#অবাক_মেঘের_বাড়ি
পর্ব : ১৯
সুরমা
অনু বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে পুতি নিয়ে বসে। আবার ইউটিউব থেকে ভিডিওটা দেখে ঝাড়বাতি বানানোর জন্য ট্রাই করে। প্রিতি ফ্রেশ হয়ে নিচে চলে যায়। এমন সময় কাজল রেখা রুমে প্রবেশ করেন। তিনি দেখন অনু পুতি নিয়ে বসেছে বিছানায়। কাজল রেখা বিছানায় গিয়ে অনুর পাশে বসেন। অনু মাকে দেখে পুতিগুলো সরিয়ে রাখে। কাজল রেখা হেসে বলেন,,,,,,
-রেখে দিলি কেন? বানাবিনা?
-তুমি মনে হয় আমার সাথে কথা বলতে এসেছো। এই কাজটা করতে করতে কথা শোনলে না আমি তোমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনবো না এটা বানানোতে মনোযোগ দিতে পারবো। কোনোটাই ঠিকঠাক করা হবে না। তারচেয়ে তোমার কথাটা মনোযোগ সহকারে শুনি তারপর এটা বানাবো। আমার মনে হলো তুমি গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলবে। বলো কি বলতে চেয়েছিলে। কাজল রেখা নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন,,,,,
-আসলে রিয়াদ তোর জন্য একটা ছেলে দেখেছিল। কয়েকদিন আগে তোকে বলেছিলাম। কিন্তু তুই তখন মানা করেছিলি। বলেছিলি পরীক্ষা শেষ হোক। তখন আমিও রিয়াদকে না করেছিলাম। এখন তোর পরীক্ষা শেষ হয়েছে। রিয়াদ আবার বলছিল। সামনে শুক্রবার ওরা তোকে দেখতে আসতে চায়। মায়ের কথা শোনে অনু চমকে উঠে। বুকের ভেতরে থাকা হার্টবিটটা অসম্ভব গতিতে দৌঁড়াতে শুরু করে। অনু থুতলিয়ে বলে,,,,,,
-এতো তাড়াতাড়ি কেন? আরেকটু সময় নিলে হতো না? কাজল রেখা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,,,,,
-এখন কি পারফেক্ট সময় না? অনু মা আমার। কঠিন বাস্তবতাকে যত তাড়াতাড়ি আঁকড়ে ধরবি ততই মঙ্গল। প্রিতিও তো বড় হচ্ছে। তোর একবার প্রিতির কথাও চিন্তা করতে হবে। আমারও বয়স হয়েছে। কখন কি হয় আল্লাহ জানে। বুড়ামানুষদের বিশ্বাস থাকে না। তোর ভাই একা হাতে সব দিক সামলায়। তোর জীবনে এতো বড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে। তবুও সে তোর মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে আছে। আমরা সবাই তোকে ভালোবাসি। তোর ভালো চাই। অবাক তো বিয়ে করে পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন করেছে। তোর কি নিজের পরিবার নেই? তাদের প্রতি কি তোর কোনোই দায়িত্ব নেই? অনু মাথা নিচু করে। পরিবারের প্রতি অবশ্যই দায়িত্ব আছে। তার জীবনের কোনো কিছু পরিবারের উপর পড়বে এটা হয়না। তাকেও সবার প্রতি যত্নশীল হতে হবে। আর এক জীবনে তো অবাককে ভুলে যাওয়া সম্ভব হবে না। কিন্তু তবুও ভুলতে হবে। অনুর গলা ধরে যায়। অনু ধরা গলায় বলে,,,,,,,,
– ঠিক আছে। তোমাদের যা ভালো মনে হয় তাই করো। আমার কোনো কিছুতেই আপত্তি নেই। আমি চাইনা আমার কোনো প্রভাব তোমাদের উপর পড়ুক। কাজল রেখা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,,,,,
-আমি জানতাম তুই আপত্তি করবি না। তোর উপর আমার বিশ্বাস আছে। অনু জোরপূর্বক হাসি দেয়। কাজল রেখা অনুর দুগালে হাত রেখে কপালে চুমু খায়।
-দেখবি তুই সুখি হবি। আল্লাহ তোকে সুখি করবে। তোর মতো মেয়েকে আল্লাহ কষ্ট দিবে না। যাকে কপালে লিখা আছে সে অবশ্যই ভালো হবে। তোকে ভালোবাসবে। আমি আজকেই রিয়াদকে বলবো। তোর ডিসিশন শোনলে রিয়াদ খুশি হবে। অনু মৃদু হাসে। তবে বুকে হাহাকার করে উঠে। এটা তো কথা ছিল না। যাকে নিয়ে এতদিন স্বপ্ন দেখলো আজ তাকে নয় অন্য একজনকে বিয়ে করতে হবে। অনুর মনটা হঠাৎ করেই খারাপ হয়ে যায়। সবকিছু কেমন ধুয়াশা লাগছে। কাজল রেখা চলে গেলে অনুর চোখ জলে ভরে উঠে।
নতুন করে জীবনে আবার কে আসতে চলেছে আল্লাহ জানে। সেই মানুষটা কেমন হবে? তার সম্পর্কে সব কিছু জেনে কি মেনে নিবে? নাকি অবহেলার স্বীকার হবে? কিন্তু তার কাছে কিছু লুকাবে না অনু। সবকিছু বলবে। তারপর যদি মেনে নেয় তবেই বিয়েটা হবে। মিথ্যে দিয়ে নতুন জীবন শুরু করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই তার। অনু পুতি গুলো তুলে রাখে। এখন আর বানাতে ইচ্ছে করছে না। অনু বিছানা থেকে উঠে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। বিকেলটা কেমন নীল হয়ে আছে। আকাশের রং আজ এতো সুন্দর কেন? সাদা নীলে পুরোটা আকাশ ঢাকা। অনুর মনে হলো, এই বিকেলে এক কাপ চা হলে খারাপ হয়না। অনু ঘুরে ফিরতেই দেখে প্রিতি হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। অনু মৃদু হেসে ভ্রু উপর নিচ করে। প্রিতি হেসে বলে,,,,,
-চা নিয়ে এসেছি। অনু প্রিতির হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে দুটো কাপ হাতে। অনু হেসে বলে,,,,,,
-ভালো করেছিস। আমার ইচ্ছে করছিল চা খেতে।
-এজন্যই তো নিয়ে এলাম। প্রিতি এককাপ চা অনুর দিকে এগিয়ে দেয়। অনু চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে আবার বাহিরের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে বলে,,,,
-তুই কিভাবে জানলি আমার এখন চা খেতে মন চাইছে? প্রিতি অনুর কাঁধে নিজের থুতনি রেখে বলে,,,,
-মনের টান ম্যাডাম। মনের টান। এটাকে ভালোবাসা বলে। অনু হেসে চায়ে চুমুক দেয়। প্রিতি চেয়ার টেনে বসে।
-আপু তুই সত্যিই খুবই ভালো। প্রিতির কথা শোনে অনু প্রিতির দিকে ফিরে তাকিয়ে বলে,,,,,
-আমি আবার কি করলাম?
-এতো বড় একটা আঘাত পেয়েও তুই অবাক ভাইয়ার প্রতি বিন্দুমাত্র অভিযোগ করিস নি। রাগ দেখাস নি। আজ আবার অবাক ভাইয়ার বউয়ের সাথে কি সুন্দর আচরণ করলি। আমি হলে কিন্তু তার উল্টো হতো। আমি তোর মতো এতো মহৎ না। আবার নিজের জীবন নিয়েও নতুন করে ভাবছিস। কারো মন যদি বড় না হয় তাহলে কেউ এতো সুক্ষ আর মহৎ চিন্তাভাবনা করতে পারবে না। অনু মৃদু হেসে আবার আকাশের দিকে তাকায়। শীতল কণ্ঠে বলে,,,,
-আকাশে তো মেঘ জমে। সেই মেঘ কি সব সময় থাকে? বৃষ্টি এসে মেঘ ধুয়ে আকাশ আবার পরিষ্কার করে দেয়। আর সূর্য তার উত্তাপে বৃষ্টিকে শুকিয়ে ফেলে। চাঁদ আকাশে আলো দিয়ে ঘন অন্ধকার দূর করে ফেলে। জীবনটাও এরকম। সুখ-দুঃখ আসে আবার যায়। একজনের আগমন আরেকজনকে দূরে সরিয়ে দেয়। স্বপ্ন সবাই দেখে। সবার স্বপ্ন পূরণ হয়না। তবে আল্লাহ কাউকেই নিরাশ করেন না। মানুষের চাওয়া পাওয়ার থেকে বেশি কিছুই দিয়ে দেন। প্রিতি উঠে এসে অনুকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,,,,,
-আপু এজন্য তোকে আমরা সবাই খুব ভালোবাসি রে। অনু এক হাত প্রিতির হাতের উপর রেখে বলে,,,,,
-আমিও।
অবাক আর অফিস যায় নি। অনুর সাথে কথা বলার পর অফিস যাওয়ার ইচ্ছেটা একেবারে শেষ হয়ে গেছে। অবাকের ভাবতেই খুব খারাপ লাগছে যে অনু তাকে আর ভালোবাসে না। আগের মতো আর তার কথা ভাবে না। তাকে তার জায়গা থেকে সরিয়ে ফেলেছে। অবাকের চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। এটাতো তার প্রাপ্য। সে নিজেই তো পাপী। অনুর তো কোনো দোষ নেই। জীবনটা যদি এমনই হওয়ার কথা ছিল তাহলে হৃদয়ে ভালোবাসা তৈরি হয়ে এতটা কষ্ট দেওয়ার কি প্রয়োজন ছিল? অবাক বিছানায় হেলে শুয়ে থাকে। আর অনুর বলা কথা গুলো ভাবতে থাকে। এটা ঠিক, মেঘের কোনো দোষ ছিল না। তার জীবনের কোনো কিছুর জন্যই মেঘ দায়ী নয়। সে নির্দোষ। তবে দোষ কার ছিল? ভাগ্যের?
বিলকিস বেগম দুদিন ধরে খেয়াল করছেন মেঘের মন খারাপ। আজ মেঘকে অন্য রকম লাগছে। বিয়ের পর থেকে মেয়েটা একবারের জন্যও কোথাও যায় নি। এক জায়গায় বসে আছে। হয়তো এজন্য আরেকটু বেশি খারাপ লাগছে মেয়েটার। অবাকের সাথে সম্পর্ক তেমন ভালো নয় এটাও তিনি বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু সম্পর্ক তো এমন ভাবে চলতে পারে না। সব ঠিক করতে হবে। অবাকের মনে মেঘের জন্য একটা জায়গা তৈরি করতে হবে। আর সেটা মেঘকেই করতে হবে। বিলকিস বেগম নিজে নিজেই অবাকের রুমে আসে। অবাক বিলকিস বেগমকে দেখে শুয়া থেকে উঠে মায়ের কাছে ছুটে আসে। অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে,,,,,,,
– আম্মা তুমি এখানে? কোনো দরকার ছিল? আমাকে ডাকলে না কেন? তাহলে আমিই তোমার রুমে যেতাম। বিলকিস বেগম শান্ত কণ্ঠে বললেন,,,,
– আমিতো সারাক্ষণ রুমেই বসে থাকি। হাঁটতে তো আর পারি না। এই হুইলচেয়াটাই এখন পায়ের কাজ করে। তাই ইচ্ছে করে এটার সাহায্যেই একটু রুম থেকে বের হই।
– বাহিরে ঘুরতে যাবে? আমি নিয়ে যাবো? বিলকিস বেগম মৃদু হেসে বললেন,,,,,
– না না। বাহিরে নিয়ে যেতে হবে না। বাসার ভেতরে একটু ঘুরতে পারলেই শান্তি।
– আম্মা, তোমার শরীর কি আগের থেকে ভালো আছে?
– আমার শরীর ভালোই আছে। এখন যদি হাঁটতে পারতাম তাহলেই হতো। আসলে আমি আসছিলাম তোর সাথে কিছু কথা বলতে।
– হ্যাঁ আম্মা বলো কি বলবে।
– কয়দিন ধরে খেয়াল করছি মেঘের মন খারাপ। মায়ের কথা শোনে অবাক মাথা নিচু করে ফেলে। বিলকিস বেগম নিঃশ্বাস ফেলে আবার বলেন,,,,
– মেয়েটা এতদিন ধরে এখানে পড়ে আছে। এই বয়সে তো মেয়েরা ছুটে বেড়ায়। কিন্তু ও বন্দি হয়ে আছে। আমি বলছি কি তুই মেঘকে নিয়ে কক্সবাজার সেন্টমার্টিন থেকে ঘুরে আয়। তোরও ভালো লাগবে। মেঘেরও মনটা ভালো হবে। ও ছোট মানুষ। ওখানে তো যায়ও নি। নতুন জায়গায় গেলে ওর মনটা ভালো হয়ে যাবে। অবাক হতভম্ব। আম্মা এটা বলতে এসেছে? অবাক বুঝতে পারছে না আম্মাকে কিভাবে না করবে। সরাসরি তো না বলাও যাবে না। কিন্তু মেঘকে নিয়ে কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে নেই তার। অবাক আমতা আমতা করে বলে,,,,
– আম্মা তোমাকে এই অবস্থায় রেখে আমরা ঘুরতে যাবো তা তো হয়না। তুমি সুস্থ হও তারপর যাবো।
– আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। ডাক্তার আছে বিন্তি আছে। তোর মামাকেও নাহয় বলবো কয়দিন এসে থেকে যেতে।
– আম্মা তা নাহয় বুঝলাম। কিন্তু এখন তো অফিসে প্রচুর কাজ।
– কাজ তো সব সময় থাকে। তাই বলে কি সারাক্ষণ কাজ নিয়েই পড়ে থাকবি? কয়েকদিনের জন্য ছুটি নে অফিস থেকে। বলবি নতুন বিয়ে করেছি বউ নিয়ে ঘুরতে যাবো। অবাকের শরীর ঘেমে যায়। কি মুসিবত। আম্মা দেখছি কথার পিটে কথা লাগিয়ে রেখেছে। অবাক চুপচাপ দাঁড়ায়ে থাকে। বিলকিস বেগম অবাকের মতলব বেশ ভালোই বুঝতে পারছেন। তিনি বলেন,,,,,
– ম্যানেজার সাহেবের কাছে কল দিয়ে ফোনটা আমাকে দে। আমি কথা বলছি। কয়েকদিন কাজ কর্ম উনি সামলে নিবেন। অবাক আম্মার কাছে এসে অনুরোধের কণ্ঠে বলে,,,,,
– আম্মা আমি বলছি কি, কয়েকদিন পর মেঘকে নিয়ে ঘুরতে যাবো। ততদিনে কাজ কর্ম সব গুছিয়ে ফেলবো। বিলকিস বেগম নাছোড়বান্দা কণ্ঠে বলেন,,,,,
– তোরা কালকেই যাবি। সব ব্যবস্থা আমি করবো। তোর মামাকে কল দিয়ে বলেছি তোর আর মেঘের জন্য যেন বিমানের টিকেট কাটে। আম্মার কথা শোনে অবাক হা হয়ে যায়। আম্মা সব ঠিক করে এখন এসে বলছে? বিলকিস বেগম আবার বললেন,,,,
– কি হলো? কল করে দে আমি কথা বলছি। অবাক ভালোই বুঝতে পারছে আম্মা তাকে এত সহজে ছাড়বে না। সে অসহায় কণ্ঠে বলে,,,,,,
– তোমাকে বলতে হবে না। আমি বলে নিবো।
– আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে ব্যাগপত্র গুছিয়ে নে। তোর মামা রুমও বুক করে রাখবে। ওসব নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। কয়দিন মেয়েটাকে নিয়ে নতুন জায়গায় ঘুর। দেখবি মেয়েটা কতো খুশি হয়। আর এবার থেকে ওকে একটু সময় দে। তোরেই তো বউ। ঘরের বউ সুখে থাকলে আল্লাহও খুশি হয়। ওর এতো চাওয়াও নেই। অল্পতেই খুশি হয় মেয়েটা। ওর দিকে একটু নজর দে। ওকে একটু ভালোবাস। ও বড্ড ভালোবাসার কাঙ্গাল।
অবাক ব্যাগ গুছাতে আলমারি খুলে। সাথে সাথে কতোগুলো প্যাঁচানো আর্ট পেপার গড়িয়ে নিচে পড়ে। অবাক বিরক্তি নিয়ে বলে,
-এসব কাগজ কি এখানে রাখার জায়গা? আলমারিতে একটুকুও ফাকা নেই। কিসব দিয়ে ভরে রেখেছে। এই মেয়েটাকে যে কি করতে ইচ্ছে করছে। অবাক বিরক্তি নিয়ে কাগজ গুলো ফ্লোর থেকে তুলে আলমারিতে রাখতে গিয়ে আটকে যায়।
কিছু একটা চিন্তা করে কাগজ গুলো আবার হাতে নেয়। কি আছে এই কাগজে? যে আলমারিতে এতো যত্ন করে রাখতে হবে। হাজারটা প্রশ্ন মনে নিয়ে কাগজ গুলো খুলে অবাক রীতিমতো চমকে যায়। কাগজে পেন্সিল ক্র্যাচে একটা সুন্দর বাড়ির আঁকা। বাড়িটার উপরে সুন্দর করে আর্ট করা
‘অবাক মেঘের বাড়ি’
আবার নিচে লিখা আর্ট বায় মেঘ। তারিখ এবং সালও দেওয়া আছে। ৫ বছর আগে আঁকা ছবি। অবাকের কপালে ভাজ পড়ে। অবাক চিন্তা করে পাঁচ বছর আগে এই মেয়ে কতটুকু বড় ছিল? কি বা বুঝতো? আর এখনেই কি বুঝে প্রেম ভালোবাসার? অবাক নিচের কাগজটা হাতে নেয়। অবাকের একার একটা ছবি আঁকা। যে কেউ দেখলেই বুঝতে পারবে এটা অবাকের চেহারা। মেঘের আর্ট দেখে অবাক বিস্মিত হতে থাকে। এতো পিচ্চি মেয়েটার এতো প্রতিভা! গানের গলাও অসম্ভব মিষ্টি। সুযোগ পেলে মেঘ অনেক কিছু করতে পারবে। অবাক পরের কাগজটা হাতে নেয়। এই আর্ট পেপারে অবাক আর মেঘের ছবি এক সাথে আঁকা হয়েছে। যার জন্য অবাক মুটেও প্রস্তুত ছিল। ছবিটা অবাকের হৃদয়ে বড়সড় একটা ধাক্কা দেয়। তবে মেঘের প্রশংসা না করে পারা গেলো না। নিখুঁত হাতের অবিশ্বাস্য সুন্দর্যে চেয়ে গেছে ছবিটা। অবাক একে একে সব গুলো ছবি দেখে। অনেক গুলো ছবি। কতো গুলোতে অবাক একা আবার কতগুলোতে মেঘ সঙ্গে আছে।
অবাক কি বলবে বুঝতে পারছে না। এগুলোর জন্য তার রাগ করা উচিত নাকি মেঘের শিল্পকর্মের জন্য প্রশংসা করা উচিত? উত্তরটা পেলো না অবাক। কিন্তু মনে বিন্দু পরিমাণ রাগও জমলো না। অবাক ছবিগুলো হাতে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ বিছানার উপর বসে থাকে। সে নির্বাক। নিজেকে সামলে নিতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগে তার। তারপর পেপার গুলো আবার আগের মতো আলমারিতে রেখে দেয়। অবাক টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে। একটু পরেই বের হতে হবে। ৩.৪৫ এর টিকিট কাটা আছে। এখন বাজে ১২.২২মিনিট। রেডি হতে হতে একটার উপরে বাজবে। কমপক্ষে ১ দেড় ঘণ্টা সময় হাতে নিয়ে বের হতে হবে। এখান থেকে এয়ারপোর্ট যেতে কতক্ষণ সময় লাগে ঠিক নেই। অনেকসময় জ্যামেই আটকে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা । ভাগ্য ভালো হলে আধ ঘণ্টা ৪০ মিনিটে চলে যাওয়া যায়। অথচ পথটা ২০ মিনিটের।
মেঘ অনেক্ষণ আগে তৈরি হয়ে বিলকিস বেগমের রুমে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে। বিলকিস বেগম খাটের মাথায় হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছেন। মেঘ রেডি হয়েছে ২০ মিনিট আগে। তার যেন তর সইছে না। ইচ্ছে করছে উড়ে চলে যেতে। আবার টেনশনও হচ্ছে। বাপরে বাপ। একটা রাগী গুমরা মুখো ছেলের সঙ্গে ঘুরতে যাচ্ছে। রাগে যদি কখনও নদীতে ফেলে দেয়? ভাবলেই মেঘের শরীরে লোমগুলো খাড়াখাড়া হয়ে যায়। মেঘ মুখটা বাচ্চাদের মতো করে বলে,,,,,
-আম্মা তুমিও আমাদের সাথে চলো। বিলকিস বেগম মৃদু হেসে বলেন,,,,
-এখন নিয়ে এই কথাটা ৫২ বার বলেছিস।
-তবুও তো তুমি রাজি হচ্ছো না
-এই অবস্থায় আমি গিয়ে কি করবো বলতো?
-আমাদের সাথে ঘুরবে।
-আমি কি এখন আর হাঁটতে পারি? আর ওখানে বালুময় জায়গা। চেয়ারের চাকাও ঘুরবে না। আমি গেলে তোরাও ঘুরতে পারবি না শান্তিতে। তারচেয়ে তোরা গিয়ে ঘুরে আয়। তারপর যদি আমি সুস্থ হই তখন নাহয় আবার সবাই মিলে যাবো।
-কিন্তু তোমাকে একা রেখে যেতে ইচ্ছে করছে না।
-আমি একা কোথায়? বিন্তি আছে। ডাক্তার আছে। তোর মামাও আসবে। আমাকে নিয়ে চিন্তা করবি না। তোরা যা। ঘুরেফিরে আনন্দ কর। মেঘের মুখটা তবুও কাঁচুমাচু করে রাখে।
-ওখানে আমার একা একা লাগবে। তাইতো তোমাকে এতো রিকুয়েস্ট করছি। বিলকিস বেগম সোজা হয়ে বসে মেঘের মাথায় হাত বুলিয়ে আশ্বাস দিয়ে বলেন,,,,,
-একা কোথায়? অবাক তো সাথে যাচ্ছে। মেঘ ঠোঁট ভাঙ্গে। একদম বাচ্চাদের মতো করে বলে,,,,,
-তোমার ছেলের বিশ্বাস নেই। আমাকে যদি কোথাও বিক্রি করে দেয়। বিলকিস বেগম মেঘের কথা শোনে একদম হা হয়ে যান। মেঘ জিভে কামড় দেয়। আমতা আমতা করে বলে,,,,,
-না মানে,,,, বিলকিস বেগম হেসে দিয়ে বলেন,,,,,
-আমার ছেলেটা খুব ভালো। ওর মনটা কোমল। ওকে একটু সময় দে সব ঠিক হয়ে যাবে। মেঘ আর কিছু না বলে চুপচাপ বসে থাকে। কিছুক্ষণ পা ঝুলিয়ে আবার বলে,,,,,
-তোমার ছেলে এখনও কি করছে বলোতো? বিলকিস বেগম ভ্রু তুলে বলেন,,,,,,
-রুমে বসে থেকে কিভাবে বলবো সে কি করছে? তুই গিয়ে দেখ কি করছে।
-নিশ্চয় রেডি হচ্ছে। আচ্ছা আম্মা তোমার ছেলে এতক্ষণ ধরে রেডি হচ্ছে কেন? ছেলেরা কি এতো সাজগোজ করে নাকি? আমি কখন থেকে রেডি হয়ে বসে আছি। আর উনি এখনো সাজছেন?
-এখানে আমার কাছে বসে এতো কথা না বলে গিয়ে দেখলেই তো পারিস সে কি করছে। শাশুড়ির কথা শোনে মেঘ খাট থেকে নেমে বলে,,,,,
-আচ্ছা দাঁড়াও গিয়ে দেখে আসছি। মেঘ টিপটিপ করে পা ফেলে রুমে উঁকি দেয়। কিন্তু রুমে অবাককে দেখতে পায়না। তারপর ব্যালকনিতে গিয়েও দেখে অবাক নেই। মেঘ বিড়বিড় করে বলে,,,,,
-ওমা! উনিকি আমাকে রেখে চলে গেছেন নাকি? আমি কতক্ষণ ধরে রেডি হয়ে বসে আছি। আমাকে ডাকলও না? মেঘ মুখটা অসহায় করে রুমের মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে থেকে দাঁত দিয়ে হাতের নখ কোঁচাতে থাকে। অবাক একটা টাওয়াল পড়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়। এক হাত দিয়ে মাথার চুলের পানি ঝাড়তে থাকে। মেঘকে দেখেই থমকে যায়। মেঘ লাল শাড়ি পরেছে। চোখ ভর্তি কাজল। হাত ভর্তি রেশমি চুড়ি। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। মুখে কোনোরকম মেকাপ নেই। তবুও মেঘকে লাল পরীর বাচ্চা মনে হচ্ছে। মেঘের চোখে মুখে যেন পৃথিবীর সব মায়া এসে জড়ো হয়েছে। অবাক আগে কখনও মেঘকে এরূপে দেখে নি। এ যেন স্বর্গ থেকে চলে আসা কোনো অপ্সরী। অবাক ঘোরের মধ্যে চলে যায়।
মেঘও অপলক দৃষ্টিতে অবাকের দিকে তাকিয়ে থাকে। অবাকের শরীরে কোনো জামা নেই। শুধু একটা টাওয়াল পরে আছে। অবাককে এমন অবস্থায় আগে কখনও দেখেনি মেঘ। অবাকের ফর্সা প্রসস্ত বুকে ঘন কালো লোমে আবৃত। মাত্রই গোসল করার কারনে লোম গুলো ভিজে বুকের সাথে লেপ্টে আছে। লোমের একটা সরু রেখা বুক থেকে নাভির কাছে নেমে এসেছে। যাকে চাষের জমির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সরু খাল বলা যায়। হাত দুটিও লোমে ঢাকা। হাটু থেকে নিচ পর্যন্ত পা গুলো দেখা যাচ্ছে।
পায়ের লোমগুলো অসম্ভব সুন্দর। বড় বড় লোম গুলো বেঁকে গোল হয়ে পায়ের সাথে মিশে আছে। লোমের সাথে হালকা পানি আটকে থাকার কারনে লোম গুলো কিছুটা সবুজ রং ধারণ করেছে। মেঘের কেবলেই মনে হচ্ছে এই লোম গুলো কোন উর্বর জমিতে চাষ করা ধানের অঙ্কুর। এর আগে সে কখনও এমন অদ্ভুদ জিনিস দেখে নি। ইশ! কি মারাত্মক জিনিস। অদ্ভুত ভালো লাগা। দেখেই মেঘের ভেতরে কেমন একটা ফিল হচ্ছে।
অদ্ভুত রকমের লোভ লাগছে মেঘের। ইচ্ছে করছে একবার এই বুকে হাত রাখতে। ইচ্ছে করছে একবার সেই বুকটায় ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁয়া পৌঁছে দিত। নাক ডুবিয়ে দিয়ে বিলিন হওয়া ঘামের ঘ্রানটা তুলে নিতে। মেঘ যেন এখন নিজের মধ্যে নেই। সে বেহায়ার মতো তাকিয়ে আছে অবাকের দিকে। কেউ যে একজন তাকে খেয়াল করছে সেই বোধটাও তার এখন নেই। মেঘের এমন চাহনি দেখে অবাকের প্রথম কিছুটা খারাপ লেগেছিল। লজ্জা এবং অস্বস্তি ফিল হচ্ছিল।
কিন্তু এখন আর তার লজ্জা লাগছে না। সেও ভ্যাবলার মতো লোভাতুর চোখে মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে। অবাক এখন মেঘের চোখে নেশা দেখতে পাচ্ছে। কালো হরিণের চোখ দুটি নেশায় কিছুটা ছোট হয়ে গেছে। মেঘের রক্তিম লাল ঠোঁট দুটি কাঁপছে। অসম্ভবভাবে আকর্ষণ করছে অবাককে। অবাকের কেবলেই মনে হচ্ছে এই ঠোঁট দুটি তাকে নিজের দিকে নিমন্ত্রণ করছে।
অবাক আনমনে মেঘের দিকে এগিয়ে আসে। মেঘ আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। দুজনের হার্টবিট সমান তালে চলছে। দূর থেকেই হয়তো একজন আর একজনের হার্টবিটের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। দুজনেই এক অদ্ভুদ নেশায় ডুবে যায়। কারো কোন হুশ নেই। অবাক এগিয়ে গিয়ে মেঘের সামনে দাঁড়ায়। দুজনের মধ্যে দুই ইঞ্চিও ব্যবধান নেই। দুজনের নিঃশ্বাস একত্রিত হয়ে লুটিয়ে পড়ছে। মেঘ হঠাৎ করেই আনমনে নিজের হাতের আঙ্গুল দিয়ে আলতো করে ছুঁয়ে দেয় অবাকের বুকের পশম গুলো।
সাথে সাথে তার হাত সুড়সুড়ি দিয়ে উঠে। মুহুর্তেই মেঘের সারা শরীর কেঁপে উঠে। সাথে অবাকের শরীরও কাটা দিয়ে উঠে। ঘোর কেটে যায় দুজনেরই। অবাক মেঘ দুজনেই ছিটকে দূরে সরে যায়। দুজনেই লজ্জায় কাঁচুমাচু হয়ে যায়। অবাক বুঝে উঠতে পারেনা সে কি করতে যাচ্ছিল। তার শরীর ঘেমে যায়। মনে অজানা এক অপরাধবোধ জন্ম নেয়। মেঘের তো লজ্জায় মাঠির নিচে চলে যেতে ইচ্ছে করছে। অবাক পড়লো এক অস্বস্তিকর অবস্তায়। কারো মুখ দিয়েই কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। অবাক মাথা নিচু করে দাঁড়ায়।
মেঘ লজ্জায় লাল হয় রুম থেকে এক দৌঁড়ে বের হয়ে যায়। অবাক হা করে তাকিয়ে থাকে দরজার দিকে। মেঘ বিলকিস বেগমের রুমে ঢুকে যায়। দৌঁড়ে বিছানায় উঠে শাশুড়ি মাকে জড়িয়ে ধরে হাঁপাতে লাগে। মেঘের এমন আচমকা কাজে বিলকিস বেগম হতভম্ব হয়ে যান। তিনি কিছু বুঝে উঠতে পারেন না। বিলকিস বেগম মেঘের পিটে হাত রেখে অধীর হয়ে জিজ্ঞেস করে,,,,,
– কি হয়েছে? এভাবে দৌঁড়ে এলি কেন? কিছু হয়েছে? মেঘ কোনো উত্তর দেয়না। বরং একটু আগে ঘটে যাওয়া কাণ্ড মনের ভেতরে ঘুরতে থাকে। আর সেটা ভেবে মেঘ নিজে নিজে ব্লাশিং হতে থাকে। সে নিজেও বুঝতে পারছিল না কি করতে যাচ্ছিল। লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিল মেঘের। মেঘ বিলকিস বেগমকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে ফেলে। মেঘ বুঝতে পারছে না একটু পর অবাকের সামনে সে কিভাবে গিয়ে দাঁড়াবে। ভীষণ লজ্জা লাগছে এখনেই। বিলকিস বেগম মেঘকে মেঘকে ঝাকি দিয়ে বলে,,,,
– কিরে কিছু বলছিস না কেন? কি হয়েছে বল? মেঘ মাথা তুলে বিলকিস বেগমের মুখের দিকে তাকিয়ে লজ্জামাখা হাসি দিয়ে আবার জড়িয়ে ধরে বলে,,,,,
– বলতে পারবো না। আমার লজ্জা লাগছে।
চলবে—-