আমি পদ্মজা – ১১
___________
মাঘ মাস চলছে। কেটে গেছে চার মাস। শুষ্ক চেহারা আর হিমশীতল অনুভব নিয়ে পদ্মজা বসে আছে নদীর ঘাটে। গুনে গুনে তিন নম্বর সিঁড়িতে। নাকের ডগায় মেট্রিক পরীক্ষা। দিনরাত পড়তে হচ্ছে। নিয়ম করে প্রতিদিন ভোরে পড়া শেষ করে পদ্মজা। এরপর ঘাটে এসে বসে নিজের অনুভূতিদের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য। কখনো উদাস হয়ে আবার কখনো লাজুক মুখশ্রী নিয়ে ভাবে কারো কথা। সেই যে চিঠি দিয়ে হারালো আর সাক্ষাৎ মিললো না তার। কখনো কী মিলবে? তিনি কী আসবেন? এক চিঠি প্রতিদিন নিয়ম করে পড়ে পদ্মজা। ধীরে ধীরে অনুভব করে তার মধ্যে আছে অন্য আরেক সত্ত্বা। যে সত্ত্বা প্রতিটি মেয়ের অন্তঃস্থলের গভীরে জেঁকে বসে থাকে ভালবাসার অনুভূতি নিয়ে। পূর্ণা আসল শীতের চাদর মুড়ি দিয়ে। দুই দিন আগে তার অষ্টম শ্রেণির চূড়ান্ত পরীক্ষা শেষ হয়েছে। হিমেল হাওয়ার হাড় কাঁপানো শীতে পূর্ণা থেমে থেমে কাঁপছে।

‘আপা?’

পদ্মজা তাকাল। মৃদু হেসে বলল, ‘কী?’ পরপরই আবার উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল, ‘আম্মা আবার অসুস্থ হয়ে পড়ছে?’
পূর্ণা পদ্মজার পাশ ঘেঁষে বলল,’না, আম্মার কিছু হয় নাই।’

পদ্মজা হাঁফ ছেড়ে বলল,’আম্মা সারাদিন সেলাইর কাজ করে। একদিকে তাকিয়ে থাকে, এক জায়গায় বসে থাকে। এজন্যই শরীরে এতো অশান্তি। দূর্বল হয়ে পড়ছে। আব্বারে বলিস, আম্মারে নিয়ে সদরে যেতে। আমার কথা তো আব্বা শুনবে না।’
‘আচ্ছা।’

দুজন নদীর ওপারে চোখ রাখল। অতিথি পাখির মেলা সেখানে। রোমাঞ্চকর আকর্ষণ। এত পাখি দেখে মন ভরে গেল। পাখিদের কলকাকলিতে এলাকা মুখরিত। এপার থেকে শোনা যাচ্ছে। কোত্থেকে দৌড়ে আসে প্রান্ত। সে চার মাসে শুদ্ধ ভাষা রপ্ত করে নিয়েছে ভালভাবে। এসেই বলল, ‘আপারা কী করো?’
পূর্ণা বলল,’পাখি দেখি। আয়, দেখে যা।’

প্রান্ত দূরে চোখ রাখল। সকালের ঘন কুয়াশার ধবল চাদরে ঢাকা নদীর ওপার। পাখিদের ভাল করে চোখে ভাসছে না। শীতের দাপটে প্রকৃতি নীরব। তাই পাখির কলকাকলি শোনা যাচ্ছে দারুণভাবে। প্রান্ত বলল, ‘বড় আপা,একটা পাখি ধরে আনি?’
‘একদম না। পাখি ধরা ভাল না। অতিথি পাখিদের তো ভুলেও ধরা উচিত না। ওরা আমাদের দেশে অতিথি হয়ে এসেছে।’
প্রান্ত চুপসে গেল৷ এরপর মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল,’আচ্ছা,ঠিকাছে।’

‘তোরা এইহানে কী করস?’

মোর্শেদের কণ্ঠস্বর শুনে তিনজন ফিরে তাকাল। প্রান্ত হাসিমুখে ছুটে এসে বলল, ‘আব্বা,আমি আজ তোমার সাথে মাছ ধরতে যাব।’
মোর্শেদ প্রান্তকে কোলে তুলে নেন। এরপর বললেন,’তোর মায় আমার লগে কাইজ্জা করব।’
‘আম্মারে, আমি বলব।’
‘আইচ্ছা যা, তুই রাজি করাইতে পারলে লইয়া যামু।’

পদ্মজা চোখ দুটি জ্বলজ্বল করে উঠল। মোর্শেদ গত দু’মাস ধরে প্রান্তকে চোখে হারাচ্ছেন। ছেলে নাই বলেই হয়তো!প্রতিটা বাবা-মায়ের একটা ছেলের আশা থাকে।
হেমলতা পর পর তিনটা মেয়ে জন্ম দিলেন। এ নিয়ে মোর্শেদ অভিযোগ করেননি। তবে, মনে মনে খুব করে একটা ছেলে চাইতেন। প্রান্তকে যখন প্রথম আনা হলো, মোর্শেদের খুব রাগ হয় ভিক্ষুকের ছেলে বলে। সময়ের সাথে সাথে প্রান্তকে চোখের সামনে ঝাঁপাতে, লাফাতে দেখে ছেলের জন্য রাখা মনের শূন্যস্থানটা নাড়া দিয়ে উঠল। মোর্শেদ দু’হাত বাড়িয়ে দেন অনাথ ছেলেটির দিকে। এখন দেখে আর বোঝার উপায় নেই, মোর্শেদ আর প্রান্তের মধ্যে রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই। মোর্শেদ কাঠখোট্টা গলায় দুই মেয়েকে বললেন,’সদরে যাইয়াম। দুইডার লাইগা চাদর আনতাম না সুইডার?’

পদ্মজা কথাটা শুনে চমকাল। অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু পেলে মানুষ কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। পদ্মজার অবস্থাও তাই হলো। খুশিটা প্রকাশ করার মতো পথ খুঁজে পাচ্ছে না। স্নায়ু কোষ থমকে গেছে। শীতের তান্ডবে প্রকৃতি বিবর্ণ অথচ তার মনে হচ্ছে, বসন্তকাল চলছে। ঢোক গিলে ঝটপট উত্তর দিল,’আব্বা,তোমার যা পছন্দ তাই এনো আমার জন্য।’

খুশিতে পদ্মজার গলা কাঁপছে। মোর্শেদ অনুভব করলেন সেই কাঁপা গলা। গত সপ্তাহ রমিজের মেয়ে এক ছেলের সাথে রাত কাটাতে গিয়ে ধরা পড়ে। অলন্দপুরে সে কী তুলকালাম তাণ্ডব! ছেলেটাকে ন্যাড়া করে জুতার মালা পরিয়ে চক্কর দেওয়ানো হয়েছে পুরো অলন্দপুর। আর মেয়ের পরিবারকে সমাজ থেকে আলাদা করে দেয়া হয়েছে। পদ্মজা এতো সুন্দর হওয়া সত্ত্বেও আজও কোনো চারিত্রিক দোষ কেউ দিতে পারেনি। মেয়েটার দ্বারা কোনো অনৈতিক কাজ হয়নি। তার ঘরে যেন সত্যি একটা পদ্মফুলের বাস। মোর্শেদ পদ্মজাকে নিয়ে দোটানায় ভোগেন। খারাপ ব্যবহারটা আগের মতো আসে না। তিনি দ্রুত জায়গা ত্যাগ করেন।

_____________
পরদিন সকাল সকাল কলস ভরে খেজুরের মিষ্টি রস নিয়ে আসেন মোর্শেদ। প্রেমা খেজুরের রস দেখেই মাকে বলল, ‘আম্মা,পায়েস খাবো।
‘আচ্ছা, খাবি।’

সূর্য অনেক দেরিতে উঠল। প্রকৃতির ওপর সূর্যের নির্মল আলো ছড়িয়ে পড়ে। সূর্যের আলোতে কোনো তেজ নেই। চার ভাই-বোন কাঁচা খেজুরের রস নিয়ে উঠানে বসল পাটি বিছিয়ে। খেজুরের কাঁচা রস রোদে বসে খাওয়াটাই যেন একটা আলাদা স্বাদ,আলাদা আনন্দ। মোর্শেদ নারিকেল গাছে উঠেছেন। পায়েসের জন্য নারিকেল অপরিহার্য উপকরণ। আচমকা পদ্মজা প্রশ্ন করল, ‘আজ কী সোমবার? ‘
পূর্ণা কথা বলার পূর্বে হেমলতা বারান্দা থেকে বললেন, ‘আজ তো সোমবারই। কেন?’
পদ্মজা খেজুরের বাটি রেখে ছুটে আসল বারান্দায়।
‘আজ স্কুলে যাওয়ার কথা ছিল আম্মা। ঝুমা ম্যাডাম বলেছিলেন,গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। সবাইকে যেতে বলেছেন।’
‘আমায় বলে রাখতি। সামনে পরীক্ষা। গুরুত্বপূর্ণ দেখে পড়া দিবেন এজন্যই ডেকেছেন। তাড়াতাড়ি যা। এই পূর্ণা, তুইও যা।’

দুই বোন বাড়ি থেকে দ্রুত বের হলো। সূর্য উঠলেও কনকনে শীতটা রয়ে গেছে। দুজনের গায়ে মোর্শেদের আনা নতুন সোয়েটার। পদ্মজা যখন মোর্শেদের হাত থেকে সোয়েটার পেল আবেগ লুকিয়ে রাখতে পারেনি। মোর্শেদের সামনে হাউমাউ করে কান্না করে উঠে৷ মোর্শেদ অপ্রস্তুত হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। ফিরেন অনেক রাত্রিরে। পূর্ণা বলল, ‘আব্বার পছন্দ ভালো তাই না আপা?’
‘কীসের পছন্দ?’
‘সোয়েটার গুলো কী সুন্দর।’

পদ্মজা হাসল। সামনের ক’টি দাঁত ঝিলিক দিল। হাতের ডান পাশে ধানক্ষেত। ধান গাছের ডগায় থাকা বিন্দু বিন্দু জমে থাকা শিশির রোদের আলোয় ঝিকমিক করছে। অনেকে হাতে কাঁচি নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে ধান কাটার। বাতাসে নতুন ধানের গন্ধ। হঠাৎ পূর্ণা চেঁচিয়ে উঠল, ‘আপারে, লিখন ভাই।’

পদ্মজার নিঃশ্বাস গেল থমকে। মুহূর্তে বুকের মাঝে শুরু হয় তাণ্ডব। পূর্ণার দৃষ্টি অনুসরণ করে পিছনে তাকাল পদ্মজা। লিখন ব্যস্ত পায়ে এদিকে আসছে। পাশে মগা।
পদ্মজা অজানা আশঙ্কায় চোখ ফিরিয়ে নিল। পূর্ণাকে বলল, ‘এখানে আর এক মুহূর্তও না।’ কথা শেষ করে পদ্মজা স্কুলের দিকে হাঁটা শুরু করল। পূর্ণা অবাক হয়। কিন্তু, এ নিয়ে রা করল না। লিখন পিছন পিছন আসছে। পদ্মজার বুক কাঁপছে বিরতিহীন ভাবে। চাহনি অশান্ত।

চলবে…
®ইলমা বেহরোজ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here