#অমানিশা❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-২
এশার আজান দিয়ে দিয়েছে।
মুনতাহা একদৌড়ে নিচে নেমে এলো আধছেঁড়া ওড়না নিয়েই। ডানপাশের আচঁল নেই। সেখানটায় এবড়োথেবড়ো ছেঁড়া। বাকি অংশটুকু এখনো গাছেই ঝুলছে। একহাতে কাপড়ের স্তুপ। সেগুলো সামলে লকে চাবি ঢুকাতেই সিঁড়ি ভেঙে উপরে ওঠার পদচারণ শোনা গেলো। মুনতাহা ত্রস্ত চোখে তাকালো একবার। আপনমনেই বিরবির করলো ,”আল্লাহ! বাবা চলে এলো নাকি? এতোরাতে একা একা ছাদে গিয়েছি শুনলে নিশ্চিত তুলকালাম বাঁধিয়ে দিবে। ও খোদা, বাঁচাও!”
আরশাদ উঠে এসেছে। সিঁড়ি থেকেই চোখাচোখি হলো। বিগত কয়েকমিনিটে প্রথম স্বস্তির শ্বাসটা ফেললো মুনতাহা। চোখ ফিরিয়ে নিলো ধীরগতিতে। চাবি ঘোরালো। দরজা খুলে যেতেই সে ঢুকে গেলো তারাতারি।ভেতর থেকে আটকে দেয়ার আগেই একহাতে শক্তিশালী ঠেস দিয়ে বাঁধা দিলো আরশাদ। মুনতাহা ঘাবড়ে গেলো মূহুর্তেই। চেহারায় অনিচ্ছায়ও নিখুঁতভাবে ফুটে উঠলো সেই ভীতি। আরশাদের ঠোঁটের কোঁণে দূর্বোধ্য হাসি। মেয়েটা যে ঘনঘন শ্বাস ফেলছে বোঝা যাচ্ছে। মুনতাহা আচমকাই জোর দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলোনা। আরশাদের হাল্কা চাপেই দরজা খুলে গেলো বাদবাকিটা। ধুম করে বারি খেলো পাশের দেয়ালে।
চেহারাটা মূহুর্তেই অবিকল কাগজের মতো সাদা হয়ে গেলো মুনতাহার। আরশাদ তার আগত কাঁদো কাঁদো চোখ দুটোর দিকে চেয়ে আস্তে করে বললো,
—“আপনার আব্বুকে দিয়ে দিয়েন মু-ন-তা-হা।”
মুনতাহা বিচলিত ভঙ্গিতে দেখলো আরশাদ একটা কালো রঙের ফাইল এগিয়ে দিয়েছে। ভেতরে কাগজপত্র।সে ধরছে না দেখে আরো একটু সামনে এগিয়ে দিলো আরশাদ।
মুনতাহা চট করে হাতে নিলো। মিনমিন করে বললো,”আচ্ছা।”
আরশাদ দরজায় রাখা হাত সরিয়ে নিয়েছে ততক্ষনে। মুনতাহা একনজর দেখেই ধারাম করে লাগিয়ে দিলো মুখের উপর।
আরশাদ ঠোঁট কামড়ে কয়েকসেকেন্ড স্হির চেয়ে রইলো কাঠের দরজার দিকে। চোখের দৃষ্টি বরফের মতোন। কঠিন- শীতল। আচ্ছা, মেয়েটাকি জানে? তার একদুটো কাঁধের ধাক্কায়ই এই কাঠ ভেঙে গুড়িয়ে যাবে?
ফাইলটা পড়ার টেবিলের উপর রেখে বিছানায় যেয়ে বসলো মুনতাহা। জোড়ে জোড়ে শ্বাস টানলো কয়েকবার।
এই একুশ বছরের জীবনে কখনো এমন পরিস্থিতিতে পরেনি। লোকটা কিভাবে যেনো একটা চেয়ে ছিলো? একদম সরাসরি! মুখের দিকে! ছিহ্!
___________
সাবিনা বেগম জানালার ধারে বসে লবঙ্গ চিবাচ্ছেন। বয়স্ক মানুষ। জীবনভর্তি কাজ শেষে এবেলায় তার অফুরান ছুটি। আরশাদের মা রান্নাঘর থেকে গজগজ করছে,”আম্মা, আপনি একটু তো কথা শোনেন আমার। এমন ঠাট মেরে বসে আছেন সন্ধ্যা থেকে। পরেতো রাতভর পিঠের ব্যাথায় শুতে পারবেন না।”
সাবিনা বেগম আরো একটা লবঙ্গ মাড়ির ফাঁকে চালান করে দিয়ে বললেন,”আরে দেখ না, কেমন জোছনা উঠেছে। না দেখে, মটকা মেরে শুয়ে থাকা যায় নাকি?”
আরশাদের মা বিরক্তি নিয়ে তাকালেন। আপনমনেই বিরবির করলেন,”জোছনা উঠেছে! জোছনা দেখে ভাত পাওয়া যাবে?”
শাশুড়ি মানুষ কই তাকে শাসন করবে একটু। নাহ্! উল্টো তিনিই উনাকে শাসন করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন। চুলোর তেলে পিয়াজের কুঁচি ছেড়ে দিতেই বিশ্রি একটা শব্দ হলো। ঝাঁ ঝাঁ ঝাঁ।
সাবিনা বেগম ঘাড় ফিরালেন। এখানে থেকে রান্নাঘর দেখা যায়। মেয়েটাকে আরো একটু রাগিয়ে দিতে বললেন,”আচ্ছা বৌমা? তোর মতো একটা রসকষহীন মেয়ের সাথে আমার ছেলেটা এতগুলো বছর সংসার করলো কেমনে? বুঝিনা!
আরশাদের মা চোখমুখ কুঁচকালেন। তিক্ত গলায় বললেন,
—“আম্মা! আপনি কি আসলেই আমার শাশুড়ি? আপনাদের জামানায় না মেয়েমানুষ লজ্জায় মুখ তুলতো না? আপনি এমন হলেন কেনো?”
সাবিনা বেগম হেসে বললেন, তুই আমাকে এখনো শাশুড়ি ভাবিস নাকি? বাব্বাহ্! তুই আর আধুনিক হতে পারলি নারে বৌমা!”
—“আমার আধুনিক হওয়া লাগবেনা। আপনি চুপ করেনতো। আপনার কথার তালে আমার পিয়াজ পুড়ে গেলো। আর ভাল্লাগেনা! আর ভাল্লাগেনা আমার!”
আরশাদ জুতোর ফিতা খুলতে খুলতে সবই শুনছিলো। চাবি দিয়ে দরজা খুলেছে বিধায় ঝগড়ারত দুই রমণী তার আগমন টের পায়নি। জুতোর ফিতা খুলে র্যাকে রাখতে রাখতে দেখলো নিচে ছাপ ফুটে আছে সিগারেটের। কমতো না! বিশটা সিগারেট থাকে এক প্যাকেটে।
আরশাদকে দেখামাত্র সাবিনা বেগম ডাক দিলেন,”এই ছেলে, এদিক আয়। তোর মা যে আমার সাথে দিনরাত লেগে থাকে, সে খবর থাকে? সারাদিন শুধু বান্ডিল বান্ডিল টাকার পিছে ঘোরা। এক পা কবরে রাখা দাদি মরলো না বাঁচলো কোনো খেয়াল নেই। এ দিন দেখার জন্য তোর পায়খানার খাতা নিজহাতে পরিষ্কার করতাম? ওই গ্যাদাকালে আমি সরিষার তেল না মালিশ করলে তোর চামড়া এতো চকচক করতো? মেয়েরা পছন্দ করতো তোকে? একটা বউ পাইতি তুই? বল পাইতি?”
আরশাদ হেসে ফেললো,
—“বউ তো এখনো পাইনি দাদু।”
—“বউ পাবি কেমনে? মেয়ে দেখলেই তো তিনগজ দূর থেকে ‘আল্লাহ হাফেজ’ বলে পগারপার, তোর ছেলে বাচ্চার বাপ হয়ে গেলে তারপর বিয়ে করিস।”
আরশাদ এবারো হাসলো,
—“আমি বিয়ে না করলে আমার ছেলে হবে কোথ্থেকে?”
—“আসমান থেকে…আমার লবঙ্গের কৌটোটা দিয়ে তারপর যা।”
আরশাদ এগিয়ে এলো। কাঁচের টেবিলের উপর থেকে লবঙ্গের কৌটো নিয়ে হাতে নিলো। ঠান্ডাজনিত সমস্যার জন্য তিনি লবঙ্গ মুখে রাখেন। দাদিকে কৌটো দিয়ে আরশাদ একবার চাঁদের দিকে তাকালো। আচ্ছন্নের মতো বললো,
—“চাঁদকে বিয়ে করা যায় দাদু?”
সাবিনা বেগম আৎকে উঠলেন,
—“ধুরো! মাথা গেছে নাকি? চাঁদকে কেনো বিয়ে করবি? চাঁদ কি তোর পাশের ঘরে থাকে যে এই ধরলাম আর বিয়ে করে নিলাম?”
আরশাদ মৃদু হাসলো। ঝাপসা স্বরে বললো,”থাকেতো, আমি মাত্র দেখে এলাম।”
_____________
টিভিতে খেলা চলছে। ক্রিকেট খেলা। ধারাভাষ্যকারের অনবরত বকবকে ড্রইংরুম মেতে আছে। হাতে ধরা ঠান্ডাজল ভর্তি গ্লাসের গা বেয়ে চুইয়ে চুইয়ে পরা পানি দিয়ে হাত ভিজে গেছে। টিভি স্ক্রীনের দিকে চেয়ে ধীরস্থগতিতে গ্লাসটা সামনের টেবিলের উপর রেখে দিলো মাহতাব সাহেব। মুনতাহা ঘুমাতে গিয়েছে। কিন্তু এখনো ঘুমোয়নি। না দেখেই বলতে পারছে মেয়েটা আয়নার সামনে চুল আচরাচ্ছে। মায়ের মতো স্বভাব। রোজ রাতে ঘুমানোর আগে নিয়ম করে চুল আচরানো। দু’পাশে দুটো বিনুনি গাঁথা।
কিছু একটা স্বৃতিচারণ করতে করতে অন্যমনস্ক হলো মধ্যবয়স্ক মন। ভাটা পরলো মেয়ের কন্ঠে। মুনতাহা ডাকছে? চোখ খুললো চকিতে। মুনতাহা খোলা চুলে দাড়িয়ে আছে। তার দিকে কিছু একটা বাড়িয়ে ধরেছে। বারকয়েক চোখ পলক ফেলে দৃষ্টি পরিষ্কার করলেন তিনি। মেরুদন্ড সোজা করে বসলেন। বললেন,
—“কি এটা আম্মা?”
মুনতাহা ফাইলটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে সরলকন্ঠে বললো,
—“তুমি কি ভাবছিলে আব্বু? আমি এ নিয়ে পাঁচবার ডেকেছি।”
মাহতাব সাহেব হাসলেন। চাপা হাসি। উওর না দিয়ে কাগজটা উল্টে পাল্টে বললেন,
—“কিসের ফাইল মা?”
—“ওইযে ওই লোকটা দিয়ে গেলো। সকালে এসেছিলো যে।”
মাহতাব সাহেব ভ্রু কুঁচকালেন। ভেতর থেকে কাগজ বের করে দেখলেন ব্যাংকের কাগজই। আরশাদই দিয়ে গেছে তারমানে। কাগজগুলো পুনরায় ঢোকাতে ঢোকাতে খানিকটা গম্ভীর কন্ঠে বললেন তিনি,
—“তুই দরজা খুলেছিলি কেনো? আমি মানা করেছিনা?”
মুনতাহা সাথেসাথেই উওর দিলো,
—“আমি দরজা খুলিনি আব্বু। ছাদ থেকে নামলাম যখন, তখন উনি উঠছিলেন। তখনই দিলেন। আমি নিয়েই দরজা আটকে দিয়েছি।”
মাহতাব সাহেব একপলক তাকালেন। মুনতাহা পাশে বসেছে। মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,
—“আমাকে ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করবিনা আম্মা। কক্ষণো বিশ্বাস করবিনা। এই বিশ্বাস জিনিসটা খুব সেনসিটিভ একটা বিষয়। খুব স্পর্শকাতর। একবার পাকাপক্তভাবে হয়ে গেলেই এর ভাঙন টা তখন আর সহ্য হয়না। সবসময় মনে রাখবি, বিশ্বাসভঙ্গ জিনিসটার মতো বাজে জিনিস পৃথিবীতে আর দুটি নেই। তাই কখনো কাউকে?”
মুনতাহা গলা নামিয়ে উওর দিলো,”বিশ্বাস করবোনা।”
মাহতাব সাহেব হাসলেন। মুনতাহার শান্তশীতল চোখদুটিকে একটুখানি চমকে দিতে ধীরগলায় বললেন,
—“এতরাতে ছাদে যাবিনা আর। বিকেলেই কাপড় নিয়ে আসবি।”
যতখানি আশা করেছিলেন তার থেকে বেশি চমকালো মুনতাহা। মাহতাব সাহেব এবারো হাসলেন। তিনি জানেন, আরশাদ ফেরে রাত করে। তার ডিউটি টাইম কতটুকু তাও তিনি জানেন। ব্যাংক থেকে বাসার দুরত্ব সম্পর্কেও অবগত আছেন। আরশাদ তখন উঠছিলো তারমানে অফিস থেকেই ফিরেছে। আর মুনতাহা তখন ছাদ থেকে নেমেছে মানে সে রাত করে ছাদে গিয়েছে।
মুনতাহা আমতাআমতা করে বললো,”আমি আসলে..”
মাহতাব সাহেব তার অপরাধী চেহারার বিপরীতে নরম কন্ঠে বললেন,
—“আজকের টা মাফ। এখন ঘুমাতে যা আম্মা। শুভরাত্রি।”
মুনতাহা মিষ্টি হেসে “শুভরাত্রি আব্বু” বলে উঠে যেতেই মাহতাব সাহেব সন্ধানী গলায় প্রশ্ন করলেন,
—“চুল খুলে রেখেছিস কেনো? বেণি করলিনা?”
মুনতাহা সাবলীল কন্ঠে উওর দিলো,
—“কালতো ভার্সিটির প্রোগ্রাম আছে। সকাল সকাল যেতে হবে। বেণি করে ঘুমালে চুল ভাঁজ ভাঁজ হয়ে কুঁকড়ে থাকবে। তাই করিনি।”
_____________
শাড়িতে মেয়েদের অন্যরকম দেখায়। তবে এতো বেশি অনুমান করেনি আরশাদ।
এই পঁচিশ টাকা ডজনের লাল রেশমিতেও যে কারো হাত এতটা সুন্দর লাগতে পারে, ভাবেনি একদম। নরম তালুর মাঝবরাবর বৃত্তাকারে আলতা আঁকানো। নখে মেহেদি। ঢেউ খেলানো চুল কানের পিছে গোঁজা। আরশাদের ধারণা, অধিকাংশ মেয়েদের মাঝখানে সিঁথি কাটলে বাজে দেখায়। কিন্তু এই মেয়েটাকে দেখাচ্ছেনা। উল্টো, মনে হচ্ছে এই কপালে নাক বরাবর সিঁথি না কাটলেই বরং বিরাট কেলেঙ্কারি হয়ে যেতো।
মুনতাহা যখন একহাতে শাড়ির কুঁচি ধরে রিকশায় উঠলো আরশাদের ঈগল চোখ তার পায়ে লেপ্টে থাকা অযত্নের নুপুরজোড়াকেও চোখের নির্লজ্জ্ব ভাষায় উত্যক্ত করতে সময় নষ্ট করলো না। সেই চাহনীতে নুপুরগুলো বোধহয় লজ্জা পেলো খুব। মুনতাহা কুঁচি ছেড়ে দিতেই তারা ঝটপট লুকিয়ে নিলো নিজেদেরকে। পহেলা বৈশাখ না আজ? বাংলার নববর্ষ। নতুন বছর।
সদ্য ঘুম ভাঙা আরশাদের চোখ দিনের উজ্জ্বল আলোয় এ বছরের প্রথম লালগোলাপটাকেই দেখে নিলো যেনো।
মাহতাব সাহেব রিকশার হুট তুলে দিলেন।
আরশাদ চোখ সরিয়ে নিলো। নিজেকে বুঝ দিলো,”গোলাপে কাঁটা থাকে।”
~চলবে~