#আমার_মন_মেঘ_করেছে
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ০২ (শেষ পর্ব)
_________________

আকাশের বুকে গোলাকৃতির উজ্জ্বল চাঁদ। জোছনায় ভাসছে শহর। মিনারের মানসপটেও চন্দ্রকিরণে ভেসে উঠলো চার বছর আগের স্মৃতি। দিনটা জাবিদের বিয়ের দিন ছিল। সেদিনও আকাশে আজকের মতো একটা গোলাকৃতির উজ্জ্বল চাঁদ উঠেছিল। মিনার ছাদে উঠে দেখলো ইরন ছাদের বেঞ্চে বসে আছে। দূর থেকে দেখেই বুঝেছিল ইরন কাঁদছে। মিনার পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে বসলো ইরনের পাশে।

“কতক্ষণ ধরে কাঁদছো?” জানতে চাইলো মিনার।

ইরন কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দিলো,
“এক মিনিট হয়েছে বোধহয়।”

মিনার আর কিছু বললো না। হঠাৎ একটু খারাপ লাগলো তার। ইরনের সাথে সব সময় যে মানুষটার ওঠা বসা ছিল সেই মানুষটা হলো সে। অথচ জাবিদ ভাইয়া ইরনের থেকে এত দূরবর্তী হয়েও ইরনের মনে প্রভাব ফেলেছিল। অথচ সে কি না এত কাছে থেকেও ইরনের মনে প্রভাব ফেলতে পারলো না! খুব হতাশবোধ করলো মিনার। এর মাঝে ইরনের কণ্ঠ শুনতে পেল,
“জানিস, মানুষ জনের যন্ত্রণায় আমি আজ সারাদিনেও একটু কাঁদতে পারিনি। নিরিবিলি জায়গাই পাচ্ছিলাম না কোথাও। এখন একটু পেয়েছি, তাও ফুলফিল পাইনি। একটু ইচ্ছে মতো কাঁদবো তা পারছি না। মানুষগুলোর জেগে থাকার কী দরকার আছে? কেউ কেউ তো আবার হুট করে ছাদে এসে পড়ছে, কল করতে, সিগারেট খেতে। আমার মেজাজটাই খারাপ। যদি কেউ আমাকে কাঁদতে দেখে তাহলে কী বলবো আমি তাদের?”

ওড়না দিয়ে চোখের পানি মুছে নিচ্ছে ইরন। চন্দ্রপ্রভায় মিনার তাকিয়ে রইল ইরনের মুখশ্রীতে। মনে মনে নিজেকে শুধালো, ‘মেয়েদের কখন বেশি সুন্দর লাগে?’
নিজেই উত্তরখানা দিয়ে দিলো নিজের মনকে, ‘যখন মেয়েরা কাঁদে তখন। কান্নার সময়েই মেয়েদের প্রকৃত সৌন্দর্য উন্মোচিত হয়।’

সেদিন প্রথম…জীবনে ওই প্রথম মিনারের ভীতু মনে হঠাৎ কিছু সাহসের বাতাস ঢুকেছিল অজানায়। কিছু মুহূর্তের জন্য সে ভুলে গিয়েছিল নিজের ভীতু পরিচয়। মুগ্ধ আবিষ্ট নয়ন জোড়া মেলে চেয়ে থেকে বললো,
“তুমি কাঁদলে তোমাকে কেউ দেখতে পাবে না ইরন। কারণ আমি তোমাকে ঢেকে রাখবো।”

ইরন অশ্রু থলথল চোখে তাকালো। জানতে চাইলো,
“কীভাবে?”

হুড়মুড় করে ঢুকে পড়া সাহসের বাতাসের কারণে তখন আর মিনারের মাঝে কোনো ভয়-ডর নেই। হঠাৎ পাওয়া সাহসের দরুন সে ইরনের মাথার পিছনে একহাত নিয়ে ওর মাথাটাকে এনে নিজের বুকে রাখলো। তারপর শার্টের এক প্রান্ত উঁচিয়ে ধরে বললো,
“এভাবে ঢেকে রাখবো।”

জীবনে ওই প্রথম ভীতু ছেলেটা কোনো সাহসিকতার কাজ করেছিল। ওই সময়টায় খুব সুন্দর এক অনুভূতি হয়েছিল তার হৃৎকাননে। কিন্তু মেয়েটার ধারে কাছ দিয়েও অনুভূতিরা হাঁটলো না। সে সত্যিই মিনারের ঠাঁই দেওয়া স্থানটাকে সুরক্ষিত মনে করে নিশ্চিন্তে প্রাণ খুলে কাঁদতে শুরু করলো। এর মাঝেই হঠাৎ বাতাসের সাথে এসে কানে ধাক্কা খেলো আমিনার কণ্ঠস্বর,
“ইরন!”

মিনারের মাঝে থাকা সাহসের বাতাস আমিনার এক ডাকে ফুঁস করে উড়ে গেল। ইরনকে সরিয়ে দিয়ে ফট করে দাঁড়িয়ে গিয়ে হনহন করে চলে গেল সে।

হেসে ফেললো মিনার। এত ভীতু হয়ে সে কেন জন্মগ্রহণ করেছে? সেদিনের পাওয়া সেই সাহসের বাতাসটুকু যদি আবার দ্বিতীয়বার পেতো তাহলে তার মতো সুখী আর কেউ হতো না।
কারো পদ শব্দের আওয়াজে সজাগ হয়ে উঠলো মিনার। পিছনে তাকিয়ে জাবিদকে এগিয়ে আসতে দেখলো।
জাবিদ এসে দাঁড়ালো মিনারের পাশে।

“কী করছো?”

“হাওয়া খাচ্ছি আর চাঁদের আলোয় স্নান করছি।” বলে হাসে মিনার।

জাবিদ কীয়ৎক্ষণ নীরব থেকে বললো,
“ভালো আছো তুমি?”

“আমার কি খারাপ থাকার কথা ছিল?”

জাবিদ হাসার চেষ্টা করে দুই পাশে মাথা নাড়লো।

নির্জন কাটলো বেশ কিছু সময়।
বিজনের জাল চিরে জাবিদ বললো,
“আমি জানতাম ইরন আমাকে পছন্দ করে। ওর পছন্দ করার শুরুর দিক থেকেই জানতাম। কিন্তু জেনেও না জানার মতোই ছিলাম। ও হয়তো ভাবতো আমি বোকা। আমি বুঝতে পারিনি। কিন্তু আসলে বোকা কিন্তু ইরন নিজে। কারণ, ও সর্বদা যে মানুষটার সাথে থেকেছে তাকেই বুঝতে পারেনি।” মিনারের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমি তোমাকে বুঝতে না পারার কথা বলছি।”

মিনারের মন হঠাৎ বিস্ময়ে চমকে উঠলো। জাবিদ কীভাবে টের পেল ও ইরনকে…
কিছু জিজ্ঞেস করারও সাহস পেল না মিনার। শুকনো একটা ঢোক গিলে পালিয়ে গেল এক প্রকার।

_________________

পরের দিন মিনার খাবার টেবিলে এলো ঠিক সময়ে। খেলোও স্বাভাবিক ভাবে। কিন্তু কে খবর রাখে তার ভিতরটা কত অস্বাভাবিক!

ইরন মিনারকে লক্ষ করে অবাক হচ্ছিল আর কষ্ট পাচ্ছিল। মিনার যেন তার দিকে ভুল করেও একবার তাকায় না। হঠাৎ এত দূরত্ব সৃষ্টি হলো কেন? কিছুদিন পূর্বেও এমন দূরত্ব ছিল না। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরেই মিনার পালটে গেল, একেবারে ঋতু পরিবর্তনের মতো করে। বিয়ের ব্যবস্থাপনা শুরু হয়ে গেছে এর মধ্যেই। কিন্তু বিয়ে নিয়ে সামান্যতম চিন্তাও ইরনের মস্তিষ্কে আসছে না। তার মাথা সর্বক্ষণ ডুবে আছে মিনারকে নিয়ে। মিনার তার সাথে কথা বলছে না, তার দিকে তাকাচ্ছে না, ভুল করে সামনে পড়লে দেখে পালিয়ে যাচ্ছে, এ কেমন পাগলামি? মিনার যেন এটা কেবল তার সাথেই করছে। কী কারণ এর? এমনটা নয় যে তাদের মাঝে ঝগড়া হয়েছে। তাহলে?

পরেরদিন আর এরকম অবস্থা সহ্য করতে পারলো না ইরন। মিনারের কাছে গিয়ে খুব ভালোভাবে জিজ্ঞেস করলো ওর কী হয়েছে। মিনার কিছু না বলে মাথা নত করে রইল। যে কৃত্রিম রূপ সে এতক্ষণ চেহারায় এঁটে রেখেছিল তা একটু একটু করে ভাঙতে আরম্ভ করলো। ইরন ওর হাতে হাত রেখে বললো,
“এরকম করে থাকিস না প্লিজ। কী হয়েছে বল? দেখ, আমার খারাপ লাগে।”

মিনারের চোখে বিন্দু বিন্দু অশ্রু জমাট বাঁধলো। সে সেই অশ্রুসিক্ত চোখেই তাকালো ইরনের দিকে। ওর চোখের দৃষ্টিতে তাকিয়ে ইরনের ভিতরটা হঠাৎ ধক করে উঠলো। সে মিনারের চোখে এমন কিছু দেখলো যা দেখার জন্য আসলে সে পূর্ব প্রস্তুত ছিল না। মিনারের হাত থেকে হাত সরে এলো ইরনের। মিনার সে সময় তাকে কম্পমান কণ্ঠে বলে উঠলো,
“ইরন, আই থিংক ইট’স…”

এতটুকু বলেই থেমে গেল মিনার। হঠাৎ জাগ্রত হয়ে উঠলো মস্তিষ্ক। অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিলো। ভাবলো। তারপর আবার একবার তাকালো ইরনের দিকে। ইরন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
মিনার আর কিছু না বলে দ্রুত পায়ে চলে গেল জায়গাটা থেকে।
ইরন দাঁড়িয়েই রইল। হঠাৎ আজ মিনারের চোখে তাকিয়ে এমন কিছু মনে হলো কেন? যা দেখলো আসলেই কি তা সত্যি? অন্ধকারের মতো একরাশ দুশ্চিন্তা তার মস্তিষ্ক চেপে ধরলো। কীভাবে সম্ভব?

______________

এভাবে থাকা আর সম্ভবই হচ্ছে না। এরকম চললে আসলেই সে মরে যাবে। টের পাচ্ছে সে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। শারীরিক অসুস্থতা নয়, মানসিক। মানসিক অসুস্থতা পাগল করে দেবে তাকে। জানে তার মনের কথা প্রকাশিত হলে অনেক কিছু লন্ডভন্ড হবে। হোক। সে আর সহ্য করতে পারবে না। ইরনের বিয়ে ভাঙা তার উদ্দেশ্য নয়। সে শুধু নিজের কথা জানিয়ে বুকের ব্যথাটা উন্মুক্ত করবে। এতে যদি গণ্ডগোল লাগে, তবে লাগুক। পাগল হয়ে যাওয়ার চেয়ে তো ওই গণ্ডগোল বেশি মারাত্মক হবে না। মিনার এমন চিন্তা ভাবনা করেই বেরিয়ে পড়লো। এখন রাত অনেক। বাড়িটা নিস্তব্ধ। মনে হচ্ছে পাতালপুরী। সে ইরনের দরজায় কড়া নাড়লো। নিস্তব্ধতার ভিতর কড়া নাড়ার শব্দটা একটু বেশিই জোরালো শোনালো।
একটু পরেই খুলে গেল দরজাটা। ইরন দাঁড়ালো সামনে এসে।
মিনার কেমন অস্বস্তিতে পড়ে গেল। দৃষ্টি নত রেখে বললো,
“আমার কিছু বলার আছে।”

অজানা আশঙ্কায় ইরনের হৃৎপিণ্ড লাফাতে লাগলো। ঘেমে উঠলো শরীর। নার্ভাস বোধ করছে সে।

“হুম বল।”

“আজ নয়, কাল। কাল রাত ৭:৩০ এ ছাদে আসতে পারবে?”

“কাল কেন? আজকে বলতে কী সমস্যা?”

“অনেক সমস্যা।”

“তুই বল।”

“আমি চাইলেও অনেক কিছু বলতে পারি না। কারণ, সবকিছু বলার সাহস আমার নেই। তুমি শুনতে চাইলে কাল আসতে পারো, আর না শুনতে চাইলে আসার দরকার নেই।”

মিনার আর দাঁড়ালো না, দ্রুত পদে গিয়ে নিজের রুমে ঢুকলো।
ইরন অনেকক্ষণ যাবৎ মিনারের বন্ধ দরজাটার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল ঠাঁয়। মনে হলো কিছু একটা ঠিক হচ্ছে না।

_______________

বিকেলে গায়ে হলুদ হয়েছে। রাতে বিয়ে। পাত্রপক্ষ এসে গেছে। ইরনের পরনে শাড়ি। বউ সাজানো হয়েছে তাকে। মুখটা গম্ভীর হয়ে আছে। সে সময় থেকেই তার ঠোঁট হতে হাসি অদৃশ্য হয়ে গেছে, যে সময় থেকে সে মিনারের চোখে অদ্ভুত ওই জিনিসটা দেখেছিল। যদিও সে জানে না যা দেখেছিল আদৌ তা সঠিক কি না। মিনারের সাথে সে সেই নিজের জন্মকাল থেকে একসাথে আছে। এতকালেও সে একবারের জন্যও অমন কিছু দেখতে পায়নি। কিন্তু কাল হঠাৎ… ইরনের মনে হচ্ছে তারই কোথাও ভুল হচ্ছে। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো ইরন। ঘড়িতে সাতটা বিশ বাজে।

_________________

“শুধু শুধু এমন সময়ে গিয়ে ওকে এসব কথা বলে ঝামেলা সৃষ্টি করো না মিনার।” নয়না বললো।

মিনার জানে না নয়না এটা কীভাবে জানতে পারলো। ইদানীং সবাই যেন তার সবকিছু জেনে যাচ্ছে। সেদিন জাবিদ ভাইয়ার কথায়ও সে অবাক হয়েছিল। মিনার বললো,
“আমি শুধু আমার কথা বলবো। এই বিয়ে ভাঙা, অথবা ঝামেলা সৃষ্টি করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি শুধু…”

“কী দরকার?” বলে উঠলো নয়না, “এত দিন ধরে কথাগুলো বলোনি তাতে কী হয়েছে? হ্যাঁ, তুমি এই বিয়ে ভাঙতে চাও না, ঝামেলা সৃষ্টি করতে চাও না, কিন্তু ইরন? তোমার কি মনে হয় ইরন এই বিয়েটা করবে জানার পর? করবে না। কারণ এমনিতেই ওর তোমাকে ছাড়া থাকতে কষ্ট হবে, আর যখন এটা জানবে তখন থাকতেই চাইবে না। ঝামেলা তুমি না, ও সৃষ্টি করবে। কিন্তু এই ঝামেলা সৃষ্টি করে লাভ কী বলো তো? তোমাদের কি এই পরিবারের কেউ মেনে নেবে? নেবে না। কখনও নেবে না। কারণ এ পরিবারটা এমনই। দেখা যাবে তোমাদের জন্য সৃষ্টি হওয়া ঝামেলায় ভাইদের এত সুন্দর সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে!”

মিনার নীরব হয়ে গেল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। যন্ত্রণায় চিৎকার করতে ইচ্ছা করছে। সব দিক থেকে এত বাধা! আসলেই কিন্তু সে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এটা বাইরে থেকে দেখে কেউ বুঝতে পারছে না, কিন্তু তার ভিতরকার খবর তো সে জানে। ব্যথায় বিষাক্ত তার বক্ষ। কিন্তু সে চায় না বিয়ে ভেঙে কোনো ঝামেলার সৃষ্টি হোক, আর সেই সৃষ্ট ঝামেলা তার বাবা-চাচার সম্পর্কে প্রভাব ফেলুক। কী করবে সে? মরে যাবে?

________________

মিনারের কথা অনুযায়ী ঠিকই সাতটা ত্রিশের সময় ছাদে এলো ইরন। বিয়ে পরানো হবে ঠিক আটটায়। এমন সময়ে কনের ছাদে আসা সহজ ব্যাপার নয়। তবুও ইরন এসেছে। কিন্তু যার জন্য আসা সেই মানুষটাই নেই। মিনার আসতে বলে নিজে আসেনি কেন?
ভালো যে ও আসার সময় ফোনটা নিয়ে এসেছে। মিনারকে কল দিলো। কলটা প্রায় সাথে সাথেই রিসিভ হলো।

“আমাকে আসতে বলে নিজে আসিসনি কেন?”

ওপাশ থেকে বললো,
“খুব বড়ো একটা ভুল করতে যাচ্ছিলাম, কেউ একজন থামিয়ে দিলো এত বড়ো ভুলটা হওয়া থেকে।”

“মানে?”

“বুঝবে না তুমি।”

“যা বলবি বলেছিলি তা বলবি না?”

“বলবো, তবে এখন না।”

“এখন না বললে কখন?”

“শ্বশুর বাড়ি গিয়ে ফোন দিয়ো, তখন।”

“এখন বলতে কী সমস্যা?”

“সব কথা বলার জন্যই একটা উপযুক্ত সময় লাগে। আমার কথাগুলো বলার জন্য এই সময়টা উপযুক্ত নয়।”

ইরন কিছু বললো না। অনেকটা সময় নীরব থেকে হঠাৎ কেঁদে ফেললো,
“কোনো কিছু কি ভুল হচ্ছে মিনার?”

“না, সব সঠিক হচ্ছে।”

“তাহলে আমার কেন মনে হচ্ছে যে কিছু একটা ভুল হচ্ছে?”

“ওটা তোমার মনের ভুল।”

“যা বলার এখনই বলে দে।”

“তখনও যদি বলি তখনও তো শুনবে, তাহলে এখনই বলে লাভ কী? নিচে এসো।”

মিনার কল কেটে দিলো। ইরনের চোখে পানি চিকচিক করছে। তার কেবলই মনে হচ্ছে ভুল হচ্ছে, খুব বড়ো একটা ভুল হচ্ছে। ভীষণ শূন্যতা অনুভব হচ্ছে!

_______________

বিয়েটা হয়ে গেল। বিয়ের আসরে বসে ইরনের চোখ বার বার চলে যাচ্ছিল মিনারের দিকে। ইরনের মনে তখনও যে চিন্তার উদ্বেগ ছিল, এখনও সেই একই চিন্তার উদ্বেগ। কিছু একটা ঠিক হয়নি। বড়ো একটা ভুল হয়েছে কোথাও। খুব বড়ো। ইরন মিনারকে কল দিলো বাসর ঘরে ঢুকে। সজল তখনও আসেনি। এবারও কলটা খুব শীঘ্রই রিসিভ হলো।
মিনার বললো,
“শ্বশুর বাড়ি গিয়ে সাথে সাথে কল না দিলেও হতো।”

“আমি এখনই শুনতে চাই। বল।”

মিনার ক্ষণকাল নীরব থাকার পর বললো,
“আমি ভেবেছিলাম কথাগুলো তোমাকে বলবো না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল কথাগুলো চেপে রাখলে আমি পাগল হয়ে যাব! আমি পাগল হতে চাই না। ইরন, আমি ভীষণ ভীতু একটা ছেলে…”

শেষের কথাটা শোনা মাত্র ইরনের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। মনে পড়ে গেল সেই চিঠির কথা, যে চিঠির প্রথম লাইন ছিল,
‘প্রিয় ইরন,
আমি ভীষণ ভীতু একটা ছেলে!’

মিনার বলে চললো,
“তেরো বছর বয়সে প্রথম টের পেয়েছিলাম তোমাকে পছন্দ করি। ধীরে ধীরে টের পেলাম আসলে এটা পছন্দ নয়, ভালোবাসা। তোমাকে ভাবতাম সব সময়। এমন বাজে রোগও আমার হয়েছিল যে আমার ডায়েরির সব পাতায় তোমাকে নিয়ে নানা ধরনের কথা লিখে ভর্তি করে ফেলেছিলাম। আমার এই অনুভূতি খুব গাঢ়। অন্য মানুষের অনুভূতি সম্পর্কে ধারণা নেই, কিন্তু আমার যে অনুভূতি আছে এটা খুব মারাত্মক! জানি না এমন মারাত্মক অনুভূতিও মানুষের হয় কি না। তারা কীভাবে সামলে ওঠে এই মারাত্মক অনুভূতিকে? আমি পারছি না। এই মুহূর্তে যে কষ্ট হচ্ছে সেটাও সামলাতে পারছি না ইরন। খুব ব্যথা আমার হৃদয়ে! এতদিন অনেক কেঁদেছি। কিন্তু আজ কাঁদতে ভয় হচ্ছে, কষ্ট পেতে ভয় হচ্ছে। মনে হচ্ছে এত কাঁদলে, এত কষ্ট পেলে মরে যাব!
কী আশ্চর্য! আমি তোমার জন্য মরে যাব! অথচ দেখো, তোমাকে দায়ী করার কোনো অধিকার আমার নেই। আচ্ছা, আমার এত কাছে থেকেও তোমার কোনোদিন এক সেকেন্ডের জন্যও মনে হয়নি আমি তোমাকে ভালোবাসি? তুমি কি বোকা? না কি আমি বোকা, যে তোমাকে নিজের অনুভূতি সম্পর্কে বোঝার সুযোগই দিইনি? আমি এত ভীতু হয়ে কেন জন্মগ্রহণ করলাম ইরন? আমাদের পরিবারই বা কেন এমন? আমি কিন্তু অনেক আগে থেকে জানতাম তোমার বিয়ে অন্য কারো সাথে হবে। ঠিক তাই হলো! কিন্তু তাও আমার কাছে এমন লাগছে যে হঠাৎই সব কিছু হয়ে গেছে, আমি টেরও পাইনি। আসলে তো টের পেয়েছি। কিন্তু আমি যে ভীতু, সাহস কম। টের পেলেও কী করতে পারবো? আর কিছু করতে পারলেও চাইনি করতে। চাইনি আমি কিছু করার কারণে পরিবারের মাঝে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হোক, পরিবারটা ভেঙে তিন টুকরো হোক।” মিনার কেঁদে উঠলো, “ইরন, ভালোবাসি তোমায়! অনেক! অনেক বছর ধরে। সেই চিঠি, যে চিঠির জন্য শামীম ভাই মা’র খেয়েছিল, ওই চিঠির জন্য আসলে আমার মা’র খাওয়া উচিত ছিল। ওই চিঠি আমি লিখেছিলাম। আমার লেখা প্রথম এবং শেষ চিঠি।”
বিরতি নিয়ে আবার বললো,
“সাতটা ত্রিশেই আমি তোমাকে এই কথাগুলো বলতাম। কেউ একজন আমাকে থামিয়ে দিলো। আমার উদ্দেশ্য তোমার বিয়ে ভাঙা ছিল না, কিন্তু সে বললো কথাগুলো শোনার পর তুমি নিজেই বিয়ে ভেঙে দেবে। তার এমন কথা বলার মানে কী? আসলেই কি তুমি বিয়ে ভেঙে দিতে? দিলেও কেন? কোথাও এরকম নয়তো তোমার হৃদয়েও এই ভীতু ছেলেটার জন্য অনুভূতি আছে?”
মিনার হেসে বললো, “বেশি বেশি ভাবা হয়ে যাচ্ছে।”
তারপর আবার বললো,
“যাই হোক, আমার ভালোবাসা সব সময় আমার একান্ত ছিল। এই একান্ত ভালোবাসার জন্য সবাইকে কষ্ট দেওয়া উচিত হতো না। তবে তুমি কিন্তু একটুখানি কষ্ট পেয়ো। তাহলেই আমার ভালোবাসা, এই কথাগুলো বলা সার্থক হবে।
শেষে শুধু একটা কথাই বলবো, আমার মন মেঘ করেছে! ভীষণ কালো মেঘ জমেছে! নেই, এক রত্তি আফসোস নেই তাতে। শুধু তুমি সেই মেঘ ভেঙে বৃষ্টি হয়ে নামবে না বলেই আমার যত আফসোস আর আক্ষেপ!”
কলটা কেটে গেল কথাটা শেষ হওয়া মাত্রই।

ইরনের দুই চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে স্বচ্ছ জল ধারা। কষ্টে বুক হাহাকার করছে। এটাকে কি একটুখানি কষ্ট বলে? মিনার তো বলেছে একটুখানি কষ্ট পেতে, সে কেন তাহলে এত বেশি কষ্ট পাচ্ছে? ইরন চোখ বুজলো। অস্পষ্ট গলায় বললো,
“সেই তো বললি, কিন্তু অনেক দেরি করে! দেরি মানা যায়, কিন্তু ইচ্ছাকৃত দেরি মানা যায় না!”
অশ্রু তখনও ঝরে পড়ছে ইরনের চোখ বেয়ে।

“কার সাথে কথা বলছো?” পিছন থেকে সজলের কথা ভেসে এলো।

চোখ খুললো ইরন। অশ্রু মুছে নিলো। পরিবেশটা খুব দমবন্ধকর মনে হচ্ছে। খোলা একটা স্থান চাই তার। সজলকে বললো,
“ছাদে যাবেন?”

সজল একটু অবাক হলো,
“ছাদ?”

ইরন সজলের দিকে তাকিয়ে বললো,
“চলুন যাই।”

সজল আর দ্বিরুক্তি না করে ছাদে নিয়ে এলো ইরনকে। ইরন ছাদে এসে মাথার ওড়নাটা খুলে রুফটপে ফেললো। নোলকটাও খুলে ফেললো। ঝিরিঝিরি সমীরণ ছুঁয়ে দিচ্ছে। আকাশে উজ্জ্বল চাঁদ, ছড়ানো-ছিটানো নক্ষত্র। উজ্জ্বল চাঁদটার দিকে অপলক তাকিয়ে রইল ইরন।
সজল দূর থেকে তাকিয়ে রইল ইরনের দিকে। ইরন যেন অন্যরকম হয়ে গেছে। হঠাৎ ইরন বলে উঠলো,
“ভীতু ছেলেটা যদি বিয়ের এক মিনিট আগেও আমাকে কথাগুলো বলতো, আমি আপনাকে মরে গেলেও বিয়ে করতাম না!”

সজলের ভ্রুতে কুঞ্চন সৃষ্টি হলো।
“কী বলছো?”

“কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে, বড়ো একটা ভুল হয়ে গেছে! এই ভুল শুধরানোর সুযোগ নেই আর!”
কথাগুলো চাঁদের দিকে চেয়ে থেকে বলছিল ইরন। সজলের দিকে তাকালো হঠাৎ। সজল বিস্মিত মনে দাঁড়িয়ে আছে। ইরন এগিয়ে এলো। খুব কাছে এসে দাঁড়ালো সজলের। চোখে হঠাৎ আবার অশ্রু এসে হানা দিলো। মাথাটা ঠ্যাকালো সজলের বুকে। চমকে উঠলো সজল।
ইরন কান্নাটা আটকে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে বললো,
“আমাকে প্রচুর ভালোবাসবেন ডাক্তার সাহেব, প্রচুর! আপনার ভালোবাসা খুব প্রয়োজন আমার।”

ইরন কান্নাটাকে আর আটকে রাখতে পারলো না।

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here