#আড়াল_কথা
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_১২

আমি কি শেষের কথাটা জোরে বলে ফেললাম। হায় খোদা। ওই দানবটাও তো দেখছি এখন আমার দিকেই বিহ্বলিত হয়ে তাকিয়ে আছে। এবার আমি শিওর হয়ে গেলাম। শেষের কথাটা মনে মনে না। মুখেই বলেছি। এবং যথেষ্ট উচ্চ স্বরেই বলেছি। কোনভাবে কি মাটি ফাঁক হয়ে যেতে পারে না। আমি একটু ঠাঁই নিতাম।

একি! উনি উঠে আসছে কেনো? আমার দিকেই তো আসছে মনে হচ্ছে। এবার কি আমায় মা’রবে টারবে নাকি। তখন যে চড়টা মেরেছিলো। এখনে গালে হাত দিলে ব্যা’থা লাগে। এখন আবার দিলে আমি শেষ। আমি দুই হাতে আমার ছোট্ট গাল দুটো চেপে ধরে দাড়িয়ে রইলাম। অন্য কোথাও দিক। গালে না। বাহুতে একটা দিয়ে দিক। বেশি ব্যাথা পাবো না। একি, উনি তো আমার ঘারের দিকে হাত বারাচ্ছে। হায়হায়! এতোগুলো মানুষের সামনে কি আমায় ঘাড়ে চেপে ধরবে। নাকি তুলে আছাড় মারবে। কেউ কিছু বলছে না কেনো।

আমি চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেললাম। কিন্তু কিছুই বুঝে ওঠতে পারলাম না। এখনো তো কোন কিছুরই আভাস পাচ্ছি না। ভয়ে ভয়ে চোখটা সামান্য খুললাম পরিবেশ বুঝতে। কিন্তু সামনে তো উনি নেই। উনি তো চলে যাচ্ছেন। এটা কি হলো! উনি আবার নিজের জায়গায় গিয়ে বসে প্লেট পর্যক্ষনে মনোনিবেশ করলেন। আমি বিমূঢ় হয়ে দাড়িয়ে রইলাম।

মামনি হটাৎ আমায় আশ্বাস দিয়ে বললো,

‘তুমি ভয় পেয়ো না। টিকটিকি দুটোকে তোমার কাঁধ থেকে শুদ্ধ সরিয়ে দিয়েছে। টিকটিকি দেখে এতো ভয় পাও তুমি? একেবারে চোখমুখ খিঁচে দাড়িয়ে ছিলে।’

আমি মামনির কথায় হতবাক হয়ে গেলাম। আমার কাঁধে টিকটিকি পড়েছিলো! তাই সবাই এমন করে তাকিয়ে ছিলো। আর ছোটরা হাসছিলো। আর আমি কি না কি ভেবে বসেছিলাম। যাক, তখনকার কথাটা জোরে বলিনি তাহলে।

বুক ভরে শ্বাস নিলাম। গলা টা শুকিয়ে গেছে। পানি পেলে ভালো হতো। মামনির সাথে টেবিলে গিয়ে বসলাম। মামনি আর সেই পরি দাদী সবাইকে খাবার বেড়ে দিতে লাগলেন। আমার ডান দিকে বৃষ্টি বেসেছে আর বাম দিকে শান্ত। আর ঠিক সামন বরাবর বসেছে দানবটা। সবাই চুপচাপ খাচ্ছে। আমিও খাওয়া শুরু করলাম। এতোগুলো অচেনা মানুষের সামনে বসে খেতে একটু অস্বস্তি
লাগছে। ঠিকমতো খেতে পারলাম না। অল্প কয়েকবার খাবার মুখে দিয়ে উঠে পরলাম। মামনি আরও কিছুটা খেতে বললো। আমি না করায় আর বেশি জোরাজোরি করলো না কেউই। আমি চলে এলাম আমার রুমে।

আধঘন্টা পর হটাৎ ছোট মা আর মামনি এলো আমার ঘরে। হাতে দেখছি খাবারের প্লেট। ছোট মায়ের মুখের দিকে তাকালে মায়ের চেহারার বেশ মিল পাওয়া যায়। যদিও খুব বেশি নয়। কিন্তু বোঝা যায়।

দুজনে আমার সামনে এসে বিছানায় বসে বললেন, ‘তখন নিশ্চয় এতো মানুষের সামনে বসে খেতে পারনি। অচেনা জায়গা। অচেনা মানুষ। মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগবে মা। আমরা তা বুঝি। এবার খাবারটা খেয়ে নাও। নিশ্চই পেটে খিদে আছে। আরেকটা কথা বলি মা।
আমার মাথায় হাত রেখে মামনি স্নেহভরা কণ্ঠে বললো,

‘আমরা তোমার আপনজন। আমাদের পর মনে করো না। বাড়ির সবাইকে আপন করে নেওয়ার চেষ্টা করো।’

‘হ্যা মা। এই বাড়ি টাকে নিজের বাড়ি মনে করো। আর বাড়ির মানুষগুলোকে নিজের আপনজন। দেখবে সবাই তোমাকে কতোটা ভালোবাসে।’

‘তুমি কিছু মনে না করলে আমি একটা আবদার করতে পারি তোমার কাছে?’

ছোট মা আর মামনির কথা শুনে আমার অদ্ভুত ভালো লাগা সৃষ্টি হচ্ছে। বড্ড আপন মনে হচ্ছে। ইচ্ছে করছে একবার জরিয়ে ধরতে। মামনির কথায় আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালে মামনি এক গাল হেসে দিয়ে আমার হাত টা ধরে বলে,

‘আমরা সবাই তোমাকে তুই করে বললে কি তুমি রাগ করবে মা? তুমি করে বললে পর পর মনে হয়। আমার তিন জা মানে তোমার আরও তিন মামিরাও কিন্তু বাইরে দাড়িয়ে আছে। যদিও ওরা বলতে মানা করেছিলো। কিন্তু বলে দিলাম। ওরাও চায় তোমাকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসতে। কাছে টেনে নিতে।’

মামনির কথা শেষ হতে না হতেই ভেতরে প্রবেশ করলো তিন মামি। সাথে পরি দাদী। সবাই আমাকে ঘিরে দাঁড়ালো। সবার চেহারায় মুখভর্তি হাসির ঝলকানি।
আমি এবার আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না। মনের সুপ্ত আবেগ গুচ্ছ অশ্রু হয়ে নির্দ্বিধায় বাঁধ ভেঙে গড়িয়ে পড়লো। ছুঁয়ে দিলো আমার গাল, থুতনি, গলা। আমার কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কেন সেদিন সবটা ওলট-পালট হয়ে গেলো। আজকের এই মুহুর্তে তো মায়েরও আমার সাথে থাকার কথা ছিলো। সব ঠিক থাকলে আজ মা ও এই খুশির ভাগীদার হতো।

আমার অঝোরে কান্নার বহর দেখে সবাই উত্তেজিত হয়ে পড়লো। সবাই আমায় এমনভাবে শান্তনা দিতে লাগলো যেন আমি কোন ছোট বাচ্চা। মামনি প্লেট তুলে নিয়ে নিজে হাতে আমার মুখে খাবার তুলে দিতে লাগলেন। খাওয়া শেষে সবাই হাসি মুখে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। আমি প্রাণ ভরে শ্বাস নিলাম। সব শুন্যতা এভাবে চোখের পলকে গায়েব হয়ে যাবে ভাবি নি।

ঘুমানোর প্রস্তুতিতে বিছানায় শুতে গেলে ওমনি কেউ দরজায় নক করে। বালিশের কাছ থেকে ওরনা গলায় ঝুলিয়ে নিয়ে অনুমু দিয়ে ভিতরে আসতে বলি।

দরজাটা খুলে ভিতরে আসে শুদ্ধ ভাইয়া। তাকে এখন এই সময়ে মোটেও আশা করি নি। একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম উনাকে দেখে। উনি খানিকটা এগিয়ে এসে আমায় জিজ্ঞেস করে,

‘দরজাটা খোলা ছিলো যে? লক করো নি কেনো?’

‘এখনি লক করতাম। ঘুমানোর প্রস্তুতিই নিচ্ছিলাম। ওমনি আপনি চলে এলেন।’

‘তখন ছাঁদে ওমন করে তাকিয়ে ছিলে কেনো? যেনো আমাকে একা পেলে একেবারে কাঁচা চিবিয়ে খেতে।’

‘আমি যে তখন আপনার দিকে রেগে তাকিয়ে ছিলাম তা আপনি বুঝেছিলেন? তাহলে তখন ওমন একটা কথা কেনো বললেন?’

‘যাতে আর কখনো আমার দিকে ওমন রেগে না তাকাও তাই।’

‘একশো বার তাকাবো। আমিও দেখি আপনি কি করেন?’

‘ভারী নির্লজ্জ মেয়ে তো তুমি। অন্যের বরের চোখে ওমন করে সময় জ্ঞান ভুলে চেয়ে থাকতে লজ্জা লাগে না?’

‘আপনি বিবাহিত?’

‘কেন? অবিবাহিত হলে বুঝি তাকিয়ে থাকার লাইসেন্স পেয়ে যাবে।’

‘আমি কি তাই বলেছি নাকি? আপনার বউ তো দেখলাম না। তাই জিজ্ঞেস করেছি।’

‘তাও তাকানো ছাড়বে না তাই না?’

আচ্ছা আমি এই হাত জোর করে বলছি আমি আপনার দিকে তাকাবো না। এবার খুশি?’

‘তুমি আমার দিকে তাকাবে না কেনো? আমায় দেখলে বুঝি নিজেকে কনট্রোল করতে পারো না?’

‘আচ্ছা আজব মানুষ তো আপনি। আপনিই তো বললেন, আমি যেন রেগে তাকিয়ে না থাকি আপনার দিকে। তখন রেগে তাকিয়ে ছিলাম বলেই নাকি ওমন কথা বলেছেন।’

‘এইতো এবার পথে এসেছো। এটাই বোঝাতে চাচ্ছিলাম। এইটা যেনো মাথায় থাকে। ভুলেও আমার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকাবে না। ফের যদি এমন করেছো তাহলে এমন নাকানিচুবানি রোজ খাওয়াবো।’

আমার মাথা ভো ভো করে ঘুরছে। সামনে দাড়ানো লোকটাকে জ্বলন্ত উনুন এর চেয়ে কোন অংশে কম মনে হচ্ছে না। একেবারে ভাজা ভাজা করে ছাড়লো। মন চাচ্ছে হাত পা বেঁধে বসিয়ে রেখে সারাদিন আগুন চোখে চেয়ে থাকি দানবটার চোখে।

‘কি হলো তোমাকে দেখে আবারও রাগী মনে হচ্ছে যেনো?’

আমি অসহায় কন্ঠে মিনতি করে বললাম,
‘আপনি ঠিক করে দেখুন। রাগ নয় ঘুম দেখতে পাবেন আমার চোখে।’

‘ঘুম দেখার জিনিস নয়। দেখাদেখি বাদ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আর মনে যেনো থাকে, ভুলেও আমার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকাবে না। এবার দরজাটা লক করে ঘুমিয়ে পড়ো। গুড নাইট।

দরজাটা লক করে দিয়ে বিছানায় এসে ধপ করে বসে পড়লাম। প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। বাড়ির সবাগুলো মানুষ এতো ভালো। আর এই লোকটা আস্ত এক দানব। প্রথম দেখায়ই লোকটাকে দেখে মনে মনে দানব
নামের উপাধি দিয়েছিলাম। আজ মনে হচ্ছে নামটা সার্থক হলো। এসেছি পর থেকে জ্বালিয়ে মারছে। কি ঘারত্যারা। ওফ্ফ!

___________

সকালে সূর্যের মিঠে আলো গায়ে মেখে ঘুম ভাঙলো আমার। চোখ খুলে দেখি রাতে জানালার গ্লাস না টেনেই ঘুমিয়ে পড়েছি। তাই রোদের অবাধ বিচরণ এখন আমার ওপর। যেনো দখল করে নিয়েছে আমায়। উঠে বসে ঘরির দিকে তাকিয়ে দেখি সকাল আটটা বাজে। ইশ একটু বেলা হয়ে গেলো। আরেকটু আগে উঠতে পারলে ভালো হতো। বাথরুমে ঢুকে কোনমতে ফ্রেশ হয়ে বাইরে চলে এলাম। রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে দেখি সবাই মিলে কিছু না কিছু করে যাচ্ছে। আমি একটু এগিয়ে গিয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠি,

‘কোন হেল্প লাগলে আমায় বলনা তোমরা। আমি একটু আধটু কাজ জানি কিন্তু। আমাকে..

সবাই হটাৎ এমন ভয়ংকর চাহনি দিলো যে মুখের কথাটা আর শেষ করতে পারলাম না। কোনমতে ওখান থেকে চলে এলাম। ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ার টেনে বসে পরলাম। আমি বসতেই বৃষ্টি আর সৃষ্টি চলে এলো। ওরা এসেই এমন করে গল্প জুড়ে দিলো যেনো আমি ওদের কত আগের চেনা কেউ। হটাৎ ডাইনিং রুমে আগমন ঘটলো শুদ্ধ ভাইয়ার। এসেই আমার সামনের চেয়ারটা টেনে বসে পড়লো। বৃষ্টি আর সৃষ্টির সাথে টুকটাক কথা বলে আমার দিকে তাকিয়ে আচমকা বলে ওঠলো,

‘খাওয়া শেষ করে রেডি হয়ে থেকো। ওদের রোজ আমি কলেজ নিয়ে যাই। আজ থেকে তুমিও ওদের সাথে কলেজ যাবে।’

‘কিন্তু ওদের কলেজ তো আলাদা।’

‘তাতে কি? এক রাস্তা দিয়েই তো যেতে হবে। একসাথে যেতে তোমার সমস্যা কোথায়?’

‘তার কোনো দরকার নেই। আড়াল রোজ আমার সাথে কলেজ যাবেন। আবার আমার সাথেই বাড়ি ফিরে আসবেন।’

হটাৎ স্যারের গলা শুনে পিছনে ফিরে দেখি স্যার গম্ভীর মুখ নিয়ে দাড়িয়ে আছেন। আমি স্যারকে দেখে মাথা নিচু করে বসে রইলাম। ওনার দিকে তাকানোর সাহস হলো না। অপরাধ বোধে ঝুঁকে এলো আমার দৃষ্টি।

বাবার কথা শুনে শুদ্ধ ঠোট বাকিয়ে খানিকটা হাসলো। তারপর বৃষ্টি আর সৃষ্টিকে কিছু একটা ইশারা করতেই ওরা দুজন আাসিফ সাহেবকে চেপে ধরে রাজি করানোর জন্য। ওদের যেনো একসাথে যেতে দেওয়া হয় এটাই ওদের দাবী।

আসিফ সাহেব কখনো বাড়ির মেয়েদের কোন আবদার অবহেলা করেন না। ইচ্ছে না থাকলেও রাজি হয়ে গেলেন। বৃষ্টি আর সৃষ্টি লাফিয়ে ওঠে আড়ালকে জরিয়ে ধরে। এদিকে বাবা ছেলের মধ্যে চোখে চোখে চলতে থাকে বাক্য বিনিময়। শুদ্ধ বাঁকা হেসে আসিফ সাহেবকে জিজ্ঞেস করেন,

‘তাহলে তোমার কোন আপত্তি নেই তো বাবা? আমি আড়াল কে নিয়ে যাবো তো?’

আসিফ সাহেব উত্তর না দিয়ে খবরের কাগজ নিয়ে বসে পড়লেন। তার মুখভঙ্গিতে মনের অবস্থা বোঝা দায়।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here