) মারা যাবেন ভাবতেও কষ্টে বুক ভেঙ্গে আসছিলো। অনেকদিন পড়া বন্ধ রেখেছিলাম।
ফ্লোরে সালাত পড়তে কষ্ট হচ্ছিলো। হাতে তেমন টাকা ছিলোনা। ভাবছিলাম কিছু টাকা জমিয়ে একটা জায়নামায কিনবো। কিন্তু আর কিছুদিনের মাঝেই আমার ভার্সিটির এক ফ্রেন্ড আমাকে সুন্দর একটা জায়নামায উপহার দেয়। আলহামদুলিল্লাহ! রমাদান মাস সম্পর্কে, এই মাসের ইবাদাত, বিদ’আত ইত্যাদি সম্পর্কে জানার ইচ্ছা ছিলো। সিহিন্তার বাসায় গেলাম ও নিজে থেকেই আমাকে একটা বই দিলো যেটাতে রমাদান সম্পর্কিত ডিটেইলস হাদিস সহ বর্ণনা ছিলো। আলহামদুলিল্লাহ! যেহেতু আমরা কারো মাধ্যমে মুসলিম হইনি, তাই মাযহাব সম্পর্কে আমার ভালো ধারনা ছিলোনা।
একদিন ক্লাসে একজন আমাকে প্রশ্ন করেছিলো আমি কোন মাযহাব পালন করি, একটা না একটা মাযহাব নাকি পালন করতেই হয়। সেদিন সিহিন্তার বাসায় তাফসিরে সুমাইয়ার আম্মু বিক্রি করার জন্য কিছু বই আনেন। সেখান থেকে চারজন ইমামের জীবনিমূলক একটা বই ছিলো। ওটা কিনে নেই। রমাদান মাসে আমি আরবি পড়া শিখবো নিয়ত করেছিলাম। কিন্তু আমার তো কোনো শিক্ষিকা নেই। একদিন এ্যান্ড্রয়েডের প্লে স্টোরে একটা খুব ভালো সফট ওয়ের পাই। যেটা থেকে আরবি রিডিং পড়া শিখে যাই একা একা। উচ্চারণ ঠিক না হলেও পড়তে তো শিখে গেলাম আলহামদুলিল্লাহ!!
আরবি পড়া শিখলাম কিন্তু বাসায় আরবি কুরআন নাই। একটা কিনবো ভাবছি, এমন সময় এক ফ্রেন্ড বাংলা অর্থ সহ একটা আরবি কুরআন উপহার দেয়! আলহামদুলিল্লাহ!! এভাবে আল্লাহর সাহায্য আসতেই লাগলো। মন খারাপ থাকলে দেখতাম কেও না কেও ওই বিষয় নিয়েই fb তে পোস্ট করেছে। কোনো বিষয়ে সমস্যা থাকলে ওটা নিয়েই কোনো না কোনো হাদিস বা লেখা পেয়ে যেতাম নেট এ আসলে। সবচেয়ে বড় যে সাহায্য আল্লাহ আমাকে করেন তা হলো আমি চাইলেও আল্লাহ আমাকে অনেক গুনাহ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতেন। যেমন কোনো এক জায়গায় গেলে হয়তো গুনাহ হবে এমন কিছু করতে হতো, দেখা যেত ওইদিনই আমি অসুস্থ্য হয়ে পরেছি বা কোনো বাধাঁ এসে উপস্থিত। আলহামদুলিল্লাহ! প্রতিটা পদে আল্লাহ আমাকে সাহায্য করেন। কখনো আর নিজেকে একা মনে হয়নি। ইউসুফ ওদিকে চাকরী খুঁজতে লাগলো, আর এদিকে আমি নিজেকে আল্লাহর পথে চলতে আরো বদলে নিতে লাগলাম।
আমি ঈমানের স্বাদ গ্রহণ করছিলাম। অনেকদিনের দু:শ্চিন্তা, ভয় সব দূর হয়ে গিয়েছিলো। মা আমার ইসলাম হবার ব্যাপার মেনে নিয়েছেন, নামায পড়তে বাঁধা দেন না। আত্মীয়রা অনেকেই অনেক কথা শুনায় মাকে কিন্তু আমার সেসব কথা গায়ে লাগতোনা। আমার মামি খ্রীস্টান হয়েও আমাকে অনেক সাপোর্ট দেন। তার কারণের আমার বড় মামা আর নানী আমার মুসলিম হবার ব্যাপারটা মেনে নেন। যদিও মন থেকে মানেনি তাও আমাকে কিছু বলতোনা। আমি ভালোই ছিলাম কিন্তু আমার মাকে অনেক কষ্ট পেতে হয়েছে। হয়তো মা বাসায় আমাদের সাথে হাসি খুশি থাকতেন। কিন্তু বাইরে গেলে কারো সাথে দেখা হলে হয়তো বলতো,আহারে! তোমার জন্য কষ্ট হয়, তোমার দুই মেয়েই তোমার ধর্ম ছেড়ে চলে গেল। বা বলতো এতো করলা মেয়েদের জন্য কিন্তু ওরা কেও তোমার থাকলোনা। ইত্যাদি এমন অনেক কথাই মাকে সহ্য করতে হতো। মা বাসায় এসে কাঁদতো, মন খারাপ করে থাকতো। কিন্তু কখনও আমাকে জোর করতো না ইসলাম ধর্ম ছেড়ে দিতে। মাঝে মাঝে আমাকে অল্পতেই বকতো। আবার আমার বিয়ে হবে, চলে যাবো ভেবেও কাঁদতো। খুব কষ্ট হতো মার জন্য কিন্তু দুআ করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলোনা আমার্।
ইউসুফ ততদিনে আবার তার পরিবারকে রাজী করায় বিয়ের জন্য। ওরা জুন মাসের এক শনিবার বিয়ের কথা বলতে বাসায় আসবে ঠিক হলো। ওরা যেদিন আসবে তার আগেরদিন icd থেকে একটি বিয়ের উপর দে লং প্রগ্রাম এ্যারেঞ্জ করা হয়। আমরা দুইজনই ওই প্রগ্রামে পার্টিসিপেট করি। সেখানে পাত্র পাত্রি বাছাই, দেখা, ওয়ালীমা, তালাক ইত্যাদি বিয়ে সম্পর্কিত সব বিষয়ে আলোচনা করা হয়। আলহামদুলিল্লাহ আমাদের বিয়েটা কিভাবে করতে হবে,কি কি করা যাবেনা অনেক কিছুই আমরা শিখতে পারি। পরেরদিন বিকালে আমার বাসায় ও, ওর মা, বোন আর ভাবীকে নিয়ে আসে আমাকে দেখতে। সিহিন্তা আর অপু ভাইয়াও আসেন। কথা ঠিক হয় ও চাকরী পেলে সেপ্টেম্বরে বিয়ে হবে। খুব সুন্দর একটা বিকেল কাটিয়ে ওরা বাসায় চলে গেলো। বাবা মা সবাই খুশি।
পরেরদিন সিহিন্তা কল করে জানালো ইউসুফের মা নাকি বিয়েতে রাজিনা। এখন ও না পারছে ওর মাকে কষ্ট দিতে, না পারছে আমাকে মানা করে দিতে। ও আবার সময় চাচ্ছে। আমার কেমন লেগেছে শুনে বলতে পারবোনা। আসলে কোন অনুভূতিই কাজ করছিলোনা। ইউসুফ আবার সময় চেয়েছে তাই অপেক্ষা করতে লাগলাম আবারো। মা বাবা শুনে কিছু বললেন না। আমাকে কোনো প্রশ্নও করলেন না। তারাও বুঝতে পেরেছিলো আমি কষ্ট পাচ্ছি। দুইবার এমন হলো। সবর করতে লাগলাম।
জুন মাসের মাঝামাঝিতে একদিন হটাত অপু ভাইয়া বিকালে কল করে বলেন আমাকে উনার বাসায় যেতে। ইউসুফ আর ওর মা আসবে। ওর মা আমার সাথে কথা বলতে চায়। ইউসুফের সাথে আমার যোগাযোগ নাই। ফলে কেন আসছে, রাজী হয়েছেন কিনা কিছুই জানিনা। বাবার সাথে সন্ধ্যার দিকে গেলাম সিহিন্তার বাসায়। ওর মা আমার সাথে অনেক কথা বললেন। তাদের বাসার অবস্থা, ছেলে মেয়েদের কথা ইত্যাদি অনেক কিছুই বললেন। শরীফুন্নেসা আন্টিও উনাকে আমার সম্পর্কে একটা ধারনা দিলেন। ওর মা আমাকে প্রশ্ন করলেন আমি উনার বাসার অবস্থা সব জেনেশুনে বিয়েতে রাজি কিনা। আমি বললাম রাজি। তখন উনি ইউসুফকে ডাক দিয়ে বললেন, চল বউমাকে বাসায় নিয়ে যাই। আমি আর ইউসুফ দুজনই অবাক! এটা কি হলো!! যিনি বিয়ের জন্য একদমই রাজি ছিলেন না তিনিই আমাকে পারলে এখনই বিয়ে করিয়ে বাসায় নিয়ে যান! আলহামদুলিল্লাহ!! সবর করার ও আল্লাহর প্রতি ভরসা করার ফল হাতে নাতে পেলাম। ওই মাসেই ইউসুফের গাজীপুরে চাকরি হয়ে গেল। মোটামোটি ঠিক হলো বিয়েটা সেপ্টেম্বরে হবে।
কিন্তু ওর মা চাচ্ছিলেন বিয়েটা রমাদানের আগেই মানে জুলাই মাসেই হোক। যাতে রমাদানটা আমি উনাদের সাথে থাকতে পারি। আমরা ওদের বাসায় গেলাম। বিয়ে ঠিক হলো জুলাই মাসের ৯ তারিখ। কিন্তু ও থাকবে গাজীপুর আমি থাকবো ঢাকায়। ও প্রতি বৃহ:স্পতিবার আসবে গাজীপুর থেকে। কিন্তু আমি আর ইউসুফ কেও এভাবে থাকতে রাজি হলাম না। পরে ঠিক হলো বিয়ে না আখদ হবে। ও তিনমাস পর গাজীপুরে বাসা নিয়ে আমাকে ওখানে নিয়ে যাবে। সব ঠিক, ৮ তারিখ আমার বান্ধবিদের বাসায় দাওয়াত দিলাম। হটাত শুনি ইউসুফ বলেছে ওকে নাকি ছুটি দিবেনা। ও ঈদের ছুটিতে বিয়ে করবে। আবারো বিয়ে নিয়ে ঝামেলা!! আল্লাহ জানেন তখন কেমন লাগছিলো। প্রথমে প্রচন্ড রাগ হচ্ছিলো। একবার মনে হচ্ছিলো বিয়েই করবোনা। রমাদান মাসে ওর জন্য পাঞ্জাবি কিনতে যাওয়ার কথা আমার আর মার্। মা ওর মাপ জানতে ওকে কল করেছিলো। কথায় কথায় ও মাকে বললো যে বিয়ের পর ৬মাস বা এক বছর আমাকে ঢাকায় থাকতে হবে। এখনই সে গাজীপুর নিয়ে যেতে পারবেনা। এবার সত্যি রেগে গেলাম। আমি কোথায় থাকবো, কি করবো আমাকে জিজ্ঞেস না করেই ডিসিশন নিয়ে নিল? আমি জানি এক আর এখন দেখি আরেক! বাস! এটা নিয়ে আমাদের মাঝে ঝগড়া লেগে গেলো। বিয়েটা ভেঙ্গেই গেলো!
এই যখন অবস্থা তখন এতোদিন যিনি বিয়ের বিরোধিতা করেছেন উনিই আসল ভূমিকা পালন করলেন। ওর মা বিয়েটা ভাংতে দিবেন না কিছুতেই। সেদিন রাত থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত অন্তত ৭/৮ বার কল করেছেন যেন সকালে ওদের বাসায় যাই। সকালে ওদের বাসায় যাওয়ার পর উনি কিছুই না জেনেও ছেলের হয়ে আমার কাছে ক্ষমা চাইলেন,বার বার মন খারাপ করতে না করলেন। আলহামদুলিল্লাহ আমাদের মাঝে ভুল বুঝবুঝি মিটে গেলো। ২য় সাবান, ১০ই আগস্ট, ২০১৩, ঈদের পরদিন আমাদের বিয়ের ডেট ঠিক হলো। আমাদের বিয়েতে ৩৫,০০০ টাকার মতো খরচ হয় সর্বমোট।
শরিয়ত মুতাবিক আমার মা বাবা একটা টাকাও খরচ করেনি। ICD তে আমাদের বিয়ে হয়। ৬০জন লোকের খাবার এ্যারেঞ্জ করা হয়। ছেলে মেয়েরা সম্পূর্ণ আলাদা বসার ব্যবস্থা করা হয়। মেয়েদের ওখানে মেয়েরাই খাবার সার্ভ করে। বিয়ের খাবার যা বেচে যায় মাদ্রাসায় দিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি উচ্ছিষ্ট হাড্ডি, খাবার কুকুর বিড়ালকে খাওয়ানো হয়। বিয়ের মোহর ঠিক হয় ৫০০০০টাকা ও সূরা আল-মূল্ক । টাকা বিয়ের আগেই আমার কাছে দেয়া হয় আর সূরা বিয়ের রাতে ইউসুফ আমাকে তেলাওয়াত করে শুনায়। সেদিন সকাল থেকে অনেক বৃষ্টি হচ্ছিল। খুব সুন্দর একটা দিন। সবচেয়ে বড় কথা হলো আমার বিয়েতে আমার মা খুশি মনেই উপস্থিত ছিলেন আলহামদুলিল্লাহ। শুধু তাই না আমার খ্রীস্টান আত্মীয়রাও সবাই ছিলেন। আল্লাহ আমার দুআ কবুল করে নিয়েছিলেন। সবাই বিয়ের দিন কাঁদে, কিন্তু আল্লাহ আমার ইচ্ছা এভাবে পূরণ করায় আমি এতো খুশি ছিলাম যে সারাক্ষন আমার মুখে হাসি ছিলো। আল্লহকে যতোই ধন্যবাদ দেই ততোই কম হবে।
আমার বিয়ের পিছে, অনুষ্ঠান সুন্দর করার পিছে অপু ভাইয়া আর সিহিন্তার অবদান অনেক বেশি ছিলো। ওরা প্রতিটা ব্যাপারে খেয়াল রেখেছিলেন যাতে বিয়েটা সুন্দর ভাবে ও শারিয়া মুতাবিক হয়। বিয়ের পর ইসলাম পালনে আমার আর সমস্যা হয়নি আলহামদুলিল্লাহ। ওর মা,যিনি আমাকে প্রথমে পছন্দ করেননি, এখন উনি সবাইকে বলেন, আমি বউ না, মেয়ে এনেছি বাসায়। মা বলে ডাকেন আমাকে। আমার মা যিনি দাড়ি আলা মুসলিম ছেলে পছন্দ করতেন না,উনি আমাকে এখন সব সময় বলেন ইউসুফ অনেক ভালো ছেলে, ওর বা ওর পরিবারের কারো মনে কষ্ট দিওনা। আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহর এতো রহমত, এতো বরকত আমি পেয়েছি যে আমাকে আর পিছে আমার জাহিলি যুগের দিকে ফিরে যেতে হয়নি।
এই ছিল আমার ইসলামের পথে আসার কাহিনী। এখন আমার জীবনে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। এবং এখনও প্রতি পদে আল্লাহ আমাকে সাহায্য করে যাচ্ছেন। আলহামদুলিল্লাহ! আমি এখন গর্ব করে বলতে পারি আমি একজন মুসলিমা। ইসলামের পথে আসাই আমার জীবনেরসবচেয়ে বড় পাওনা। আল্লাহ তার বান্দাদের কখনও নিরাশ করেন না। আল্লাহর পথে চলতে গেলে বাঁধা, কষ্ট আসবেই। কিন্তু আল্লাহর উপর ভরসা করে সবর করলে এর ফল অনেক বেশি মধুর হয়। আল্লাহু আকবার!