#অভিশপ্ত_জীবন
পর্ব ৯
লেখিকা #Fabiha_Busra_Borno

মনে হচ্ছে কেউ একজন বুকের ভেতর থেকে টেনেহিঁচড়ে কলিজা ফুসফুস সহ সব কিছু বের করে নিয়ে যাচ্ছে। হাত পা অবশ হয়ে যাচ্ছে, ছুটে গিয়ে প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে করছে কিন্তু সেগুলো কিছুই সম্ভব না। মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে জ্ঞান হারালে খুব ভালো হতো। যেচে কষ্ট নিয়েছি আমি তাই নিথর শরীরটা জীবন্ত লাশ বানিয়ে বালিশে মুখ গুজে কান্না করলাম বেশ কিছুক্ষন। বুঝলাম প্রতিটি মেয়ের ই এমন কষ্ট হয়, নিজের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি যখন চোখের সামনে অন্য কারো সাথে থাকে। মজিবুর চাচার বউদের যেমন হাসিখুশি দেখতাম তাদের ভেতরেও ঠিক আমার মতোই হয়তো হয়।

ও ঘর থেকে আর কোন শব্দ আসছে না। হয়তো সামান্য কিছু সময়ের জন্য চোখ টা লেগে গেছিলো কিন্তু অতি সাবধানে কারো দরজা খোলার শব্দে আবারও জেগে গেলাম। হয়তো ওরা বাইরে বের হয়েছে,, উউফফঃ এই যন্ত্রণা সহ্য করা অসম্ভব। কাল থেকে বিকালেই ঘুমের ঔষধ খাবো। চাপকল হওয়ার জন্য বুঝা যাচ্ছে কল চাপার শব্দ। ইয়া মাবুদ কেন আমি এমন অনলে ঝাপ দিলাম

অনেক ছটফটানির মধ্যে কোন রকম ভোর হলো। আমি অযু করে নামাযে বসে মোনাজাতে আল্লাহর কাছে আরো ধৈর্য্য চাইলাম এবং ভবিষ্যতে যেন আমাদের সংসার সুখে থাকে তার জন্য দোয়া করলাম। শিহাব ঘুমিয়ে আছে, মুহিত রুনা ও উঠে নি। হালকা অন্ধকার বাইরে,, বাড়ির ভিতর দম বন্ধ হয়ে আসছে,, মুহিত রুনার দরজা খোলার দৃশ্য দেখা সম্ভব না তাই বাইরে হাটতে বের হলাম। পুকুর পাড়ের পাশে দিয়ে মাটির কাঁচা রাস্তা বয়ে গেছে, হাটতে হাটতে অনেক দূর চলে এসেছি, হাঁস মুরগী কিছুই ছাড়া হয় নি, তাছাড়া শিহাব একা ঘরে এইসব মনে হতেই পিছনে পা বাড়ালাম। বাড়ি ফিরে দেখি রুনা হাঁস মুরগীকে খাবার দিয়েছে এবং উঠোন বাড়ি ঝাড়ু দিয়ে রান্না ঘরে পেয়াজ রসুন কাটছে।

হয়তো রাতে স্বামী কে নেওয়ার পরে এখন সংসারটাও নিয়ে নিচ্ছে,,কথা গুলো মনে মনে ভাবছি আর রুনার কাছে গিয়ে বললাম, এতো সকালে কি দরকার ছিল একা একা এতো কাজ করার। তুমি শিহাবের কাছে যাও, আর মুহিত কোথায় গেছে?

রুনা- শিহাব ঘুম থেকে উঠে কান্না করতে লাগছিলো তাই ও দোকানে নিয়ে গেছে

রুনার বলা “ও” কথা তে বুকের ভেতর আবারও মোচড় দিয়ে উঠে, এতোদিন ভাই বলতো কিন্তু আজ “ও”।
দুজনে মিলে রান্না করলাম, শিহাব কে নিয়ে মুহিত ফিরেছে। মুহিত আমার দিকে তাকাতে সংকোচ করছে,,হয়তো আমি কষ্ট পাচ্ছি তা বুঝতে পারছে।

আমার ঘরে সুয়ে আছি, মাথাটা ঝিমঝিম করছে,, মুহিত কিছুক্ষণ পরেই আমার কাছে এসে বসে।কিছুক্ষণ চুপ থাকার পরে বলে,,

আমি জানি তুমি রাতে ঘুমাও নি, আমি পড়েছি দু-টানাতে,, এই মুহূর্তে আমার কি করা উচিত আমি জানি না। তবে তোমার মতো মেয়েকে বউ হিসেবে পেয়ে আমি ধন্য। আগেও তুমি আমার কাছে যেমন ভালোবাসা পেয়েছো এখনো তেমন পাবে এবং আগামী জীবনেও একই রকম পাবে। তোমার যায়গা কখনো কেউ নিতে পারবে না।

মুহিত আমার পাশে বসে আছে,, পরম শান্তিতে দু’চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। গত দুই রাতের ঘুম যেন এখন আমার চোখে হানা দিয়েছে। ঘুম থেকে উঠতে উঠতে দুপুর গড়িয়ে গেছে,, চোখ খুলে আড়মোড়া দিতেই বাইরে থেকে মুহিত রুনার হাসাহাসি আর কথা শুনতে পেলাম। আমি ঘুমানোর পরে মুহিত চলে গেছে, যাওয়াটাই স্বাভাবিক।

মুহিতের বিয়ের ৫ দিন হয়েছে। মুহিত দুই রাতে আমার সাথে ঘুমানোর কথা বলেছিল কিন্তু আমি জোর করে রুনার ঘরে যেতে বলতাম,, প্রতিদিন বিকালে ঘুমের ঔষধ খেলে সন্ধ্যার পরপরই ঘুম এসে যায় চোখে। শান্তিতে ঘুমাতে পারি এভাবে। আজ মুহিত আমার সাথে ঘুমিয়েছে, যদিও নিশেধ করেছিলাম কিন্তু শোনেনি, জোর করে এঘরেই ঘুমিয়েছে। পাশের বালিশ টা পরিপূর্ণতা পেল আজ। কিন্তু মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখি সেই পরিপূর্ণ বালিশটা শুন্য। হ্যাঁ মুহিত রুনার কাছে চলে গেছে আমার ঘুমানোর সুযোগে। এখন কষ্টটা আরো বেশিই পাচ্ছি। কি দরকার ছিল আমার কাছে আসার আমি তো আসতে বলিনি,,

কোন ভাবে চুপচাপ জেগে আছি। বেশ কিছুক্ষন পরে মুহিত আবারও চুপিচুপি আমার ঘরে আসছে,,সে ভেবেছে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি তাই দরজা আটকিয়ে বিছানার কাছে আসে। আমি সাথে সাথে বলি,, রুনাকে ছেড়ে যদি থাকতেই না পারো তাহলে কেন আসলে, কই আমি তো তোমাকে বলিনি আমার কাছে আসার জন্য। নিজে থেকেই যদি আসলে তাহলে কেন আবারও গেলে? একটা রাতেরই তো ব্যাবধান ছিলো। নিজের মনকে শক্ত করেছি বলেই তোমাকে বিয়ে দেওয়ার মতো সাহস পেয়েছি,, তোমাকে ছাড়া বাকি জীবন ঠিকই পার করতে পারবো। তাই কাল থেকে আর কখনো তুমি আমার ঘরে আসবে না।

মুহিত কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে চুপচাপ সুয়ে আছে। যেহেতু রেগুলার ঘুমের ঔষধ খায় তাই আমি ও ঘুমিয়ে গেলাম। প্রতিদিনের রান্না বান্না সাংসারিক টুকটাক কাজের মধ্যে দিয়ে দিন পার হতে লাগলো। আমি এখন বেশ অবসর সময় পাই,, মায়ের বাড়ি তে গেলে ১০/১২ দিন থাকি। মায়ের বাড়ি তে রেখে আসতে বা নিয়ে আসতে মুহিত আর আসে না। একাই যাওয়া আসা করি।

মুহিত মাঝে মাঝে আমার সাথে স্বামীর অধিকার খাটানোর চেষ্টা করে কিন্তু আমি বারবার ফিরিয়ে দিয়েছি। ওইরাতের স্মৃতি টা মনে প্রচুর দাগ কেটেছে। নিজের কথা চিন্তা না করে মুহিতের জীবন গুছিয়ে দিলাম অথচ তার সামান্য কিছু সময় আমার কাছে থাকতে হাসফাস লাগে।

রুনার সাথে সম্পর্কটা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। আমি ভালো কিছু বললেও সে রাগ দেখিয়ে বকবক করে। নিজের ইচ্ছে মতো কোন কিছু রান্না করতে পারিনা। মুহিত কে বারবার বলার পরেও আমার প্রয়োজনীয় জিনিস এনে দেয় না। এক সাথে খাওয়ার জন্য খাওয়ার সময় কখনো আমাকে ডাকে না। মাঝে মাঝে শিহাব ওর দাদার বাড়ি গিয়ে অনেক দিন থাকে। আমার জন্য মুহিতের আর সামান্য আফসোস হয় না অথচ বিয়ের পরের দিন বলেছিল আমার যায়গা নাকি কেউ নিতে পারবে না। আসলে আমার যায়গা টা কই জানি না।

টানা সাত মাস পরে রুনা প্রেগন্যান্ট হলো। মুহিতের চোখে রাজ্য জয়ের আনন্দ, রুনার বাবা মা ও ভিষণ খুশি। আমিও খুশি কিন্তু সত্যিই খুশি নাকি বুঝতে পারছি না। আমি তো এইদিনের জন্যই নিজের অধিকার ত্যাগ করলাম, কিন্তু তাও মন থেকে খুশি হতে পারছি না কেন। আল্লাহ আমার এইসব চিন্তাধারার জন্য যেন ওদের বাচ্চার কোন ক্ষতি না হয়।

মুহিত প্রতিদিন রুনার জন্য পুষ্টিকর খাবার ফলমূল নিয়ে আসে। রুনার কাজ গুলো আমি করে দিই এবং স্বার্ধমত চেষ্টা করি বাচ্চার পরিপূর্ণ পুষ্টি প্রদানে। রুনার মা সব সময় এটা সেটা দিয়ে যায়।

শামিমের বিয়ে ঠিক হয়েছে। বারবার ফোন দিয়ে মুহিত কে যেতে বলছে কিন্তু মুহিত বিভিন্ন কাজের অজুহাতে যাচ্ছে না। অথচ পপির বিয়ের সমস্ত দ্বায়িত্ব নিজ হাতে সামলিয়েছিলো। রুনার চার মাস চলছে, সবকিছু স্বাভাবিক আছে। রুনার মায়ের বাড়ি তো কাছেই তাই আমি আর মুহিত বিয়েতে কয়দিন আগে গেলে কোন ক্ষতি হবে না। কিন্তু মুহিত কিছুতেই যাবে না। আর দুইদিন পরে বিয়ে অথচ কোন ভাবেই মুহিত কে রাজি করাতে পারছিনা।

আজ কেন যেন নিজের মনের কথা গুলো চেপে রাখতে পারলাম না। তাই ইচ্ছে মতো মুহিত কে কিছু কথা শুনালাম। মুহিতের হয়তো যাওয়ার ইচ্ছে জেগেছে তাই সে দুপুরের গোসল সেরে রেডি হচ্ছে। কিন্তু রুনা মুহিত কে বলছে,, এভাবে আমাকে রেখে চলে যাবে,, তোমার কাছে সন্তান আগে নাকি ওইসব বিয়ে খাওয়া আগে।তুমি জানো না তোমাকে ছাড়া রাতে আমার কত টেনশন হয়। আর এই অবস্থায় টেনশন করলে বাচ্চার ক্ষতি হবে না? তোমার বড় বউয়ের বুড়াতি বয়সে এতো সখ কেন ভা/তার কে সাথে নিয়ে ভাইয়ের বিয়ে খাওয়ার?

কথা গুলো কানে আসতেই রাগে শরীরের লোম গুলো দাঁড়িয়ে গেছে। আমি ও সাথে সাথে চিল্লাইয়ে বলতে লাগি,, আমার যদি এতোই সখ থাকতো তাহলে তোর সাথে নতুন করে বিয়ে দিতাম না। সখ থাকলে আমি আমার ঘরের দরজা মুহিতের জন্য বন্ধ করে দিতাম না। কই আমি তো তোদের বিয়ের পরে একবারও স্বামীর অধিকার চেয়ে মুহিতের সামনে যায় নি। নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস গুলো তো আদায় করে নিই না। নিজের সংসার স্বামী সব দিয়েছি তোকে কই আমি তো কখনো এভাবে চুপিচুপি কানমন্ত্র দিইনি।

আমার কথার আওয়াজে পাশের বাড়ির দুইতিন জন মেয়ে আসে,, রুনা ন্যাকা কান্না শুরু করেছে। মুহিত বাইরে রাখা চেয়ারে লাত্থি মেরে চলে গেছে।আশেপাশের সবাই রুনার নামে ছিঃছিঃ করে চলে গেলো। আমি আর কোন কথা না বাড়িয়ে নিজের প্রয়োজনীয় কাপড় জিনিসপত্র নিয়ে বেড়িয়ে পরলাম। রাস্তার মোড়ে একটা দোকানে মুহিত বসে ছিলো। আমাকে দেখে কাছে এসে কিছু টাকা দিতে লাগে।

ইচ্ছে করছে ঠাসিয়ে একটা থাপ্পড় মারি। দুইদিনের বউয়ের সামনে আমার হাত খরচের টাকা দিতে যার ভয় করে তার থেকে টাকা নিয়ে ভাইয়ের বিয়ে খাবো??রাস্তায় এবং দোকানে মানুষ ছিলো তাই আস্তে করে মুহিত কে বলি,,এই টাকা দিয়ে তোমার আদরের ছোট বউয়ের জন্য কিছু নিয়ে যেও,,তাহলে দিনের রাগ গুলো ভুলে রাতে সোহাগের রাজ্যে নিয়ে যাবে।

এবাড়িতে আসার পরে সবাই জিজ্ঞেস করছে কেন মুহিত আসেনি। কোন রকম কাটিয়ে নিলাম। বিয়ের তিন দিন পরে শামিম আমাকে নিয়ে রেখে আসে। রুনা একবারও শামিমের সাথে কথা বলে নি। শামিম আমাকে বলে,, আপা তুই এতোই দুঃখে পড়িস নি যে তোর আগাছার মতো এখানে পড়ে থাকতে হবে। তুই আমার সাথে চল, থাকতে হবে না এখানে। শামিম কে বুঝিয়ে পাঠিয়ে দিলাম

রুনার আট মাস চলছে,, ইদানীং মুহিত আমার কাছে আসার জন্য ছটফট করে। হয়তো পুরুষালি চাহিদা গুলো মিটানোর তাড়োনায়। আমার প্রয়োজনে যখন কাউকে পায় না তখন অন্যের প্রয়োজনে নিজেকে বিলিয়ে আর দিবো না । আমার হাঁস মুরগী বিক্রি টাকা, দুটো গরুর টাকা সব আমার আলাদা ক্যাশ। আগে ওদের জন্য অনেক কিছু কিনে দিতাম কিন্তু এখন কিছুই দিইনা।

আজ রুনা ওর বাপের বাড়ি আছে। মুহিত খুব জোরে জোরে দরজা খোলার জন্য বলছে কিন্তু আমি খুলছি না। এতে মুহিতের রাগ আরো বেড়ে গেলো। তাই দরজা খুলে দিয়ে বাইরে চলে যায়। মুহিত আমার চুল ধরে টেনে ঘরে নিয়ে আসে আর বলে, মা* তোর অনেক ত্যাজ হয়েছে তাই না। আমার খাস আমার পড়িস আমার বাড়িতে থাকিস আর আমার সাথে ভাব মারাস,,

নিজেকে ছাড়াতে মুহিত কে ধাক্কা দিই কিন্তু বুঝতে পারিনি পাশেই কাঠের চেয়ার ছিলো,, ধাক্কা দেওয়ার সাথে সাথে মুহিতের,,,,,

চলবে,,,,

আগেই সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি,, কাল গল্প দিতে পারবো না। ফোন হাতে দেখলেই বাসায় সিত্রাং শুরু হচ্ছে, আর ৬ তারিখ তো এক্সাম 🙂

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here