আমি পদ্মজা – ২৭
____________
পদ্মজার কণ্ঠে আম্মা ডাকটি হেমলতার অস্তিত্ব মাড়িয়ে দিয়ে গেল। হেমলতা থমকে গিয়ে তাকান। উঠে দাঁড়াতে প্রস্তুত হতেই পদ্মজা ঝাঁপিয়ে পড়ে হেমলতার বুকে। হেমলতা টাল সামলাতে না পেরে আবার মাটিতে বসে পড়েন। পদ্মজা নিরবচ্ছিন্ন কাঁদতে থাকল। হেমলতা সীমাহীন আশ্চর্য হয়ে,কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেন। নির্বাক,স্তব্ধ থেকে পদ্মজার কান্না অনুভব করেন। কান্নার দমকে পদ্মজার শরীর ঝাঁকি দিচ্ছে বারংবার। পূর্ণা পদ্মজাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,’আর যাবা না আপা।’
পদ্মজা অনুরোধ স্বরে হেমলতাকে বলল,’আম্মা,আমি যাব না।’
হেমলতার দুই চোখ বেয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। প্রতি ফোঁটা জল পদ্মজার বুকে সাইক্লোন, টর্নেডো,ঘূর্ণিঝড়,ভূমিকম্প সহ সব ধরণের দূর্যোগ বইয়ে দিচ্ছে। হেমলতা শক্ত করে জড়িয়ে ধরেন পদ্মজাকে। অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন,’কোথাও যেতে হবে না তোর।’
হেমলতার এহেন কথা শুনে হানি,মনজুরার মাথায় বাজ পড়ল। সেকী কথা! হেমলতা একবার যখন বলেছে তাহলে সত্যি যেতে দিবে না। তাহলে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার কী দরকার ছিল! হানি শক্ত কিছু কথা শোনানোর জন্য প্রস্তুত হয়। তখনই হেমলতা পদ্মজাকে সরিয়ে দেন নিজের কাছ থেকে। চোখে মুখ শক্ত করে কাঠ কাঠ কণ্ঠে বলেন,’এটা ঠিক হয়নি পদ্ম! এভাবে চলে আসা মোটেও ভদ্রতা নয়। আবেগকে এতো প্রশ্রয় দিতে নেই। বিয়ে দিয়েছি এবার শ্বশুর বাড়ি যেতেই হবে। ওইতো আমির এসেছে।’
হেমলতা হাত ঝেড়ে মাটি থেকে উঠে দাঁড়ান। পদ্মজা হা করে তাকিয়ে আছে হেমলতার দিকে। চোখের পলকে কী রকম রূপ পাল্টে ফেলল। এইতো মাত্রই কাঁদছিল!
____________
পদ্মজা নিজের চুলে আঙ্গুল পেঁচাতে পেঁচাতে হাসছে। তুষার রয়ে সয়ে প্রশ্ন করল,’হাসছেন কেন?’
পদ্মজা নাটকীয়ভাবে ব্যথিত স্বরে বলল,’আপনি কাঁদছেন তাই।’
তুষার দ্রুত চোখের জল মুছল। মৃদু হেসে বলল,’কাঁদছি নাকি!’
পদ্মজা হঠাৎ গুনগুনিয়ে কাঁদতে শুরু করল। তুষার জানতে চাইল,’আপনি কাঁদছেন কেন?’
মুহূর্তে পদ্মজা দাত কেলিয়ে হেসে উঠে। চোখে জল ঠোঁটে হাসি নিয়ে বলে,’মনে চাইলো। আম্মা বলতেন,যখন যা ইচ্ছে হয় করে ফেলতে। তাতে কারো ক্ষতি বা নিজের কোনো ক্ষতি না হলেই হলো।’
‘আপনার মায়ের খবরটা গতকাল শুনলাম। জানেন,সারারাত ঘুমাতে পারিনি।’
‘আপনার মনটা খুব নরম স্যার। কিন্তু কঠিন ভাব নিয়ে থাকেন,আমার আম্মার মতো।’
‘তারপর কী হলো?’
পদ্মজা চেয়ার ছেড়ে ফ্লোরে বসে বলল,’আর তো বলব না।’
তুষার শ্বাসরূদ্ধকর কণ্ঠে বলল,’কেন?’
পদ্মজা ঘাড়ে এক হাত রেখে ক্লান্তভঙ্গিতে বলল,’এমনি।’
‘হেয়ালি করবেন না পদ্মজা। আপনি ছাড়া এই রহস্যের কিনারা অসম্ভব। আপনার পুরো গ্রাম আপনার বিপক্ষে। খুনের কারণ ও কেউ বলতে পারছে না। আমরা তদন্ত করেও কুল পাচ্ছি না।’
পদ্মজা চোখ গরম করে তাকায়। কটমট করে বলল,’বলব না মানে বলব না।’
তুষার দ্বিগুণ গলা উঁচিয়ে বলল,’তাহলে এতটুকু কেন বললেন?’
‘আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই।’
‘আপনার ইচ্ছায় সব হবে না।’
‘যা খুশি করে নিতে পারেন।’
পরিস্থিতি বিগড়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতি সামলাতে তুষার দুই হাতে মুখ ঢেকে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে। এরপর ধীরেসুস্থে বলে,’দেখুন আপনি যদি সব খুলে না বলেন আমি আপনাকে আইনের হাত থেকে বাঁচাতে পারব না। নির্দোষ প্রমাণ করতে পারব না। আর আমার মন বলছে,আপনি দোষ করতে পারেন না।’
‘সবসময় মন সঠিক কথা বলে না।’ বলল পদ্মজা, করুণ স্বরে।
‘তাহলে বলছেন,আপনি নির্দোষ না?’
পদ্মজা চোখ সরিয়ে নিল। হাসল। কী যন্ত্রনা! কত কষ্ট সেই হাসিতে! চোখ ভর্তি জল নিয়ে আবার তাকাল তুষারের দিকে। বলল,’আমি খুন করেছি। একই রাতে,একই প্রহরে,একই জায়গায় একসাথে পাঁচ জনকে। আপনার আইন যা শাস্তি দেয় আমি মাথা পেতে নেব।’
তুষার অধৈর্য্য হয়ে বলে,’ আপনার ফাঁসির রায় হবে পদ্মজা। আপনি বুঝতে পারছেন না। আমার আপনাকে বাঁচাতে ইচ্ছে হচ্ছে।’
‘ওপারে যাওয়া আমার জরুরি। আমি সব রায় মেনে নেব।’
‘আমি মানতে পারব না।’ তুষারের অকপট কথা। কথাটা মুখ থেকে বের হওয়ার পর তুষার বুঝলো সে অচেনা এবং ভয়ংকর অনুভূতি নিয়ে খেলছে। পদ্মজার দিকে চেয়ে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। পদ্মজা তুষারকে পরখ করে নিয়ে হাসে। শান্ত ভঙ্গিতে বলল,’এতো ব্যকুল কেন হচ্ছেন?’
বেশ অনেকক্ষণ তুষার গাঁট হয়ে বসে রইল। উপর থেকে অর্ডার এসেছে,আসামী পদ্মজা কেন এতোগুলি খুন করেছে তার রহস্য উদঘটন করতে। না পারলে চাকরি চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। চাকরি চলে যাক সমস্যা নেই,নিজের শান্তির জন্য আত্মতৃপ্তির জন্য হলেও পদ্মজার পেছনের ছয়টি বছরের গল্প জানতেই হবে। এই কেস হাতে পাওয়ার পর থেকে তার ঘুম হচ্ছে না রাতে। সারাক্ষণ মস্তিষ্ক কিলবিল করে। এতো জটিল কেস কখনো ফেস করতে হয়নি। অলন্দপুর পুরোটা ঘেঁটেও কিছু জানা যায়নি। যারা খুন হয়েছে তারা আর পদ্মজা ছাড়া হয়তো কেউ জানেও না। তুষার আবার বলল,’আপনার বিরুদ্ধে সব প্রমাণ। আপনার বিরুদ্ধে সবাই সাক্ষী দিচ্ছে। আপনি কী…”
কথার মাঝপথে তুষারকে থামিয়ে দিয়ে পদ্মজা বলল,’খুনগুলো তো সত্যি আমি করেছি। তাহলে প্রমাণ আমার বিরুদ্ধেই তো থাকবে।’
তুষারের মন বিরক্তে তেঁতো হয়ে পড়ে। পদ্মজার সামনে কয়েকবার পায়চারি করে বেরিয়ে যায়। সিগারেট ফুঁকে মাথা ঠান্ডা করে। ফাহিমা চা নিয়ে আসে। তুষার বলল,’মেয়েটাকে তোমার অপরাধী মনে হয়?’
‘আমি কিছু ভাবতে পারছি না স্যার। মেয়েটাকে দেখলে আমার হাত পা অবশ হয়ে পড়ে। এতো মেরেছি শুরুতে। কিছুতেই টু শব্দও করেনি। এরপর থেকে আমি রাতে ভয়ংকর স্বপ্ন দেখি।’
‘পৃথিবীটা রহস্যে ঘেরা ফাহিমা। একজন নারী পাঁচ জনকে কীভাবে খুন করতে পারে? আবার একসাথে? সেই সাহস কী করে পেল?’
‘সেটা আমিও ভাবছি স্যার। কীভাবে খুন করেছে সেটা ধারণা করা যাচ্ছে। কিন্তু এতো সাহস,ধৈর্য্য কীভাবে কোনো নারীর থাকতে পারে!’
‘নারীরা চাইলে সব পারে। কথাটা শুনে এসেছি। এবার স্বচক্ষে দেখছি।’
‘জি স্যার।’
‘কত আসামী পায়ে পড়ে জীবন ভিক্ষা চেয়েছে। কিছুতেই মন গলেনি। মন কাঁদেনি। এই মেয়েটা জীবন চায় না,তবুও আমার ইচ্ছে হচ্ছে জীবন দিতে,নির্দোষ প্রমাণ করে বাঁচাতে।’
ফাহিমা চকিতে তাকাল তুষারের দিকে। তুষার সবসময় হু,হ্যাঁ এর বাইরে কিছু বলে না। খুব কঠিন,কাঠখোট্টা একটা মানুষ। অনুভূতি বলতে নেই। তার মুখে এত কথাবার্তা শুনে অবাক হচ্ছে ফাহিমা।
‘পরিস্থিতি হাতের বাইরে স্যার। পদ্মজার ফাঁসি দেখার জন্য দেশ উতলা হয়ে আছে।’
‘কেন এমন হচ্ছে ফাহিমা?’
‘আজ যদি হেমলতা উপস্থিত থাকতেন গল্পটা অন্যরকম হতো স্যার।’
তুষার আবার ফিরে আসে। পদ্মজার সামনে চেয়ারে বসে। ধীরকণ্ঠে বলে,’আজই শেষ দিন। এরপর আর আমাদের সাক্ষাৎ হবে না।’
পদ্মজা চকিতে তাকাল। দ্রুত তুষারের পায়ের কাছে এসে বসল। বলল,’আপনার আম্মা আপনাকে বিয়ে করতে চাপ দেয় তাই না?’
‘আপনি কী করে জানলেন?’
‘সেদিন দেখলাম ফোনে কাউকে আম্মা ডেকে রেগে বলছিলেন,বিয়ে করব না।’
‘আমি তো অনেক দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। আপনার শ্রবণ শক্তি তো প্রখর।’ তুষার বলল। এরপর থামল। লম্বা করে নিঃশ্বাস নিয়ে আবার বলল,’আপনার মা বিশ্বাসঘাতকতা কী কথা লুকিয়ে করেছেন?’
‘আপনি জানলেন কী করে?’
‘কিছু তথ্য পেয়েছি গতকাল। এইটুকুর জন্য বিশ্বাসঘাতক অপবাদ দিতে পারেন না। উনি আপনার ভালোর জন্যই…”
পদ্মজা চুপ থেকে হুট করে ফোঁস করে জ্বলে উঠে বলল,’আপনি বুঝবেন না আমার কষ্ট। আমার না পাওয়া দামী সময়টাকে আমি কতবার মনে করে বুক ভাসিয়ে কেঁদেছি। বুঝবেন না আপনি।’
পদ্মজা কাঁদতে কাঁদতে বলল। পরপরই হেসে আবার করুণস্বরে কান্না শুরু করল। গা কাঁপিয়ে তোলার মতো কান্না। মনে হয় কোনো অশরীরী কাঁদছে। কী বিশ্রি,ভয়ংকর সেই কান্নার ছন্দ। তুষারের কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠে।
চিন্তায় মাথার রগ দপদপ করছে। আগামীকাল ভোরে পদ্মজাকে কোর্টে তোলা হবে,রায় হবে। পদ্মজার ফাঁসি চাই বলে,রাস্তায় রাস্তায় আন্দোলন। রেডিওতে আন্দোলন। কিন্তু তুষারের মন যে কিছুতেই মানতে পারছে না এই আন্দোলন। এমন নিষ্পাপ মনের, অপরূপ সুন্দরীর বিরুদ্ধে পুরো পৃথিবী! কী আশ্চর্য তাই না!
__________
বাঁকা রাস্তা পেরিয়ে পালকি চলছে ধীরে ধীরে। সন্ধ্যার আযান পড়েছে কিছুক্ষণ আগে। দিনের আলো কিছুটা এখনও রয়ে গেছে। দক্ষিণ দিক থেকে ধেয়ে আসছে হাওয়া। শীতল, নির্মল পরিবেশ। পদ্মজার বুক ধুকপুক করছে। নতুন মানুষ নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারবে তো! একবার সে হাওলাদার বাড়ি গিয়েছিল। অন্দরমহল নামে এক বিশাল বাড়ি আছে। সেই বাড়িতে মেয়েরা,বউরা থাকে। এখন কী সেও থাকবে? পদ্মজা পর্দার ফাঁকফোকর দিয়ে বাইরে চোখ মেলে তাকায়। আমির হাতে পাগড়ী নিয়ে তার বড় ভাইয়ের সাথে কী যেন আলোচনা করছে। চোখেমুখে খুশি উপচে পড়ছে। পদ্মজা চোখ সরিয়ে নিল। মায়ের কথা,পূর্ণার কথা খুব মনে পড়ছে।
পালকি থামে। আমির থামিয়ে দিল। অন্দরমহলে মেয়েরা অপেক্ষা করছে নতুন বউয়ের জন্য। আর আমির গেইটের সামনেই পালকি থামিয়ে দিল। জাফর বিরক্তিতে ‘চ’ এর মতো শব্দ করে বলল,’এইখানে আবার থামালি কেন?’
আমির পাগড়ী রিদওয়ানের হাতে দিয়ে বলল,’আমার বউ আমার কোলে চড়ে অন্দরমহলে যাবে।’
পদ্মজা কথাটা শুনেই কাচুমাচু হয়ে গেল। আমির পালকির পর্দা সরিয়ে হাত বাড়িয়ে পদ্মজাকে নামতে ইশারা করে। পদ্মজার নাক অবধি টানানো ঘোমটা। আমির সরাতে গিয়েও সরাল না। মুখে বলল,’কী হলো? নেমে আসো।’
পদ্মজা লজ্জায় জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে। সে গাঁট হয়ে বসে থাকে। আমির হেসে এক হাতে নিজের কপাল চাপড়াল। এরপর নিজেই টেনে নামাল পদ্মজাকে। তখনো পদ্মজার নাক অবধি ঘোমটা। আমির চট করে পদ্মজাকে পাঁজাকোলা করে নেয়। পদ্মজা কুঁকড়ে যায়। ভয়ে দুই হাতে আমিরের গলা জড়িয়ে ধরে। আমির যত এগোচ্ছে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে তার গায়ের উষ্ণতা পদ্মজার শাড়ি ভেদ করে সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে। অচেনা,অজানা অনুভূতি চারিদিকে যেন জেঁকে বসেছে। মরণ প্রেমের সূত্রপাত হয়তো এখান থেকেই শুরু হয়!
চলবে…
®ইলমা বেহরোজ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here