#আকাশ_এখন_মেঘলা
মোর্শেদা হোসেন রুবি

১||
আজকের মতো ক্লাস শেষ। ব্যাগ গুছিয়ে বেরোনোর পথেই ডাক পড়লো।
” এ্যাই গহনা…।”
কণ্ঠটা পরিচিত। নিজের নাম শুনে থেমে গেলো। ঘাড় ফিরিয়ে শব্দের উৎস খুঁজলো। দুলিকে দেখা যাচ্ছে। সাইন্স বিল্ডিং এর দোতলা থেকে হাত নেড়ে ওকে ডাকছে। বিরক্তই হলো এবার। এভাবে চেঁচিয়ে সারা কলেজ মাথায় করার কোন মানে হয়না। ডাকার জন্য একটা কল বা মিসকলই যথেষ্ট ছিল। দুলির কাছে গহনার নাম্বার আছে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই দুলিকে দেখা গেলো দৌড়ে এদিকে আসছে। তাকে বেশ উত্তেজিত আর আনন্দিত দেখাচ্ছে।

” কী রে, এতো চিৎকার করে ডাকছিলি কেন ? ” অসন্তুষ্টির সুর গহনার কণ্ঠে। দুলির হাসি তাতে এতোটুকু ম্লান হলো না। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,” আরে তোকে পেয়ে আমি সব ভুলে গেছি। তাই খুশিতে ইচ্ছামতো চেঁচাইসি। রাগ করিসনা দোস্ত।”

-” হম, রাগ করবো না। পুরো কলেজে আমার নাম ভাইরাল করে দিছিস আর বলিস…।” কথা অসমাপ্ত রেখে উষ্মার সাথে বাম কাঁধের ব্যাগটা ডান কাঁধে আনলো গহনা। এটা সত্যি ওর নামটা যেই শোনে সে দ্বিতীয়বার ওর দিকে তাকায় এবং তারপর অবশ্যাম্ভবী ভিত্তিতে নামটা কে রেখেছে জানতে চায়। এ পর্যন্ত হলেও ঠিক ছিল। কিন্তু এরপর শুরু হয় কুইজ কনটেস্ট। প্রশ্নকর্তা বা কর্ত্রী যেই হোন না কেন তিনি গহনার নাম বৃত্তান্তের পাশাপাশি জীবন বৃত্তান্ত জানতে চেয়ে একটার পর একটা প্রশ্ন করতে শুরু করেন। দু একজন মাত্র নামে থেমে যায়। বেশিরভাগেরই প্রশ্নবৃষ্টি এসে থামে গহনার ফোন নম্বরে।

-” আরে না শুনেই রাগ করিস। তোর জন্যই দৌড়ে এলাম আর তুই ফাউ রাগ দেখাচ্ছিস। আসল ঘটনা শুনলে রাগের বদলে থ্যাঙ্কস দিবি। আমাকে কোলে নিয়ে নাচতেও পারিস।”

” আসল ঘটনা কী ? ” ভেতর থেকে ততটা আগ্রহ না জুটলেও দুলির কথায় চোখেমুখে আগ্রহ টেনে বললো গহনা। যদিও ক্ষিধেয় ওর চোখ মুখ অন্ধকার হয়ে আসছে।

” বলবো। তার আগে বল তোর মার্কসিট তুলতে চাস ? ”

” মার্কসিট তুলতে চাই মানে ? ওটা কী কলেজে এসেছে নাকি ? ” একসেকেন্ডের তরে ক্ষিধে নামক অনুভূতিটা গায়েব হয়ে গেলো গহনার।

” জানতাম তুই এটাই বলবি। সেজন্যেই পাগলের মতো তোরে খুঁজে বের করলাম। একা নিজের ভালো ভাবতে পারলাম না বলে। ” মিষ্টি একটা হাসি দুলির ঠোঁটে। গহনা ক্লান্ত চোখে ওর হাসির রহস্য ধরার চেষ্টা করলো। দুইসেকেন্ড পর হাল ছেড়ে দিয়ে বললো,” আমার খুব ক্ষিধে পেয়েছে। বাসায় যাবো। পরে ফোনে শুনে নেবো। বাই।”

গহনা হাঁটতে শুরু করার আগেই হ্যাঁচকা টান খেলো ব্যাগে। দুলি বিষম অবাক হয়ে বললো, ” উফ্, গহনা। তোর মতো কোল্ড ব্লাডেড মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি। ”

” হট হবার মতো অবস্থায় যে আমি নেই সেটা কতবার বোঝাবো ? ”

” ওকে। তাহলে কিছু একটা কিনে নিয়ে তারপর বাসে উঠবো। পানি আছে সাথে? ” বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো তুলি।

” আছে। কিন্তু বাসে কোথায় যাবো ? ”

” গাজিপুর। আমি সেখানেই যাচ্ছি। কারণ আমাদের মার্কসিট চলে আসছে ওখানে।”

” বলিস কী ? ” অস্ফুটে বিস্ময় প্রকাশ করলো গহনা।

-” জি। কিন্তু এতো খুশি হবার কিছু নাই। ওটা সিল ছাপ্পড় হয়ে কলেজে আসতে কমপক্ষে আরো দুই তিন সপ্তাহ। আর আমাদের ভূঁইয়াতে ফর্ম জমা দেবার লাস্ট ডেট আগামী পরশু। কাজেই বুঝতেই পারছিস। আমি তো কোন অবস্থাতেই এই টার্মটা মিস করবোনা। এক্কেবারে ছয়মাস পিছিয়ে যাবো তাহলে। প্রয়োজনে একটু কষ্ট করে নিজে গিয়ে মার্কসিটটা তুলে আনবো। ওখানে গিয়ে একটু চা-পানির পয়সা খরচ করলেই মার্কসিটটা হাতে হাতে পেয়ে যাবো। কাল তাহলে ভূঁইয়াতে জমা দিয়ে এই সেশনের জন্য ফর্মটা ফিলাপ করে ফেলবো। তুই নিজেও তো এই টার্মেই ভর্তি হতে চেয়েছিলি। তাহলে এতো কেন কিন্তু করছিস কেন। আমার সাথে গাজিপুর চল।”

গহনা মনে মনে কিছুটা উত্তেজিত হয়ে পড়লো এবার। দুলির কথা ঠিক হলে ওর নিজেরও এটাই করা উচিত। কিন্তু কথাটা কতটা ঠিক কে জানে। গহনা বুঝতে পারছেনা সে কী করবে। গহনাকে দোনোমোনা করতে দেখে দুলি ওর হাত ধরে টান দিলো।
-” তুই আয়তো। দেরি হয়ে যাবে আমাদের। রাস্তায় যে জ্যাম পৌঁছাতে পৌঁছাতেই পাঁচটা বেজে যাবে। আমাদেরকে তার আগেই পৌঁছাতে হবে। পাঁচটায় অফিস বন্ধ হয়ে যায়।”

গহনা কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখলো। পৌণে তিনটা। চিন্তিত ভঙ্গিতে হাঁটতে লাগলো দুলির পাশাপাশি। গেট থেকে বেরিয়েই রিক্সা নিলো দুলি। গহনার হাত ধরে টেনে তুললো ওকে। শেষ পর্যন্ত গহনাকে উঠে বসতে হলো রিক্সায়। যদিও ক্ষিধায় জান যায় অবস্থা। বিরক্তি চেপে বললো, ” যদি সময়মতো পৌঁছাতে না পারি তাহলে পুরো কষ্টটা জলে যাবে।”

” যাবেনা।” দুলি ভ্রু নাচালো।

” যাবেনা ? কেন ?”

” কেন আবার কী। যতদেরিই হোক আমরা মার্কসিট পাবোই সেটাই বলতে চাচ্ছি। ”

-” কিন্তু কীভাবে ? ”

” চল যেতে যেতে বলছি। তার আগে তুই বাসস্ট্যান্ড থেকে কিছু কিনে নে তো। তোর চেহারা দেখে আমারই ভয় লাগছে। এমনিতেই তুই কৃষ্ণকলি, তারমধ্যে রোদে পুড়ে তোরে যা দেখাচ্ছে। একটু পরে তোরে আর খুঁজেই পাওয়া যাবেনা।”

” না পাওয়া গেলেই ভালো। ইনভিজিবল হয়ে যাবো।” বিরক্তি চেপে বললো গহনা।

গহনার জানে তার গায়ের রং কালো। আপনজনেরা খাতির করে বলে শ্যামলা। আত্মীয় বন্ধু সবাই ওর গায়ের রং নিয়ে একবার হলেও মজা করে। আর এগুলো গহনার গা সওয়া হয়ে গেছে। সেকারণেই কোন প্রতিবাদ করেনা। করতে ইচ্ছেও করেনা। তাই বলে সবসময়ই এক কথা বলতে হবে ?

গহনাকে মুখ বানাতে দেখে দুলি কনুই চালালো, ” কীরে মাইন্ড করলি ? ”

-” নাহ, মাইন্ড করা ছেড়ে দিয়েছি। ” গহনা সামনের দিকে তাকালো। পড়ন্ত বিকেলের তপ্ত রোদে ছায়াবিহীন পথটা পুড়ছে। যতক্ষণ বিল্ডিংগুলোর আড়ালে থাকে রিক্সাটা। ততক্ষণই শান্তি। ছায়া ছেড়ে নড়লেই ঘাড় মাথা জ্বালা শুরু করে দেয়।

বাসস্ট্যান্ডের সামনে এসে রিক্সা ছেড়ে দিলে ব্যাগে হাত ঢোকালো দুলি। হতাশ ভঙ্গিতে গহনার দিকে তাকালো, ” দোস্ত, খুচরো টাকা আছে। থাকলে ভাড়াটা দে। আমাকে নোট ভাঙাতে হবে। ”

তর্ক না করে ভাড়া মিটিয়ে দিলো গহনা। ওর নিজের কাছেও ভাংতি ছিলো না। পাশের দোকান থেকে দুটো হানিবান আর ঠান্ডা জুস কিনে বাকি টাকা থেকে রিক্সা ভাড়া দিলো। বাসে ওঠার পর দুলির হাতে একটা বান আর জুস ধরিয়ে দিয়ে বললো, ” নে, তুইও খা।”

” আরে আমার লাগবেনা, তুইই খা। আমার অতটা খিদে নেই। বারোটার দিকে চা সিঙারা খেয়েছিলাম ক্যান্টিনে ঢুকে।” দুলি মৃদু আপত্তি জানালো।

” তবুও আমার সাথে খা। আমি একা খাবো নাকি। ” বলে ছোট্ট কামড় বসালো মিষ্টিরুটিটায়। বান্ধবীর আবেদন অগ্রাহ্য করতে না পেরে দুলিকেও সঙ্গ দিতে হলো। বাস চলতে শুরু করেছে। জুস শেষ করে প্যাকেটটা দুমড়ে হাতের পলি ব্যাগে পুরে ফেললো গহনা। দুলির দিকে হাত বাড়ালো, ” তোর প্যাকেটটা দে।”

” কী করবি ? জানালা দিয়ে ছুঁড়ে মারলেই তো হয়। পোটলা বানাচ্ছিস কেন? ”

” আরে নাহ্, রাস্তায় ফেলবো না। এটায় রেখে দে। বাড়ি নিয়ে যাবো। বাসার ডাস্টবিনে ফেলে দেবো নয়তো পথে কোন ডাস্টবিন পেলে সেখানে ফেলবো।” দুলি তর্ক না করে খালি প্যাকেট তুলে দিলো গহনার হাতে। গহনার দেশপ্রেমিক স্বভাব নিয়ে আগে ওরা সবাই হাসাহাসি করতো। এখন আর করলো না। কেবল টিস্যুতে ঠোঁট মুছে দুষ্টুমির সুরে বললো,” তোকেই খুঁজছে বাংলাদেশ।”

গহনা ওর কথায় তেমন গা করলো না। চিন্তিত স্বরে বললো, ” আচ্ছা তখন বললি যত দেরিই হোক মার্কসিট পাবো। কীভাবে পাবি তা তো বললি না। পরিচিত কেউ আছে নাকি ওখানে ? তখন বললি বাসে উঠে বলবি।”

-” থাকতেও পারে।” বলে আলগোছে হাসলো তুলি। গহনা বোকার মতো বললো,” মানে?”

” মানে কিছু না। সব কিছুর মানে হয়না। ” দুলির কণ্ঠে রহস্য। গহনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। গুলিস্তানের জ্যামে আটকা পড়েছে বাস। চারিদিকে মানুষ থিক থিক করছে। কতো মানুষ এদেশে। এদের প্রত্যেকেরই নিশ্চয়ই একটা করে গল্প আছে।

বাস ঠিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে থামলে ওরা দুজন নেমে পড়লো। গহনা একটু ভয়ে ভয়ে ছিলো। পাঁচটা না বেজে যায়। নেমেই ঘড়ি দেখলো। সাড়ে চারটার কিছু বেশি। স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়লো। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল খোলা চত্বর পেরিয়ে একটা ভবনে ঢুকতেই দুলির বড় ভাই সাবেরের সাথে দেখা হয়ে গেলো ওদের। ঠিক দেখা হলো বলা ঠিক হবেনা। সাবের দুলির অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়ে ছিলো। গহনাকে দেখে বিস্মিত হলো কিছুটা। গহনা সালাম দিলে মাথা নেড়ে বললো, “কেমন আছো গহনা ? ”

” জি, আলহামদুলিল্লাহ ভাইয়া। আপনি ভালো ? ”

” এই তো আছি। তোমারও কাজ আছে নাকি এখানে? ”

সাবেরের প্রশ্নের জবাব দেবার আগেই ভাইকে থামিয়ে দিয়ে ত্রস্তে গহনার হাত ধরে টানলো দুলি। তাড়া দিয়ে বললো, ” ভাইয়া, দেরি হয়ে যাবে আমাদের। তুমি আগে আমার মানে আমাদের কাগজ বের করো তো।”

সাবের একবার দুলি আরেকবার গহনাকে দেখে দোতলার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। দোতলায় উঠে একটা বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো ওরা। গহনা মাথা তুলে গেটের ওপর লাগানো বোর্ডটা পড়লো। নামের নিচে ধাম পড়ে মনে হলো রুমের অফিসারটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। গহনা দুলির দিকে তাকালো, ” ইনিই কী আমাদের পেপারস দেবেন? ”

দুলি জবাব না দিয়ে কেবল কাঁধ ঝাঁকালো। ব্যাগের ভেতর থেকে কমপ্যাক্ট বের করে দ্রুত পাফ করে ঠোঁটে আলতো লিপগ্লস বুলিয়ে নিলো। রোদে ঠোঁট শুকিয়ে একেবারে চড়চড় করছিলো। গহনা সেদিকে তাকিয়ে নিজের ব্যাগ থেকে বোতল বের করলো। গলা ভেজাতেই যাবে অমনিই পিয়ন উঁকি দিলো, ” আপনারা আসেন। ”

গহনা দ্রুত বোতলটা ব্যাগেই রেখে দিলো। সাবেরের নেতৃত্বে ওদের তিনজনের ছোটখাটো দলটা রুমে প্রবেশ করলো। টেবিলের ওপাশে যিনি বসে আছেন তাকে আরো বয়স্ক আর রাশভারী আশা করেছিলো গহনা। তিনি বয়স্ক তো ননই, রাশভারীও নন। সাবেরকে দেখে হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন। সাবের হাত মিলিয়ে বোনকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললো ,” পরিচয় করিয়ে দেই। এ হলো আমাদের দুলি। যাকে তুমি দুলু বলে ডাকতে আর দুলি উনি হলেন আমান ভাই। এ বছরই ন্যাশনালে জয়েন করেছেন। ”

দুলির চেহারায় স্মিতহাসি দেখে বোঝা গেলো আমান ভাই সম্পর্কে সে অনবহিত নয়। বুক পর্যন্ত হাত তুলে আনারকলি স্টাইলে ‘স্লামালিকুম’ বলতে দেখে মনে মনে যারপরনাই বিরক্ত হলো গহনা। এটা আবার কোন জাতের সালাম। তবে বিরক্তির ছাপ পড়তে দিলো না চেহারায়। যার যেভাবে খুশি সালাম দেবে। ওর কী।

ঘাড় ঘুরিয়ে রুমের দেয়ালে টাঙানো ছবিগুলো দেখলো গহনা। ছবি দেখা শেষে একটা বিশালকায় কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো কিছু নাম এবং তাঁদের কর্মদিবস পড়তে লাগলো। মোট আঠারো জনের নাম ও সাল লেখা রয়েছে। সবার নিচে লেখা মোহাম্মদ আমান মিকদাদ। এখানে শুরুর সালটা আছে শেষের সালটা নেই। তার মানে ইনি এই চেয়ারের আঠারো নং অধিপতি। পড়া শেষ হতে চোখ পিছলে নিচে নেমে গেলো। ফ্রেমের নিচে বসা মানুষটাতে ঠেকলো। মনে মনে সামান্য চমকালো। ভদ্রলোক অদ্ভুত চোখে ওকেই দেখছেন। সচেতন হতে হলো গহনাকে। বেশ অনুগত ছাত্রীর ভঙ্গিতে স্পষ্টসুরে সালাম দিলো। ভদ্রলোক হাসিমুখে সালাম নিলেন। ” ওয়াআলাইকুমুস্সালাম।”

” ইনি কী তোমাদের সাথে ? ” শেষ কথাটা সাবেরের দিকে তাকিয়ে বললেন ভদ্রলোক। গহনা দেখলো সাবের মাথা নাড়ছে , ” জি, আমান ভাই। ও হলো গিয়ে আমাদের দুলির বান্ধবী। একসাথে পড়ে।” বলেই গহনার দিকে তাকালো। ” তোমারও কী কাজ আছে যেন বললে ? ”

গহনা বিস্ময় চেপে দুলির দিকে তাকালো। দুলিকে দেখা গেলো পুতুলের মতো চুপটি মেরে বসে আছে চেয়ারে। গহনার দিকে তাকানো বন্ধ রেখেছে সে। যেন চেনেই না। গহনা বলতে বাধ্য হলো, ” আমি..আমি তো দুলির সাথে এসেছি ভাইয়া। ও বললো, আজ আমাদের মার্কসিট দেবে। সেজন্যেই…!” গহনার মুখে খুব বেশি কথা যোগালো না। সব কেমন যেন এলোমেলো লাগছে। ওরা যে এখানে আসবে এটা কী সাবের জানতো না ? তা কী করে হয় ! ” গহনা দুলির দিকে তাকালো। সে তার মুখে তালা মেরে বসে আছে কেন বুঝে এলো না গহনার।

এবারও আমান নামের লোকটাই নিরবতা ভাঙলেনন। প্রশ্নটা সরাসরি গহনাকেই করলেন।
” কিসের মার্কসিটের কথা বলছেন ? ”

” জি, আমাদের ডিগ্রীর কোর্স পরীক্ষার মার্কসিট স্যার।” সসম্ভ্রমে বললো গহনা।

” ওটা তো এখনও দেরি আছে। আপনি কোন ব্যাচ। বসুন। ” গহনাকে ভালো করে একনজর দেখে সাবেরের পাশের চেয়ারটা নির্দেশ করলেন আমান মিকদাদ। গহনা সেদিকে তাকিয়ে কিছুটা ইতস্তত করলো। বসবে কিনা ভাবছে। আমান পুনরায় ইশারা করলে বসতে বাধ্য হলো গহনা।

” দুলিদের ব্যাচ স্যার।” সপ্রতিভ কণ্ঠে বলার চেষ্টা করলো। সরাসরি মার্কসিটের আলোচনা আসায় গহনা কিছুটা সাহস ফিরে পেলো এবার। তবে ভদ্রলোকের পরের কথায় পুরোপুরি মিইয়ে গেলো সে। লেখা বন্ধ করে প্রশ্ন করলেন তিনি।

” এটা কী ধরণের উত্তর ? দুলিদের ব্যাচ বলে কোন ব্যাচ গোটা বাংলাদেশে আছে বলে তো আমার জানা নাই। ভদ্রলোক কৌতুহলী চোখে চেয়ে আছেন ওর দিকে।:

আমান মিকদাদের কথায় হেসে মুখে টিস্যু চাপলো দুলি। গহনা সেদিকে তাকিয়ে নার্ভাস ভঙ্গিতে বললো,” ইয়ে, মানে টু থাউজেন্ড টু ওয়ানের ব্যাচ।”

” সেটা বলুন। কিন্তু ওটার মার্কসিট তো এখন পাবেন বলে মনে হয় না। ওটা আরো পরে আসবে। আর যখন ওটা আসবে তখন সোজা কলেজগুলোতে চলে যাবে। আপনাদেরকে এখানে আসতে হবে না। এখানে আসার বুদ্ধি আপনাকে কে দিয়েছে ? ”

গহনার বিস্ময় ততক্ষণে হতাশায় রূপ নিয়েছে। সে দুলির দিকে তাকালো কয়েকবার। কিন্তু দুলি যেন এ জগতেই নেই। নাকের দুপাশে টিস্যু চেপে ধরাই এখন ওর একমাত্র কাজ।

” তুমি এক কাজ করো, বোকামি করে যখন এসেই পড়েছো। আর বসে থেকে কাজ নেই। বেলা থাকতে থাকতেই বেরিয়ে পড়ো। এখান থেকে সোজা বাস ধরে শাহবাগ চলে যাও। এটাই সবচে ভালো হবে। শাহবাগ নেমে রিক্সা নিয়ে নেবে।” সাবের মাঝখান থেকে বলে উঠলো এবার। গহনা সবে বলতেই যাচ্ছিলো সে একা বাসে চলে অভ্যস্ত নয়। তার মিথ্যুক বোনের চাপাচাপিতেই সে এখানে এসেছে কারণ দুলি তাকে আগাগোড়া মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে টোপ ফেলে এখানে নিয়ে এসেছে। কাজটা সে কেন করেছে জানেনা গহনা। নইলে এই ভরদুপুরে একরাশ ধুলো উড়িয়ে দুঘন্টার জার্ণি করার কোন খায়েশ তার ছিল না। কিন্তু কিছুই বলা হলো না। নিজেকে বোকা হতে দেখে কণ্ঠস্বর আপনা হতেই চেপে এলো ওর। শুনতে পেলো, ” নাম কী আপনার ? ”

বলতে বলতেই টেবিলের উপর পড়ে থাকা ফাইলটা খুলে তাতে চোখ রাখলেন আমান। গহনা সেদিকে তাকিয়ে নির্জিবপ্রায় কণ্ঠে বললো, ” গহনা।”

আমানের চোখগুলো ফাইলে ঝুঁকে ছিলো। সেখান থেকেই ছুটে এসে গহনাকে বিদ্ধ করলো, ” নাম জিজ্ঞেস করলে পুরো নাম বলাটাই নিয়ম। গহনা কোন নাম হলো না। হয় গহনা খাতুন, নয় বেগম, নয়তো সুলতানা নাকি গহনাগাটি…কোনটা.?”

-” গহনা হাসান। ” অপমানে লাল হলো গহনার মুখ। তবে বেচারী কালো বলেই ওর লালচে ভাবটা চেহারার কালচে ভাবটাকে প্রকট করে তুললো। গহনা মুখ নামালো।

সাবের কিছু বলতে চাইলে হাত তুলে ওকে থামালেন আমান, ” বাড়ি কোথায় আপনার?”
গহনা বোকার মতো দুলি আর সাবেরের দিকে তাকালো। দুজনের চেহারার আলো এবার নিভতে শুরু করেছে। দুলিকে এতোক্ষণে দেখা গেলো সক্রিয় হতে দেখা গেলো। বেশ নড়েচড়ে উঠে ববলতে শুরু করেছিলো, ” ওর বাড়ি হচ্ছে…!”

” উঁহু, প্রশ্নটা তাকে করা হয়েছে। জবাবটা তাকেই দিতে দিন। আমি জানতে চাই এ যুগের মেয়েরা কতোটা বোকা হলে কোন যাচাই বাছাই ছাড়াই এতোদুর চলে আসে।” কথা শেষ করে ফাইলটা বন্ধ করলেন আমান।

” ঝিগাতলা।” মৃদুস্বরে উত্তর দিলো গহনা। আমান মাথা নেড়ে ফাইলটা ছোট্ট ঢিল দিয়ে একপাশে ছুঁড়ে ফেলে বেল বাজালেন। পিয়ন ঢুকলে তাকে সফট ড্রিঙ্কস আনতে বলে দুলির দিকে তাকালেন।
” কতদিনের বন্ধুত্ব আপনাদের ? ”

” স্কুল জীবন থেকে।”

” তাহলে তো খুব বন্ধুত্ব। ” আমান হাসলেন। গহনা জবাব দিলো না। সাবের হে হে করে হেসে বলতে লাগলো, ” আরে খুব বন্ধুত্ব মানে খুব বন্ধু। গহনার আধাবেলা কাটে আমাদের বাড়িতে। ”

-” হম, সেকারনেই ও চোখ কান বন্ধ করে ওকে বিশ্বাস করেছে। আচ্ছা, আপনাকে কে বলেছে আজ মার্কসিট পাবেন ? ” এবারের প্রশ্নটা দুলিকে করলেন আমান।

দুলি এবার ঘামতে লাগলো। সাবেরও নিরব। ওরা হয়তো ভাবতেই পারেনি ঘটনা এভাবে প্যাঁচ খেয়ে যাবে। কী করা যায় ভাবতে লাগলো দুলি। (চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here