’আকাশে অনেক তারা – ৪

—–
আজ দিবাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। বসন্ত গেছে আজ অনেকদিন। অথচ দিবার গোলগাল পুতুলের মত মুখটা বসন্তের প্রকৃতির মতোই রঙিন, সতেজ আর উপভোগ্য এখনো। সাদা জমিনে ফুলের নকশা করা লাল পাড় তাঁতের শাড়ি, কৃষ্ণবর্ণ কেশ ধানখেতের আলের মতো সরু পথ করে দু’ভাগ হয়ে মাথার দু’পাশ হয়ে ঘাড় গলিয়ে কটিদেশ স্পর্শ করেছে সগর্বে। সেই সরু আলপথে লেপ্টে থাকা গাঢ় লাল রঙ বসন্তের কৃষ্ণচূড়ার রঙকে-ও যেন হার মানিয়েছে। মুহিবের তো তাই মনে হচ্ছে। সে দিবার দিকে হাসিমুখে নির্নিমেখ চেয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। দিবার চাহনি অবিন্যস্ত।
বেশ চঞ্চল। সে মুহিব, লেখা কারো চাহনিতে নিজের চাহনি মেলানোর অভিপ্রায় খুঁজে পাচ্ছে না। সঙ্কোচ বোধ করছে খুব। মুহিবের দৃষ্টি যতটাই কোমল লেখার দৃষ্টি ঠিক ততটাই কঠিন। চোয়াল শক্ত করে সে দিবার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তিনজনের মাঝে বিরাজমান অবিচ্ছিন্ন নিরবতা।

”কি দিনরাত্রি বিয়ে করে ফেললে দাওয়াত-টাওয়াতও দিলে না? আমাকে না দিলে টুকিকে অন্তত ডাকতে পারতে তোমার বিয়েতে!”

মুহিবের স্বরে চিরায়ত রসিকতা। মুখভঙ্গিতে-ও খুব বেশি ফারাক নেই। লেখা তাকাল মুহিবের দিকে। তার মুখ কিঞ্চিৎ হা হয়ে রয়েছে। মুহিব লেখার হাত ধরে টান দিতে তার সম্বিত ফিরে আসে।

”টুকি চুপ করে আছিস কেন? কিছু বল। তোর বেস্ট বেস্ট ফ্রেন্ড বিয়ে করে বসে আছে অথচ তুই কিছু জানিস না! দিস ইজ নট ফেয়ার টুকি!”

দিবা ঠোঁট কামড়ে ধরে লেখার দিকে তাকাচ্ছে চিন্তিত মুখভঙ্গি নিয়ে। তার কপালে ভাঁজ পড়ছে উদ্বীগ্নতায়। মুহিব তীর্যকচোখে তাকায়। দিবার কপালের মাঝ বরাবর রক্তিম থালার মত প্রস্ফুটিত লাল টিপটা চামড়ার ভাঁজের আঁড়ালে লুকোচুরি খেলছে। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে দিবাকে। মুহিব ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। সঙ্গে তার বক্ষদেশ উত্তলিত হয়ে মূহুর্তে সংকীর্ণ হল। লেখার কথা কর্ণকূহরে প্রতিধ্বনিত হল,

”কি করে করলি তুই এটা দিবা?”

দিবা যেন লেখার কথা বলার প্রতীক্ষায় ক্ষণ গুনছিল।
সে ঝাপিয়ে পড়ে জবাব দিল,

”তোকে আমি ইঙ্গিত করেছিলাম এমন কিছু হতে পারে। কিন্তু, এতদ্রুত ঘটে যাবে বুঝতে পারিনি। আমি নিজেই প্রতিক্রিয়া করার কোনো সুযোগ পাইনি। জাস্ট যা হয়েছে সেটা পালন করে গেছি।”

তীক্ষ্ণ চাহনি নিক্ষেপ করল দিবার দিকে লেখা। মুখটা কাচুমাচু করছে দিবা। মুহিব বুঝল পরিস্থিতি বেগতিক দিকে যাচ্ছে। দিবার চোখে পানি টলমল করতে শুরু করেছে ইতোমধ্যে। যেকোনো সময়ে ঝড়ে পড়বে। মুহিব বলে বসল,

”দিনরাত্রি কে সেই দুর্ভাগ্যবান যার ঘাড়ে তুমি ঝুলে গেলে!”

কথাটা দিবার ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি ফোঁটাল। চোখে পানি ঠোঁটে হাসি। রমণীর মুখশ্রীতে এই দৃশ্য ভীষণ ভীষণ সুন্দর। দিবার মুখে হাসি দেখে লেখার রাগটা বেড়ে গেল বেশ। সে দাঁত কিড়মিড় করে অন্য দিকে চলে যেতে নিলে দিবা দৌঁড়ে গিয়ে ঝাঁপটে ধরে লেখাকে। লেখা ছাড়ানোর জন্য ধস্তাধস্তি করেও না পেরে হাল ছেড়ে দিয়ে নিঃশব্দে প্রতিক্রিয়া না করে দাঁড়িয়ে থাকে। এবার জলোচ্ছ্বাস সত্যিই দিবার চোখ বেয়ে নেমে আসে। সবকিছু ছাপিয়ে লেখার শুধুই মনে হচ্ছে দিবার জীবনে তার কোনো গুরুত্ব নেই। নয়তো, একসপ্তাহের ব্যবধানে মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেল অথচ সে জানতে পর্যন্ত পারল না। কেন? এতটুকু অধিকার কি তার ছিল না? দু’জন দু’জনের বিয়েতে উপস্থিত থাকবে। একজন উপস্থিত না থাকলে অন্যজন বিয়ে করবে না। এমনই তো কথা ছিল। তবে, আজ কেন দিবা তাকে না জানিয়ে বিয়ে করে নিল! অভিমান তার হৃদাকাশে ছেয়ে গেল হুরহুর করে। তার চোখেও তীব্র অভিমানে পানি জমেছে। দুই বান্ধুবিই কাঁদছে। মুহিব ছাড়াও আশেপাশে অনেক দর্শক রয়েছে। অনেকেই লেখা-দিবা জুটির পাগলামির সঙ্গে পরিচিত। বেশি আমলে নিচ্ছে না তারা। মুহিব এগিয়ে গিয়ে লেখার মাথায় টোকা দিল। ব্যথা পেয়ে চোখমুখ কুঁচকে লেখা মুখ ঘুরিয়ে মুহিবের দিকে তাকায়। মুহিব হাসিহাসি মুখ করে বলে,

”ঢাকা শহরে এমনিই জলাবদ্ধতার সমস্যা। দু’জনে মিলে দয়া করে বণ্যা আনিস না এখানে! বুড়িগঙ্গার ময়লা পানিতে সাঁতার কাটতে আমি চাই না।”

দিবা মুচকি হাসল। লেখা দিবাকে ছেড়ে দিয়ে মুহিবের দিকে তেড়ে যায়। দু’টো পরে মুহিবের পিঠে। মুহিব কিছু বলে না। হাসে। আজ শুধু তার হাসতে ইচ্ছে করছে।
_______________________________

ক্লাস শেষ হতে দিবাকে নিতে তার স্বামী এসেছে। সুভাস রয়। নামটার মত ব্যক্তিটিও ভীষণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। দিবার সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছিল বেশ কয়েকবছর ধরেই। তিনি উচ্চশিক্ষা অর্জনে বিদেশ পাড়ি জমাবেন কিছুদিনের মধ্যে। সেজন্যই হুটহাট করে বিয়েটা হয়ে গেল দু’জনের। তেমন করে কাউকে জানানোর সুযোগ হয়নি। বিয়ের পরই দিবা জানিয়েছে তার জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ রয়েছে। তার বন্ধু, বোন লেখা। মুহিবের কথাও জানিয়েছে সে সুভাসকে। সুভাস নিজে থেকে দু’জনের সঙ্গে দেখা করার স্পৃহা পোষন করেছে। বিয়েতে দু’জনকে দাওয়াত দিতে পারেনি বিধায় দুপুরে বেশ দামি রেস্তোরাঁয় চারজনে মিলে ভোজন শেষ করেছে। বিলটা সুভাসই দিল। মুহিব দিতে চেয়েছিল। সুভাস রাজি হয়নি। লেখার মনে ধরেছে লোকটাকে। আচরন, কথাবার্তা মার্জিত। বেশ ভালো মনে হচ্ছে। দিবা ভালো থাকবে। দিবা ভালো থাকলেই তার আর কোনো অভিযোগ থাকবে না। সুভাস রয়ের পরিচিত একজনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল রেস্তোরাঁ থেকে বেরনোর সময়। ভার্সিটি জীবনের বন্ধু দু’জনে। দিবাকে পরিচয় করিয়ে দিল সুভাস বন্ধুর সঙ্গে। কুশল বিনিময় করে দু’একটা হাসিঠাট্টা করে দু’জনে কথা বলতে বলতে একটু সামনে এগিয়ে গেছে। পেছনে মুহিব, লেখা আর দিবা হাঁটছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। রাস্তায় নেমে বন্ধুকে বিদায় দিয়ে সিএনজি ঠিক করে দিবাকে হাতের ইশারায় ডাকল সুভাস। দিবা নিজেও ইশারায় বোঝায় আসছি।

”দিনরাত্রি!”

মুহিবের ডাক শুনে দিবার কদম স্থির হয়ে গেল। সে ধীরে পেছনে ঘুরল। লেখা তার পাশে। সে ঘুরলো না পিছনে। শুধু সন্তর্পণে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে গেল। মুহিব ঠোঁটে প্রশ্বস্ত হাসি ফুঁটিয়ে বলল,

”ভালো থেক দিনরাত্রি!”

দিবা কয়েক সেকেন্ড কোনো প্রতিক্রিয়া করে না। পরে মুচকি হাসে। মাথা দোলায় হ্যাঁ সূচক। দিবার পাশেই লেখা। দু’জনে থেমে থাকায় মাঝের সময়টুকুতে সুভাস এগিয়ে এসেছে তাদের দিকে। লেখা আর মুহিবের থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল সুভাস আর দিবা।

মুহিব লেখা কোনো কথা বলল না। লেখাকে নিয়ে মুহিব রাস্তার পাশে টং দোকানে বসল। দু’টো চা দিতে বলল সে।

”মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোর! এই গরমে কে গরম চা খায়?”

মুহিব নির্বিকারভাবে জবাব দিল,

”তুই, আমি! খাব।”

”হাহ্, মাথা খারাপ? খা তুই ইচ্ছা হলে!”

লেখা অবশেষে খেতে বাধ্য হল। হুঁট করেই কেমন রোদটা পড়ে গিয়ে মেঘ জমেছে আকাশে। সুন্দর হাওয়া বইছে। শীতল একটা ভাব। চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিতে দিতে লেখা জিজ্ঞেস করল,

”আবহাওয়ার খবর দেখেছিলি নাকি?”

”দেখেছিলাম, সকালে।”
________________________________

চা শেষ করে টং দোকানের বেঞ্চিতে কিছুক্ষণ বসে রইল দু’জনে। মুহিব আকাশ দেখছে। লেখা মুহিবকে দেখছে। দিবার ব্যপারটা নিয়ে কোনো কথা হয়নি। হুঁট করে এক সপ্তাহ কোনো যোগাযোগ করেনি। যখন সে সামনে এল তখন বিশাল চমক নিয়ে হাজির হল। সে কি বুঝতে পারেনি মুহিব পছন্দ করে তাকে? মুহিবের তো ধারনা ছিল দিবা তাকে একটু একটু পছন্দ করে। লেখা দ্বিধান্বিত। এই বিষয় নিয়ে মুহিবকে কিছু জিজ্ঞেস করবে কি করবে না ভেবে পাচ্ছে না। মুহিবের মন খারাপ হলে লেখা বুঝতে পারে। এতদিন এমনই ধারনা ছিল তার। অথচ আজ সে বুঝতে পারছে না।
কয়েক ঘন্টায় সব কেমন বদলে গেল! মুহিব লেখার হাত ধরে টান দেওয়ায় তাঁর সম্বিত ফিরে।

”টুকি চল। সন্ধ্যা হতে চলল।”

লেখা ব্যগ ঠিক করে উঠে দাঁড়ায়। ততক্ষণে, মুহিব কিছুটা পথ এগিয়ে গেছে সামনে। লেখা মুহিবের পিছু পা বাড়ালে পেছন থেকে হাঁক শোনে,

”মামা, দামটা দিয়া যান!”

লেখা মুখটা বটে মুহিবের পেছন দৃশ্যের দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকায়। পাজিটা দাম দেয়নি। অগত্যা ব্যগ থেকে টাকা বের করে দিয়ে সে মুহিবের দিকে ছোটে। কাছাকাছি যেতেই শুনতে পায় মুহিব গানের মত সুর করে গাইছে,

‘আমার ইচ্ছে ছিল,
থাকুক গোপন।
তাঁর ইচ্ছেতেই,
আমার সুখ অকৃপণ!’

মুখভঙ্গি নরম হয় লেখার। তবে, এমন হলে সে মুহিবের সঙ্গে কিছুতেই স্বাভাবিক আচরন করতে পারবে না। সিমপ্যথি দেখাবে। যেটা মুহিব মেনে নিতে পারবে না। দূরত্ব বাড়বে দু’জনের মাঝে। দুম করে ঘুষি বসিয়ে দিল সে মুহিবের পিঠে। কপাল কুুচকে মুহিব বাম হাতটা পিঠে নিয়ে এল। তার বুঝতে অসুবিধা হয়নি কে মেরেছে তাকে। লেখার দিকে রাগান্বিত চাহনি নিক্ষেপ করে সে। লেখার ভঙ্গি নির্বিকার। সে মুহিবের পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে ভাবলেশহীনভাবে বলে,

”তুই ডিজার্ব করিস। চা খাইয়েছিস, টাকা দিসনি কেন?”

”টাকা নেই আমার কাছে টুকি!”

দিবা চোখ বড় বড় করে মুহিবের দিকে তাকায়। বলে,

”তাহলে, তখন রেস্টুরেন্টে কেন বিল দিতে চাইছিলি?”

”সৌজণ্যতা। আর আমি জানতাম ভদ্রলোক নিজে দেবেন। নতুন বউয়ের সামনে অন্তত নিজের সম্মান খোয়াবেন না।”

”তোর কেমন মনে হয়েছে রে সুভাসদা কে?”

মুহিব ভ্রু বটে। বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলে,

”বাব্বা, সুভাসদা!”

লেখা চিমটি বসিয়ে দিল মুহিবের বাহুতে। মুহিব তাঁর চুল টান দিল সঙ্গে সঙ্গে। বেশ জোরেই দিয়েছে। আর বলল,

”ইদানীং বেশি হাত নাচে তোর টুকি!”

লেখার চোখে পানি জমে গেছে। কোনো কথা বলছে না সে। নিঃশব্দে হাঁটছে। অভিমান হয়েছে। মুহিব খুব বুঝতে পেরেছে। এটাও বুঝল চুলটা খুব জোরে টান দিয়ে ফেলেছে। সে-ও নিঃশব্দে লেখার পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করেছে। কিছুদূরে গিয়ে লেখা রিকশা থামাল। মুহিব রিকশাওয়ালাকে বলে বিদায় করে দিল।

”সমস্যা কি তোর?” চটে গেছে লেখা।

”কোনো সমস্যা না!”

”তাহলে, রিকশাওয়ালা মামাকে চলে যেতে বললি কেন? আমি বাসায় যাব।”

”যাবি! এত তাড়া কিসের!”

”তোকে এখন সহ্য হচ্ছে না আমার!”

মুহিব রাগল না। কথাটা ধরলও না। লেখার স্বর জড়ানো দেখে সে বলল,

”জোরে জোরে নিঃশ্বাস নে।” তার স্বরে চিন্তা।

লেখা তাই করল। লেখার ব্যগ থেকে পানির বোতলটা নিয়ে মুখ খুলে সামনে ধরল। পানি পান করে বোতলটা মুহিবের হাতে দিল সে। হুটহাট শরীর খারাপ হয়ে যায় লেখার। ছোটবেলা থেকেই সে একটু বেশি সেনসিটিভ।
নির্বাক অনেকক্ষণ পাড় হল ভীড়ের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে। রাস্তায় জোড়ার মেলা বসেছে যেন এখন। কপোত-কপোতীর সংখ্যা চোখে পড়ার মতো। মুহিব আর লেখাকে-ও অন্যকারো দৃষ্টিতে ভিন্ন মনে হবে না।

’ভাই গার্লফ্রেণ্ড কি নিয়ে অভিমান করেছে! যা নিয়েই করুক। দ্রুত অভিমান ভাঙ্গান নয়তো ছেড়ে যাবে। পরে পস্তাবেন। যেমন আমি পস্তাচ্ছি।’

মুহিব শব্দের উৎস খোঁজ করল। কবি কবি চেহারার
এলোচুলের একটা ছেলে। ছ্যাকা যে খেয়েছে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। সেকারণেই, মুহিবকে নিজের পরিস্থিতি বিবেচনায় উপদেশ দিল। মুহিব ছেলেটার দিকে চেয়ে মাথা চুলকে স্মিত হাসল। ততক্ষণে লেখা বেশ অনেক পথ এগিয়ে গেছে। দ্রুত দৌঁড়ালো মুহিব। লেখা ফের রিকশা ঠিক করছে। লেখার পাশাপাশি সে রিকশায় উঠে বসল। লেখা বিরক্ত চাহনিতে তার দিকে তাকাল।
জিজ্ঞেস করল,

”কি সমস্যা?”

”বারবার একই প্রশ্ন করছিস আজ টুকি?”

দাঁতে দাঁত ঘর্ষণের শব্দ স্পষ্ট পৌঁছাল মুহিবের কর্ণকূহরে।

”মুহি, প্লিজ নেমে যা। মেজাজ খারাপ। আর করিস না।”

মুহিব মুখটায় বোকাসোকা ভাব আনল। হাড়হাবাতের মত বলল,

”আমি কি করেছি?”

”কিছু করিসনি। আমার ভালো লাগছেনা। নাম রিকশা থেকে।”

”ঠিক আছে নেমে যাব! আগে টাকা দে!”

লেখার মুখভঙ্গি নির্দিষ্ট করে কি ভাব প্রকাশ করছে বোঝা যাচ্ছে না। সে খুব সম্ভবত দ্বিধান্বিত। মুহিব নিচু শব্দে বলল,

”সঙ্গে যা টাকা ছিল সেটা আসার সময় ভাড়া দিয়েছি। আজও ভুলক্রমে টাকা নিয়ে বেরোইনি।”

রিকশা চলতে শুরু করেছে। লেখা ভ্রু উঁচাল,

”ক্যশ আউট করতি!”

”ব্যলেন্স জিরো!”

হাতে শূণ্য বানিয়ে দেখাল মুহিব।

”কেন, টাকা কি করেছিস?”

লেখা বলে নিজেই থেমে গেল। মুহিব কখনোই কার্ড সাথে নিয়ে ঘোরে না। ফোনে সবসময় টাকা থাকে না তার। ভাঙ্গা রাস্তায় আকস্মিক রিকশা ঝাঁকি খেল। অসাবধানতার কারনে লেখা সামনের দিকে ঝুঁকে গিয়ে পড়ে যেতে নিতেই মুহিব দু’হাতে শক্ত করে ধরল তাকে। লেখা কাঁপছে। লেখাকে বাঁচিয়ে তাতেই সে ক্ষান্ত হল না। মুখে রুষ্ট ভাষা ছোড়া শুরু করল রিকশাওয়ালাকে কেন্দ্র করে,

”গা* খেয়ে রিকশা চালাস, সালা! এক্ষুনি যদি ও পড়ে যেত! এই রোডে আজকের পর থেকে কি করে রিকশা চালাস দেখব আমি। কোথায় ব্রেক কষতে হবে সেটাও জানিস না। বা* ফা**** রিকশা চালাস! কিছু জানিস না।”

রিকশা থামিয়ে দিয়েছে। মুহিব লেখাকে ছেড়ে নেমে লোকটার কলার চেপে ধরেছে। আশেপাশের কিছু মানুষ জড়ো হয়েছে। লেখা নিজেও দ্রুত নেমে মুহিবের হাত ধরে আঁটকায়। লোকজন এখন মুহিবকে দুষবে।
কি ঠিক কি ভুল সেটা দেখবে না। লেখার হাত ঝাড়া দিল মুহিব। রেগে উচ্চ গলায় বলল,

”সর। দোষ তোর। কার রিকশায় উঠছিস সেটা দেখবি না? রাগ দেখিয়ে ঢ্যং ঢ্যং করে যার তার রিকশায় উঠে যাবি! এই হারাম** নেশাখোর। তাকায় দেখ এর চোখের দিকে। রিকশায় কয় ট্রিপ মেরে যে টাকা পাবে সে টাকা নিয়ে সারারাত উড়াবে। ফূর্তি করবে। হতে পারে রাস্তায় কোনো যাত্রীকে ধরে সব ছিনতাই করবে সুযোগ বুঝে। এই হা**গুলারে পুলিশ চোখে দেখে না। এখন যদি আমরা স্টুডেন্ট একপেগও গিলতাম সোজা থানায় নিয়ে হাজতে ঢোকাত।”

রাস্তার লোকজন রিকশাওয়ালাকে সহমর্মিতা দেখানোর জন্য এগিয়ে এলেও মুহিবের কথা শুনে গভীর চাহনিতে লোকটাকে পরোখ করল। স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। ঢুলুঢুলু একটা ভাব লোকটার শরীরে।
______________________________

এবারে মুহিব রেগে আছে। আবহাওয়া বেশ বেগতিক। বৃষ্টি নামবে যেকোনো সময়ে। রিকশা নেওয়া দরকার।
বদটা কোনো কথা শুনছে না। লেখার ফোন এসেছে। সে রিসিভ করে কথা বলল। বাবা ফোন দিয়েছে। তিনি আজ বাড়ি ফিরবেন না। রাতে তাকে খেয়ে নিতে বলেছে। লেখা বেশ অবাক হয়েছে। মাসে বেশিরভাগ দিনই তিনি বাড়ি ফিরেন না। কিন্তু, এমন করে ফোন দিয়ে তো আগে কখনো জানিয়ে দেননি। তাকে খেয়ে নিতেও বলেনি। মুহিব তাকায় লেখার মুখের দিকে। তার মুখভঙ্গিতে বিস্ময় দেখে নিজে থেকে জিজ্ঞেস করে,

”কি হয়েছে?”

”বাবা ফোন দিল!”

”তো?”

”বলল, বাড়ি ফিরবে না।”

”বাহ্, ভালোই। তোর বাপ ফোন দিয়ে অন্তত নিজের অনুপস্থিতির কথা জানান দেয়। আর আমার..”

থেমে যায় মুহিব। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। লেখা বলে,

”ধুর, কি বলিস না বলিস। অন্যদিন দেয় না তো। আজ দিল। অবাক হয়েছি আমি। কি হয়েছে বলত?”

”মেইবি তোর বাপও প্রমোশন পেয়ে দেশ ছাড়ছে। সে কারনে আমার মায়ের মত মনে হয়েছে সন্তানকে একটু সময় দেই।”

”উনি যেখানে খুশি যাক। উনি থাকা না থাকায় তেমন কোনো পার্থক্য নেই। শুধু আজকের মত হুঁট করে যেন এমন বিহ্যাভ করে যেন আমাকে অস্বস্তিতে না ফেলে দেয়।”

”বেশি ভাবিস না।”

মুহিব রিকশা থামিয়েছে হাত নাড়িয়ে। দু’জনেই উঠে পড়ল।
_________________________________

দু’জনে কাক ভেজা হয়ে ফ্ল্যটে ফিরেছে। মাঝরাস্তায় বৃষ্টি নেমেছিল আকাশ ভেঙে। লেখা একটা ধোঁয়া ওঠা গ্রিন টির কাপ মুহিবের হাতে ধরিয়ে দিল। তার নিজের হাতেও একটা। চা খেতে খেতে সে জিজ্ঞেস করল,

”কি খাবি রাতে?”

”রান্না করে যায়নি বুয়া?” মুহিব জিজ্ঞেস করে।

”কালকের সব। আজ করেনি।”

”নুডলস কর। বেশিকিছু লাগবে না। দুপুরে তো রিচ ফুড খেলাম।”

লেখা মাথা নাড়িয়ে কিচেনের দিকে চলে গেল। মুহিব রিমোর্টটা হাতে নিয়ে আয়েশ করে সোফায় হেলান দিয়ে শুয়ে টিভি অন করল।
__________________________________

লেখা নুডলস করছে। সঙ্গে একটা ডেসার্ট আইটেমও করছে সে। মুহিব কিছুদূরে পেছনে দাঁড়িয়ে দেখছে তাকে। টিভি দেখতে ভালো লাগছিল না। তাই সে কিচেনে এসেছে। ছোট্ট মেয়েটা কত বড় হয়ে গেছে। লেখা মুহিবকে খেয়াল করল।

”কিছু লাগবে তোর?”

”হোস্ট হোস্ট বিহ্যভ করছিস টুকি। আর মনে হচ্ছে যেন আমি কোনোদিন আসিনি এই বাসায়! এই প্রথম এসেছি।”

লেখা হাসল। জবাব দিল না। মুহিব আকস্মিক বলে উঠল,

”তুই-ও কি বিয়ে করে নিবি একদিন টুকি?”

স্থির হয়ে গেল কয়েক মূহুর্তের জন্য লেখা। পিছু ঘুরে মুহিবের দিকে একপলক তাকিয়ে মুচকি হেসে জবাব দিল,

”করব না? ভালো পাত্র পেলে অবশ্যই করব।”

”সত্যিই আমাকে ছেড়ে চলে যাবি তুই টুকি?”

”তুই চাসনা আমি যাই? রেখে দিবি?”

’যদি সম্ভব হয় তো রেখে দেব টুকি! তোর শরীরে মা মা একটা গন্ধ রয়েছে!’

মুহিব বিরবির করল শেষের কথাগুলো। লেখার কান অবধি পৌঁছায়নি গভীর অর্থযুক্ত শব্দসমূহ।
___________________________________

®সামিয়া বিনতে আলম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here