#অবাক_মেঘের_বাড়ি

পর্ব : ১২
সুরমা

অনু অবাকের মেসেজ দেখে রাত ১০টায়। মোবাইলটা হাতে নিতেই দেখে উপরে অবাকের নাম ভেসে আছে। অনু অস্থির হয়ে মেসেজ সিন করে। অবাকের মেসেজ পড়ে তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। সে হয়তো অবাকের কাছে অন্য কিছু আশা করেছিল। কিন্তু নিয়তি সব সময় তাই করছে যা কষ্টকর। অনু ছোট করে উত্তর পাঠায়,,
-দোয়া করি তোমার নতুন জীবন সুখে ভরপুর হয়ে উঠুক।

অটোমেটিক অনুর চোখ জলে ভরে উঠে। অনু দৌঁড়ে ব্যালকনিতে চলে যায়। ধুম করে ফ্লোরে বসে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে। কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে। অনু ওড়না দিয়ে মুখ চেপে ধরে।

ভালোবাসার স্মৃতি গুলো চোখের সামনে ভাসছে। সেগুলো এখন কষ্টের কারণ। এক সময় সেই স্মৃতি গুলোই হৃদয় রাঙাতো। আজও রাঙায়। পার্থক্য শুধু পরিণতিতে। আগে রাঙাতো ভালোবাসায়। এখন অশ্রুতে।

অনেক্ষণ কাঁদার পর অনুর কান্না কমে আসে। সে ব্যালকনির ডিবানে মাথা হেলিয়ে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে।

অবাক অনুর মেসেজ দেখে আরো ভেঙ্গে পড়ে। তারও চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে। মোবাইটা বুকে লাগিয়ে বলতে থাকে,,,,,
-তোমাকে ছাড়া আমি সুখি হবো না অনু। তুমি আমার সুখ। আমি তোমাকে ভালোবাসি। শুধুই তোমাকে। তোমাকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

রাত শেষে ভোরের আলো ফুটলেই একটা নতুন জীবন। একদম অন্যরকম জীবন। যে জীবন সে কখনও কল্পনা করে নি। যে জীবনে বেঁচে থাকতে হবে জীবন্ত লাশের মতো। কেন মা একবারের জন্যও বুঝলো না তার কষ্ট।

আচ্ছা মা’রা কি এমনই হয়? পরিবাররা কেন বুঝে না। ভালোবাসার মানুষের সাথে থাকতে পারলেই তাদের জীবন সুখের হয়। কেন বুঝে না? সারা রাত অবাকের চোখের পাতা এক হয়নি। তার বারবার অনুর কথা মনে পড়ছিল। মনে পড়ছি অনুর সাথে কাটানো প্রত্যেকটা ভালো মুহূর্তের কথা।

অনুর মতো মেয়ে হয়? এতো বছর প্রেম করার পর যখন তাকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করতে যাচ্ছে তবুও মেয়েটা এক বারের জন্য অভিযোগ করেনি। নীরবে সব মেনে নিয়েছে। সে কষ্ট পাচ্ছে। তবুও মুখ ফোটে তাকে কিছু বলছে না।

তার জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে থাকলে এভাবে সব কিছু মেনে নিতো? কথা ভাবতেই অবাকের বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসে। আর বলতে থাকে,,,

– অনু তোমার সাথে করা অন্যায়ের শাস্তি আল্লাহ ঠিক আমাকে দিবে। তোমার মতো একটা মেয়ের হৃদয় ভাঙ্গার শাস্তি মসজিদ ভাঙ্গার থেকেও বেশি। আমাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করলেও কম হবে।

আমিতো আরো কঠিন শাস্তি পাবো অনু। আমার যদি মৃত্যু হতো তাহলে আমার চেয়ে খুশি কেউ হতো না। আমার শাস্তি হবে তিলে তিলে। আমার শাস্তি হবে ধীরে ধীরে। আমি না পারবো বাঁচতে না পারবো মরে যেতে। আমি শুধু চিংড়ি মাছের মতো চটপট করবো।
অনু, আমাকে ক্ষমা করো। আমাকে ক্ষমা করে দিও।

সকালের সূর্যের লাল আলো এসে চোখে পড়তেই অনুর ঘুমটা ভেঙ্গে যায়। অনু মিটমিট করে তাকায়। সে সোজা হয়ে বসে। চোখ ফুলে কলাগাছ হয়েছে। মাথা পাথরের মতো ভার হয়ে আছে। চোখ মাথা চিনচিন ব্যথা করছে।

আজ ফজরের আযান শুনেনি সে। রাতে রুমেও যায় নি। রাতে কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে গেলো বলতে পারলো না। অনু ওঠে রুমে আসে। ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে ওযু করে আসে।

মেঝেতে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে বসে। আজ অবাকের বিয়ে। চিরদিনের মতো অন্যের হয়ে গেলো প্রিয়তম। আর কোনোদিন এই মানুষটাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারবে না সে।

আর কোনোদিন হাতে হাত রেখে চলা হবে না কিছু পথ। হয়তো এই মুখটাও আর দেখা হবে না। নামাজে অনু কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। নামাজে মনটা ঠিক নেই। মন পড়ে আছে অবাকের কাছে।

প্রতিদিন অনুর মোনাজাতে থাকে অবাক। আজও আছে। তবে অন্যভাবে। অনু দুহাত তুলে বললো,

” আল্লাহ তুমি এই মানুষটাকে সুখে রেখো। তাকে সব রকম সুখ উপভোগ করার রহমত দিও। আমাকে ভুলে যাওয়ার তওফিক দান করো। অবাককে আর কাঁদিও না প্রভু। ওকে আর কোনো কষ্ট পেতে দিও না। আমাকে সব দুঃখ সহ্য করার ক্ষমতা দান করিও।

আমি যে আর পারছি না প্রভু। তুমি আমাকে এতো আয়োজন করে দুঃখ দিলে কেন? কি দরকার ছিল এতো ভালোবাসার মায়ায় আমাকে বাঁধার। তুমি তো সবার মনের খবর জানো। তুমি জগৎযামী।

তুমি যেহেতু জানো আমি তাকে পাবো না তাহলে কেন তার জন্য আমার বুকে এতো ভালোবাসার জন্ম দিলে? আল্লাহ! তুমি যার জন্য যাকে সৃষ্টি করো নি তার জন্য মনে ভালোবাসা সৃষ্টি করো না। ভালোবাসা হারালে নিজেকে অসহায় লাগে। নিঃস্ব লাগে।

আল্লাহ আমার মতো এতো কষ্ট যেন আর কোনো মেয়ে জীবনে না পায়। কাউকে ফুলের আঘাত দিও না। ফুলের আঘাত যে সহ্য হয়না হৃদয়ে।” অনু নামাজে বসেই শব্দ করে কাঁদতে থাকে।

অনুর কান্নার আওয়াজে প্রিতির ঘুম ভেঙ্গে যায়। প্রিতি হুরমুর করে উঠে বসে। অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে,
– আপু তুই কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে? প্রিতির কথা শোনে অনু চোখ মুছে জায়নামাজ তুলে। নিথর কণ্ঠে বলে,,

– কই কিছু হয়নি তো।
– তাহলে কাঁদছিস কেন?
– কাঁদছি না। মোনাজাত পড়ছিলাম। প্রিতি চোখ কচলায়। অনুর দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু কিছু বলে না। তার কাছে সবটা পরিষ্কার। অনু জায়নামাজ রেখে ব্যালকনিতে চলে আসে।

আজ অবাকের বিয়ে। বাড়িতে না আছে কোনো বিয়ের আমেজ না আছে আনন্দ। আত্মীয়স্বজন বলতে অবাকের দুএকজন বন্ধু এসেছে আর অবাকের মামা মামীরা। বাড়িটাও সাজানো হয়নি। আশেপাশের লোকজনদেরও জানানো হয়নি।

বিলকিস বেগম আগের থেকে অনেকটা সুস্থ। তবে হাঁটতে পারেন না তিনি। হুইলচেয়ারে চলাচল করতে পারেন। বাসায় সব রকম চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ডাক্তার সব সময় বিলকিস বেগমের শারীরিক অবস্থা রেকর্ড করে রাখছে।

একমাত্র ছেলের বিয়েটা এভাবে হচ্ছে ভাবতেই বিলকিস বেগমের মন কেঁদে উঠছে। তিনি ছেলের বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছিলেন। পরিস্থিতি এমন এক জায়গায় নিয়ে এসেছে যার জন্য কিছুই মনের মতো হচ্ছে না।

অবাককে বর সাজানো হয়েছে। সে বিলকিস বেগমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বিলকিস বেগম অপলক দৃষ্টিতে ছেলেকে দেখছেন। মনে মনে বললেন, ” মাশআল্লাহ! আমার ছেলেকে আজ রাজপুত্রের মতো লাগছে ।

আল্লাহ তুমি আমার ছেলেকে চিরসুখী বানিয়ো। আমার কথা রক্ষা করতে গিয়ে আমার ছেলেটা নিজের ভালোবাসাকে বিসর্জন দিয়েছে। অনেক কষ্ট পেয়েছে। তুমি তার এই কষ্টের প্রতিদান দিও। আমার ছেলে যে সুখের জন্য চোখের জল জড়িয়েছে তুমি তাকে সেই সুখের থেকে আরো বেশি সুখ দিও। ”

বিলকিস বেগম অবাকের হাত ধরে হাতে কনিষ্ঠ আঙ্গুলে আলতো করে কামড় দিয়ে বললেন,,,,
– খুব সুন্দর লাগছে আমার রাজপুত্রকে। কারো নজর যেন না লাগে। সাবধানে যাবি আর আমার ঘরের লক্ষ্মীকে নিয়ে ফিরে আসবি।

অবাকের গলা আটকে গেলো। সে কথা বলার আগেই কান্না চলে আসছে। অবাক মায়ের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে। মায়ের দুটো হাত জড়িয়ে ধরে। অবাকের চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে। বিলকিস বেগম অবাকের চোখ দুটো মুছে দিয়ে বলেন,,,,

– পাগল ছেলে। আজকের দিনে কাঁদতে আছে? চোখ মুছ। অবাক কান্নামাখা কণ্ঠে বলে,,,,,
– আম্মা তুমি যাবে না আমার সাথে? বিলকিস বেগম মৃদু হেসে বললেন,,,,,

– আমার কি আর যাওয়ার মতো ক্ষমতা আছে?
– তুমিও চলো আমার সাথে। আমি তোমাকে না নিয়ে যাবো না আম্মা।
– আমার এই অবস্থায় ওখানে গিয়ে কি করবো?

– আমার পাশে বসে থাকবে। তুমি রেডি হও। আমি তোমাকে নিয়ে যাবো। তোমার বউমা। তুমি গিয়ে নিয়ে আসবে। আমি অপেক্ষা করছি তোমার জন্য। যাও আম্মা। তুমি রেডি হয়ে আসো।

বিলকিস বেগম অবাককে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু অবাক বুঝতে রাজি না। সে মাকে ছাড়া যাবেই না। বাধ্য হয়ে বিলকিস বেগম রেডি হোন। মা ছেলে রওনা হয় কনের বাড়ির দিকে। অবাকের সব আশা শেষ। ভেতরে ভেতরে অবাক অনেক ভেঙ্গে পড়ে। তবুও নিজেকে শক্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। মায়ের সামনে হাসি খুশি থাকার চেষ্টা করে।

সেন্টারে গিয়ে অবাক বিস্মিত হয়। এতো আয়োজন কখন করলো? কেউতো কিছু বললোও না তাকে। সে নিজের বিয়ের জন্য যেমন স্বপ্ন দেখেছিল ঠিক তেমন করেই সব সাজানো হয়েছে। কোনো কিছুর কমতি নেই। সব কিছু ছিল। শুধু ভালোবাসার মানুষটাই নেই সেখানে।

অবাকের ভেতরটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। কারো কাছে মন খুলে কিছু বলতেও পারছে না। নীরবে সব কিছু মেনে নিতে হচ্ছে। অবাকের ইচ্ছে করছে এখন একটু কাঁদতে। কাঁদলে হয়তো মনটা শান্ত হতো। এতো আয়োজন দেখে অবাকের অস্বস্তি লাগছে। অবাক গাড়ি থেকে নামে। লোকজন তাদের গাড়িটা ঘিরে রেখেছে।

কয়েকজন মহিলা বরণঢালা নিয়ে এসে দাঁড়ায় অবাকের সামনে। অবাক মনে মনে অনেক বিরক্ত প্রকাশ করে। একরাশ কষ্ট বুকে নিয়ে মনে মনে বলে,

” আজ নিজেকে কোরবানির পশু মনে হচ্ছে। কোরবানির সময় সবাই আনন্দে মেতে উঠে। কিন্তু পশুটার চোখ জলে ভিজে উঠে। কিন্তু আজ আমাদের দুজনের মধ্যে পার্থক্য, সেই পশুর পানিটা সবাই দেখে। আর আমার হৃদয় ভেজার পানি কেউ দেখলো না।”

মহিলাদের বরণ করা হলে হায়দার সাহেব অবাকের গলায় একটা স্বর্ণের চেইন পরিয়ে দেন। তিনি ভেজাচোখে বলেন,

-বাবা, আমি জানি তুমি এর চেয়েও বেশি কিছু রিজার্ভ করো। কিন্তু আমার ক্ষমতা এর চেয়ে বেশি নেই। আমি আমার সব ক্ষমতা দিয়ে চেষ্টা করছি। আমার জায়গা থেকে আমি সর্বোচ্চ করার চেষ্টা করেছি। হায়দার সাহেবের কথা শোনে অবাক মাথা নিচু করে। বিলকিস বেগম বলেন,,

-ভাইজান এভাবে বলছেন কেন? আমাদের কোনো কিছুতেই অভিযোগ নেই। আপনি যা করেছেন তারচেয়ে বেশি আর কিছু হয়না। তাছাড়া আপনি আপনার অমূল্য সম্পদ আমাদের দিয়ে দিচ্ছেন। আর কি চাওয়ার থাকে?
-সব আল্লাহর ইচ্ছা ভাবী। বিলকিস বেগম আনন্দিত কণ্ঠে বলেন,,,,

-ভাইজান আমার মেয়ে মেঘ কোথায়? ওকে সাজানো হয়েছে?
-জ্বি ভাবী। মেঘকে সাজানো হয়েছে। আপনারা আসুন। আমি মেঘকে স্টেইজে আনার জন্য বলছি।

অবাককে নিয়ে যাওয়া হয় স্টেইজে। অবাকের পাশে বসানো হয় মেঘকে। অবাক একবারের জন্যও মেঘের দিকে তাকায় নি। মেঘকে দেখে বিলকিস বেগম বললেন,,,,,

-মাশআল্লাহ! আমার মেয়েকেতো আজ লাল পরী লাগছে। বিলকিস বেগম হাত বাড়িয়ে মেঘকে কাছে ডাকলেন। মেঘ বিলকিস বেগমের কাছে এলে বিলকিস বেগম মেঘের কপালে আলতো করে চুমু খেলেন।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাই অবাক মেঘের প্রশংসা করতে লাগলো। এসব কিছুতেই অবাক মনোযোগ দিলো না। সে অন্যদিকে তাকিয়ে মন খারাপ করে বসে রইলো। তার মনে শুধু অনুর বসবাস।

ইসলামিক মোতাবেক অনুযায়ী অবাক মেঘের বিয়ে সম্পন্ন হয়। কাবিননামায় সাইন করতে গিয়ে অবাকের হাত কাঁপতে শুরু করে। বুকে অসহনীয় ভাবে ব্যথা করতে থাকে। সাইন করার সময় না চাইতেও অবাকের চোখ দিয়ে এক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে।

অবাক ব্যালনকিতে রাখা রকিং চেয়ারে বসে একের পর এক সিগারেট টানছে। রাত বাড়ছে। কষ্ট গুলোও দাউদাউ করে জ্বলে উঠছে। যতই সিগারেটের ধোয়ায় কষ্ট গুলো ঢাকার চেষ্টা করছে ততই বেশি করে কষ্ট গুলো বাড়ছে। কষ্ট গুলো মনে হয় আজ জেদ ধরছে। কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না।

আজ তার জীবনের মোরটাই বদলে গেলো। প্রিয় মানুষটার থেকে চিরতরে দূরে সরে গেলো। আর কি কখনও প্রিয়তমাকে আপন করে পাওয়া হবে? মায়ের ইচ্ছের গুরুত্ব দিতে গিয়ে নিজের জীবনের সুখটাকে বিসর্জন দিতে হলো।

আজ এই বাসর রাতে অনুর থাকার কথা ছিল। কিন্তু সেখানে অচেনা একটা মেয়ে বসে আছে। যার কথা মনে হলেই রাগে চুল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে অবাকের। কখনও তো ইচ্ছে করছে রুমে গিয়ে মেয়েটার গালে ঠাসঠাস করে কয়েকটা দিয়ে বলতে,

” তোর জন্য আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেছে। তোকে আমি দুচোখে দেখতে পারছি না। তোর জন্যই আমার কলিজাটা কষ্ট পাচ্ছে। ” কিন্তু মন চাইলেও সব কিছু করা যায় না।

অবাক অনুকে খুব মিস করছে। কষ্ট হচ্ছে অনুর জন্য। কেমন আছে অনু? কি করছে এখন সে? অবাকের চোখ জলে ভরে উঠে। তার ইচ্ছে করছে চিল্লিয়ে বলতে,

“আমি জানি তুমি ভালো নেই অনু। তুমি খুব কষ্টে আছো। অনু তোমাকে ছাড়া হয়তো আমি বেঁচে থাকবো কিন্তু ভালো থাকবো না। আমি ভালো নেই। আমি একটুকুও ভালো নেই।”

কিন্তু কিছু কথা ভেতরে থেকে হৃদয়টা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে তবুও বাহিরে বের হয়না। অনুকে বলার মতো অনেক কথা আছে। হয়তো না বলা একথা গুলো আর বলা হবে না অনুকে। বুকের গহীনে আজীবনের জন্য চাপা পড়ে থাকবে।

অজানা অচেনা একটা মেয়ে তার বিছানায় বউ সেজে বসে আছে। কিন্তু প্রিয়তমা কতো কষ্টেই না আজ রাত যাপন করবে। হয়তো কষ্টে তার হৃদয় চিহ্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। কাউকে নিজের মনের না বলা কথা গুলোও হয়তো কখনও বলতে পারবে না সে।

রাত ৩টা। অবাক এক প্যাকেট সিগারেট শেষ করে ফেলেছে। একটা শেষ হতে না হতেই আরেকটা সিগারেটে আগুন ধরায়। আগে কখনও সিগারেটের সাথে তার পরিচয় ছিল না। ভাবেও নি কখনও এটার সাথে পরিচিত হবে।

লোকে বলে নেশা করলে নাকি কষ্ট কমে। তার কষ্ট আজ অনেক। কিছু কষ্ট কমানোর জন্যই এমন উদ্যোগ। এক প্যাকেট সিগারেট শেষ। এখন মনে হচ্ছে আরো একটা প্যাকেট হাতে থাকলে ভালো হতো। এখানে বসেই রাতটা কভার করা যেতো।

খালিখালি তো বসে থাকা যায় না। একা বসে থাকলে অসহ্য লাগবে। সিগারেটটা থাকলে সঙ্গী হতো। অবাক কাশছে। গলায় কুশকুশ করছে। বুকেও মনে হয় কিছু জমাট বেঁধেছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।

বুকটা কেমন ভার হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে বুকের উপর উঠে কেউ বসে আছে। অবাক ব্যালকনিতে আরো কিছুক্ষণ বসে থাকে। এখন আর পারছে না। মনে হচ্ছে বিছানায় একটু গা এলিয়ে দিলে বেশ হতো।

হঠাৎ বুকে প্রচণ্ড চিনচিন ব্যথা। অবাক তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে ফিসফিস করে বলে,,,,
” আমি কি এখন মরে যাবো? মরে গেলে খারাপ হবে না।”

অবাক বুকে হাত দিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ায়। পা চলছে না। মনে হয় কেউ পা ধরে রেখেছে। সে নিঃশব্দে রুমে প্রবেশ করে।

মেয়েটা এখনও জেগে আছে। মৃদু আলোয় ঘোমটা টেনে বসে আছে বিছানার মাঝখানে। তার খাটটা সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। মনে হচ্ছে বিছানাটা আজ একটা ফুলের বাগান। অবাক একপলক খাটের দিকে তাকিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সে বিড়বিড় করে বলে,

– বাসায় বিয়ের কোনো রকম আমেজ নেই। বাসাটা সাজানোও হয়নি। তবে কেন ফুলসজ্জার জন্য রুমটা সাজানো হলো? আমাকে এত কষ্ট দিয়েও মন ভরেনি সবার? আবার আয়োজন করা হয়েছে কষ্টটাকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য?

অবাক ব্যালকনির দরজায় হেলে দাঁড়ায়। সাথে সাথে দরজায় খট করে শব্দ হয়। মেঘ মাথা তুলে তাকায়। মাথার ঘোমটাটা হালকা টেনে মুখ বের করে। রুমে অবাককে দেখে সে খাট থেকে নামে।

অবাক মৃদু পায়ে গিয়ে বসে সোফায়। হঠাৎ করে তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। মাথা ভনভন করছে। মেঘ এগিয়ে এসে অবাকের পা ছুঁয়ে সালাম করে। মেঘের হাতের স্পর্শে অবাকের শরীর হালকা কেঁপে উঠে। অবাক নিজের পা গুটিয়ে নেয়।

অবাকের মুখে ঘাম জমা হয়। মেঘ অবাকের দিকে তাকিয়ে শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,,,,,
-আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে? অবাক কোনো উত্তর দেয়নি। মেঘ আবার বলে,,,,

-আপনি কি পানি খাবেন? পানি দিবো? অবাকের চোখ লাল হলো। এমনিতেই এই মেয়েকে সহ্য হচ্ছে না। আবার এসে তার সাথে কথা বলতে চাইছে। অবাক দাঁতে দাঁত চেঁপে বলে,,,,
-তুমি গিয়ে ঘুমাও। আমাকে নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। অবাকের কথায় মেঘের বুকে ধাক্কা লাগে। তবুও নিজেকে সামলে বলে,,,,,

-কিন্তু আপনাকে দেখেতো মনে হচ্ছে আপনি অসুস্থ। আমি কি কাউকে ডাকবো? মেঘের কথা শোনে এবার অবাকের রাগ উঠে গেলো। এই মেয়েটাকে দেখলে তার আরো কষ্ট হবে। অবাক রাগী কণ্ঠে দমকের স্বরে বলে,,,,,,,

-তোমাকে এখান থেকে যেতে বলিনি? অবাকের রাগী কণ্ঠ শোনে এবার মেঘ কেঁপে উঠে। চোখ জলে ভরে উঠে। বিয়ের প্রথম রাতেই স্বামী এমন আচরণ? মেঘ কিছুটা পিছিয়ে যায়। অজানা কষ্ট বুকের ভেতরে তোলপাড় শুরু করে। চোখ থেকেও কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে।

চলবে———-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here