#অবাক_মেঘের_বাড়ি

পর্ব : ১০
সুরমা

অবাকের গাড়ি এসে থামে অনুর বাসার সামনে। অবাক শরীরে শক্তি পাচ্ছে না। গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে ফিল করলো তার শরীরের জোড়া গুলো সব আলাদা হয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে গাড়ির মধ্যেই শুয়ে পড়তে। অবাকের মাথা ঝিমঝিম করছে। শরীর কাঁপছে। হঠাৎ এমন করছে কেন শরীর? এতক্ষণ কিছু না খেয়ে থাকার জন্য?

অবাক গাড়ি থেকে নেমে কিছুক্ষণ গাড়ির সাথে হেলে দাঁড়িয়ে থাকে। মাথাটা হালকা ঘুরছে। চোখ গুলো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। এমন লাগছে কেন? সে শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। সব প্রতিকূলতা এভয়েট করে এগিয়ে যায় বাসার দিকে। পা গুলো এগোতে চাইছে না। মনে হচ্ছে পিছন থেকে কেউ টেনে ধরছে। তবুও সে এগিয়ে যাচ্ছে।

রিমি দুপুরের খাবার বানাচ্ছে। সে রান্নাঘর থেকে বের হতেই দেখে অবার বাসার ভেতরে প্রবেশ করছে। অবাককে অসুস্থ মনে হচ্ছে। তার শরীরের ভয়ংকর অবস্থা। রিমি বিচলিত হয়ে এগিয়ে যায় অবাকের দিকে। অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে,,,,,,

-অবাক তোমার কি হয়েছে? তোমাকে এতো করুণ দেখাচ্ছে কেন? তুমি কি অসুস্থ? অবাক ঢুলুঢুলু পায়ে দাঁড়ায়। রিমির মনে হচ্ছে অবাক পড়ে যাবে। তাই সে গিয়ে অবাকে হাত ধরে বলে,,,,,
-আরে তুমি তো পড়ে যাবে। বসো এখানে। অবাক শরীর টানটান করে দাঁড়ায়। নিস্তেজ হয়ে বলে,,,,,

-কিছু হবে না। আমি ঠিক আছি।
-তাহলে তোমাকে এমন লাগছে কেন? অবাক রিমির কথার কোনো উত্তর দিল না। নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,,,,

-ভাবী অনু কোথায়? আমি অনুর সাথে দেখা করতে এসেছি। আমাকে ওর সাথে একবার দেখা করতে দাও। রিমি বুঝতে পারছে না অবাকের ঠিক কি হয়েছে। তবে মারাত্মক কোনো ব্যাপার আছে। এর আগে অবাককে কখনও এভাবে দেখে নি। রিমি ধীর কণ্ঠে বলে,,,,,

-নিজের রুমেই আছে। অবাক আর দাঁড়ায় নি। সে অনুর রুমের দিকে যেতে শুরু করে। আর রিমি বিস্মিত হয়ে চেয়ে থাকে অবাকের যাওয়ার দিকে।

যে ছেলেটা সব সময় নিজে হাসি খুশি থাকে অন্যকেউ হাসিখুশি দেখতে পছন্দ করে আজ তার কি অবস্থা। তার এই অবস্থা কি অনুর জন্য হয়েছে? নাকি অন্য কোনো ব্যাপার আছে?

অবাক অনুর রুমে গিয়ে দেখে রুম ফাঁকা। ব্যালকনিতে গিয়ে দেখে অনু আনমনে দাঁড়িয়ে আছে। অনুর একটা চোখ দেখা যাচ্ছে। চোখটা ফোলে কালচে হয়ে আছে।

অন্য সময় অনুর চোখের মুখে যে লাবণ্যতার ছোঁয়া লেগে থাকে এখন সেটা নেই। বরং বিষণ্ণতায় চেয়ে গেছে তার চেহারায়। অবাকের বুক কেঁপে উঠে। ফরফর করে চোখ বেয়ে পানি পড়তে শুরু করে। অবাক ধরা গলায় অনুকে ডাকে,,,,

-অনু। হঠাৎ করে অবাকের কণ্ঠ শুনে অনু চমকে তাকায়। তাকিয়ে দেখে অবাক দাঁড়িয়ে আছে। খুশিতে অনু পা বাড়িয়েও থমকে যায়। সে নিজের পা গুটিয়ে নেয়। অবাকের এমন করুণ চেহারে দেখে অনুর বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসে। সে দূর থেকে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে,,,,,

-তুমি আমাদের বাসায়? অবাক কিছুটা এগিয়ে যায় অনুর দিকে। অনুকে দুহাত দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। অনুও নিজের কান্না আটকে রাখতে পারে নি। অনু অবাকের টিশার্ট কামচে ধরে কাঁদতে থাকে।

অনুর চোখ থেকে গরম পানি স্রোতের গতিতে পড়তে শুরু করে। সে কখনও অবাকের এতো নাজেহাল অবস্থা দেখেনি। সে ভেবেছিল অবাক হয়তো তাকে ভুলে গেছে। আজকে অবাকের চেহারাই বলে দিচ্ছে সে কতটা সুখে ছিল। অবাক কাঁদতে কাঁদতে বলে,,,,,,
-অনু,, অনু,,,। অনু নিজের কান্না আটকানোর জন্য নিজের সাথে আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে থাকে। কিন্তু মনের সাথে যুদ্ধ করে পারা যাচ্ছে না। তবুও সে যুদ্ধ করে যাচ্ছে।

কারণ অবাক তার শুনে আরো বেশি ভেঙ্গে পড়ছে। অনু আরেকটু নরম হলে তখন অবাককে সামলানো কঠিন হয়ে যাবে। অনু অবাকের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,,,,,

– তোমার একি অবস্থা দেখছি? এমন কেন হলো? নিজের যত্ন কেন নিচ্ছ না। তোমার দিকে তো তাকানো যাচ্ছে না। অবাক অনুর হাত চেপে ধরে বলে,,,,,
– অনু আম্মা হসপিটালে। আম্মা আমার সাথে আর কথা বলে না অনু। আমার দিকে চোখ মেলে একবারের জন্যও তাকায় নি। অবাকের কথা শোনে অনুর শরীর নরম হয়ে যায়। সে চোখ বড় করে বলে,,,,,
– মামীর কি হয়েছে? হসপিটালে কেন?
– আম্মার স্টোক করেছে। ডাক্তার বলছে আমার এক পাশ অবশ হয়ে গেছে। আম্মার জ্ঞান ফিরছে না। অনু কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে সোফায় বসে পড়ে। তার এখন নিজেকে আরো অসহায় মনে হচ্ছে। অবাকও এগিয়ে গিয়ে অনুর সামনে হাঁটু গেরে বসে। অনু অন্যদিকে তাকিয়ে বলে,,,,,,,,

– তুমি মামীকে বলেছো মামীর পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করবে না? আঘাত দিয়েছো উনাকে? অনুর কথা শোনে অবাক আরো কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। অনুর দুটো হাত একত্র করে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,,,,,,

-অনু আমি যে তোমাকে খুব ভালোবাসি । তোমাকে ছাড়া আমি অন্য কাউকে এজীবনে জায়গা দিতে পারবো না। আমি তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবো না।

অনু,, আমাদের জীবনটা এভাবে এলোমেলো কেন হয়ে গেলো বলতে পারো? আমরা তো দুজন দুজনকে ভালোবেসেছি। তাহলে আজ কেন এতো কষ্ট পেতে হচ্ছে আমাদের? অনু আমার ভুল কি ছিল?

আমার ভালোবাসা গুলো কেন আমাকে ছেড়ে চলে যায়? আব্বাও সেই কবে আমাকে রেখে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। আম্মাও আজ মৃত্যুর কাছে। তুমিও নিজেকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছো। আমাকে এখন আর কল করো না। আমি করলেও রিসিভ করো না। আমি কোথায় যাবো অনু?

আমি কেন মরি না? আমার মতো মানুষ কেন এখনও বেঁচে থাকে? অবাক অনুর হাত আরো শক্ত করে চেপে ধরে। অনুর হাঁটুতে মুখ রেখে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে শুরু করে। অনু কোনো কথা বলছে না।

তার চোখ দিয়ে শুধু অঝর ধারায় পানি পড়ছে। অবাক কেমন বাচ্চাদের মতো কাঁদছে। যে অবাককে কোনো কিছু কাবু করতে পারতো না সেই মানুষটা আজ কাঁদছে। সময় মানুষকে কতটা অসহায় বানিয়ে ফেলে। একটা ছেলে কতটা কষ্ট পেলে এভাবে কাঁদে।

অনু বুঝতে পারছে না তার এখন কি বলা বা করা উচিত। অবাককে কি বলে শান্তনা দেওয়া উচিত। অবাক তো ছোট না। তুমি কষ্ট পেয়োনা বললেই তো আর তার কষ্ট কমে যাবে না। অবাকের মায়ের যদি কিছু একটা হয়ে যায় সারাজীবন নিজেকে অপরাধী মনে হবে। তখন কি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে??

অবাক আবার বলে,,,,
– অনু তুমি আমার সাথে কথা বলবে না? তুমি আমাকে এভাবে আর কষ্ট দিও না। আমি এতকষ্ট এক সাথে নিতে পারছি না। সবাই মিলে আমাকে এভাবে দূরে সরিয়ে দিও না। আমার যাওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই। তুমি আমাকে যতই দূরে ঢেলে দাও তবুও আমি তোমার কাছেই আসবো। সব সময় আসবো।

এবার অনুর কলিজা ফেটে যায়। কান্নায় তার শরীর কাঁপতে থাকে। অশ্রু বাঁধ ভাঙ্গা স্রোতের মতো গড়িয়ে পড়তে তাকে। অনু তাড়াতাড়ি চোখের পানি লুকিয়ে অবাকের হাত ধরে টেনে তুলে। অবাকের চোখের পানিটা মুছে দিয়ে বলে,,,,,,,

-পাগল একটা। এমন বাচ্চাদের মতো কাঁদছো কেন? হুম। তোমাকে কি এতো অল্পতে কাঁদতে মানায়? পুরুষ মানুষ কাঁদে নাকি? পুরুষ মানুষ হলো বীরের জাতি। তারা বীরের মতো শক্ত থাকবে। এভাবে ভেঙ্গে পড়বে কেন? অনু অবাকের চোখের পানি মুছে দেয়। অবাক অনুর দিকে তাকিয়ে অসহায় মুখ করে বলে,,,,,,

– অনু তুমি আমার উপর রাগ করে নেইতো? অনু মৃদু হেসে বলে,,,,,
– অবাক সাহেবের সাথে রাগ করে কেউ থাকতে পারে? তোমার উপর আমার কোনো রাগ নেই। তোমার উপর আমি কখনও রাগ করেছি? ভবিষ্যৎ এও করবো না। অবাক আবার চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলে,,,,

– অনু,,! অনু হালকা কঠিন স্বরে বলে,,,,
– আবার কাঁদছো? বলছি না কাঁদবে না। আর একদিনে শরীরের একি হাল করেছো? হুম? এতোটা খারাপ সময়ও আসে নি আমাদের জীবনে যে এভাবে নিজেকে অবহেলা করতে হবে। নিজেকে কষ্ট দিতে হবে।

অনু অবাকের চুলে নিজের আঙ্গুল চালায়। হাত দিয়ে অবাকের চুল গুলো ঠিক করে দেয়। তারপর অবাকের টিশার্টের কলার ঠিক করে। টিশার্টটা নিচের দিকটা টেনে বুকের উপরে থাকা দুটো বোতাম লাগিয়ে বলে,,,,,,

– এবার ঠিক আছে। যাই হোক, সবসময় নিজের প্রতি যত্নশীল থাকবে। পরিপাটি থাকবে। যেমন থাকলে অবাক সাহেবকে অবাক সাহেবের মতোই লাগে। আর যদি এমন এলোমেলো হয়ে থাকো লোকে দেখলে বলবে অবাক সাহেব ছ্যাকা খেয়ে ব্যাকা হয়ে গেছে। অবাক অদ্ভুত দৃষ্টিতে অনুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

অবাকের ফোন বাজছে। অবাক পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে ছোট মামা কল করছে। অবাকের বুক লাফ দিয়ে উঠে। অনুর দিকে তাকিয়ে অস্থির হয়ে বলে,,,,,,,

-হসপিটাল থেকে মামা কল করছে। অনু বলে,,,
– রিসিভ করো। দেখো উনি কি বলে। অবাক চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়। অনুও অবাকের পাশে দাঁড়ায়। অবাক কলটা রিসিভ করে বলে,,,,,

-হ্যালো মামা। আম্মা ঠিক আছে তো??
-,,,,,,,,,,
-আচ্ছা আমি আসছি। তাড়াতাড়ি আসছি। অবাক কল কেটে দেয়। অনু অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে,,,,,,
-কি হয়েছে? সব ঠিক আছে তো?
-আম্মার জ্ঞান ফিরেছে। আম্মা আমাকে দেখতে চেয়েছে। অবাকের চোখ চিকচিক করছে। অনু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,,,,
-সব ভালো হলেই ভালো।

-সব ভালো হবে এখন। দেখো। সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। আমি আম্মাকে আবার সব বুঝিয়ে বলবো। তোমার কথা বলবো। আম্মা আমাকে খুব ভালোবাসে। আমার কথা ফেলতে পারবে না। ঠিক আমাদের সম্পর্কটা মেনে নিবে। অনু অবাকের থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে বলে,,,,,

-এসব বলে মামীকে আর কষ্ট দিও না। তুমি মামীর পছন্দ করা মেয়েকেই বিয়ে করো। নতুন করে আবার মামীকে আঘাত করলে হয়তো মামী আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে। অনুর কথা শোনে অবাক শকট হয়ে যায়। সে অনুর সামনে গিয়ে বলে,,,,,

– এসব তুমি কি বলছো? আম্মার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করবো মানে??
– আমি সব ভেবে চিন্তেই বলছি। আমার জন্য যদি মামীর কিছু হয় তাহলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না। আর মামীর চোখেও আমি অপরাধী হয়ে যাবো। অবাক, প্লীজ। তুমি আমাকে ভুলে যাও।

-অনু, আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না। আমি মরেই যাবো। অনু অবাকের মুখ চেপে ধরে বলে,,,,
– এসব কথা বলতে আছে? অবুঝদের মতো আচরণ। অবাককে এই অল্পতে ভেঙ্গে পড়া মানায় না। অবাক সব প্রতিকূল অবস্থায় লোহার মতো শক্ত থাকবে। আর মামী যা বলছে মেনে নাও।

-এটা কিছুতেই সম্ভব নয়। আমি তোমাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবো না। তুমি চিন্তা করো না। আম্মা সুস্থ হলে আমি আম্মাকে ঠিক ম্যানেজ করবো। আম্মা আমার কথা ঠিক শোনবে দেখো। আম্মা তোমাকে ভুল বুঝবে না। তুমি আর এসব কথা বলো না। তুমি কি আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে বলো? আমি জানি তুমি পারবে না। আমিও পারবো না। দুজনেই কষ্ট পাবো।

অনুর ভেতরে ভেতরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। তবুও নিজেকে শক্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। অবাকের সামনে দূর্বল হলে চলবে না। তাহলে অবাককে কিছুতেই বুঝানো যাবে না। অনু অবাকের গালে হাত দিয়ে বলে,,,,,

– মা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। মনের সুখ। সুখের জান্নাত। মাকে কষ্ট দিয়ে কেউ কখনও সুখি হয়েছে দেখেছো? আমরাও সুখি হবো না। তুমি ফিরে যাও। মামী যার সাথে তোমার বিয়ে ঠিক করেছে তাকেই বিয়ে করো। তোমার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। অনুর কথা শোনে অবাক ঠাস করে ফ্লোরে বসে পড়ে।

অনু তুমি আমাকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছ? তুমিও? তুমিও আমার হৃদয়ের কথা শোনছো না? অবাক পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ে। অবাককে এভাবে দেখতে অনুর ভালো লাগছে না। তার মনে হচ্ছে মৃত্যু হয়তো এই কষ্টের কাছে কিছুই না।

মরে গেলে তো একবারেই সব কষ্টের অবসান ঘটতো। কিন্তু এই কষ্ট প্রতিনিয়ত ভোগ করতে হবে। প্রতিদিন মৃত্যুর থেকেও বেশি ভয়ানক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। অনুর কাঁদতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে বলতে,,,,,,

-অবাক আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না। আমি তোমাকে আমার থেকেও বেশি ভালোবাসি। আমি তোমাকে পৃথিবীর কোনো সুখের জন্য হারাতে চাই না। আমি তোমাকে চাই। তোমার পাশে থাকতে চাই।

তোমার পাশে থেকে হাজার কষ্ট হলেও আমি সব মেনে নিবো। পৃথিবীর সব কিছুর বিনিময়ে আল্লাহ তোমাকে আমায় করে দিক। আমি আর কিছু চাইবো না। কথাগুলো মনে মনে বললেও মুখ ফুটে বলতে পারছে না। পারছে না মন প্রাণ উজাড় করে কিছুক্ষণ কাঁদতেও।

ভেতরে ভেতরে তার বুকে ফেটে যাচ্ছে। কান্নায় ভেঙ্গে যাচ্ছে তার হৃদয়। তবুও অনু নিজেকে কন্ট্রোল করে নিলো। শক্ত হয়ে বললো,,,,,,

-দূরে সরিয়ে দেওয়ার কথা আসছে কেন?
-তাহলে বলছো কেন আম্মার পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করতে? তুমি জানো না এই কাজটা করা আমার জন্য কতো কঠিন? অনু অবাকের কাছে ফিরে আসে। অবাকের সামনে বসে বলে,,,,

-বাস্তবতা অনেক কঠিন। কখনও ফ্যামিলির স্বার্থে আমাদের অনেক সময় মূল্যবান কিছু ত্যাগ করতে হয়। সেগুলোর মধ্যে কিছু জিনিস আমরা মন থেকে মানতেও পারি না। তাছাড়া তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করলেই কি আমার থেকে দূরে চলে যাবে? যাবে না।

কখনও আমরা একজন আরেকজনের থেকে দূরে থাকি ঠিক। কিন্তু মন থেকে পুরোপুরি দূরে যেতে পারিনা। অনেক মানুষ আছে যাদের বছরের পর বছর যায় কিন্তু একবারো দুচোখে দেখা হয়না। কিন্তু মনে থেকে যায়।

হয়তো আমরাও দুজন পাশাপাশি থাকবো না। চোখের সামনে থাকবো না কিন্তু মনের খুব কাছাকাছি থাকবো। মন থেকে তো কেউ সরাতে পারবে না। আমাদের দেখা হবে। কথা হবে। একজনের প্রতি আরেকজনের সম্মান থাকবে।

অনেকদিন পর যখন দুজনের দেখা হবে তখনও একে অপরের জন্য ভালোবাসা অটুক থাকবে। দুজন দুজনকে জিজ্ঞেস করতে পারবো। কথা বলতে পারবো। আমরা দূরে যাচ্ছি। কিন্তু একে অপরের জন্য ভালোবাসা সম্মান রেখে যাচ্ছি।

দেখো নরমাল যখন দুটো ছেলে মেয়ের ব্রেকআপ হয় তখন কি তারা কখনও একে অপরের সাথে কথা বলে? বলে না। নিজের ইচ্ছায় দুজন আলাদা হয় অথচ একজন আরেকজনকে দুচোখে দেখতে পারে না। দুজন দুজনের চোখে শত্রুর মতো আচরণ করে। একজন আরেকজনের চোখে অপরাধী হয়ে যায়।

অথচ আমাদের যখন দেখা হবে তখন ঠিক কথা বলতে পারবো। একে অপরের প্রতি কোনো অভিযোগ থাকবে না। অপরাধ বোধ কাজ করবে না। আমাদের রিলেশনটা হবে অন্যরকম। অনু অবাকের চোখ গুলো মুছে কপাল থেকে চুলগুলো সরিয়ে কপালে একটা চুমু দেয়।

অবাক আরো বেশি ভেঙ্গে পড়ে। তার নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি অসহায় মনে হচ্ছে। অনু অবাককে টেনে তুলে বলে,,,,,

-উঠো তো। কি বাচ্চাদের মতো করছো হুম? এভাবে কাঁদছো কেন? আমি কি মরে গেছি? আজব তো তুমি। অবাক অনুকে জড়িয়ে ধরে ভ্যাউ ভ্যাউ করে কাঁদতে থাকে। অনু যে কতো কষ্টে নিজেকে স্থির রেখেছে সেটা শুধু সেই জানে। অনু অবাককে জোর করে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বলে,,,,,,

-তুমি এখন মামীর কাছে যাও। এখন তোমার উনার পাশে থাকা উচিত। উনার পাশে থেকে উনাকে সাপোর্ট দেওয়া উচিত।

-অনু, আমি যাচ্ছি। কিন্তু আমি আবার আসবো। বারবার আসবো। তুমি তাড়িয়ে দিলেও আসবো। যাই হোক তবুও আমি তোমার কাছেই আসবো। অবাক ঘুরে দাঁড়ালেও যেতে পারছে না।

তার যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু এখন তার মায়ের কাছে যাওয়া উচিত। মাকে বুঝাতে হবে। মা অনুকে মেনে নিলে অনু আর তাকে দূরে সরিয়ে দিবে না। অবাক আবার পেছন ফিরে অসহায় ভঙ্গিতে অনুর দিকে তাকায়।

অনু সাথে সাথে চোখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে নেয়। অবাকের দিকে চেয়ে থাকলে অবাক আরো বেশি ভেঙ্গে পড়বে। অবাক কুটিকুটি পায়ে এগুতে থাকে। তার ইচ্ছে করছে না অনুকে ছেড়ে যেতে। তবুও যেন যেতে হচ্ছে।

রুমে প্রিতি দাঁড়িয়ে আছে। অবাক প্রিতির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। প্রিতি বলে,,,,,
-আর এসো না আমাদের বাসায়। তুমি যত আসবে তত আপুর কষ্ট হবে। অবাকের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। অবাক অসহায় হয়ে বলে,,,,

-আমি আসলে অনু মোটেও কষ্ট পাবে না। বরং না আসলে কষ্ট পাবে। আমি আসবো। প্রিতি কঠিন গলায় বলে,,,,

-না তুমি আসবে না। তুমি যত আসবে আপু ততবেশি কষ্ট পাবে। তুমি না আসলে আপু ঠিক তোমাকে ভুলে যাবে।
-অনু আমাকে ভুলবে না। কোনদিন ভুলতে পারবে না। তোরা আমার সাথে এমন কঠিন আচরণ কেন করছিস? কেন সবাই মিলে আমাকে এতো কষ্ট দিচ্ছিস? আমিও মানুষ। আমার শরীরেও রক্ত মাংস আছে। আমারও কষ্ট হয়। খুব কষ্ট হয়।

আমি আসবো। আমাকে আসতে না দিলেও আমি আসবো। বাসার ভেতরে আসতে না দিলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবো। তবুও আমি আসবো। অবাক বিড়বিড় করেতে করতে এগিয়ে যায়। প্রিতি ব্যালকনিতে গিয়ে দেখে অনু মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। প্রিতি অনুর কাঁধে হাত রাখতেই অনু ঝাপটে পড়ে প্রিতির বুকে। প্রিতিকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে।

কাজল রেখা ড্রয়িংরুমে বসে আছেন। হঠাৎ অবাককে ভেতর থেকে আসতে দেখে তার রাগ উঠে যায়। আবার কি চায় এই ছেলে? নিশ্চয় অনুর সাথে দেখা করতে এসেছে। কাজল রেখা উঠে দাঁড়ালেন।

অবাক হাঁটছিল মৃদু পায়ে। আনমনে নিচের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে আসছে। কাজল রেখা এসে অবাকের সামনে দাঁড়ালে অবাক মাথা তুলে তাকায়। কাজল রেখাকে দেখে সে আবার মাথা নিচু করে ফেলে। কাজল রেখার চোয়াল শক্ত হয়। তিনি দাঁতে দাঁত চেপে বলেন,,,,,,

-তুমি আবার আমাদের বাসায় কেন এসেছো? তোমাকে আসতে মানা করেছিলাম না? অবাক কোনো কথা না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। কাজল রেখা আবার রাগী কণ্ঠে বলেন,,,,,,,

-তোমরা মা ছেলে কি চাও? আমার মেয়েটা মরে যাক? এমনিতেই তোমাদের জন্য আমার মেয়ের লাইফটা নষ্ট হয়ে গেছে। আমার যে মেয়েকে কখনও কাঁদতে দেখিনি সেই মেয়েটা এখন কারণে অকারণে চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে। তুমি আর কখনও আমাদের বাসায় আসবে না। অবাক হাত জোর করে বলে,,,,,,,

-ফুফি তুমি এতো কঠিন হয়ো না। আমাকে এতো বড় শাস্তি দিও না। তুমি আমাকে মারো। কিন্তু অনুর কাছে আসতে মানা করো না। আমি তোমার কথা রাখতে পারবো না। অবাক আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় নি। সে বাসা থেকে বের হয়ে আসে।

অনু নিজের কান্না কিছুতেই থামাতে পারছে না। কষ্টে তার বুক ফেটে যাচ্ছে। প্রিতি অনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,,,,,,,,,

-আপু প্লীজ শান্ত হো। এভাবে ভেঙ্গে পড়িস না।
-আমি কিভাবে শান্ত হবো? আমি আমার ভালোবাসাকে আজ দূরে সরিয়ে দিলাম। আমার এতদিন যত্নে রাখা ভালোবাসা। এক মুহূর্তে ভেঙ্গে দিলাম। আমি কিভাবে বাঁচবো। কিভাবে আমি অবাককে ভুলে থাকবো।

কিভাবে থাকবো? প্রিতি আর কিছু বললো না। কাঁদুক। এখন কাঁদাই উচিত। না কাঁদলে কষ্ট টা আরো বেড়ে যাবে। একটু আগে নিজেকে শান্ত রেখে অনু অবাককে কিভাবে বুঝালো। সেটাতো নিজের চোখেই দেখেছে প্রিতি।

তখন অনুর বুকে কান্না জমা ছিল। অনুর চোখে স্পষ্ট কষ্ট দেখা যাচ্ছিল। তবুও সে একবার কাঁদে নি। এখনও যদি না কাঁদে তাহলে কষ্টে সে পাথর হয়ে যাবে। কাঁদুক। তবুও যদি কষ্টটা কমে।

অবাক বাইরে এসে গাড়িতে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদতে থাকে। রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করা লোকজন দাঁড়িয়ে থেকে অবাকে কান্না দেখছে। অবাকের সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। সে নিজের মতো করে কেঁদেই যাচ্ছে।

এমন সময় অবাকের মোবাইলটা আবার বাজতে শুরু করে। অবাক নিজের কান্না থামিয়ে মোবাইলটা হাতে নেয়। ছোট মামা কল করছে। অবাক কলটা রিসিভ করে বলে,,,

-মামা আম্মা ঠিক আছে তো?
-আপা ঠিক আছে। কিন্তু তুই কোথায়? এখনও আসছিস না কেন? আপা তোকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে গেছে। তাছাড়া তোর সাথে কথা আছে। তাড়াতাড়ি আয়।

-আমি এক্ষণি আসছি। অবাক কলটা কেটে দিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। স্পিডে গাড়ি ছাড়ে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হসপিটালে পৌঁছাতে হবে। আম্মার সাথে কথা বলতে হবে। আম্মার কাছে শেষবারের মতো অনুকে চাইতে হবে। আম্মাকে বুঝিয়ে বললে ঠিক বুঝবে । বুঝতেই হবে।

চলবে——-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here