#অবাক_মেঘের_বাড়ি

পর্ব : ১৬
সুরমা

রাত ২টা। অনুর চোখে ঘুম নেই। পড়ায়ও মন নেই। হঠাৎ করেই নিঃসঙ্গতা চেপে ধরেছে তাকে। প্রিয়জনকে হারানোর ব্যথা বুকে। অনু চেষ্টা করছে নিজেকে সামলাতে। কিন্তু পারছে না। বেহায়া মনটা মানছে না কোনো বাঁধা।

নিজেকে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু পারলো না। মনের সাথে যুদ্ধে হেরে যায় সে। না চাইতেও চোখ বেয়ে পানি আসছে। দিনের বেলায় কষ্ট গুলোকে পরাজিত করতে পারলেও রাতে পারে না।

রাতের বেলায় কষ্ট গুলো যেন একজোট হয়ে আক্রমণ করে। চোখের জলে বালিশ ভিজে যায়। অনু ওয়াশরুমে ঢুকে হাউমাউ করে কিছুক্ষণ কাঁদে। কান্না করার কারণে বুকটা কিছুটা হালকা হয়।

অনু ওজু করে বের হয়। তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করবে। গভীর রাতের আল্লাহ নাকি বান্দার মনের আশা পূরণ করে। আজ সেও আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে। প্রার্থনা করবে এই কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়ার।

আল্লাহ যেন তাকে রহমত দেন। অবাককে ভুলে থাকার রহমত। অবাককেতো ভুলে যাওয়ায় উচিত। মানুষটা এখন তার নয়। অন্য কারো। এই অবাকতো তার নয়। তাহলে এখন তার জন্য মনে ভালোবাসা থাকা পাপ। অনু জায়নামাজ পেতে নামাজে দাঁড়ায়।

শেষ রাতের দিকে অবাকের হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায়। চোখ মেলে দেখে মেঘ তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো ঘুমাচ্ছে। অবাক মেঘকে নিজের থেকে সরাতে গিয়ে দেখে মেঘ তার বুকের টিশার্ট হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছে।

অবাক মেঘের হাত সরাতে গেলে মেঘ অবাককে আরো শক্ত করে চেপে ধরে। অবাক কিছুক্ষণ মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকে। কি নিষ্পাপ লাগছে মেয়েটাকে। কি মায়াবী লাগছে মুখটা। যেন কোনো মেয়ে না, একজন ছোট এঞ্জেল ঘুমিয়ে আছে। এক মায়বী অপ্সরী।

মেঘের মুখে কিছু চুল উড়ে এসে পড়ছে। যখন চুল গুলো মুখের উপর এসে পড়ছে তখন মেঘ একটু নড়ে উঠে। দৃশ্যটা মুগ্ধকর। অবাক মেঘের মুখ থেকে আলতো করে চুলগুলো সরিয়ে দেয়। অবাকের আঙ্গুলে মেঘের স্পর্শ লাগতেই তার শরীর কেঁপে উঠে। এটা কি হচ্ছে?

অবাক মেঘকে জোরে ধাক্কা মারলে মেঘ খাট থেকে নিচে পড়ে যায়। ঘুমের মাঝে এমন আক্রমণের জন্য মেঘ প্রচুত ছিল না। হঠাৎ ধোম করে নিচে পড়ায় মেঘ ব্যথায় কাতর হয়ে যায়। সে কিছুই বুঝতে পারছে না কি হলো এটা। মেঘ হুরমুর করে উঠে বসে।

প্রচণ্ড ব্যথায় তার চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসে। মেঘ কষ্ট করে উঠে দেখে অবাক চোখ লাল করে তাকিয়ে আছে। ব্যথায় কুঁকড়ে গেছে সে। মেঘ কাঁদো কাঁদো গলায় জিজ্ঞেস করে,,,,,

-আপনি আমাকে ফেলে দিলেন কেন? আমি কি করেছি? অবাকের কান দিয়ে যেন আগুন বের হচ্ছে। অবাক কিছুতেই নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারছে না। হঠাৎ করে রাগে শরীর ফুটে যাচ্ছে তার। ইচ্ছে করছে টেনে মাথার সব চুল ছিঁড়ে ফেলতে।

অবাক উঠে মেঘের কাছে আসে। মেঘের হাত ধরে টেনে নিজের কাছে এনে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,,,,
-নিজেকে খুব বুদ্ধিমতী মনে করো না? নানা অজুহাতে আমার কাছে আসার বাহানা?

অবাকের কথায় মেঘ কিছুই বুঝতে পারছে না। সে ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। অবাক আবার মেঘকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়। অবাক আচমকা ধাক্কাতে মেঘ গিয়ে পড়ে টেবিলের উপর। টেবিলের কোনায় কাঁচে লেগে মেঘের হাত কেটে যায়। মেঘ আঁতকে উঠে। অবাক চিল্লিয়ে বলে,,,,,,,,

-আমি অনুকে ভালোবাসি। অনুকে ভালোবাসি আমি। আমার মন প্রাণ জুড়ে অনুর বসবাস। আমার এই মন থেকে অনুকে সরানো এতো সহজ নয়। আর ভুল করেও কখনও অনুর জায়গাটা নেওয়ার চেষ্টা করবে না।

নেক্সট টাইম যদি কখনও আমার কাছে আসার চেষ্টা করো তাহলে আমি তোমাকে খুন করে ফেলবো। মেঘের চোখে বন্য বয়। নীল আকাশ মেঘে ঢেকে যায়। মেঘ নিজের হাত চেপে ধরে বসে। হাত থেকে রক্ত ঝরছে। অবাকের মুখে অনুর কথা শোনে মেঘের বুক হাহাকার করে উঠে। চোখ থেকে রক্ত পানি হয়ে ঝরে পড়ে। মেঘ ধরা গলায় বলে,,,

-অনু আপুকে যখন এতোই ভালোবাসেন তখন তাকে রেখে আমাকে বিয়ে করলেন কেন?? আমার জীবনটা নষ্ট করলেন কেন? মেঘের কথা শোনে অবাকের রাগ হুড়হুড় করে বাড়তে থাকে। রাগে অবাকের চোখ থেকে আগুন বেরিয়ে আসে।

অবাক এগিয়ে গিয়ে মেঘের সামনে হাটুতে ভর করে বসে। বাম হাত দিয়ে মেঘের মুখ শক্ত করে চেপে ধরে বলে,,,,,,

-আমি তোমার জীবন নষ্ট করেছি? বরং তোমার জন্য আমার সাজানো লাইফটা নষ্ট হয়ে গেছে। আমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছো তুমি। আমার জীবন থেকে সুখটা চলে গেছে। তোমার জন্য আমি আমার ভালোবাসাকে হারিয়েছি। আমার অনুকে কষ্ট দিয়েছি। তোমার জন্য আমার অনু কেঁদেছে।

তোমার জন্য। সব তোমার জন্য। এর শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে। আমি তোমাকে ডিভোর্স দিবো। অবাকের কথা শোনে মেঘের চোখ বড় হয়ে যায়। মেঘের বুকে এক রাজ্যের ভয় জড়ো হয়। বুকে অসহনীয় ব্যথা আক্রমণ শুরু করে। হাত কেটে রক্ত পড়ছে। এতক্ষণ হাতের ব্যথায় সে অতিষ্ঠ হয়ে গেছিল। কিন্তু এখন মনের ব্যথার কাছে হাতের ব্যথা তুচ্ছ। মেঘ ভয়ার্ত চোখে অবাকের দিকে তাকিয়ে বলে,,,,,,

-আপনি এসব কি বলছেন???
-ঠিক বলছি। তুমি আমার জীবনের একটা অভিশাপ। একটা বিপদজনক কাটা। তোমাকে আমার জীবন থেকে উপড়ে ফেলতে না পারা পর্যন্ত আমি শান্তি পাবো না। অবাক আবার মেঘকে ধাক্কা দেয়। মেঘ ফ্লোরে পড়ে যায়।

অবাক ওয়াশরুমে ঢুকে। মেঘের চোখে শুরু হয় গরম পানির তোলপাড়। মেঘ হাত চেপে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। কষ্টে মেঘের বুক ফেটে যাচ্ছে। মানুষটা কতো রূপি। মেঘ ফ্লোরে কপাল ঠেকিয়ে বলে,

-আল্লাহ আমাকে আর কতো কষ্ট পেতে হবে। আর কতো কষ্ট পাওয়ার পর তুমি আমাকে একটু সুখ দিবে আল্লাহ? আমি যে আর নিতে পারছি না প্রভু। আমাকে তিলেতিলে মারার চেয়ে একবারে আমাকে তুমি নিয়ে যাও। সব কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা থাকলে এই কষ্টটা সহ্য করার ক্ষমতা নেই আমার।

অবাক ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখে মেঘ কাঁদছে। অবাক দূর থেকে বিরক্তি প্রকাশ করে বলে,,,,,,
– আমার সামনে এসব ন্যাকা কান্না করবে না। এসব ন্যাকা কান্না দেখলে মেজাজ বিগড়ে যায়। মেঘের কান্নার আওয়াজ কমে এলেও কষ্টের বন্যা বাড়তে থাকে।

সে মুখ চেপে কাঁদতে থাকে। অবাক রুম থেকে বের হয়ে যায়। মেঘ উঠে বসে। হাত থেকে এখনও রক্ত পড়ছে। মেঘ ড্রয়ার খুলে এইড বক্স বের করে। রক্ত পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে। হাতে ঠনঠন ব্যথা করছে। মাথাও ব্যথা করছে। তারচেয়ে বেশি ব্যথা করছে বুকের গহীনে। যে ব্যথা দেখাও যায়না বুঝানোও যায় না।

পৃথিবীর সব কষ্ট মেনে নেওয়া যায়। শুধু মেনে নেওয়া যায় না স্বামীর আঘাত। যে মানুষটার উপর ভরসা করে একটা মেয়ে নিজের শৈশবকালের স্মৃতিময় জায়গা। নিজের প্রিয়জন ছেড়ে চলে আসে। সেই মানুষটার কাছ থেকে যদি প্রাপ্য ভালোবাসাটুকু না পাওয়া যায় তাহলে বেঁচে থাকার আশাটাই বৃথা। তার স্বামী অন্য একজন মেয়েকে ভালোবাসে। কিভাবে মেনে নিবে এটা। মানা যাচ্ছে না। কিছুতেই মানা যাচ্ছে না। এর চেয়ে কঠিন শাস্তি হয়না।

অবাক বাসায় ফিরে ৮টার দিকে। মেঘ তখনও নিজের রুম থেকে বের হয়নি। একবারের জন্যও বিলকিস বেগমের সাথে দেখা করতে যায় নি। ইচ্ছে করছে না কোথাও যেতে। ইচ্ছে করছে না কারো সাথে কথা বলতে।

মেঘ ব্যালকনির গ্রিল ধরে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অবাক গুণগুণ শব্দ শোনতে পাচ্ছে। অবাক একটু এগিয়ে যায় ব্যালকনির দিকে। এখন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। মেঘ মৃদু কণ্ঠে গান গাইছে। মেঘের গানের কণ্ঠ বেশ মধুর। এতো সুন্দর একটা প্রতিভা আছে মেয়েটার অবাক কল্পনাও করেনি। অবাক স্থির হয়ে দাঁড়ায়।

এই মেঘলা দিনে একলা
ঘরে থাকেনাতো মন
কাছে যাবো কবে পাবো
ওগো তোমার নিমন্ত্রণ?

শুধু ঝরে ঝর ঝর
আজ বারি সারাদিন
আজ যেন মেঘে মেঘে
হলো মন যে উদাসীন।

শুধু ঝরে ঝর ঝর
আজ বারি সারাদিন
আজ যেন মেঘে মেঘে
হলো মন যে উদাসীন।

আজ আমি ক্ষণে ক্ষণে
কি যে ভাবি আনমনে
আজ আমি ক্ষণে ক্ষণে
কি যে ভাবি আনমনে

তুমি আসবে ওগো হাসবে
কবে হবে সে মিলন
কাছে যাবো কবে পাবো
ওগো তোমার নিমন্ত্রণ।

এই মেঘলা দিনে একলা
ঘরে থাকেনাতো মন
কাছে যাবো কবে পাবো
ওগো তোমার নিমন্ত্রণ?

অবাকের মন বিষণ্ণতায় চেয়ে যায়। সে বিড়বিড় করে বলে,
-কখনও পাবে না। কোনোদিন পাবে না। আমার প্রেমের নাম অনু। এখন আমার অপেক্ষার নামও অনু। অনু অনু অনু। অবাক গিয়ে আলমারি খুলে। আলমারির শব্দে মেঘের ধ্যান ভেঙ্গে যায়।

মেঘ ধীর পায়ে রুমে উঁকি দেয়। অবাকের সামনে যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু তাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। এই মুখটা দেখলেও মনে তৃপ্তি আসে। সুখ আসে। অবাক প্যান্ট শার্ট পরে অফিসের জন্য তৈরি হয়। মেঘ অপলকে অবাকের দিকে চেয়ে থাকে। মনে মনে বলে,

‘আমি যে আপনাকে ভালোবাসি অবাক বাবু। যখন জেনেছি আপনার সাথে আমার বিয়ে ঠিক তখন থেকে ভালোবাসি। আমি আপনার প্রোপাইলে ঢুকে চুপিচাপি আপনার ছবি দেখেছি। রাতে ঘুমানোর আগে আপনার ছবিটা বুকে নিয়ে ঘুমিয়েছি।

আপনার জন্য অপ্রিয় জিনিসগুলোকে প্রিয় জিনিসে রূপান্তর করেছি। আপনার জন্য হৃদয়ের গহিনে ভালোবাসা দিয়ে ঘর বুনেছি। তার নাম দিয়েছি
“অবাক মেঘের বাড়ি”।

নিজের অজান্তে আপনাকে আমার অভ্যাসে পরিণত করেছি। আপনাকে করেছি প্রিয় থেকেও প্রিয়। আপনি হলেন আমার অক্সিজেন। আপনাকে ছাড়া কিভাবে বেঁচে থাকি বলেন? আপনার উপর যে রাগ করতে পারিনা।

আমাকে কষ্ট দিয়ে যদি আপনি সুখ পান তাহলে আমি আপনার দেওয়া সমস্ত কষ্ট আমার প্রাপ্য ভালোবাসা হিসাবে গ্রহণ করবো। আমি সব কষ্ট নিরবে শয়ে যাবো। তবুও আমাকে দূর করে দিবেন না। আপনার কাছে থাকতে দিন।” মেঘ দেয়ালে পিট ঠেকিয়ে চোখ বুজে নিঃশব্দে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে।

অবাক অফিসের জন্য বের হয়। মেঘ রুমে এসেও কিছুক্ষণ কান্না করে। মানুষটা এতো কঠিন কেন? আর ভালোবাসা এতো অসহায় কেন? বিয়েতে নাকি আল্লাহ অশেষ রহমত থাকে? তাহলে কি মেঘের কান্নাটাই আল্লাহর দেওয়া সেই অশেষ রহমত?

মেঘ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ১০টার উপরে বাজে। এখনও একবার আম্মার সাথে দেখা হয়নি। আম্মা কি মনে করবেন?

মেঘ উঠে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসে। হাতে প্রচণ্ড পরিমাণ ব্যথা। ব্যথায় সে কুঁকড়ে যাচ্ছে। শরীরে জ্বর জ্বর ভাব চলে এসেছে। শরীরটা দুর্বল হয়ে আছে। ইচ্ছে করছে বিছানায় শরীর ছেড়ে দিতে। ক্ষতটা বেশ গভীর। কিন্তু এই ক্ষত কাউকে দেখানো যাবে না। বিলকিস বেগমকে তো আরো দেখানো যাবে না। তিনি দেখলে কষ্ট পাবেন। খুব কষ্ট পাবেন। মেঘ শাড়ির আঁচলে হাত ঢেকে বিলকিস বেগমের রুমে আসে।

বিলকিস বেগম শুয়ে আছেন। মেঘকে দেখে তিনি উঠে বসলেন। মেঘের মুখ বিষণ্ণতায় ঢেকে গেছে। সে বিলকিস বেগমের দিকে তাকিয়ে চাপা হাসে।

মেঘের করুণ চেহারা দেখে বিলকিস বেগমের বুক অজানা ভয়ে কেঁপে উঠে। বিলকিস বেগম উতলা হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,,,

– তোর কি হয়েছে শরীর খারাপ? মেঘ কিছু বললো না। নিঃশব্দে খাটে উঠে বিলকিস বেগমের বুকে মাথা রাখে।

মেঘের নীরবতায় বিলকিস বেগম আরো অস্থির হয়ে গেলেন। কি হয়েছে মেয়েটার? তাকে এমন নাজেহাল লাগছে কেন? অবাক কিছু বলেছে? বিলকিস বেগম মেঘের মুখে হাত রাখতেই ফিল করলেন মেঘের শরীর গরম। তিনি আকুল হয়ে মাথায় হাত রাখলেন। মেঘের শরীরে জ্বর। বিলকিস বেগম অধৈর্য হয়ে বললেন,,,,,

– তোর শরীরে তো জ্বর। জ্বর কিভাবে আসলো? ওষুধ খেয়েছিস? মেঘ মৃদু কণ্ঠে বললো,,,,
– ও কিছু হবে না। তুমি টেনশন করো না। সেরে যাবে। বিলকিস বেগম বললেন,,,,,
– এমনিতে অসুখ সারে না। দাঁড়া আমি ডাক্তারকে কল করছি।

– কল করতে হবে না আম্মা। বলছি তো কমে যাবে। তুমি আমাকে একটু আদর করে দাওতো। ওষুধের মতো কাজ করবে। মেঘ বিলকিস বেগমকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।

বিলকিস বেগম খুব ভালো করেই বুঝতে পারছেন কোনো কারণে মেঘের মন খারাপ। বিলকিস বেগম আদুরে কণ্ঠে বললেন,,,,,,
– তোর কি কোনো কারণে মন খারাপ? মেঘ ছোট করে উত্তর দেয়।
– উঁহু।

– অবাক কিছু বলেছে??? মেঘ চুপ করে থাকে।
– কি বলেছে বল আমাকে। মেঘ এবারো চুপ করে থাকে। বিলকিস বেগম আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না।

মেঘ বলতে না চাইলে তাকে জোর করলেও বলবে না। মেয়েটাকে একটু সময় দিতে হবে। বলার থাকলে সে নিজেই বলবে। বিলকিস বেগম মেঘের মাথায় বিলি কাটতে লাগলেন। মেঘ দুহাত দিয়ে বিলকিস বেগমকে আঁকড়ে ধরে। কিছুক্ষণ পর বিলকিস বেগম আবার জিজ্ঞেস করলেন,,,,,

– অবাক কি অফিসে চলে গেছে?
– হুম
– অবাক এখন আর সকাল বেলায় আমার কাছে আসে না। মাকে ভুলে গেছে এখন। মাকে দরকার পরে না আর। মেঘ কি বলবে ভেবে পেলো না। এর কোনো উত্তর তার জানা নেই।

বিলকিস বেগম মেঘের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,,,,,,
– চুপ করে আছিস কেন? কিছু বল।
মেঘ শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,,,,,,,

– আম্মা আমাকে কি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে? মেঘের এমন অদ্ভুত রকমের কথায় বিলকিস বেগম বিচলিত হয়ে গেলেন। তিনি চোখ বড় বড় করে বললেন,,,,

– কোথায় চলে যেতে হবে? কে বলেছে চলে যেতে হবে?
– কেউ বলেনি। আমি জিজ্ঞেস করছি। বিলকিস বেগম নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন,,,,,

– পাগলি মেয়ে। কোথায় যাবি তুই? এটা তোর বাড়ি। তুই এখানেই থাকবি। মেঘ অসহায় কণ্ঠে বলে,,,,
– এটা আমার বাড়ি না আম্মা। এটা তোমার ছেলের বাড়ি। বিলকিস বেগম মৃদু হাসলেন।

– আমার ছেলে তোর স্বামী। আর স্বামীর বাড়ি মেয়েদের আসল ঠিকানা। এ বাড়িতে এসেছিস বউ সেজে। যখন বের হবি তখন আবার বউ সেজে বের হবি। কিন্তু পার্থক্য হলো এসেছিলি লাল শাড়ি পরে বের হবি সাদা শাড়ি পরে। সব মেয়েরা এটাই স্বপ্ন দেখে। মেঘের গলা কাঁপছে। কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এখন কাঁদা যাবে না। মেঘ নিজের কষ্ট লুকিয়ে বলে,,,,,

– স্বপ্ন দেখলেই কি সবার স্বপ্ন পূরণ হয় আম্মা?
– কেন হবে না? স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরতে হবে। যাই হয়ে যাক কখনও হতাশ হলে চলবে না। কেউ যদি স্বপ্নকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে তাহলে তার স্বপ্ন একদিন না একদিন পূরণ হবেই।

আল্লাহর আছে মন প্রাণ খুলে চাইতে হবে। আল্লাহ কাউকে খালি হাতে ফেরান না।
– আমিও তো মন থেকে চাই। কিন্তু আল্লাহ কেন আমাকে দেখে না? বিলকিস বেগম এবার চুপ করে গেলেন। রুমে নীরবতা বিরাজ করলো। মেঘ নীরবতা ভেঙ্গে বললো,,,,,,,

– আম্মা তোমার কাছে অনু আপুর ছবি আছে? মেঘের মুখে হঠাৎ অনুর কথা শোনে বিলকিস বেগম চমকে গেলেন। তিনি বললেন,,,,,
– অনুর ছবি দিয়ে কি করবি?
– দেখবো। তোমার ছেলে একটা মেয়েকে ভালোবাসে। সে মেয়েকে দেখবো না? বিলকিস বেগম জিজ্ঞেস করলেন,,,,

– তুই জানলি কিভাবে? অবাক কি অনুর কথা তোকে কিছু বলেছে নাকি?
– না উনি কিছু বলেনি।
– তবে, তুই যে অনুর কথা বলছিস?
– তুমিই তো বলেছিলে তোমার ছেলে অনু আপুকে ভালোবাসে। আমার মনে হলো ওই আপুকে একনজর হলেও দেখা উচিত। বিলকিস বেগম নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,,,,,

– ওআচ্ছা। তাই বল।
-কি হলো বলো ছবি আছে কিনা?
-হুম আছে।
-তাহলে দেখাও না আমাকে।

বিলকিস বেগম নিজের ফোন হাতে নিয়ে অনুর ছবি বের করে বললেন,,,,,,,
– এই হলো অনু। মেঘ উঠে বসে। বিলকিস বেগমের হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে খুব কাছ থেকে সুক্ষ্মভাবে ছবিটা দেখে বলে,,,,,,

– কি সুন্দর আপুটা। মানুষও এতো সুন্দর হয়? বিস্ময়ে মেঘের চোখ ছোট ছোট হয়ে যায়। বিলকিস বেগম বললেন,,,,,,,,

– তুই কি কম সুন্দর নাকি? তুইও খুব মিষ্টি। মেঘ চোখ তুলে বিলকিস বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে,,,,,
– অনু আপুর কাছে আমি কিছুই না। আল্লাহ যাকে দেয় তাকে সব কিছু দেয়। অনু আপু এতো মিষ্টি আবার তোমার ছেলের মতো একজনের ভালোবাসাও পেয়েছে। একেই বলে কপাল।

– তুই এসব কি বলছিস বলতো? দে মোবাইলটা দে। বিলকিস বেগম মেঘের হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে নেয়। মেঘের খুব কান্না পাচ্ছে। এই প্রথম কারো জন্য হিংসা জন্ম নিয়েছে মেঘের মনে। একটা মেয়ে কতোটা ভাগ্য নিয়ে জন্ম নেয়।

তার নেই বলতে এমন কিছু নেই। সব আছে। অথচ তার জীবনে কিছুই পেলো না। জন্মের পর মায়ের ভালোবাসাও কপালে ছিল না। মাকে মা বলে জড়িয়ে ধরার সুখ পেলো না। আর যাকে বিয়ে করলো সেই মানুষটাও কতো রকম ভাবে অবহেলা করছে।

আঘাতের পর আঘাত দিয়ে যাচ্ছে। একবারও ভালোবেসে একটা কথা বলে নি। মেঘের বুক ফেটে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। মেঘ খাট থেকে নামে। বিলকিস বেগম বলেন,,,,,

– কিরে কোথায় যাচ্ছিস?
– রুমে।
– আরেকটু বস আমার কাছে।
– একটু পর আসবো। তুমি রেস্ট করো। মেঘ তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়। আরএকটু সময় থাকলে হয়তো বিলকিস বেগমের সামনেই কেঁদে দিতো সে।

চলবে——–

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here