#অবাক_মেঘের_বাড়ি
পর্ব : ৩
সুরমা
কাজল রেখা বসে আছেন ড্রয়িংরুমে। সাথে রিমি আর প্রিতি। কাজল রেখা বললেন,,,,
-অনু কোথায় বউমা।
-মা, অনু তো অবাকের সাথে বের হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। কাজল রেখা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। কিন্তু কিছু বললেন না। প্রিতি বসে বসে নাটক দেখছে। তাকে দেখে বুঝা যায় তার কোনো দিকে আগ্রহ নেই।
রিমি শাশুড়ি মায়ের সাথে বসে গল্প করছে।
এমন সময় রুমে একজন মহিলা ঢুকে। পাশের বাসার। কাজল রেখা তাঁকে দেখে বললেন,,,,,,
-আপা আপনি হঠাৎ আমাদের বাসায়? কি মনে করে?? মিহিলা চাপা হেসে এগিয়ে এসে বসলেন সোফায়। তারপর মুখে মিষ্টি হাসি এনে বললেন,,,,,
-কয়েকদিন ধরে ভাবছিলাম আপনার কাছে আসবো। সময় পাচ্ছি না। আজ চলেই আসলাম। কাজল রেখা সাদরে বললেন,,,,
-ভালো করেছেন। মিহিলা বসে কিছু একটা নিয়ে ইতস্তত করতে লাগলেন। ব্যাপারটা কাজল রেখা বুঝতে পেরে বললেন,,,,
-আপা আপনি কি কিছু বলতে চাইছেন?
-আসলে একটা কথা বলতে চেয়েছিলাম। কিছু মনে করবেন না আপা। আপনার ছেলেমেয়েদের তো আমরা ভালো বলেই জানতাম। কিন্তু কিছুদিন যাবৎ আমরা খেয়াল করছি আপনার বাসায় প্রত্যেকদিন একটা সুন্দর ছেলে আসে।
আবার আপনার বড় মেয়েকে দেখি যখন তখন তার সাথে ঘুরতে বের হয়। পাড়াপড়শির চোখে বিষয়টা পড়েছে। তাঁরা আপনার বড় মেয়েকে নিয়ে সব সময় সমালোচনা করে যাচ্ছে। ছেলেটা কে???
কাজল রেখা এই ভয়টাই পাচ্ছিলেন এতদিন। তাই তিনি অবাকের সাথে এতো মেলামেশা পছন্দ করতেন না। কিন্তু অনু বা অবাক কাউকেই দমাতে পারেন নি। তিনি শান্ত কণ্ঠে বললেন,,,,,
-ছেলেটা আমার ভাইয়ের ছেলে। খুব ভালো ছেলে।
-তা নাহয় বুঝলাম। তাহলে আপা আপনি আপনার মেয়েকে বিয়ে দিচ্ছেন না কেন? বয়স তো কম হয়নি। এমন একটা মেয়ে ঢিং ঢিং করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যতই কাজিন হোন। ওরা তো এখন প্রাপ্ত বয়স্ক। এলাকার ছেলে মেয়েদের চোখেও পড়ছে তাদের বিষয় গুলো।
অন্য ছেলে মেয়েরাও তাদের ফলো করতে চাইছে। এভাবে চলতে থাকলে তো ছেলে মেয়েদের কন্ট্রোল করা কঠিন হবে। কাজল রেখার চোখ ছোট হলো। তিনি কিছু বলতেও পারছিলেন না। কথা বলতে গিয়ে বুঝতে পারলেন তাঁর কথায় জড়তা তৈরি হচ্ছে। তবুও সঙ্কোচ রেখে বললেন,,,,,
-আচ্ছা আমি বিষয়টা দেখছি।
-আপা আপনি আমার কথায় কিছু মনে করবেন না। আজকে আমি এসে সুন্দর করে বলে গেলাম। কাল হয়তো পাড়াপড়শি সবাই একজোট হয়ে বলবে।
ওরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রেমালাপ করছে। এগুলো তো ভালো না। কাজল রেখা মাথা নিচু করলেন। প্রিতির গাঁ জ্বলে যাচ্ছে কথা গুলো শোনে। সে চোখ মুখ লাল করে বলে,,,,,
-নিজের ঘর সামলান। আপনার নিজের ছেলেমেয়ের কৃত্তি দেখেছেন? আমার আপু যথেষ্ট শালীনতা বজায় রেখে চলা ফেরা করে। রাস্তায় কথা বললেই প্রেমালাপ হয়ে যায় না।
সেদিন তো দেখলাম অটোতে উঠে আপনার ছেলে একটা মেয়েকে কিস করেছে। ওগুলো কি?? প্রিতির কথা শোনে মহিলা চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলেন,,,,,
-আমি তোমাদের ভালর জন্যই বললাম। উপকার করতে এসে জুতার বাড়ি খেতে হবে জানলে আসতাম না। মিহিলা উঠে যায়। কাজল রেখা মেয়ের দিকে ধারালো চোখে তাকিয়ে বলেন,,,,
-প্রিতি, আমি তোদের এই শিক্ষা দিলাম??? প্রিতির মুখ কুঁচকে যায়। সে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,,,,
-মহিলা যে আপুকে খারাপ বলছিল। আমার আপু মোটেই খারাপ না। অবাক ভাইয়া খুব ভালো আম্মা। সে আপুর অসম্মান হবে এমন কিছু করে না। প্রিতি বসা থেকে উঠে নিজের রুমে চলে যায়। কাজল রেখা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেন। রিমি বলে,,,,,
-মা, ঐ মহিলার কথায় মন খারাপ করবেন না। অনু খুব ভালো মেয়ে। সে সব বুঝে। আপনার অসম্মান হবে এমন কাজ সে কখনও করবে না। কাজল রেখে উঠে দাঁড়ালেন। কিছুটা এগিয়ে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন,,,,,
-বউমা। আজ অবাক আর অনু আসলে দুজনকে আমার সাথে দেখা করতে বলবে। আমি ওদের সাথে কথা বলবো।
সূর্য লাল হয়ে গেছে। পশ্চিম দিকে হেলে গোলাবারুদের মতো হয়ে আছে। অবাক হাত দিয়ে ইশারা করে দেখিয়ে বলে,,,,,,
-অনু সূর্যটা দেখো। অনু চোখ তুলে সূর্যটার দিকে বিস্ময়ে তাকায়। অন্যদিনের তুলনায় সূর্যটা বেশি বড় দেখাচ্ছে। অনু বলে,,,,
-ওয়াও। কতো সুন্দর লাগছে। মনে হচ্ছে সূর্যটা আমাদের কতো কাছে। আর নদীর পানিটা দেখো। চিকচিক করছে। অবাক হাসে। অনু তাকিয়ে থাকে সুন্দর আকাশের দিকে।
অনু অবাকের সাথে একটা সুন্দর স্মরণীয় বিকেল কাঁটায়। সন্ধ্যার দিকে কিছুক্ষণ লেকের পাড়ে ঘুরে। চা খায়। তারা রাতে বাহিরে ডিনার করে বাসায় আসে। তখন রাত সাড়ে আটটা। অনু অবাক এক সাথে বাসায় প্রবেশ করে।
কাজল রেখা গম্ভীর মুখে ড্রয়িংরুমে বসে আছেন। অনু বাসায় প্রবেশ করে দেখে মাকে। মাকে এমন গম্ভীর দেখে অনুর কিছুটা ভয় কাজ করে। অনু কিছু না বলে অবাকের থেকে বিদায় নিয়ে নিজের রুমে যেতে নিলে কাজল রেখা ডাক দেন। অনু অনেকটা চমকে দাঁড়ায়। তিনি বলেন,,,,,,
-অবাক, অনু। তোদের দুজনের সাথে আমার কথা আছে। এদিকে আয়। অনু অবাকের দিকে তাকিয়ে দেখে অবাকও তার দিকে চেয়ে আছে। অনু ধীর পায়ে এগিয়ে আসে। অবাকও কিছুটা এগিয়ে এসে বলে,,,,,,
-কিছু বলবে ফুফি। কাজল রেখার গাঁ জ্বলে যাচ্ছে রাগে। লোকে কথা বলবেই না কেন? এতো রাতে একটা সাবালিকা মেয়ে ঘুরেফিরে বাসায় এসেছে। তাঁর এখন কথা বলতেও খারাপ লাগছে। কথা গুলো না বলেও থাকা যাচ্ছে না। তাই তিনি কঠিন গলায় বললেন,,,,,
-অবাক আজকের পর থেকে তুমি আর আমাদের বাসায় আসবে না। অনুর সাথে দেখাও করবে না। আর অনু, তোকেও বলছি। তুই নিজেও কখন অবাকের সাথে দেখা করবি না।
মায়ের এমন কথা শোনে অনুর বুক কেঁপে উঠে। অবাকও বেশ হতবম্ভ হয়ে তাকান অনুর দিকে। তারপর ফুফির দিকে এগিয়ে গিয়ে বিচলিত কণ্ঠে বলে,,,,,,
-কেন ফুফি? আমি কি ভুল কিছু করেছি? করলে বলো আমি সংশোধন করার চেষ্টা করবো।
-আমি চাইনা কেউ আমার দিকে আঙ্গুল তোলে কথা বলুক। আজ তোমাদের জন্য একজন বাড়ি এসে বলে গেলো। কাল প্রতিবেশিরা সবাই আসবে। অনুর হাত পা কাঁপছে। সে এক হাত দিয়ে আরেক হাত মুচড়ে বলে,,,,
-কিন্তু মা আমরা তো,,,,, কাজল রেখা মেয়েকে কথা বলতে দিলেন না। তিনি চোখ রাঙিয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,,,
-আমি যা বলবো তাই। এর পর কোনো কথা বলবে না। অবাক কাজল রেখার সামনে পয়ের উপর ভর দিয়ে বসে বলে,,,,
-ফুফি আমি অনুকে ভালোবাসি। ওকে না দেখে কিভাবে থাকবো? ফুফি প্লীজ তুমি কঠিন কোনো উপদেশ আমাদের দিও না। আমি অনুকে ছাড়া থাকতে পারবো না। ওর পরীক্ষা শেষ হলেই আমি আম্মাকে বলবো বিয়ের কথা বলতে।
-বিয়ের পর তোমাদের যা মন চায় তাই করো। বিয়ের আগে আর দেখা করতে এসো না। ততদিন ফোনে কথা বলো। এখন বাসায় যাও। অবাকের চোখ ছলছল করছে। বুকে হাহাকার। হাত পাও অবশ হয়ে আসছে। অবাক করুণ স্বরে বলে,,,,,,
-ফুফি,,,,,,
-আমি কিছু শোনতে চাইনা অবাক। আমাকে কিছু বলে লাভ হবে না।বাসায় যাও। অনু, নিজের রুমে যা। কাজল রেখা বসা থেকে উঠে। অবাকের মনটা ভার হলো।
সে মাথা নিচু করেই বসে আছে। পৃথিবী সবচেয়ে অসহায় মানুষ মনে হচ্ছে অবাক কে। অবাককে এভাবে দেখে অনুর কান্না আসছে। তার মনে হচ্ছে সে অবাকের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। অনুর বুক টিপটিপ শব্দ করছে।
অবাক নিজের বাসায় প্রবেশ করে অসহায় ভঙ্গিতে। যাওয়ার সময় কয়েকবার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। দেখা না হলেই ভালোবাসা শেষ হয়ে যায়? যায় না। তবুও অবাক নিজের মনকে বুঝাতে পারছে না।
আসার সময় অনুকে আশ্বাস দিয়ে এসেছে। এমন একটা ভাব নিয়েছে যে কিছুই হয়নি। অথচ নিজেই ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। বিলকিস বেগম ছেলেকে এভাবে দেখে বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে। তিনি ছেলের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন,,,,,,
– কি হয়েছে অবাক? শরীর খারাপ??? অবাক মায়ের দিকে তাকিয়ে একটা মলিন হাসি দেয়। ইচ্ছে হলো মাকে সবটা খুলে বলতে। কিন্তু বললো না। কিছুদিন পর অনুর পরীক্ষা। এখন ঝামেলা হলে পরীক্ষা খারাপ হবে।
না হয় কষ্ট করে এই কয়দিন অপেক্ষা করলো। অনুর পরীক্ষা শেষ হলেই সমস্ত কষ্টের অবসান হবে। মাকে বললে এখনি হয়তো বিয়ে নিয়ে অস্থির হয়ে উঠবে। মা অনুকে খুবই পছন্দ করে।
এমন একটা মেয়েকে কেউ অপছন্দ করবে না। রূপে গুণে অনুর মতো মেয়ে হয় নাকি? অবাক নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,,,,
– না আম্মা। আমি ভালো আছি।
– তাহলে তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
– সারাদিন কাজ করেছি তো তাই ক্লান্ত লাগছে। বিলকিস বেগম কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলেন ছেলের দিকে। কিছুতেই মিলাতে পারছেন না। তিনি অবাকের চুলে হাত দিয়ে বললেন,,,,
– আচ্ছা তাহলে যা বেশি করে পানি দিয়ে গোসল করে খেতে আয়। ফ্রেশ হলেই ভালো লাগবে।
– আম্মা, তুমি খেয়ে শোয়ে পড়ো। আমি খাবো না। খেয়ে এসেছি বাহির থেকে। অবাক নিজের রুমে চলে আসে। বিলকিস বেগম বিস্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। বুঝার চেষ্টা করেন ছেলেকে।
অনু নিজের রুমে গিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে। অনুর কান্না দেখে প্রিতি বিচলিত হয়ে যায়। প্রিতি বিছানায় বসে পড়ছিল। অনুর হঠাউ এভাবে কাঁদতে দেখে হয়ে একপাশে বই রেখে বিছানা থেকে নেমে অনুকে ধরে। অনু প্রিতিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে। প্রিতি বলে,,,,,,
-আপু, কি হয়েছে তোর? কাঁদছিস কেন? অনুর কান্নার গতি বেড়ে গেলো। সে কান্নার জন্য কথা বলতে পারছে না। কাঁদতে কাঁদতে অনুর হেছকি উঠে যায়। কিছুক্ষণ পর কান্নার গতি কমে আসে। অনু প্রিতিকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। হাত দিয়ে নিজের নাক মুখ মুছতে থাকে।
প্রিতি অনুকে টেনে বিছানায় বসিয়ে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দেয়। অনু গ্লাসটা হাতে নিয়ে পানিটা খায়। প্রিতি জিজ্ঞেস করে,,,,,,,
-এভাবে কাঁদছিলি কেন আপু?
-আম্মু আমাকে বলে দিয়েছে আজকের পর থেকে অবাকের সাথে দেখা না করতে।
-এই নর্মাল বিষয়টা নিয়ে এতো কাঁদার কি হলো? বলেছে বলেছে। অনু প্রিতির মুখের দিকে হা হয়ে তাকায়। প্রিতি বলে,,,,,,
-ভিডিও কলে কথা বলবি। ভার্সিটিতে গিয়ে কথা বলবি। মাঝে মাঝে দূরে কোথাও ঘুরতে যাবি।
-কিন্তু আম্মু যে মানা করলো।
-অবাক ভাইয়া এখানে না আসলেই তো হলো।
-আমি আম্মুকে ফাঁকি দিবো?
-দিতে না চাইলে দিবি না। তবে ভিডিও কলে কথা বলতে তো না করে নি। তাছাড়া তুই অবাক ভাইয়াকে বল বিয়েটা এবার করে ফেলতে। সব সমস্যা ডিসমিস।
-বিয়েতো করবেই। কিন্তু আমার পরীক্ষারর পর। আর এতোদিন কিভাবে,,,,,,,,
-শোন আপু, সিম্পল বিষয় নিয়ে কাঁদবি না। কাঁদতে হলে বিগ প্রবলেম নিয়ে কাঁদবি। তখন তোর সাথে আমিও কাঁদবো। দুজনে একসাথে কাঁদলে হবে কি জানিস??? অনু চোখ বড় বড় করে তাকায় প্রিতির দিকে। প্রিতি হেসে বলে,,,,,
-কষ্ট গুলো তাড়াতাড়ি ঝরে পড়বে। ইউনিক আইডিয়া না??? অনু না হেসে থাকতে পারলো না। প্রিতি এমন সব কথা কোথায় থেকে বের করে আল্লাহ জানে। প্রিতি অনুকে জড়িয়ে ধরে বলে,,,,,,
-আমার আপুকে হাসিতেই মানায়। কাঁদলে কেমন কাঁদুনে কাঁদুনে লাগে। অনু মৃদু হেসে বলে,,,,,
-স্টুপিড।
-আপু, এই স্টুপিডের একটা কথা শোন। ভালোবাসায় হাজার বাঁধা আসবে। কেঁদে নার্ভাস হয়ে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। কঠিন বাস্তবতায় বুদ্ধি দিয়ে সব হ্যান্ডেল করতে হবে।
অবাক নিজের রুমে এসে ফ্রেশ না হয়েই শুয়ে পড়ে। তার ভালো লাগছে না কিছু। ভীষণ খারাপ লাগছে। অনুকে না দেখে কিভাবে কাটবে তার সময়। ভাবতেই তার মনটা বিষণ্ণতায় চেয়ে যাচ্ছে। তার প্রচুর মাথা ধরেছে। মনে হচ্ছে মাথার শিরা গুলো ছিঁড়ে যাবে।
অবাক উঠে ওয়াশরুমে ঢুকে। ফ্রেশ হয়ে এসে আবার কিছুক্ষণ শুয়ে থাকে। কিন্তু মাথা ব্যথা কমছে না। এখন এক কাপ চা বা কফি হলে ভালো লাগতো। কিন্তু বিন্তি মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। অবাক উঠে যায় রান্না ঘরে। মায়ের রুমের লাইট অফ। মনে হয় ঘুমিয়ে গেছে ।
অবাক নিজেই এক কফি বানায়। কফিটা নিয়ে সোজা ছাদে চলে আসে। এতো নর্মাল একটা বিষয়ে মনটা এতো বিষণ্ণতায় ভরে যাওয়ার কি কারণ? মনটাকে স্থির করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে অবাক বাট পারছে না। মনের কাছে বারবার হার মানছে সে। আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবনায় ডুবে গেছে সে।
অবাকের ফোনটা কাঁপছে। এতো কিছু ভাবনায় কখন যে চোখের কোনায় পানি জমা হয়েছে অবাক নিজেও জানে না। অবাক পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখে অনু কল করছে। অবাক ফোনটা রিসিভ করে। অনু বলে,,,,,,
-কি করছো?
-ছাদে দাঁড়িয়ে আছি।
-তোমার মন খারাপ?
-না।
-আমি জানি তোমার মন খারাপ। অবাক চুপ করে থাকে। অনুও কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,,,
-অবাক
-শোনছি বলো।
-আমাদের দেখা হবে। আমরা ভিডিও কলে কথা বলবো। এখন আরো বেশি দেখা হবে। যখনই কথা বলবো তখনেই ভিডিও কল করবো। অবাক চুপ করে থাকে। অনুও চুপ হয়ে যায়। অনু বুঝতে পারছে অবাকের মনটা ভীষণ খারাপ। তার কি কম খারাপ লাগছে নাকি?
তারও কষ্ট হচ্ছে। রুমে এসে বেশ কিছুক্ষণ কান্নাও তো করেছে। প্রিতি অনেক বুঝিয়েছে। শান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। অবাককে এসব কথা বললে সে আরো ভেঙ্গে পড়বে। অবাক বলে,,,,,
-আমার সাথে দেখা না করে তুমি ভালো থাকবে অনু? অনুর কান্না আসছে। গলা ভারী হয়ে গেছে। থরথর করে কাঁপছে। সে কান্না আটকাতে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো। কিছুক্ষণ পরে সে স্থির কণ্ঠে বলে,,,,,
-থাকার কথা আসছে কেন? কথা হবে তো প্রতিদিন। প্রতিটা মুহূর্ত। শুধু,,,,শুধু সামনাসামনি দেখা করবো না। শেষের দিকে অনুর কণ্ঠটা কেঁপে উঠে। অবাক বুঝতে পারছে অনুও কষ্ট পাচ্ছে। সে শুধু একাই কষ্ট পাচ্ছে এমনটা নয়। অবাক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে,,,,,
-আই লাভ ইউ অনু। অবাকের একটা কথায় অনুর মন প্রফুল্ল হয়ে যায়। সে আনন্দিত কণ্ঠে বলে,,,,
-আই লাভ ইউ আনলিমিটেড অনুর সাহেব। অবাক হেসে দেয়। অনুও হাসে। আবার কিছুক্ষণ নীরবতা বিরাজ করে দুজনের মধ্যে।
কেউ বলার মতো কথা খুঁজে পাচ্ছে না। এমনিতে কথা শেষ হয় না। আজ বলার মতো কথা পাচ্ছে না। সময় কি অদ্ভুত। কতো রকম নিয়ম তার। কতো রকম খেলা করে মানুষের সাথে। অবাকের কফি শেষ।
সে মগটা উল্টেপাল্টে দেখছে। দুজন দুপাশ থেকে নিঃশ্বাসের শব্দ শোনছে। অনু বলে,,,,,
-আমরা কতো অল্পতেই অসন্তুষ্ট হই তাই না? অবাক ছোট করে উত্তর দেয়,,,
-হুম।
-দেখোতো আমরা পাঁচ বছর ধরে একজন আরেকজনকে ভালোবাসি। দেখা করি, কথা বলি। কতো দীর্ঘ সময় ধরে মহা খুশিতে আল্লাহ আমাদের রেখেছেন। অথচ অল্প সময়ের জন্য একটা পরীক্ষায় ফেলেছেন।
সেটাতেই আমরা কতটা আপসেট হয়ে গেছি। অসন্তুষ্টি প্রকাশ করছি। কষ্টে মরে যাচ্ছি। আমাদের সুখের মুহূর্ত গুলো কিন্তু দীর্ঘ ছিল। দুঃখটা ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু আমরা এই ক্ষণস্থায়ী দুঃখ বুকে পোষে সুখের দিনগুলোর কথা ভুলে যাচ্ছি।
অবাক, আমরা কিন্তু বেশিদিন কষ্টে থাকবো না। দুঃখের পর আবার সুখের দিন আসবে। অনুর কথাগুলো অবাক বিভোর হয়ে শোনছিল। সত্যি তো। আমরা কেমন আজব প্রাণী। কতো অল্পতেই আমরা ধৈর্য হারিয়ে ফেলি। আল্লাহর উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলি।
অবাক রেলিং এ হেলে দাঁড়ায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,,,,,
-এটা সত্যি বলছো অনু। তবে কি জানো, আমরা সুখের থেকে দুঃখকে বেশি প্রায়োরিটি দেই। তাই তো দুঃখটাকে এতো বড় মনে হয়। সব সময় ফিল করি। সুখটা এতোবার মনে আসে না।
কখনও কারো কাছে চোখের জল ফেলে বলেছো আলহামদুলিল্লাহ আমি অনেক হেপি আছি? বলোনি। হাসি মুখে কথাটা বলেছি। তখন চোখ দিয়ে জল আসে নি।
আমিও বলিনি। অথচ আজ যখন একটু নিয়মের ব্যতিক্রম হয়েছে তখন ইচ্ছে হচ্ছে চিৎকার দিয়ে কেঁদে বলি, ‘ আমি ভালো নেই। আমার এতো কষ্ট কেন?’
-ঠিক তাই। মন খারাপ করো না প্রিয়। আমাদের দুজনকে যদি দুজনের জন্য আল্লাহ বৈধ করে দিয়ে থাকে তাহলে আমরা আবার এক হবো। দুটি মন এক হবে। দুটি হৃদয় একাকার হয়ে যাবে ভালোবাসার স্বর্গে।
-অনু, এতো কিছুর পরও কষ্ট হবে । তুমি যে প্রতিদিন সেবন করা বিষাক্ত নেশা। যারা নেশা করে তারা একদিন নেশা করতে না পারলে পাগলের মতো বিহেভ করে। আমার অবস্থাও তেমন হবে। মাঝে মাঝে তোমাকে দেখার নেশায় পাগলামি করবো।
তারপর ধীরে ধীরে ছিঁড়া ফুলের পাপড়ির মতো নেতিয়ে যাবো। তবে আমি চেষ্টা করবো ভালো থাকতে। নেশা কাটিয়ে উঠতে। সেটা বেশিদিন পারবো না অনু। আমি তোমাকে চাই। তাড়াতাড়ি আমার কাছে ফিরে আসবে।
-আসবো। খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো।
প্রতিটা ভোরের মতো আজকেও একটা নতুন ভোর হলো। অবাক ফজরের সময় অনুর কলেই ঘুম থেকে উঠে । নামাজ পড়ে। হাঁটতে বের হয়। তাড়াতাড়ি বাসায় এসে রেডি হয়। প্রতিদিনের মতো আজও অনুকে দেখে অফিস যাবে।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যখন শার্ট ইন করে তখন মনে পড়ে ফুফির কথা গুলো। অনুর সাথে তো দেখা করা নিষেধ। অবাক থমকে দাঁড়ায়। বিছানায় বসে দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকে। বুকের ভেতরটা পিটপিট শব্দ করছে। কি অসহনীয় সেই শব্দ। সাথে তীব্র যন্ত্রণায় মাথা ব্যথা শুরু হয়েছে।
বিলকিস বেগমের চোখ রাত থেকেই অবাকের উপর। দিনাদিনি একটা ছেলে কেমন বদলে গেছে। মুখের হাসিটা আগের মতো লাগছে না। মনে হচ্ছে কৃত্বিম। জোর পূর্বক মুখে ধরে রেখেছে। বিলকিস বেগম অবাকের রুমে গিয়ে অবাকের পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলান।
অবাক মুখ থেকে হাত সরিয়ে মাকে দেখে বিস্মিত হয়ে বলে,,,,
-আম্মা তুমি এখানে? কিছু বলবে? বিলকিস বেগম অবাকের মাথায় হাতাতে থাকেন। অবাক অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে মাকে দেখতে থাকে। বিলকিস বেগম বলেন,,,,,
-তোর কি হয়েছে আমাকে বল। অবাক নিজেকে স্থির করে আমতা আমতা করে বলে,,,,,
-আমার কি হবে আম্মা? আমার কিছু হয়নি। আমিতো ভালই আছি।
-তুই সত্যি ভালো আছিস? আমার মনটা তাহলে কেন বলছে তুই ভালো নেই। তোর কোনো সমস্যা হয়ে থাকলে আমাকে খুলে বল। মায়ের কাছে কিছু লোকাতে হয়না। অবাক কিছুক্ষণ মায়ের মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে,,,
-আম্মা, আমি তোমার কোলে মাথা রেখে একটু শুলে তোমার কি বেশি কষ্ট হবে??? বিলকিস বেগম আদর মাখা কণ্ঠে বলেন,,,,
-কষ্ট হবে না। শো। অবাক একটা বাচ্চার মতো কাঁচুমাচু হয়ে মায়ের কোলে মাথা রাখে। আর বিলকিস বেগম পরম যত্নে ছেলের মাথায় হাত বোলাতে থাকেন।
চলবে———–