আকাশে অনেক তারা – ১০

———-
নিজের ঘরে পায়চারি করছে লেখা। আর ঘাড় ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখছে। জুবায়ের সেই সকালে বেরিয়েছিল আর এখন তিনটা বাজে। এখনো ফেরেনি। জনাব আশরাফ মেয়ে জামাইকে নিজের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছেন। সেই নিমন্ত্রণ রক্ষার্থেই লেখা আর জুবায়ের সকালে মোহাম্মদপুর এসেছিল। আশরাফ সাহেবের প্রতি জুবায়েরের ব্যবহার দেখে ভীষণ অবাক হয়েছে লেখা। দু’জনের সংখ্যতা দেখে মনে হয়েছে যেন কতকালের চেনা যেন। বেলা এগারোটার দিকে জুবায়ের জরুরি কাজ চলে এসেছে বলে বেরিয়ে যায়। সকাল থেকে নাস্তাও করেনি। কে জানে খেয়েছে কি-না? নাকি এখনো অবধি না খেয়েই রয়েছে? দু’জনের বিয়ের তেরদিনে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক তৈরি হয়নি ঠিকই তবে বন্ধুত্বের সম্পর্কটা বেশ পাকাপোক্তভাবেই হয়েছে।
কলিং বেল বাজছে। লেখা চুপসানো মুখটায় সজীবতার ছাপ ভেসে উঠল। দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে এসে মূল দরজা খুলে খুব চমকাল সে। কয়েক মূহুর্ত চোখের পাতা নড়ল না তাঁর। স্থির হয়েই দাঁড়িয়ে রইল।

”কিরে ভেতরে আসতে দিবি না?”

মুহিবের কথায় কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠে দরজা থেকে সরে দাঁড়াল লেখা। মুখে কেন জানি কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে পারছে না। ভেতরে যেতে যেতে মুহিব বলল,

”আমাকে দেখে খুশি হসনি?”

একটু বিদ্রুপ মেশানো তাঁর কণ্ঠে। লেখা ভেবেছিল জুবায়ের এসেছে। মুহিবকে দেখে চমকে গেছে। তবে, খুশি হয়েছে কি হয়নি সেটা এখনো বুঝতে পারছে না সে নিজেই। সে মুখে হাসি ফুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করল,

”কেমন আছিস?”

মুহিব ড্রয়িংরুমে সোফায় বসতে বসতে বলল,

”এইত ভালোই, তোর খবর বল!”

লেখার অস্বস্তি লাগছে। দু’জনের আচরণই কেমন ফরমাল। সে মুহিবের মুখোমুখি সোফায় বসল। আগে হলে সে যেমনতেমনভাবে মুহিবের পাশাপাশি সোফায় বসে যেত। আজ জড়তা কাজ করছে। তাঁর বসার ধরনও আজ বেশ গোছানো। সে জবাব দিল,

”আলহামদুলিল্লাহ!”

মুহিব চট করে নোয়ানো মাথাটা তুলে অদ্ভুতভাবে লেখার দিকে তাকিয়ে রইল। বিচ্ছিরি নিরবতায় বেশ অনেক্ক্ষণ অতিবাহিত হল। কি বলবে দু’জনের কেউ আকস্মিক খুঁজে পেল না। মুহিব লেখার পরিস্থিতি বুঝে নিজেই কথা বলল প্রথমে।

”তোঁর হাবি কোথায়?”

লেখার মুখভঙ্গি পরিবর্তন হল কিঞ্চিৎ। জড়তা যেন আরোবেশি পরিসরে বেড়ে গেল। লেখার জবাব না পেয়ে মুহিব জিজ্ঞেস করল,

”আসেনি? আঙ্কেল তো বলেছিল তোরা দু’জনেই আসবি।”

লেখার চাহনিতে বিস্ময় প্রকাশ পেল। সে বিস্মিত গলায় জিজ্ঞেস করল,

”বাবা বলেছে?”

মুহিব মাথা নাড়ল। ফের নিরবতা। মুহিবের ভালো লাগছে না ব্যপারটা। এটাই হয়ত লেখার সাথে তাঁর শেষ সাক্ষাৎ। এমন নির্জীব স্মৃতি নিয়ে সে ফিরে যেতে চায় না। সোফায় হাত-পা ছড়িয়ে দিয়ে আকস্মিক শুয়ে পড়ে মুখটা বিকৃত করে লেখার দিকে চেয়ে সে বলে উঠল,

”কতক্ষণ হল এসেছি টুকি! জিজ্ঞেস করেছিস আমি কিছৃু খাব কিনা! কবে থেকে ম্যানার-ট্যানার সব ভুলে গেলি তুই?”

লেখা চমকে উঠল। মুহিব স্বাভাবিক আচরণ করছে।
সেই আগের মত। সে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বসা থেকে উঠতে উঠতে জিজ্ঞেস করল,

”কি খাবি?”

মুহিব চিরায়ত পরিচিত ভঙ্গিতে জবাব দিল,

”সকাল থেকে কিছু খাইনি টুকি। হেভি কিছু খাব।”

”রান্না-বান্না সব আছে দুপুরের জন্য। ডাইনিংয়ে আয়।”

”এখানে নিয়ে আয় না।”

”আনা যাবে না। অনেক খাবার।”

অগত্যা মুহিব লেখার পিছু পিছু যায়। মুহিবের মুখটা সত্যিই শুকনা লাগছে। বোঝাই যাচ্ছে সে খায়নি। খাবার দিতে দিতে লেখা মুহিবকে বলে,

”নিজের যত্ম কবে নিতে শিখবি তুই!”

মুহিব খেতে খেতে জবাব দিল,

”শিখে কি করব? এতদিন তুই ছিলি। এরপরে মা থাকবে। শেষে বউ নেবে।”

লেখা থমকাল। জিজ্ঞেস করল,

”আন্টি?”

মুহিব প্লেট থেকে মুখ তুলে লেখার দিকে তাকিয়ে সব দাঁত বের করে হাসি দিয়ে জানাল,

”আমি জার্মানি যাচ্ছি। ওখানে মায়ের সঙ্গেই থাকব। মা নিজের পূর্ববর্তী কাজে অনুতপ্ত।”

”জার্মানি যাচ্ছিস? বলিসনি তো?”

”এখন আর কি সবকথা আমরা বলি সবাইকে!”

লেখা চুপসে গেল। মুহিবের কথার ধরনটা সে ঠিকই ধরতে পেরেছে। মুহিব সন্তর্পণে একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে গেল। তাঁর জার্মানি যাওয়ার খবর শুনে লেখার থেকে যেমন প্রতিক্রিয়া আসা করেছিল আশানুরূপ হয়নি কিছুই। অবশেষে, মুহিব পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলল,

”তোঁর জামাই কই? দেখলি ভুলেই গেছি আমি ওনার কথা! বললি না তো উনি এসেছে নাকি আসেনি?”

”এসেছে। একটু কাজে বাহিরে গেছে।”

মুহিব মাথা নাড়ল। বলল,

”খেয়েছিস তুই?”

”না!”

”তাহলে, বসে যা! প্লেট নে।”

লেখার অবস্থানে কোনো নড়চড় না দেখে ভ্রু কুঁচকাল মুহিব।

”কিরে খাবি না?”

লেখা মুহিবের তীক্ষ্ম দৃষ্টির সামনে উশখুশ করে জবাব দিল,

”পরে খাব!”

কপট হেসে মাথাটা নামিয়ে নিল মুহিব। বলল,

”উনি এলে একসঙ্গে খাবি! অপেক্ষা করছিস!”

”সেরকম কিছু না। আসলে, প্রথমবার আমাদের বাড়িতে এসেছেন। একা খাবেন। ব্যপারটা ভালো দেখাবে না। সেজন্যই।”

”আঙ্কেল কোথায়? অফিসে?”

”নাহ্, বাসায়!”

”নিজের ঘরে?”

”হুঁ, ঘুমাচ্ছে।”

”দিবার সঙ্গে কথা হয়েছে? জানিয়েছিস বিয়ে করে নিয়েছিস যে?”

এক মূহুর্ত চুপ থাকল লেখা। পরক্ষণে জবাব দিল,

”কথা হয়নি।”

মুহিব কিছু বলল না। নিঃশব্দে খেতে লাগল। লেখাও বলার মত কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছে না আজ। অথচ আগে তাঁদের কথার ভাণ্ডার ফুরাতই না।

________________________________

ঘড়িতে চারটা বেজে গেছে। মুহিবের জরুরি কাজ পড়ে যাওয়ায় তাঁকে যেতে হচ্ছে। তাঁর ইচ্ছে ছিল লেখার স্বামীর সঙ্গে দেখা করেই যাবে। জার্মানি যাওয়া নিয়ে প্রচুর ব্যস্ততা যাচ্ছে তাঁর আজকাল।
লেখার দিকে তাকাল সে মায়া নিয়ে। মেয়েটা তাঁর জীবনে কি একমাত্র সে-ই জানে। এই মেয়েটার জায়গা কোনোদিন কেউ নিতে পারবে না। কোনোদিন পারবে না। দরজাটা খুলেও বেরিয়ে না গিয়ে সে উল্টো ঘুরে লেখাকে জড়িয়ে ধরল। হয়ত এটাই শেষ সাক্ষাৎ।
আর কখনো দেখা হবে কিনা সে জানে না। একবার দেশ ছাড়ার পরে দেশে আসার ইচ্ছা নেই তাঁর। কেন ফিরবে? কিসের টানে? সব শেষ করে দিয়ে যাচ্ছে তো আজ সে। স্মৃতিগুলোই সম্বল বাকি জীবনের নির্বাহে।
লেখা অবাক হয়েছে মুহিবের এ কাজে। সে তাঁর পিঠে হাত রাখল সন্তর্পণে। অন্যরকম ঠেকছে মুহিবকে তাঁর কাছে আজ।

”কি হয়েছে মুহিব?”

তৎক্ষনাৎ জবাব দিতে পারল না মুহিব। কথা বলতে গিয়ে দেখল কণ্ঠনালি ধরে আসে। ভারি ভারি ঠেকছে।
পরপর বেশ কয়েকটা চুমু খেল সে লেখার চুলে। হাতও বুলিয়ে দিল মাথায়। ভেজা কণ্ঠে বলল,

”তোকে আমি কোনোদিনও ভুলব না টুকি!”

কেমন কষ্ট কষ্ট লাগছে লেখার। মুহিব এমন করে কেন বলছে!

”এভাবে কেন বলছিস? তুই জার্মানি যাবি তো কি হয়েছে। আমাদের যোগাযোগ তো হবেই। আর ছুটি পেলেই দেশে আসবি।”

মুহিব নিঃশব্দে ঢোক গিলল। কিছু বলল না। লেখাকে দু’হাতে একটু দৃঢ়ভাবে আলিঙ্গন করল। খুকখুক কাশির শব্দে লেখা শব্দের উৎসের দিকে তাকাল। জুবায়ের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। সে তৎক্ষণাৎ হাত দিয়ে ঠেলে মুহিবকে নিজের থেকে আলাদা করে দিল।
মুহিব বিস্মিত হলেও নিজের পেছনে ঘুরতেই পুরুষ ব্যক্তিত্বটির অস্তিত্ব দেখেই কারনটা বুঝতে পারল। কয়েক মূহুর্ত পরিস্থিতি কেমন গুমোট অতিবাহিত হল।
মুহিব হেসে নিজের হাত বাড়িয়ে দিল জুবায়েরের দিকে,

”আমি মুহিব! লেখার বন্ধু! আপনি নিশ্চয়ই লেখার স্বামী যিনি কিনা এই মেয়েটাকে বিয়ের দুর্ভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে এসেছেন?”

জুবায়ের লেখার দিকে তাকাল। লেখা বিব্রত হয়ে চিরায়ত স্বভাবের বশবর্তী হয়ে মুহিবের বাহুতে দুটো ঘুষি বসিয়ে দিল। মুহিব মুখটা ব্যথাতুর করে তাঁর দিকে তাকাতে সে চোখ রাঙ্গাল। জুবায়েরকে লেখা মুহিব সম্পর্কে জানিয়েছে। সে ভাবেনি এখানে এসে দেখা হয়ে যাবে। লেখার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে সে মুহিবের এখনো বাড়িয়ে রাখা হাতে হাত মিলিয়ে মুচকি হেসে বলল,

”আমি জুবায়ের প্রধানীয়া। জুলেখার স্বামী!”

পাঁচ মিনিট মত কথপোকথন চলল জুবায়ের আর মুহিবের মাঝে। সত্যিই খুব তাড়া রয়েছে মুহিবের। সে বিদায় নিতে নিতে বলল,

”নিজের যত্ম নিস টুকি!”

জুবায়েরকে উদ্দেশ্য করেও বলল,

”টুকি কিন্তু খুব আনাড়ি। দেখেশুনে রাখবেন। টুকির ভালো থাকা এখন আপনার উপর ন্যস্ত। আশা করছি আপনি ভালো রাখবেন আমার টুকিকে।”

জুবায়ের মাথা নাড়ল। মুখে কিছু বলল না। মুহিব বেড়িয়ে যেতেই জুবায়ের সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
লেখা তাঁর দিকে খরশাণ চাহনিতে চেয়ে বলল,

”এত দেরি হল যে আপনার আসতে?”

”কাজ শেষ হতে দেরি হয়েছে তাই।”

”কি কাজ ছিল?”

”জুলেখা ক্লান্ত লাগছে। আমার ফ্রেশ হওয়া দরকার।”

জুবায়েরের কথা শুনে লেখা কথা বাড়াল না। নিজের ঘরের দিকে নিয়ে গেল তাঁকে।
__________________________________

নৈশভোজে জনাব আশরাফ উপস্থিত আছেন। টুকটাক কথা হচ্ছে জুবায়ের আর ওনার মাঝে। লেখা নিরব শ্রোতা। এক পর্যায়ে আশরাফ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,

”মেয়েদের পড়াশোনা নিয়ে তোমার কি মতামত আব্বু?”

আশরাফ সাহেব জুবায়েরকে আব্বু সম্বোধন করেন। প্রথম প্রথম ব্যপারটা কেমন অদ্ভুত লেগেছিল লেখার কাছে। এখন সয়ে গেছে। লেখা কান খাড়া করল। সে শুনতে চায় জুবায়ের কি জবাব দেবে। কিছুদিন পর থেকেই তাঁর চতুর্থ বর্ষের পাঠ কার্যক্রম শুরু হবে। সে পড়াশোনা শেষ করতে চায়। ভেবেছিল নিজেই জুবায়েরের সঙ্গে কথা বলবে দু-একদিনে এ বিষয়ে। আজ তাঁর বাবাই তুলল কথা। সে শুনতে পেল জুবায়ের বলছে,

”মেয়েদের পড়াশোনা করাটা দরকার বাবা! বর্তমান পরিস্থিতি সাপেক্ষে আমি মনে করি আরোবেশি করে দরকার। শালীনতা বজায় রেখে তাঁরা যদি নিজেদের শিক্ষিত করতে পারে তাহলে সেখানে আমি কোনো সমস্যা দেখি না। আপনি তো জানেন নিশ্চয়ই, আমার বড় বোন একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়। নিজের হায়া বজায় রেখেই সে শিক্ষকতা করে। মেজ বোন তো মাস্টার্স শেষ করেছে। ছোট বোনও পড়াশোনা করছে।”

”তাহলে, লেখার পড়াশোনা নিয়ে তোমার কোনো বাঁধা নিষেধ থাকবে না নিশ্চয়ই?”

জুবায়ের লেখার দিকে তাকাল একনজর। লেখা মাথা নিচু করে শুনছে। সে চাহনি শশুরের দিকে স্থাপন করে জবাব দিল,

”উনি চাইলে আমি কখনোই নিষেধ করব না। তবে, শালীনতা বজায় রেখে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। কোনো উশৃঙ্খলতা, অবব্যতা আমি মেনে নেব না। পরকালে আমি নিজেকে দাইয়্যুস গনভুক্ত হিসেবে দেখতে চাইনা।”

লেখার মুডটা উৎফুল্ল হয়ে গেছে। যেটা মুহিব যাওয়ার পরে নেতিয়ে পড়েছিল। যাক, পড়াশোনাটা বন্ধ হবে না তাহলে।
______________________________

”জুবায়ের!”

”জ্বি, বাবা!”

”কাল থেকে জুলেখা মায়ের ক্লাস শুরু। জানোতো?”

মোতালেব সাহেবের কথায় সে মাথা নেড়ে জবাব দিল,

”জানি!”

”তাঁকে সহিহ সালামতে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব তোমার!”

”হুঁ!”

”জুলেখা!”

”জ্বি, বাবা!”

”জুবায়ের যদি কোনো সমস্যা করে তুমি আমাকে বলবে! তাঁর পিঠের ছাল তুলে ফেলব আমি! আর শোনো, নিজেকে হেফাজতে রাখার দায়িত্ব তোমার নিজেরও কিন্তু!”

লেখা মাথা নাড়ল। তাঁর চোখের কোণে পানি। এই মানুষগুলো এত ভালো কেন? প্রতিদিন নিয়ম করে তাঁর ভালো খারাপের খোঁজ-খবর রাখেন মোতালেব সাহেব। সে ভেবেছিল তাঁর শাশুড়ি জল্লাদ হবে। কিন্তু, না। তিনি সত্যিই মাটির মানুষ। এখন সে নামাজের নিয়মকানুন সব জানে। নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে। ইসলাম সম্পর্কে জানছে। যত জানছে ততই জানার আগ্রহ হয়। এই আগ্রহের যেন কোনো অন্ত নেই। সে কোরআন শরিফ পড়া শিখছে এখন। জুবায়েরের পাশাপাশি তাঁর শাশুড়ি নিজে তাঁকে শেখানোর দায়িত্ব নিয়েছেন। কি মধুর স্বরে পড়েন দু’জনেই। শুনতেই ইচ্ছে করে শুধু। নিজের অভ্যন্তরস্থ পরিবর্তন সে নিজেও বেশ ভালোভাবেই টের পায় আজকাল। বাপের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে। সেদিন সে নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যতে একটুখানি নিশ্চিয়তা পাবার জন্যই বিয়েটা করেছিল। সে তখন কল্পনাও করেনি এত শান্তি, স্বস্তি, নিশ্চয়তা অপেক্ষা করে রয়েছে তাঁর তকদীরে। শান্তিপূর্ণ নৈশভোজের আয়োজন আর আহার গ্রহণের দিকে তাকিয়ে সে মনে মনে আলহামদুলিল্লাহ পড়ল। জীবন সত্যিই সুন্দর!
তবে, সঠিক পরিবেশ আর মানুষের উপস্থিতিতে।
________________________________

বিয়ের তিন মাস চলমান। চার মাসে পড়বে কিছুদিনে। জুবায়েরের প্রতি নিজের অনুভূতি স্পষ্টভাবেই অনুভব করতে পারে লেখা। কিছুক্ষণ না দেখলেই, স্বর না শুনলেই কেমন যেন অস্থিরতা সৃষ্টি হয় ভেতরে। ইদানীং সে নিয়মিত ক্লাসও করছে না এই সমস্যার কারনে। জুবায়ের বারবার জিজ্ঞেস করে,
‘আপনি ক্লাসে কেন যাচ্ছেন না? কোনো সমস্যা হয়েছে? হলে বলুন!’
প্রতিবারই লেখা শুধু মাথা নেড়ে জানায়,
‘কোনো সমস্যা হয়নি। এমনিই যাইনা। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।’
জুবায়ের বেশিকিছু বলে না আর। আজও ক্লাস ছিল, সে যায়নি। অথচ জুবায়ের সারাদিন বাড়ি ছিল না। এইত ফিরল তিন মিনিট হবে। সে ঠান্ডা শরবত হাতে নিয়ে নিজেদের ঘরের দিকেই যাচ্ছে। দরজা ভেজানো। ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দেখল জুবায়ের শার্ট খুলে বিছানার উপরে রেখে ফ্যনের নিচে চোখ বন্ধ করে বসে। নিশ্চয়ই খুব পরিশ্রম গেছে সারাদিন বেচারার! কষ্ট লাগছে লেখার। সে এগিয়ে গিয়ে ডাকল,

”শুনছেন!”

জুবায়ের চোখ খুলল। লেখাকে দেখে একগাল হাসল।
লেখা বলল,

”শরবতটা খেয়ে নিন। গরমে ভালো লাগবে।”

জুবায়ের গ্লাসটা হাতে নিয়ে তিন চুমুকে এক-তৃতীয়াংশ শেষ করে বাকিটুকু লেখার দিকে এগিয়ে দিল। লেখা জিজ্ঞাসু চাহনি নিক্ষেপ করল।
জুবায়ের বলল,

”বাকিটুকু আপনি খান!”

লেখাকে নিতে না দেখে সে আবার বলল,

”নবীর সুন্নত ভুলে গেছেন!”

লেখা নিল না গ্লাসটা, বলল,

”অন্যসময় সুন্নত পালন করা যাবে। এখন আপনার দরকার ঠান্ডা ঠান্ডা শরবতটা। আপনিই খান।”

”বেশি অবাধ্য হচ্ছেন আজকাল জুলেখা। খেতে বলেছি খান।”

ঠোঁটটা বটে সে নিল গ্লাসটা হাতে। বিছানায় জুবায়েরের পাশে বসেই খেল। খেয়ে জুবায়েরের দিকে তাকাতেই দেখল সে হাসছে। তবে, ততক্ষণে লেখা অন্য আরেকটা জিনিস খেয়াল করল। জুবায়েরের শরীরের ঊধ্বাংশ সম্পূর্ণ নগ্ন। বিয়ের তিনমাস শেষ। অথচ এরমাঝে আজকের আগে সে কোনোদিন জুবায়েরকে পোশাক ছাড়া এমন অবস্থায় দেখেনি। রাতেও সে টি-শার্ট পড়ে ঘুমায়। আকস্মিক তাঁর গাল দু’টো লাল হয়ে উঠল। জুবায়ের সেটা পরোখ করে ভ্রু উঁচিয়ে বলল,

”আপনার আবার কি হল? ঠান্ডা খেয়েও দেখি লাল হয়ে যাচ্ছেন?”

লেখা জবাব দিল না। জুবায়ের বলল,

”লেবুতে তো আপনার এলার্জি নেই! হুঁট করে এমন লাল হয়ে গেল কেন গাল দু’টো! আপনি কি এলার্জি জাতীয় কিছু খেয়েছিলেন?”

তাঁর স্বরে চিন্তার উপস্থিতি। লেখা উশখুশ করে শেষে বলেই ফেলল,

”আমার শরীরে জামা নেই।”

ততক্ষণে তাঁর নিজেরও হুঁশ হল। তড়িঘড়ি করে শার্টটা নিয়ে গায়ে জড়াতে গিয়ে অন্যখেয়াল হল মাথায়। সে টিজ করল লেখাকে,

”আপনি কি লজ্জা পাচ্ছেন জুলেখা?”

লেখা বিব্রত হল এ প্রশ্নে। সে বহুদিন মুহিবকে শার্ট ছাড়া দেখেছে। অন্য ছেলে বন্ধু দেরও দেখেছে। টিভিতে হলিউড হিরোদের শার্ট ছাড়া বডি দেখে রীতিমতো শিস বাজাত। তখন স্বাভাবিকই মনে হত এসব। কি আজব? এখন সে বিব্রত হচ্ছে, লজ্জা লাগছে। ঢোক গিলে নিজেকে সামলে সে জবাব দিল,

”না। লজ্জা কেন পাব?”

”এইযে আমি পোশাক পড়ে নেই।”

”ছি, কি যা-তা বলছেন। কোথায় আপনি পোশাক পড়ে নেই!”

”সম্পূর্ণ পোশাকহীণ সেটা বুঝাইনি। যদি সেরকম হত আপনি এতক্ষণে জ্ঞানহীনভাবে আমার সামনে পড়ে থাকতেন!”

সত্যি সত্যিই ভীষণ লজ্জা পেল এবার। জুবায়ের ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠল। গ্লাসটা আর ট্রটা হাতে নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব দরজা পেরিয়ে জুবায়েরের দৃষ্টিসীমার আড়ালে বেরিয়ে এল সে। লোকটা দিনকে দিন বড্ড পাঁজি হয়ে উঠছে।
_____________________________________

রাতে ভোজন শেষে ঘরে আগে লেখাই এসেছে। জুবায়ের বাপের কাছে গেছে। ব্যবসার হিসাব নিকাশ করবে দু’জনে মিলে। সে অযথা সময় অপচয় না করে বিছানা ঝেড়ে মশারি টাঙানো শেষ করেছে। অন্যদিন এসব কাজ জুবায়েরই করে। আজ সে করল। দু’জনে ভাগাভাগি করেই বাকি জীবনটা সবকিছু করবে। বই নিয়ে বসেছে এখন লেখা। পড়ায় বিন্দুমাত্র মনোযোগ নেই। তাঁর ভাবনা জুড়ে শুধুই জুবায়েরের প্রতিচ্ছবি।
বই বন্ধ করে ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে বারান্দার দিকে গেল সে। আজ আকাশে মৃদু জোৎস্না আছে। তাঁর আশেপাশেই যেন তারার মেলা বসেছে। কি সুন্দর রুপালি আলো। আগে কখনো চাঁদকে, তার আলোকে বিমোহিতকরণী মনে হয়নি লেখার কাছে। ইদানীং লাগছে। মনে হয়, জুবায়েরের কাঁধে মাথা রেখে প্রকৃতির এই অকৃত্রিম সৌন্দর্য দেখেই একযুগ অনায়াসে সে পাড় করে দিতে পারবে। জুবায়েরের প্রতি তাঁর অনুভূতি যেমন ডালপালা ছড়িয়ে আকাশ ছুঁয়েছে জুবায়েরের দিক থেকেও কি তাই? এই প্রশ্নের জবাব নিয়ে সে মনে মনে ভীষণ শঙ্কিত হয়। খারাপ চিন্তা ভাবনাই মনে বেশি আসে। তবে, যাই হোক জুবায়েরের প্রতি ভরসা রয়েছে তাঁর। মানুষটার মত বিচক্ষণ, জ্ঞানী ব্যক্তি ঠকানোর মত কাজ কোনোদিনই করবে না।

”এই, এই জুলেখা? জুলেখা কি ভাবছেন?”

কাঁধে তীব্র ঝাঁকুনিতে সে ভাবনা জগত থেকে বেরিয়ে এল। জুবায়ের ডেকে কোনো সাঁড়া না পেয়ে কাঁধে হাত রেখে ঝাঁকুনি দিয়েছে। সে কোনো কথা না বলে নির্নিমেখ তাকিয়ে রইল জুবায়েরের দিকে। জুবায়ের অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,

”কি হয়েছে জুলেখা? ঘরে আলো বন্ধ করে দিয়ে বারান্দায় এসে বসে আছেন?”

দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে লেখা একটু নেতানো স্বরে বলল,

”কিছু হয়নি। এমনিই।”

জুবায়ের তাঁর পাশাপাশি দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,

”এমনিই!”

”হুম!”

জুবায়ের পাশ থেকে সরে এসে লেখার পেছনে দাঁড়িয়ে দু’হাত দু’পাশে গ্রিলে রেখে তাঁর কাঁধে থুতনি ঠেকাল। জিজ্ঞেস করল,

”মন খারাপ?”

ভেজা কণ্ঠে লেখা জবাব দিল,

”উহু!”

কেন তাঁর কান্না পাচ্ছে সে জানে না। সে তো জীবনের সমীকরণ কষছিল বসে বসে। কোথা থেকে কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে। শেষটা কেমন হবে অজানা।জুবায়ের নিজের অবস্থান পরিবর্তন করল না। লেখার চাহনি বরাবর খোলা আকাশে দৃষ্টি নিবন্ধিত করল,

”আকাশে কত তারা দেখেছেন? কোনো নাবিক পথ হারিয়ে ফেললে কিন্তু এই সকল তারাকে অনুসরন করে না। করে কেবল শুকতারা আর সন্ধ্যাতারাকে। ঐ দু’টো তারাই কেবল নাবিককে তাঁর সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারে। বাকিগুলো অনুসরন করলে পথভ্রষ্ট হয়ে প্রাণ হারানোর শঙ্কা থাকে।”

লেখার জবাব না পেয়ে জুবায়ের নিজেই বলল ফের,

”আপনি হয়ত এখনো দ্বিধায় আছেন। আমাকে বিয়ে করে ভুল করেছেন নাকি ঠিক করেছেন সে নিয়ে, না?
আকাশের তারাগুলোর মত অসংখ্য অপশন ছিল আপনার কাছে। আপনি বিয়েটাকেই বেস্ট সিদ্ধান্ত মনে করেছিলেন। মনে করুন না আপনার বাবা ছিলেন সন্ধ্যাতারা, আর আমি আপনার জীবনে শুকতারা। ইন শা আল্লাহ নাবিকের মত অভিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাবেন আপনি! যেখানে পথ হারানোর সম্ভাবনা নেই। কোনো শঙ্কা নেই।”

কোনো কথা হল না দু’জনের মাঝে। জুবায়ের লেখার পেছন থেকে সরে এসে পাশে দাঁড়াল। নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে দু’জনে। ঝিঁঝি পোকার ডাক শুধু শোনা যাচ্ছে। মৃদু বাতাস দোল খাচ্ছে। চাঁদের আলোয় কেমন অদ্ভুত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। মাথার দিকটায় টান পড়ায় পাশে তাকাল লেখা। এতক্ষণ সে জুবায়েরের বলা কথাগুলো নিয়েই ভাবছিল। জুবায়ের বলল,

”ওড়নাটা মাথা থেকে খুলে রাখুন এখন। আমি ছাড়া আর কেউ নেই এখানে।”

লেখা তাই করল। ওড়ানা মাথায় পেঁচিয়ে পড়তে পড়তে অভ্যাস হয়ে গেছে। যে খোলার কথা মনেই থাকে না। ভার্সিটিতেও সে থ্রি-পিসের সাথে হিজাব করে যায়। তাঁর পরিবর্তনে পরিচিত সকলে অবাক। বিশেষ করে দিবা। মুহিব জার্মানি চলে গেছে দু’মাস।
প্রথম ক’দিন যোগাযোগ হয়েছিল। এখন আর হয়না।
সে হয়ত বিজি। লেখা নিজেও ব্যস্ত থাকে। দিবার সঙ্গে ভার্সিটিতে গেলেই যা দেখা সাক্ষাৎ হয়। কথা হয়। এর বাহিরে আর কোনো যোগাযোগ হয়না। সে নিজেও তাঁর সংসার নিয়ে ব্যস্ত।

জুবায়ের হুঁট করে তাঁর চুলের খোঁপাটা খুলে দেওয়ায় সে অবাক হল। এখন তাঁর চুল আগের চেয়ে বেশ লম্বা হয়েছে। খোঁপা করা যায়। জুবায়ের অমায়িক হেসে জানাল,

”সুন্দর লাগছে এখন! মাশাল্লাহ!”

লেখা লজ্জা পেল। সে লজ্জা পেলে গাল দু’টো রক্তিম বর্ণে সজ্জিত হয় ক্ষণিকে। জুবায়েরের মুখের হাসি বিস্তীর্ণ হল তাতে।

”আপনি প্রথমে এত সেনসিটিভ ছিলেন না লেখা। ইদানীং কারনে অকারণে লজ্জা পাচ্ছেন আপনি!”

বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলল জুবায়ের। লেখা একটু অসন্তোষ হল কথাটা শুনে। সে নাকচ স্বরে জবাব দিল,

”মোটেও না।”

”মোটেও হ্যাঁ!”

”ইশ, মিথ্যে কেন বলছেন? আপনার মত মানুষের মুখে মিথ্যে মানায় না!”

”কে বলল মিথ্যে বলছি! এখন শুধু বলেছি ‘সুন্দর লাগছে’ আর তাতেই আপনি লজ্জায় লাল টমেটো হয়ে গেলেন। তখন, শার্ট ছাড়া ছিলাম। আপনার অবস্থা দেখার মত ছিল।”

লেখা বেশ বুঝল জুবায়ের মজা করছে তাঁকে নিয়ে।
সে ঠোঁট বটল অসন্তোষ নিয়ে। জুবায়ের হাসছে। হুট করে লেখা বলে উঠল,

”আপনি শার্টলেস ছিলেন তাতে আমার লজ্জা পাওয়ার কি হল? আপনি দেখতে একদমই হট নন!
আমি লজ্জা পাইনি।”

জুবায়ের হাসি থামিয়ে তীক্ষ্ণ চাহনিতে লেখার দিকে তাকাল। একটু দমে গেল তাতে লেখা। জুবায়ের বলে উঠল,

”আমি হট নই?”

”না! একদমই নন।”

”ভেবেচিন্তে বলছেন?”

”বলছি। আপনার সিক্স-প্যাক নেই। মুহিবের আছে।”

তৎক্ষনাৎ লেখার কথা শেষ হওয়া মাত্র সে নিজেকে গ্রিলের সাথে জুবায়েরের দু’বাহুর মাঝে বন্দি অবস্থায় আবিষ্কার করল। শুকনো ঢোক গিলল সে। জুবায়ের সময় নিয়ে বলল,

”নিজের স্বামীর সামনে অন্য পুরুষের প্রশংসা করছেন!”

লেখা দমে গেল। জুবায়ের ফের বলল,

”শুকরিয়া করুন আপনার স্বামী পেটমোটা, টাক মাথা নয়। আলহামদুলিল্লাহ, সিক্সপ্যাক না থাকলেও আমি ফিট আছি। হেলদি আছি। আপনিও আলহামদুলিল্লাহ পড়ুন!”

লেখা অনুভব করল ব্যপারটা সত্যিই ন্যাক্কারজনক। অন্য পুরুষের নাম নেওয়া উচিত হয়নি। সে মুখটা নুইয়ে অপরাধী ভঙ্গিতে বলল,

”স্যরি, ভুল হয়ে গেছে!”

জুবায়ের জবাব দিল না। ধীরে লেখার চিবুকটা আঙ্গুলের সাহায্যে উপরে তুলে দু’জনের মুখটা মুখোমুখি করল সে। লেখার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,

”আপনি অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছেন লেখা। আর আমি আপনার এমন পরিবর্তনই চেয়ে এসেছি শুরু থেকে। আমি যেমন চাই হয়ে উঠবেন তো তেমন সম্পূর্ণভাবে?”

লেখার নিঃশ্বাসের ঘনত্ব বেড়ে গেছে। সে চোখের পাতা ঝাপটে জবাব দিল কোনোভাবে,

”হুঁ!”

”হুঁ, কি? বলুন ইন শা আল্লাহ!”

”ইন শা আল্লাহ!”

”আমিন!”

পরক্ষণেই কপালে নরম স্পর্শের অস্তিত্ব অনুভব করল ক্ষণিক বাদে। ঠোঁটের কোণে সন্তুষ্টির হাসি নিয়ে চোখ মুঁদল লেখা।
_________________________________

®সামিয়া বিনতে আলম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here