||অনামিকার সাক্ষ্য|| ||অংশ: ১৫||

অনামিকার একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে আলতো করে ঠোঁটের স্পর্শ করায়। হেচকা টান দিয়ে হাতটা সরিয়ে বসে যায় সে। বাদলও উঠে বসে।

“কী হইছে? হাত সরাইলা ক্যান?”

“এ্যা! বিয়ার আগে কিচ্ছু হইবো না বাদল মিয়া। বেশি সুযোগ পাইয়া ঠ্যাং লম্বা হইয়া গেছে তোমার, না?”

কপট অভিমানে মুখখানা সরিয়ে নেয় বাদল। পরক্ষণেই চিঠির কথা মনে পড়ে যায় তার। অনামিকার দিকে ফিরে ম্লানমুখে বলল, “আমি না থাকলে, আমার কথা মনে হইবো তোমার?”

“কিসব উলটা পালটা কও! একদম এমন বাজে কথা কইবা না।”, বাদলের মুখের উপর আঙুল রেখে বলল।

বাদল ইতস্তত করে বলে, “আমার যে যাইতে হবে রে।”

অনামিকার ভ্রুজোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকে আসে। ঘাড়টা বাঁকা করে তাকিয়ে তার চেহারায় কিছু একটা আবিষ্কার করার চেষ্টা করছে৷ তার চোখের মণিতে যেন বিষাদের ছাপ। বাদল যে মিথ্যে বলছে না বা তার সাথে মজা করছে না এটা সে তার চোখ দেখেই বুঝে নেয়।

দৃঢ় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, “কই যাইবা?”

“ঢাকা যাইতে হইবো। চিঠি আইছে আমার।”, টেনে টেনে বলল।

ছাত্রাবাস থেকে চিঠি এসেছে। ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে তাকে দিতে চাচ্ছে সবাই। সে হবে তাদের দলনেতা। বাদল যেভাবে একটা বিষয় গুছিয়ে বলতে পারে, করতে পারে আর কেউ তা পারে না। তাছাড়া রাজনীতিতে সে বেশ পাকাপোক্ত অবস্থানে আছে৷ ১৯৮৩ ও ১৯৮৪ সালে বেশ কয়েকটি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে গড়ে উঠা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিছিলে সেনাবাহিনীর হামলায় জামাল, জসিম, ইলিয়াস, দীপা সহ অনেক ছাত্র/ছাত্রী নিহত হয়। তখন থেকে জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে এই লাগাতার ছাত্র আন্দোলন চলছে। কিন্তু জেনারেল এরশাদ কোনোমতেই পদত্যাগ করছে না। আজ সেপ্টেম্বরের ২৪ তারিখ। সামনের অক্টোবর মাসের ১তারিখ থেকে এই আন্দোলন আরো জোরদার করতে চায় তাদের সংগঠন। বাদল না থাকলে তা কোনো মতেই সম্ভব না।

সবকিছু শুনে অনামিকা কিছুক্ষণ নিশ্চুপ বসে থাকে। সে কেবল কষ্ট পাচ্ছে যে তা নয়, সে ভয় পাচ্ছে। কেন জানি কিছু একটা খারাপ হবে ভাবছিল এটাই কী তাহলে সেটা! নাকি আরো খারাপ কিছু ওঁৎ পেতে আছে!

বাদলের শার্টের কলার ঠিক করে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো, “তা যাও। একেবারেই তো আর যাইতাছো না। কয়দিনের লাইগা যাইবা আর কহন যাইবা?”

“কাইল ভোরেই যামু, আর কয়দিন থাকা লাগবো তা জানি না।”

টুপ করে একফোঁটা জল বাদলের হাতের উপর গড়িয়ে পড়ে। তৎক্ষনাৎ সে অনামিকার চিবুকে হাত রেখে মুখটা তুলে ধরে বলে, “এই পাগলী কান্তাছিস ক্যান? আমি কী একেবারে চইলা যাইতাছি। প্রতি সপ্তায় চিঠি লিখুম তো৷ আর একমাস পর আইসা যামু দেহিস।”

বাদলের চোখের দিকে তাকায় অনামিকা। তার একটা হাত নিজের গালের সাথে চেপে ধরে মাথাটা বাঁকিয়ে শুধায়, “সত্যি একমাস পর আইবা? চিঠি লিখবা প্রতি সপ্তায়?”

“হ, এই যে সত্যি, সত্যি, সত্যি… তিন সত্যি।”

কথাটা শেষ করতেই বাদলের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে সে। হঠাৎ করে তাল সামলাতে না পেরে মাটিতে শুয়ে পড়ে। শক্ত করে চেপে ধরে বুকের সাথে। তার হাতজোড়া পিঠ পার করে। কতক্ষণ নীরবে চোখের জল ফেলে ক্লান্ত হয়ে মাথা তুলে। বাদলের নাকে নাক ঘেঁষে চোখ বন্ধ করে রয়। একে অপরের উষ্ণ নিশ্বাস অনুভব করতে পারছে। চারদিকে ঝিঁঝি পোকার ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। আচমকা একটা জোনাকি পোঁকা এসে বাদলের গালে বসে। টিমটিম করে জ্বলে আলো ছড়াচ্ছে তার মুখময়। অনামিকা চোখ মেলে জোনাকিকে আঙুল দিয়ে ধরে। তখনও নিভে নিভে আলো দিচ্ছে। জোনাকির আলোয় বাদলের মুখটা খুব কাছ থেকে দেখছে সে। আলতো করে তার গালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়।

“এইহানে শুধু আমিই ছুঁইতে পারুম। আর কেউর এই অধিকার নাই। মনে থাকে যেন বাদল মিয়া।”,শাসিয়ে বলে সে।

বাদলের মুখে অর্থপূর্ণ হাসি ছড়ায়। এই মেয়ের মধ্যে কিছু কিছু বাচ্চাসুলভ আচরণও যে রয়েছে তার সাথে এর পর্বে পরিচিত ছিল না। আজ এই রুপটা নতুন দেখল।

“আমার শইল্যের সব জায়গাতেই তোর অধিকার পাগলী।”

বাদলের মুখে তুই শব্দটা শুনলে কেমন শান্ত হয়ে আসে সে। এত সুন্দর শব্দ বোধহয় তার জন্য আর কিছুই মনে হয় না।

“রাইত বাড়তাছে। বাড়ি যামু৷ নাইলে পরে সমস্যা হইবার পারে।” অনামিকা যাওয়ার তাড়া দেয়।

বাদল তার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে, “ভোরে আইবা না আমারে বিদায় দিতে?”

“আমু, অবশ্যই আমু। এক নজর আমার ঘাসফড়িংরে না দেখিলে পরে একটা মাস কেমনে থাকমু বাদল মিয়া?”

তার চোখে জল টলমল করছে। বাদল জানে আজ রাতে হয়তো সে আর ঘুমাতে পারবে না। সারারাত কান্না করবে। সকালে চোখমুখ ফুলিয়ে তার সাথে দেখা করতে যাবে। কিন্তু বাদলও কী আর ঘুমাতে পারবে? একদিকে পরিবারকে ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট, আরেকদিকে প্রিয়য়মা। আরেকটা জীবনকে সে নিজের সাথে জুড়ে নিলো। ভোর সাড়ে চারটায় বটগাছের নিচে আসার কথা বলে দেয় তাকে। অনামিকাকে বাড়ির সামনে পৌঁছে দিয়ে বাদল বাড়ির পথে পা বাঁড়ায়। মাথায় শত ধরনের চিন্তা, শত ধরনের ভয় এসে ভীড় করেছে। তাড়াতাড়ি আন্দোলন শেষ হলে সে ফিরে আসবে তার তৃণলতার কাছে। আসার সময় একটা টুকটুকে লাল শাড়ি নিয়ে আসবে। একটুও দেরি করবে না। চট জলদি বিয়ে করে নেবে৷ শত উদ্ভট চিন্তা করতে করতে বাড়িতে পৌঁছে যায়।

১৯.
ভোর পাঁচটার বাসে রওয়ানা দেবে সে। হেলাল তাকে পৌঁছে দেবে বাস স্টপে। রুজিনা বানু আর রেহানা সেই ভোর তিনটায় উঠে বাদলের জন্য গরম গরম রান্না করে। তাকে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়। চারটা বিশ মিনিটে সবার থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। রুজিনা বানু আঁচলে চোখ মুছিছেন বারবার।

বাছিদ মাস্টার তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বললেন, “আহা পোলা যাওয়ার সময় এমনে কান্দো ক্যান? যুদ্ধ জয় করতে যাইতেছে না তোমার পোলা। ওই আন্দোলন ফান্দোলন কিস্যু না। আমরা যুদ্ধ করছি বুঝছো? পাক বাহিনীর সামনে বুক ফুলায়া খাড়ায়া ছিলাম। গুলি কইরা কতজনরে মাটিতে মিশাই দিছি।”

তিনি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তখনই রুজিনা বানু কিছু না বলেই হনহনিয়ে ঘরের ভেতর চলে গেলেন। বিশ কদমের পথ যেন দশ কদমেই পার করে দেন।

“দেখছস? তোর মায়ের হাল দেখছস? আমার লগে কী করে দেখছস?” রেহানাকে রেগেমেগে কথাগুলো বললেন বাছিদ মাস্টার।

সে তাকে শান্ত করার জন্য বলল, “আহা আব্বা! এই বুইড়া বয়সে তোমরা এমন করো ক্যান? খালি ঝগড়া! আহো বাইত্তে আহো।”

বাছিদ মাস্টার পথ পানে আরেকবার তাকিয়ে ঘরের দিকে চলে যান। ছেলে চোখের আড়াল হয়ে গেছে ততক্ষণে। ভয় তিনিও কম পাচ্ছেন না কিন্তু নিজেকে সামলে রেখেছেন।

বাদল দূর থেকেই বট গাছের নিচে অনামিকাকে দেখতে পায়। ঘোমটা টেনে শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে। বাদলকে এক নজর পলকহীন চোখে দেখে সে। আজ তাকে একদম সাহেব সাহেব লাগছে। হেলাল তাদের রেখে কিছুদূর এগিয়ে যায়। বট গাছের বড় শেকড়টাতে বসে পড়ে দু’জনে। নিশ্চুপ কেটে যায় কিছুক্ষণ। নীরবতার চাদর যেন তাদের উপর চেপে বসেছে।

বাদল হাত দিয়ে ঘোমটা নামিয়ে বলে, “ঢাকা থেইক্যা আইসা বউ কইরা এমন কইরাই তোমার ঘোমটা নামামু।”

চোখে জল আসতে দিতে চাচ্ছে না অনামিকা। নিজেকে শক্ত করে ধরে রাখতে চেষ্টা করছে।

ক্ষণকাল থেমে বাদল আবার বলল, “ওই তৃণলতা, আমারে ভুইলা অন্য কাউরে অন্তর দিয়া বসিস না কিন্তু।”

অনামিকা তখনও চুপ। চোখে জল টলমল করছে। এই বুঝি গাল ভিজিয়ে ছাপ ফেলে গেল।

চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here