#অবাক_মেঘের_বাড়ি
পর্ব : ১৪
সুরমা
অনু দৌঁড়ে গিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদছে শুরু করে। প্রথমবার অবাককে এতো হার্ট করে কথা বলেছে। অবাক অনেক কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু অবাককে তো বুঝতে হবে। সে একটা মেয়েকে বিয়ে করেছে।
অবাকের এমন আচরণে নিশ্চয় মেয়েটাও কষ্ট পাচ্ছে। সেই মেয়েটাতো কোনো ভুল করে নি। একটা নির্দোষ মেয়েকে অকারণে কষ্ট দেওয়ার কোনো অধিকার নেই কারো। তার নিজের কোনো আচরণে যদি একটা মেয়ের সংসার ভেঙ্গে যায় তাহলে সে নিজেকে কখনও ক্ষমা করতে পারবে না। সে নিজেও তো একজন মেয়ে।
আর একজন মেয়ে হয়ে কিভাবে আরেকটা মেয়ের জীবন নষ্ট করবে? কিভাবে আরেক মেয়ের সংসার ভেঙ্গে দিবে? তার ধারায় একাজ সম্ভব নয়। প্রিয়জনকে হারানোর কষ্ট যে কতো ভয়াবহ এটা সে হাড়েহাড়ে ঠের পাচ্ছে।
সে চায়না তার মতো একি কষ্ট অন্য কোনো মেয়ে পাক। তাকে ভুলতে হয়তো অবাকের কষ্ট হবে। তবুও ভুলতে হবে। কারণ, অবাক এখন একটা পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ। এই পবিত্র বন্ধনকে যদি তুচ্ছ করে। ইগনোর করে তাহলে সমাজের অন্যান্য মেয়েরা এই বন্ধনে আবদ্ধ হতে ভয় পাবে।
এই পবিত্র বন্ধনের প্রতি তাদের মনে নেগেটিভ ধারণা তৈরি হবে। অনু কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে, “অবাক আমি তোমাকে ভালোবেসেছি। যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন তোমাকে ভালোবাসবো। তোমার জায়গায় তুমি থাকবে।
তোমার জায়গা থেকেই তোমাকে খুব ভালোবাসবো। আমি চাই তুমি সুখী হও। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখী মানুষ হও। কিন্তু আমাকে ক্ষমা করো। আমি তোমার জীবনে আর ফিরে আসতে চাইনা। তোমার জীবনে যে নতুন মানুষের আগমন ঘটেছে তাকে কষ্ট দিতে চাইনা।
আমি এমন কোনো আচরণ করতে চাইনা যে আচরণে একটা মেয়ের জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। তাহলে সে নিজে মেয়ে হয়ে অন্য মেয়েদের উপর থেকে বিশ্বাস হারাবে। অন্য মেয়েদের প্রতি বাজে একটা ধারণা তৈরি হবে। সে ভালোবাসার উপর থেকে বিশ্বাস হারাবে।
আমি নারী। সেও নারী। আমরা তো একি লিঙ্গধারী। তুমি আমাকে ক্ষমা করো। আমি মন থেকে চাই, তুমি মেয়েটাকে আপন করে নাও। তাকে যোগ্য সম্মান টুকু দাও। তোমরা ছেলেরা হয়তো অনেকেই একটা মেয়ের জীবনের স্বপ্ন গুলো দেখো না।
একটা মেয়ে কতোটা ত্যাগ স্বীকার করে নিজের পরিবার পরিজন ছেড়ে একটা ছেলের হাত ধরে বের হয়ে আসে। কিন্তু পরিশেষে যদি সেই ছেলেটার ভালোবাসা না জোটে তাহলে তার কতোটা কষ্ট হয়। সে কতটা ভেঙ্গে পড়ে।
বেঁচে থাকার শেষ ইচ্ছাটাও নষ্ট হয়ে যায়। একটা মেয়ে স্বামীর ভালোবাসা পেলে দিনে একবার খেলেও কখন অভিযোগ করে না। কিন্তু স্বামীর ভালোবাসা ছাড়া রাজপ্রাসাদে থাকলেও তার অভিযোগের সীমা থাকে না।
অনুর চোখ দুটো বাধভাঙ্গা নিয়মে অশ্রু ঝরাতে থাকে। কি চায় এই চোখের জল? সে কেন কোনো বাঁধা মানে না? এতো অশ্রু বিসর্জন দিয়েও কষ্ট কেন কমে না? অশ্রু আর কষ্ট কি একি সুঁতায় বাঁধা?
অবাক অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অনু কল কাটার পর অবাক পাগলের মতো অনুকে কল করতে থাকে। কিন্তু অনু কল রিসিভ করছে না। অবাক টেক্সট পাঠায়।
“অনু তুমিও এসব কথা বলোনা। আমাকে ফিরিয়ে দিও না। আমি তোমাকে ছাড়া কাউকে নিয়ে ভাবতে পারছি না অনু। অনু একটিবার কলটা রিসিভ করো। আমার সাথে একটু কথা বলো। অনু,,,,,,।”
কিন্তু অনু কল রিসিভ করছে না। অবাক রাস্তার পাশে ছাউনিতে কিছুক্ষণ বসে থাকে। কিন্তু অনু এলো না। এলোনা তার আর কোনো রিপ্লাই। সকাল শেষ হয়ে বিকেল হচ্ছে। অবাকের ইচ্ছে গুলো দোমড়ে মোচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। অবশেষে অবাক বাসায় ফেরার জন্য উঠে।
মেঘ রান্না করেছে। অবাকের প্রিয় মাছের কয়েক রকম আইটেম। অবাকের খাবারের তালিকায় মাছ প্রথম সারির খাবার। সে মাছ যতটা পছন্দ করে ততটুকু মাংসও পছন্দ করে না। এটা মেঘ আগে থেকেই জানে।
বিলকিস বেগম যখন মেঘের সাথে দেখা করতে যেতেন তখন অবাকের কি খেতে পছন্দ করে। কি করতে পছন্দ করে সব বলতেন।
রান্না শেষ হলে মেঘ হুইলচেয়ারে বসিয়ে বিলকিস বেগমকে খাবারের জন্য নিয়ে আসে। বিলকিস বেগম এক এক করে সব রকম আইটেম টেস্ট করেন। মেঘের হাতের রান্না এতো ভালো সেটা তিনি আগে কখনও জানেন নি। কল্পনাও করেন নি মেঘ এতো ভালো রান্না করতে পারে। জাস্ট ওয়াও। বিলকিস বেগম মিষ্টি হেসে বলেন,,,,,
-জাস্ট ইমাজিং মেঘ। তোর হাতে রান্না খুব টেস্ট হয়েছে। আমার ছেলেটা অনেক খুশি হবে খেয়ে। বিলকিস বেগম মেঘের প্রশংসা করলে মেঘ মাথা নিচু করে হাসে। একহাতের আঙ্গুলের নখ দিয়ে আরেকহাতের নখ কুচাতে কুচাতে বলে,,,,,,,
-উনি কোথায় গেলো? এখনও তো এলেন না? বিলকিস বেগমের মুখ মলিন হলো। সত্যি তো। অবাক এখনও আসছে না কেন? সূর্য উঠে গেছে। এখন তো জগিং করার সময় শেষ। অবাক তো এর আগেই প্রতিদিন বাসায় ফিরে আসে। বিলকিস বেগমের ভাবনায় ব্যঘাত ঘটিয়ে মেঘ আবার বলে,,,,,
-আম্মা, উনি কখন বাসায় আসবে? এর উত্তর বিলকিস বেগম নিজেও জানেন না। তবুও মেঘকে শান্তনা সূচক বললেন,,,,,,
-চলে আসবে এক্ষণি। তুই আমাকে আমার রুমে দিয়ে আয়তো। আমি ওষুধ খাবো না?
-হ্যাঁ চলো। মেঘ চেয়ার ঠেলে বিলকিস বেগমকে রুমে নিয়ে যায়। নিজে প্রেসক্রিপশন দেখে ওষুধ দেয়। বিলকিস বেগম ওষুধ খেয়ে আরাম করে বসেন বিছানায়। মেঘের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসু সূচক ভঙ্গিতে বলেন,,,,,
-তুই অবাককে আপনি আপনি করে কেন বলিস? তুমি করে বলতে পারিস না? বিলকিস বেগমের কথা শোনে মেঘ লজ্জায় লাল হয়ে বলে,,,,,
-ইয়ে মানে, আমার কাউকে আপনি বলতে ভাল্লাগেনা। কিন্তু উনাকে তুমি বলতে ভয় লাগে। যদি কিছু বলেন।
-ভয় লাগে কেন? অবাক কি ভয় পাওয়ার মতো কিছু করেছে তোর সাথে??
-ইয়ে, মানে না । তেমন কিছু করেনি। তবুও আমার ভয় লাগে। উনি কেমন জানি।
-পাগলি মেয়ে। ভয় পেলে চলবে? অবাক এখন তোর স্বামী। তার ভালোমন্দ দেখার দায়িত্ব এখন তোর। তোর এখন একান্ত কাজ হলো নিজের স্বামীকে যেকোনো উপায়ে সুখী করা। ও কোথায় যাচ্ছে। কি করছে। কার সাথে কথা বলছে সব কিছুর উপর নজর রাখা।
স্বামীদের সুঁতা বড় করতে নেই। তাদের সুঁতা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে রাখতে হবে বুঝলি। নাহলে সুঁতা ছিঁড়ে এরা চলে যাবে। যা এখন গিয়ে অবাককে কল করে জিজ্ঞেস কর ওও এখন কোথায় আছে।
-উনি যদি কিছু মনে করেন?
-মনে করবে কি? তুই ওর স্ত্রী। তোর তো জানার অধিকার আছে। নিজের অধিকার নিজেকেই বুঝে নিতে হয়। নাহলে কেউ কাউকে অধিকার দেয় না। মেঘ চুপ করে শোনে। কিন্তু কিছু বলে না।
কিছুক্ষণ পর মেঘ নিজের রুমে যায়। মোবাইলটা হাতে নিতেই অবাক রুমে প্রবেশ করে। অবাকের মুখটা কালো হয়ে আছে। মেঘ মোবাইলটা রেখে এগিয়ে যায় অবাকের দিকে। অবাক আনমনে হাঁটে। সে গিয়ে বসে সোফায়। মেঘ গিয়ে দাঁড়ায় অবাকের সামনে।
-আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? আপনি কি অসুস্থ? এতক্ষণ আপনি কোথায় ছিলেন? সকালে নাস্তা করেন নি কেন? এতো বেলা পর্যন্ত কেউ হাঁটাহাঁটি করে? মেঘ উতলা হয়ে একের পর এক প্রশ্ন করে। অবাক সোফায় হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বসে ছিল।
মেঘের এমন অনর্গল প্রশ্ন শোনে সে মুখ থেকে হাত সরিয়ে চোখ ছোট করে অদ্ভুত চাহনিতে মেঘকে দেখতে থাকে। অবাকের চাহনি দেখে মেঘ আমতা আমতা করে বলে,,,,,
-ইয়ে মানে আম্মা বলেছিল আপনাকে এগুলো জিজ্ঞেস করতে তাই জিজ্ঞেস করছি। আমি আপনার সাথে কথা বলতে আসিনি। মেঘের কথা শোনে অবাক তাজ্জব হয়ে থাকে। সে মেঘকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে।
মেঘ শাড়ি পরেছে। মেঘ আনুমানিক লম্বা হবে ৫’৪” মতো। বডি ফিটনেস দেখার মতো। হলুদ বর্ণ গায়ের রং। চেহারায় ছেলেমানুষি ভাব। ব্লু কালারের হাফ সিল্ক শাড়িতে তাকে পুতুলের মতো লাগছে। অবাক আনমনে চেয়ে থাকে মেঘের দিকে। মেঘ অসহায় ভঙ্গিতে আবার বলে,,,,,,
-আমি কি ভুল কিছু করেছি? ভুল করলে আমাকে ক্ষমা করবেন। মেঘ কথাটা বলেই মাথা নিচু করে। মেঘের কথাটা বাতাসের গতিতে গিয়ে ঢুকে অবাকের ভেতরে। মেঘের কথার মাঝে কেমন একটা বাচ্চা বাচ্চা ভাব ফুটে উঠে। মেঘের এতো প্রশ্নে এতক্ষণে অবাকের রাগ হওয়ার কথা।
কিন্তু তার রাগ উঠলো না। মেঘ নিতান্তই ছোট মানুষ। একটা মেয়ের নর্মাল বিহেভ গড়ে উঠার জন্য হলেও কিছুটা সময় লাগে। মেঘ হয়তো সেটা পায়নি। তার কথা, চাহনি এতোটা ইনোসেন্ট যা বলার মতো নয়। অবাক কিছু না বলে ব্যালকনিতে যায়।
অবাকের পেছন পেছন মেঘও যায়। অবাক মেঘকে দেখে শান্ত কণ্ঠে বলে,,,,,
-প্লীজ, তুমি আমাকে ডিস্টার্ব করো না। আমি একা থাকতে চাই।
-কিন্তু আপনার খাবারটা? অবাক দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে কঠিন গলায় বলে,,,,,,,,
-এই মেয়ে তোমাকে বলছি না আমাকে ডিস্টার্ব করবে না? মেঘ মুখটা কাঁচুমাচু করে বলে,,,,,
-আপনি আমাকে এই মেয়ে বলছেন কেন? আমার নাম মেঘ। আমাকে মেঘ ডাকবেন। অবাক রাগী চোখে মেঘের দিকে তাকিয়ে বলে,,,,,,,,
-আমি তোমার নাম জানি। আর তোমাকে ভালো করে বললে কথা কানে যায়না? কানের নিচে দুইটা দিলে তখন ঠিকেই কথাটা কানে ঢুকবে। যাও এখান থেকে। অবাকের কর্কশ কণ্ঠের কথা শোনে মেঘ বিজলির গতিতে রুমে প্রবেশ করে বিড়বিড় করে বলে,,,,,,,
-আল্লাহ গো কি খবিশ লোকটা। ভালো করে কথা বলতেও শিখেনি। আমার মতো একটা বাচ্চার সাথেও কেমন ভাবে কথা বলে। আম্মায় মনে হয় জন্মের সময় লোকটাকে মধু খাওয়াতে ভুলে গেছিল। হুম তাই হবে। আম্মাকে জিজ্ঞেস করে দেখবো আমার ধারণা ঠিক না বেঠিক।
অবাক ব্যালকনির ডিভানে গা এলিয়ে দেয়। তার খুব কান্না পাচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে। অনুর সাথে কাটানো প্রত্যেকটা মুহূর্ত চোখের সামনে ঝলঝল করে ভাসছে। কি সুখের দিন ছিল দুজনের। কেন সুখ গুলো এভাবে হারিয়ে গেলো?
অবাকের ইচ্ছে করছে অতীত গুলো আরো একবার ফিরে পেতে। ইচ্ছে করছে পরশ আবেশে অতীতে একবার ডুব দিতে। কিন্তু কিছু চাওয়া কখনই পূরণ হয়না। তেমনি অতীত কখনও ফিরে আসে না। অবাকের বেশি কষ্ট হচ্ছে অনুর জন্য। অনুর বলা শেষ কথাগুলোর জন্য। অনুও অবশেষে তাকে ফিরিয়ে দিলো।
মেঘ কিছুক্ষণ পর রুমে এসে শোনে অবাক গান গাইছে। সেই গান, যে গান শোনার সঙ্গে সঙ্গে মেঘের আকাশ মেঘে মেঘে ভরে যায়। অজানা গর্জনে বুকে ব্যথা শুরু করে। অবাকের কণ্ঠ থেকে গান নয়, যেন কষ্ট ঝরে পড়ছে।
মেঘ ফিসফিস করে বলে, ” উনার এতো কিসের কষ্ট? এসব গান কেন গাইছে? মেঘ অধীর আগ্রহ নিয়ে ব্যালকনির দিকে এগিয়ে যায়। সে ব্যালকনির দরজা ধরে দাঁড়ায়। সে অবাকের কণ্ঠে গান শোনছে।
নিজের মতো ভাল থেকো,
ছেড়ে দিলাম পিছুটান।
বাঁচবো না হয় সারাজীবন,
নিয়ে প্রিয় অভিমান।
মন তবু যে তোমাতে হারাবে
তাকে বেধে রাখা কি আর যাবে?
শুধু যাব না তোমার কাছে এই আমি
পড়বে না ভালবাসাতে ক্ষত
তুমি রবে যে আগেরই মতো
এই আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে দামী।
তোমাকে নিয়ে দেখা স্বপ্নের ভীড়ে
ছিলনা কিছু ঠাই দুচোখের নীড়ে
স্বপ্নগুলোকে হঠাৎ কেড়ে যে নিলে
আমাকে যে আধাঁর পথে ঠেলে দিলে
মন তবু যে তোমাতে হারাবে
তাকে বেধে রাখা কি আর যাবে?
শুধু যাব না তোমার কাছে এই আমি
পড়বে না ভালবাসাতে ক্ষত
তুমি রবে যে আগেরই মতো
এই আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে দামী।
ভাবিনি যা ভেবেছি ভুল হবে সবই
করতে পারনি তুমি আমাকে অনুভবই
ভুলগুলো আজ তুমি ভেঙে যে দিলে
আমাকে যে আধাঁর পথে ঠেলে দিলে
মন তবু যে তোমাতে হারাবে
তাকে বেধে রাখা কি আর যাবে?
শুধু যাব না তোমার কাছে এই আমি
পড়বে না ভালবাসাতে ক্ষত
তুমি রবে যে আগেরই মতো
এই আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে দামী।
নিজের মতো ভাল থেকো,
ছেড়ে দিলাম পিছুটান।
বাঁচবো না হয় সারাজীবন,
নিয়ে প্রিয় অভিমান।
অবাক কাঁদতে কাঁদতে বলে,
– অনু আই লাভ ইউ। আই রিয়েলি লাভ ইউ। তোমাকে ছাড়া আমি নিঃস্ব হয়ে যাবো অনু। অনু তুমি আমাকে পর করে দিও না।
অবাকের কথা শোনে মেঘের বুক কেঁপে উঠে। মেঘ কয়েকপা পিছিয়ে যায়। তার চোখ দিয়ে গরম পানি বের হয়ে আসে। মেঘ মনে মনে বলে, উনি এসব কি বলছেন? অনু কে? উনি অনুকে ভালোবাসেন? তাহলে অনু বিয়ে না করে আমাকে বিয়ে করলেন কেন?
মেঘ রুমে গিয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করে। মেঘের মনে হচ্ছে তার পৃথিবী থমকে গেছে। কষ্ট গুলো আবার বুকে আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরেছে। মেঘের মনে হচ্ছে শরীরের জোড়া গুলো আলাদা হয়ে গেছে। জীবনে সব কষ্ট পেয়েছে। এই কষ্টটা পাওয়াই বাকি ছিল। আল্লাহ এই কষ্টটা দিয়ে জীবনের ষোলকলা পূর্ণ করলো।
বিলকিস বেগম বিছানায় বসে বই পড়ছেন। মেঘ গিয়ে বিলকিস বেগমের পাশে বসে। কিন্তু কিছু বলে না। তাকে বিষণ্ণ লাগছে। বিলকিস বেগম বইটা বন্ধ করে চিন্তিত হয়ে বললেন,,,,,
– কি হয়েছে? মন খারাপ কেন? অবাক কিছু বলেছে? মেঘের চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। মেঘ ধরা গলায় বলে,,,,,,,
– আম্মা, অনু কে? মেঘের কথা শোনে বিলকিস বেগম চমকে উঠেন। তিনি উতলা হয়ে জিজ্ঞেস করেন,,,,,,
– অবাক তোকে অনুর কথা কিছু বলেছে? মেঘ মাথা নাড়িয়ে না বলে। বিলকিস বেগম ভ্রু নাচিয়ে বলেন,,,,,
– তাহলে তুই অনুর কথা কিভাবে জানিস?
– উনি কান্না করছেন আর বলছেন “আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি অনু”। এজন্যই হয়তো উনি আমার সাথে ভালোভাবে কথা বলেন না। উনি আমাকে কখনই ভালোবাসবে না।
উনি অনুকে ভালোবাসেন। বিলকিস বেগম হাত থেকে বইটা রেখে মেঘের চোখ মুছে দিয়ে বলেন,,,,,
– না। অবাক তোকে ভালোবাসবে। তুই ওর বউ। তোদের ভালোবাসা স্বয়ং আল্লাহ তৈরি করছে। তুই পারবি। পারতে হবে। মেঘ বিলকিস বেগমের দিকে উৎসুখ হয়ে তাকালে বিলকিস বেগম হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়।
– কিন্তু আম্মা উনিযে,,,,,,,
– অবাক অনুকে ভালোবাসে। সারাজীবন বাসুক। তাতে সমস্যা নাই। অনুকে অনুর জায়গা থেকে ভালোবাসবে। আর তোকে তোর জায়গা থেকে ভালোবাসবে। তুই ওর বউ। ওর মনে জায়গা করে নিতে হবে।
পৃথিবীতে কেউ কাউকে জায়গা দিতে চায়না। নিজের জায়গাটা নিজেকেই তৈরি করতে হয়। তোকেও করতে হবে। মেঘ বিলকিস বেগমকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে। বিলকিস বেগম মেঘের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,,,,,
-কাঁদছিস কেন? কাঁদলি মানে দূর্বল হয়ে গেলি। তোকে স্টং থাকতে হবে। সব সময় হাসি খুশি থাকতে হবে। অল্পতে হাল ছাড়লে চলবে না। মনে করবি তুই যুদ্ধের ময়দানে দাঁড়িয়ে আছিস। আর যুদ্ধে জয় লাভ করতেই হবে। এটা তোর জীবন যুদ্ধ।
মেঘ রুমে পায়চারী করছে। অবাকের জন্য টেনশন হচ্ছে। সে সকালে ব্রেকফাস্ট করেনি। দুপুরবেলাও খাওয়ার নাম নিচ্ছে না। কতবার বললো খেয়ে নিতে। কিন্তু প্রতিবারই চোখ গরম করে তাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে।
মেঘ রুম থেকে বের হয়ে যায় বিলকিস বেগমের রুমে। বিলকিস বেগম দুপুরের খাবার খেয়ে মাত্র বিছানায় গা এলালেন। চোখটাও কিছুটা লেগে গেছে। এর মধ্যে মেঘ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অসহায় কণ্ঠে বলে,,,,,,
-আম্মা। তোমার ছেলেতো খেতে চায়না। বিলকিস বেগম জোর করে চোখ মেললেন। তিনি মাথা তুলে মেঘকে দেখে আবার বালিশে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে বললেন,,,,,,
-আমি কি করবো? তোর স্বামী তুই যেভাবে পারিস মেনেছ কর।
-আমি পারুম না আম্মা। তোমার ছেলে বলে দিয়েছে আর একবার তাকে ডিস্টার্ব করলে আমাকে ডিল মেরে নিচে ফেলে দিবেন। আম্মা, তুমিই বলো আমাকে যদি নিচে ফেলে দেয় তাহলে কি আমি আস্ত থাকবো?
বিলকিস বেগম কিছু বললেন না। মনে মনে বললেন, ” অবাককে তোকেই ঠিক করতে হবে। তোকে পারতেই হবে।” বিলকিস বেগম দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,,,,,
-অবাক খেতে না চাইলে জোর করে খাওয়া। আমার ছেলেটাকে তোর হাতে তুলে দিয়েছি। তাকে সুখে রাখার দায়িত্ব তোর। তুই যদি আমার ছেলেটাকে যতক্ষণ খাওয়াতে না পারবি ততক্ষণ আমার সাথে কথা বলতে আসবি না। আমি কথা বলবো না তোর সাথে। মেঘের চোখ কপালে। সে বিস্মিত হয়ে বলে,,,,,
-কি মহাবিপদ। আমি তাহলে কার সাথে কথা বলবো?
-যা বিন্তির সাথে কথা বল। আমি আর কথা বলবো না।
-আম্মা তুমি এটা বলো না। আমি তোমার সাথে কথা বলবো। বিন্তির সাথে কি কথা বলবো?
-তাহলে এখন গিয়ে অবাককে খাওয়া। না খেয়েতো আমার ছেলেটা অসুস্থ হয়ে যাবে। ও না খেয়ে থাকতে পারে না।
-আচ্ছা এখনি লাস্ট। এখন না খেলে আমি কিন্তু তোমার ছেলের মাথা ফাটিয়ে দিবো। কথা শেষ করে মেঘ হনহন করে রান্নাঘরের দিকে যায়।
একটা প্লেটে করে কিছু খাবার নিয়ে নিজের রুমে যায়। অবাক এখনও ব্যালকনিতে শুয়ে আছে। মেঘ খাবারের প্লেট হাতে ব্যালকনিতে গিয়ে অবাকের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। অবাক চোখ বন্ধ করে আছে। মেঘ জোরে বলে,,,,
-আপনার খাবার নিয়ে আসছি। অবাক চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে মেঘ দাঁড়িয়ে আছে। অবাক উঠে বসে রাগী কণ্ঠে বলে,,,,,,,
-তোমার মার খাওয়ার খুব শখ হয়েছে না? মেঘ কাঁদুম কাঁদুম মুখ করে বলে,,,,,,,
-আমাকে সবাই মারতে চায়। আমি কি করেছি? অবাক ভ্রু কুঁচকায়। মেঘ আবার বলে,,,,,,
-আগে খান তারপর আস্তে করে একটা চড় মারেন। আমি কাঁদবো না। মেঘের কথা শোনে অবাক হা হয়ে থাকে। এই মেয়ে কি বলছে? মাথা ঠিক আছে তো?
মেঘ পেল্টে ভাত মেখে এক লোকমা ভাত অবাকের মুখে গুজে দেয়। বিস্ময়ে অবাকের চোখ গোলগোল হয়ে যায়। মেঘ মুখটা কাঁচুমাচু করে বলে,,,,
-প্লীজ খেয়ে নিন। অবাকের মুখ ভাতে ভর্তি। সে কথাও বলতে পারছে না। মেঘ প্লেটটা টি টেবিলে রেখে অবাকের সামনে পা গুটিয়ে বসে। অবাকের মুখের ভাত শেষ হওয়ার আগেই জোর করে একের পর এক লোকমা ভাত দিতে থাকে। অবাক মুখ ঘুরিয়ে নিলে মেঘ বাম হাত দিয়ে অবাকের মুখ চেপে ধরে ভাত দিতে থাকে। ভাতের এটোতে অবাকের মুখ বিল্লু বিল্লু হয়ে যায়। অবাক মুখ ভর্তি ভাত নিয়ে অস্পষ্ট ভাবে বলে,,,,,,
-হোয়াট দ্যা,, । আমাকে মেরে ফেলবে নাকি? মেঘ অবাকের কথায় পাত্তা না দিয়ে সে অবাকের মুখে জোর করেই ভাত দিতে থাকে। প্লেটের ভাত শেষ হলে মেঘ হাসি দিয়ে বলে,,,,,,,,,
-ভাত শেষ। আর আপনিও বেঁচে আছেন। নেন এবার পানি খান। মেঘ পানির গ্লাসটা অবাকের মুখের সামনে ধরলে অবাক ডগডগ করে সবটা পানি খেয়ে জোরে নিঃশ্বাস নেয়। মেঘ হাসি হাসি মুখ করে বলে,,,,,,,
-তরকারীটা মজা না? আমি রান্না করেছি। অবাকের রাগ চরমে। মেয়েটা বড্ড বেয়াদব। এতোবার না করার পরও এমন একটা কাজ করলো। অবাক নিজের রাগ কন্ট্রোল করে না পেরে মেঘের গালে কষে একটা চড় বসিয়ে দেয়।
তাল সামলাতে না পেরে মেঘ নিচে পড়ে যায়। তার মাথা ঘুরছে। ঘরটা মনে হচ্ছে উল্টে যাচ্ছে। সব কিছু ডাবল ডাবল লাগছে। বেশ কিছুক্ষণ পর মেঘের মাথা স্থির হয়। মেঘ গালে হাত দিয়ে অবাকের দিকে তাকিয়ে ন্যাকা কান্নার ভান ধরে বলে,,,,,,
-আপনি আমাকে এতো জোরে মারলেন কেন? আমিতো বলেছিলাম আস্তে মারার জন্য। অবাকের মাথার চুল কাড়াকাড়া হয়ে আছে। ইচ্ছে করছে এই মেয়েটাকে খুন করে ফেলতে। অবাক দাঁত কটমট করে বলে,,,,,,,
-বেয়াদব মেয়ে। একটা ডিল মেরে নিচে ফেলে দিবো। অবাকের কথা শোনে মেঘ ভয়ে গুটিসুটি মেরে একদম টেবিলের নিচে চলে যায়। অবাক আর দাঁড়িয়ে না থেকে রাগী মুডে রুমে চলে যায়।
চলবে———