#আজি_বিজন_ঘরে (৫,৬,৭)

৫.

রাজন আজকাল রাশেদার সামনে পারত পক্ষে পড়ে না। যে মহিলা নিজের মায়ের মত তাদের বড় করেছে তার কঠিন দৃষ্টি আর পাথরের মত মুখ দেখলে তার অন্তরআত্মা কেঁপে ওঠে। সকালে কোনো রকমে নাস্তা করেই তাই সে বেরিয়ে পড়ে। ভেবেছিল অর্পাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনলেই হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু অর্পা কোনো ভাবেই তার সাথে কথা বলতে রাজি না। আর এখন তো পুরা গায়েব। ওর ডিপার্টমেন্টেও দেখে না কদিন থেকে আবার হলেও খোঁজ নিয়ে জেনেছে যে সে সেখানে নেই। তবে গেল কোথায়? মা নিশ্চই জানে। কিন্তু তাকে কি বলবে?
-কি হয়েছে রে তোর ?
স্বজনের প্রশ্নে সে চমকে উঠলো।
-কিছু না তো।
-বললেই হলো। মা কেন এমন হয়ে ব্যবহার করছে আর অর্পা কেন হঠাৎ চলে গেল?
-তার আমি কি জানি?
-তোর কি মনে হয় আমি কিছু বুঝি না?
-বুঝলে তে ভালই।
-এভাবে কথা বলতে তোর লজ্জা করছে না?
-লজ্জা করলেও কিছু করবার নেই। ভুল যা করবার করে ফেলেছি। আর এই ভুল শোধরানোর কোন উপায় নেই।
-তোকে আগেই বলেছিলাম ঐ ছেলেগুলার সাথে না মিশতে, আমার কথা তো শুনলি না।
-তুই এখন তোর উপদেশ বাণী বন্ধ কর। এমনিতেই মাথা কাজ করে না।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরলো কিছুক্ষন। অর্পার ক্লাস রুটিন তার জানা। ক্লাস শেষ হবার আগে সে ডিপার্টমেন্টের সামনে এসে দাঁড়ালো। মিতাকে দেখতে পেল কিছুক্ষন বাদেই। মিতার পেছনে পেছনে এল কিছুটা পথ।
-মিতা শোনো।
মিতা রাজনকে দেখে হাঁটার গতি বাড়ালো। সে দৌড়ে এসে পথ আটকালো।
-অর্পা কোথায়?
-আমি কি করে বলবো ও কোথায়?
-তুমি ঠিক জানো। বলো কোথায় ও?
-আমি কিন্তু অর্পা না। বেশী বাড়াবাড়ি করলে কিন্তু পুলিশ ডাকবো। আর আমার বড় ভাই কিন্তু পুলিশে চাকরি করে। প্রাণের মায়া থাকলে বিদায় হন।
-তুমি বলবে না?
মিতা কোন কথা না বলে চলে আসে। রুমে এসে তার ভাইকে ফোন করে। এই ছেলেকে ধোলাই না দিলেই নয়।

পরের দিন মিতা কে ফলো করতেই রাজনকে পুলিশ গ্রেফতার করলো। ওসি জরুরী কাজে বাইরে গেছে তাই থানা হাজতে তাকে রেখে কন্সটেবল তালা দিয়ে চলে গেল। সে ভেবেছিল মিতা তাকে মিথ্যা ভয় দেখাচ্ছে। সত্যি সত্যি সে যে পুলিশকে জানাবে তা সে কল্পনাও করেনি।

বেশ কয়েক ঘা ডান্ডার বাড়ি দিয়ে তাকে সন্ধ্যার পর ওসির সামনে নিয়ে আসা হল। সারাদিনে পানিও খাওয়া হয়নি। আর মার খেয়ে তার হাটবার শক্তিও চলে গেছে।
-কিরে মেয়েদের পিছে ঘুরতে খুব ভাল লাগে?
-একটা দরকারে ঘুরতেছিলাম স্যার।
-কিরে কালাম এ দেখি এখনও কথা কয়। শোন তোর ভাগ্য ভাল যে স্যার ঢাকার বাইরে থাকে। তা না হলে তোর খবরই ছিল। আজকের মত ছাইড়া দিলাম। আর যদি ম্যাডামের পিছে ঘুরতে দেখি তাহলে তোর খবর আছে। বল আর জীবনেও এই কাজ করবি না।
-আর করবো না স্যার।
-যা ভাগ এখান থেকে।
রাজন কোন রকমে বাইরে এসে রিক্সায় উঠে বসে।

৬.

রোদেলা যখন ওর শয়তান স্বামীর অত্যাচারে নিজের শরীরে আগুন দিল তখন রিজভী ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। মেয়েটাও বোকামী করেছিল। নিজের পছন্দের বিয়ে বলে স্বামীর অত্যাচার সব মুখ বুজে সহ্য করতো। বাড়ির কাউকে কিচ্ছু বলেনি। কিন্তু বার্ন ইউনিটে যখন ও মৃত্যুর সাথে লড়তে লড়তে মরে গেল তখন ওদের পুরো পরিবারটাই যেন ওর সাথেই শেষ হয়ে গেল। তোমার শাশুড়ী মা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেন। রিজভী ছিল বোন অন্তপ্রাণ। বোনের ভয়ঙ্কর মৃত্যু রিজভীকে বদলে দিল একে বারেই। কবিতা আর গান পাগল ছেলেটা কেমন অন্যরকম হয়ে গেল। তারপর সব কিছু ফেলে দেশের বাইরে চলে গেল। ও চলে যাবার কিছুদিন পরেই ওর বাবা মারা গেল। তার কয়েকমাস পরেই মা। ও যখন ফিরে এল তখন আর কোনো কিছু ফিরে পাবার নয়। সময় তো আর থেমে থাকে না। আর এখন তো বন্ধু বান্ধব কারো সাথে যোগাযোগ নেই। নিজের পরিবারও নেই। আছি শুধু আমি। কিন্তু আমি বা আর কদিন বাঁচবো বলো?

মনোয়ারা বেগমের কাছে পুরোনো দিনের গল্প শুনছিল অর্পা। মানুষের বাইরেটা দেখে আসলেই ভেতরটা বোঝা সম্ভব নয়। বাইরের আড়ম্বর দেখে কে বলবে মানুষটার মনে এত কষ্ট।

-কিন্তু বউ তুমি এসে তো ছেলেটা আরও বাহিরমুখী হল। আগে তো তবুও বিকালে ঘরে আসতো । এখন তো দেখি অনেক রাতে ফেরে। লাইব্রেরির পাশে যে ছোট ঘরটা আছে সেখানে রাতে থাকে। তুমি কি তাকে কিছু বলছো?

অর্পা অপ্রস্তুত হয় এমন প্রশ্নে।

-আমি তো কিছু বলিনি ফুপু।
-ছেলেটার অনেক দুঃখ। জানিনা তোমাকে কেন বিয়ে করলো? আমি নিজেও মানা করেছিলাম শফির কাছে তোমার ছবি দেখে। কিন্তু আমার কথাও শুনলো না। এর পেছনেও নিশ্চই কোনো কারণ আছে। তুমি দেখো কি করতে পারো।

ফুপুর ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে অর্পা দেখলো মেরী বিকালের নাস্তা টেবিলে দিচ্ছে।
-কেউ কি আসবে?
-ভাইজান আসবে। ফোন করছিল।
-আমি ঘরেই আছি। উনি আসলে আমাকে ডাক দিও।
মেরী ঘাড় নাড়ে।

লাইব্রেরির পাশের এই ঘরটায় তার মা থাকতো। মায়ের প্রচন্ড রকম বই পড়ার নেশা ছিল। সব সময় কিছু না কিছু পড়তেই হবে। তাই বাবা মায়ের জন্য লাইব্রেরি বানালেন আর সাথে এই ঘরটা। মা শেষ জীবনে এই ঘরটাতে থাকলেও বই পড়তে পারেননি আর। বরং বই ছিড়ে কুটি কুটি করতেন তখন। সে সময় সে দেশের বাইরে। বাবাও বেঁচে নেই। ফুপু শক্ত হাতে আগলে আছেন ঘর বাহির দুটোই। দুর্ঘটনা এমন সময় ঘটলো। সবার অলক্ষ্যে মা ছাদে চলে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে পড়ে যান, নাকি নিজে লাফিয়ে পড়েছিলেন কেউ জানে না। অর্পাাকে নিজের মত থাকতে দিতেই সে এই ঘরটায় থাকা শুরু করেছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এটাই ভাল হয়েছে। এই ঘরে আসলেই তার কেন জানি মনে হয় মা আশেপাশেই আছে।

অফিস থেকে ফিরে কাপড় বদলে সে ডাইনিং টেবিলে বসলো। এ সময় সে তেমন কিছু খায় না। শুধু এক কাপ কফি। তবুও এরা টেবিল ভর্তি করে নাস্তা দিয়ে যায়। অর্পাকে পাশে এস দাঁড়াতে দেখে সে খুব অবাক হল।
-বসবো?
-অবশ্যই। অনুমতি নেবার তো দরকার নেই।
-আমার কিছু কথা বলবার ছিল।
-কোন সমস্যা হচ্ছে কি?
-না তো।
-তাহলে?
-কথাগুলো আমাদের বিষয়ে।
-আচ্ছা তুমি তোমার ঘরে যাও। আমি কফি শেষ করে আসছি।

৭.

ঘরে কাউকে না দেখে রিজভী বারান্দায় এল। সুর্য ডুবি ডুবি করছে। পাখিদের কলকাকলিতে চারিদিক মুখরিত। সবার ঘরে ফেরবার তাড়া এসময়। দূর থেকে দেখলেন অর্পা রেলিং ধরে দাড়িয়ে। চেহারায় বিষন্নতা। গৌধুলীর আলোয় ওকে অন্য জগতের কেউ মনে হচ্ছে। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষন। যদিও তিনি মেয়েটাকে এভয়েড করছেন। তবুও মনে সব সময় কেন জানি ওর কথা মনে হতে থাকে। শফি যখন বলেছিল ও তার ফোন নাম্বার নিয়েছে। তখন থেকেই তিনি ভাবছেন এই বুঝি ফোন করবে। তিনি কি এই বয়সে প্রেমে পড়লেন? তার ফোন বাজতেই অর্পা ঘুরে তাকালো। তিনি ফোন কেটে দিয়ে এগিয়ে এলেন।

-কি হয়েছে বলোতো?
-আপনি আমাকে কেন বিয়ে করলেন?
-এতদিন পরে এই প্রশ্ন?
-আপনি উত্তরটা দিন প্লিজ।
-যদি বলি তোমাকে ভাল লেগেছে বলে।
-আমি এটা কিছুতেই বিশ্বাস করছি না।
-কাজ নেই বলে কি বসে বসে এমন আজব চিন্তা করছো? তুমি ইউনিভার্সিটি যাচ্ছ না কেন?
-আসলে বিয়ের পর থেকে তো আপনার সাথে কথাই হয়নি। আপনার কাছে না জিজ্ঞেস করে কিছু করি কি করে?
-একটা কথা বলি শোন। তুমি আগে যেমন ছিলে তেমনটাই থাকবে। তোমার যা ভাল লাগবে তাই করবে। আমাকে জিজ্ঞেস করবার কিছু নেই। এটা যেমন আমার বাড়ি তেমন তোমারও বাড়ি।
-আমাকে তো বললেন। কিন্তু আপনার নিজের বাড়িতে তো আপনি মেহমানের মত থাকছেন। নিজের ঘরেও আসছেন না। সবাই কি ভাবছে বলেন তো?
-আমি চাইছিলাম তুমি তোমার মত করে থাক। সবার কথা ভাবতে হবে না। কাল থেকে ইউনিভার্সিটি যাবে। আমি ড্রাইভারকে বলে রাখবো। আচ্ছা কাল না হয় আমি নামিয়ে দেব। রেডি হয়ে থেক।

দুপুরের পরেই বাসায় ফিরে এল অর্পা। অনেকদিন পর বাইরে গিয়ে ভালই হয়ছে। বান্ধবীদের সাথে আড্ডাও হল। এক ফাঁকে মিতা রাজনের ঘটনা বলল। শুনে সে খুশি হল। যদিও ওর শাস্তি এতটুকুতে হবে না। দুপুরের আগেই সে ফিরে এল। দুপুর বেলাটা এ বাসায় বেস মন্থর। সে লাইব্রেরিতে এল। পাশের ঘরটাতে উঁকি দিল। সব কিছু গোছানো, ঝকঝকে। দেখলে মনেই হয় না এখানে কেউ ছিল। সে বিছানায় বসল। লোকটা অন্যরকম হলেও কেমন জানি একটা মায়া জন্মেছে। বাসায় থাকলেই তার কাছাকাছি থাকতে ইচ্ছা করে। ঠাস করে একটা শব্দ হতেই সে চমকে উঠলো। মনে হয় বই টই কিছু পড়ে গেছে। সে উঠে এল। টেবিলের পাশে ছোট্ট সেলফ থেকে ফোল্ডারের একটা নীচে পড়ে আছে। কিন্তু একটু আগেও তো ঠিক ভাবে রাখা ছিল। পড়ল কিভাবে। সবকিছু গুছিয়ে তুলতে গিয়ে তার নামের ফাইলটা চোখে পড়ল। বাকি সব গুছিয়ে রেখে সে তার ফাইলটা খুললো। তার বিষয়ে সব কিছু লিখা। রাজন যে পিছে পিছে ঘুরছে সেটাও। ফাইলটা আগের জায়গায় রেখে নিজের ঘরে চলে এল। আসল সত্যি জানলে উনি কি করবেন? তাকে কি বাড়ি থেকে বের করে দেবন? তাকে কি আবার রাস্তায় যেয়ে দাঁড়াতে হবে?

দরজায় নক হতেই সে চমকে উঠলো। ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। জানালা দিয়ে দেখলো সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
-কে?
-আপা আমি টগর।
-ভেতরে আসো।
টগর ঘরে ঢুকলো। বারো তোর বছরের একটা ছেলে। এ বাড়িতেই থাকে।
-কিছু বলবে?
-স্যার বাইরে লনে বসে আছে। আপনাকে যেতে বলেছে।
-তুমি যাও। আমি আসছি।

সে ফ্রেশ হয়ে কাপড়টা বদলালো, চুলটা ঠিক করে নীচে নেমে এল। চেয়ার টেনে বসতেই রিজভী কফি এগিয়ে দিল।
-অবেলায় ঘুমাচ্ছিলে যে? শরীর ঠিক আছে তো?
-জ্বি।
-কেমন কাটলো সময়? ইউনিভার্সিটিতে কি করলে?
-কতদিন পরে গেলাম। কত ক্লাস মিস করে ফেলেছি। আমি তো ভেবেছিলাম আর বোধহয় পড়া হবে না।
-তোমার কি টিউশন লাগবে?
-আপাতত না।
-লাগলে নিয়ে নেবে। আর কাল সকালে আমার সাথে ব্যাংকে যাবে। তোমার একাউন্ট করে দেব।
-দরকার নেই এই সবের। টাকা লাগলে আমি আপনার কাছেই চাইবো।
-দরকার আছে। তুমি বুঝবে না।

কফি শেষ করে দুজনেই উঠলো।

মনোয়ারা বারান্দা থেকে ওদের দেখলেন। তার এতদিনের পরিশ্রম কি এই পুঁচকি মেয়েটা নষ্ট করে দেবে?

চলবে….

এমি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here