#আড়াল_কথা
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_১৭

বাড়ির প্রতিটি সদস্য উপস্থিত রয়েছে রুমের ভেতরে। এতোগুলো চেনামুখ এর মধ্যে আবিষ্কার করলাম একজনের অচেনা মুখমণ্ডল। একজন বয়স্ক টুপি পড়া লোক দাড়িয়ে আছেন হাতে কিছু একটা নিয়ে। মনে অজানা ভয় অঙ্কুরিত হলো মনের ভেতর। কি হতে চলেছে আমার সাথে?

হটাৎ পেছন থেকে গুবলি এগিয়ে এলো। শুদ্ধর হাত ঝাঁকিয়ে নরম স্বরে বললো,

‘ভাইয়া তুমি আজ কেনো বিয়ে করবে? তোমার ঢিসুম ঢিসুম করা শেষ হলে না বিয়ে করবে বলেছিলে? মা বললো, আজই নাকি তোমার বিয়ে তাই আলম নানাকে ডেকে এনেছে তোমায় বিয়ে করাতে।’

গুবলু, টুবলু আর তিন্নিও এতোক্ষণে ঘিরে দাড়িয়েছে শুদ্ধকে। ওরাও একে একে বলে ওঠে,

‘হ্যা ভাইয়া। তুমি তো বলেছিলে ওয়ান মান্থ ইকুয়াল টু থার্টি ডে’স যেনো মিষ্টপু ডাকি। আর তারপর তুমি ঢিসুম ঢিসুম শেষ করে এসে মিষ্টিপুকে বিয়ে করলে পারমানেন্টলি মিষ্টি ভাবি ডাকবো আমরা। কিন্তু সবে তো দুদিন হলো। এখনি বিয়ে করলে তো এখন থেকেই মিষ্টি ভাবি ডাকতে হবে। মা ও তো এখানে আসার আগে বললো আফটার থার্টি ডে’স নয় আজ থেকেই মিষ্টি ভাবি ডাকতে হবে।’

বাচ্চাদের কথোপকথন চলতে চলতে সবাই যে যার মতোন জায়গা করে নিয়েছে। কেউ বসে গেছে কেউ দাড়িয়ে আছে। রিয়াদ শুদ্ধর দিকে এগিয়ে গিয়ে গুবলি কে কোলে নিয়ে বাকিদের শুদ্ধর থেকে সরিয়ে আনতে আনতে বলে,

আরে পিচ্চি বউ আমার, তুমি আমাদের নিজের সংসারে মন দাও না অন্যের সংসারে নাক গলানোর কি দরকার? তুমি এখানে ছোট শাশুমায়ের কোলে বসে বসে ভাবো কাল সকালে কোন রাইমটা আমায় শোনাবে। আর এইযে শা’লা শা’লি’গণ আপনারও বসে বসে তাই ভাবুন। কাল নিউ রাইম না শোনাতে পারলে কিন্তু সংসারি থেকে বাদ দিয়ে দেবো বলে দিলাম।’

শুদ্ধ দরজা খুলে দিয়ে এসে প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে এখনো একই ভঙ্গিতে দাড়িয়ে আছে। বাচ্চাদের কথারও কোনো উত্তর দেয় নি। আড়াল পাথরের ন্যায় দাড়িয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে। দুঃস্বপ্ন লাগছে সবকিছু। বাচ্চাদের কথা শুনে বুঝতে পারছে এখন সে বিয়ে নামক বাধনে বাধা পড়তে চলেছে। এটাও পরিষ্কার যে এখন বিয়েটা হুট করে হলেও আগে থেকেই ঠিক করা ছিলো বিয়ের বেপারটা। জ্ঞাত ছিলো সবাই, শুধু সেই ছিলো অজ্ঞাত।

প্রথমে যখন সবাই রুমে প্রবেশ করলো তখন গুটিকয়েক মানুষের মুখে বিভ্রান্তির ছাপ থাকলেও এখন সবার চেহারা রয়েছে প্রজ্বালিত। সবাই উদ্রি্ত, উৎসুক চেহারা নিয়ে একে অপরের সঙ্গে বিনিময় করছে কথা ও নিজেদের অনুভুতি। টুপি পাঞ্জাবি পরিহিত বয়ষ্ক কাজী কিছু লেখালেখি করছে চেয়ারে বসে। এর মধ্যে চেয়ারের ছড়াছড়ি লেগে গেছে রুমের ভেতরে। শুদ্ধর মা এসে ওরনার কিছু অংশ টেনে মাথায় ঘোমটা দিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলো আড়ালকে। আড়াল করুণ চাহনি দিলো আলো বেগমের দিকে। আড়ালের থুতনি ছুয়ে চুমু খেলো আলো বেগম। ভরসা বিনিময় করলো মায়া দৃষ্টি দিয়ে।

শুদ্ধের ইশারা পেয়ে বৃষ্টি এগিয়ে এসে একটা টাচস্ক্রীন প্রযুক্তির ফোন এনে আড়ালের হাতে দেয়। আড়াল প্রশ্নাত্মক চেহারায় ফোন হাতে নিতেই শুদ্ধ নিজের ফোনে কিছু টাইপ করে আড়ালের হাতে থাকা ফোনে পাঠিয়ে দেয়। হটাৎ হাতে থাকা ফোনটা কেপে ওঠে। আড়াল লকহীন ফোনটার আলো জ্বলে ওঠতে দেখে স্ক্রিন এ তাকায়। কিছু শব্দের মাঝে নিজের মা ও টুসু নাম চোখে পড়ে স্ক্রিনে ভেসে থাকা একটি এসএমএস নোটিফিকেশন এ। তা দেখে ক্ষিপ্রবেগে মেসেজ ওপেন করে আড়াল। চোখে পড়ে পাঁচ ছয় লাইনের অপ্রতিম কিছু লেখা।

‘সুষ্ঠুভাবে তিন কবুল বলে দিলে তিনদিন পর পর যেকোন তিনটি করে প্রশ্নের উত্তর পাবে আমার কাছ থেকে। আর যদি কোন নাটকীয়তার চমৎকারিত্ব দেখাও, তাহলে জিবনে কখনো তোমার মায়ের আসল খু’নি’র নাগাল পাবে না। তোমার চাচি তো শুধুমাত্র একটা গুটি মাত্র। মেইন প্লেয়ার অন্যকেউ। যাকে তুমি তোমার মায়ের খু’নি হিসেবে ভাবতেও পারবে না।’

আড়াল স্তম্ভিত হয় গুটিকয়েক লাইনের ছোট বার্তাটি পড়ে। মনে মনে আওরায়, ‘তার মানে মায়ের খু’নি অন্যকেউ। চাচি নয়? কিন্তু চাচি যে বললো সে নিজ হাতে আমার মায়ের প্রা’ণ নিয়েছে। তাহলে আসল খু’নি কে? তার নাগাল পেতে হলে এই বিয়েটা আমায় করতেই হবে। এতোদিন পর্যন্ত মনে হতো জানা প্রশ্নের উত্তরগুলোই শুধু অজানা। এখন মনে হচ্ছে শুধু উত্তর নয় প্রশ্নের ও সন্ধান করা বাকি আছে। আরও কত অজানা প্রশ্ন রয়ে গেছে গোপনে তাই জানা নেই, তাহলে একা একা এতো উত্তরের সন্ধান কি করে করবো?’

এতোক্ষণ মনে মনে কবুল না বলার ছক কষলেও এখন কবুল বলার তর সইলো না আড়ালের। মনে মনে উদগ্রীব হলো কবুল নামক পবিত্র শব্দ দিয়ে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে। এই শব্দটি যে শুধু অজ্ঞাত প্রশ্নের উত্তর নয় একটা নতুন সম্পর্কেও আটকে দেবে তা বুঝেও মনে ঠায় দিলো না কোন দ্বিধাদ্বন্দ। নিজের মনকে বুঝ দিলো নানান ভাবে। মস্তিষ্ক ঘিরে ছেয়ে গেলো তিক্ততা। মনের কোনে উকি দিলো মায়ের শেষ স্মৃতি। মা যেনো রান্না করছে আর তার হাতের বালার সুমধুর টুংটাং আওয়াজ আসছে কানে। রান্না ঘরের সামনে দাড়িয়ে শুনে যাচ্ছে একটি মেয়ে। যে কখনো তার মাকে জরিয়ে ধরে বলতে পারেনি, ‘মা ভালোবাসি তোমায়’। হটাৎ কারো ঝাঁকি পেয়ে আড়াল অশ্রু টলটলে চোখে সামনে তাকায়। যে চোখে এতোক্ষণ মায়ের মায়ামাখা মুখটা ভাসছিলো, সেই চোখে এখন মামনির চেহারা দেখতে পেলো। কবুল বলার জন্য তাগিদ দেওয়া হচ্ছে পাশ থেকে। নিজেকে সামলাতে না পেরে আলো বেগমকে জাপটে ধরে ঝরা বৃষ্টির মতো ঝমঝমিয়ে কেঁদে ওঠলো আড়াল। সবাই বেশ থমকে গেলো আড়ালের কান্না দেখে। কাঁদতে কাঁদতে তিনবার বলে দিলো কবুল শব্দটি। সই করতে বলা হলে কাঁপা হাতে সই করে দেয়। সম্পূর্ণ বিয়ের কাজ সুষ্ঠুভাবে শেষ হয়ে গেলে শুদ্ধ রুম থেকে বেড়িয়ে যায় বিনাবাক্যে। আড়াল এখনো আলো বেগমকে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে।

চারপাশে বিবর্ণ কৃষ্ণকায় তলিয়ে আছে আশপাশ। এই অন্ধকার এর বুকে শুদ্ধর নিজেকে মেলে ধরতে ইচ্ছে করছে নিজের সত্তাকে। আড়ালের কান্নার প্রতিটি মুহূর্ত উপপ্লব তুলেছে শুদ্ধর বুকে। ভীষন যন্ত্রণা ঘোষণা করছিলো মন তখন। নিজের অনুভূতি গুলো ফিকে লাগছিলো। মনে হচ্ছিল খুব শক্ত করে বুকে টেনে নিতে। চোখের ঝরা মুক্তগুলোকে নিজের বুকপকেটে জমানোর বড্ড তৃষ্ণা লাগছিলো। এ তৃষ্ণা মিটবে কবে?

‘কাঁদিস না মা। হা কর। খেয়েনে। বিয়েটা তোর অমতে হলেও তোর জন্য কষ্টের কারণ কখনোই হবে না এই বিয়ে। আমার ছেলেটার ওপর ভরসা রাখ। তোর ইচ্ছের বিরুদ্ধে হয়তো বিয়েটা হয়েছে, কিন্তু তোর ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ের সম্পর্কটা শুদ্ধ এগিয়ে নেবে না। আমায় বলেছে ও। তুই যত সময় চাস নে। জানি না আজ তোদের মধ্যে কি কথা হয়েছে। কেনো এমন হুট করে আলম চাচাকে ডেকে এনে বিয়ের ব্যবস্থা করলো। তোদের বিয়ে আরও একমাস পর হবার কথা ছিলো। তোকে বলেছে কিনা জানি না। বললেও কতটা বলেছে তাও জানি না। এখন বিয়েটা যখন হয়েই গেছে মন থেকে মেনে নিস মা।’

আলো বেগম আড়ালকে কয়েক গাল ভাত খাইয়িয়ে দিয়ে বৃষ্টিকে আড়ালের সাথে বসিয়ে চলে যায় রান্নাঘরে। ওদিকে আলম সাহেবের আতিথেয়তা হচ্ছে। সেদিকে যেতে হবে। বৃষ্টি কাছে এসে বসতেই আড়াল নিজেকে ধাতস্থ করে এক গ্লাস জলে গলা ভিজিয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘স্যার কোথায়?’

‘জেঠু তো আজ এখনো আসেনি। কোথায় আছে জানি না। শুদ্ধ ভাইয়া বললো চলে আসবে।’

‘সবসময় এতো রাত করে বাসায় ফেরেন স্যার?’

‘নাহ তো। এর আগে দুই একবার দেরি করে এসেছে। সবসময় না।’

‘তোমরা সবাই আগে থেকেই জানতে ওনার সাথে আমার বিয়ে হবে? এটা আগে থেকেই ঠিক করা ছিলো?’

‘হ্যা। সবাই জানতো। আমরা তো সবাই অনেক এক্সাইটেড ছিলাম। তবে তোমাকে এ বিষয়ে কিছু বলা মানা ছিলো। কিন্তু জেঠু ক…’

‘তুই তোর রুমে যা। আমার ওর সাথে কিছু কথা আছে।’

হটাৎ শুদ্ধর গলা পেয়ে আড়াল চকিতে দরজার দিকে তাকায়। সদ্য জলে ভেজানো গলা আবারও শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো যেনো। কি বলবেন উনি?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here