||অনামিকার সাক্ষ্য|| ||অংশ: ১৪||
“আমারে এমনে কইরা জড়াই রাখবা বাদল মিয়া? আমার না ভীষণ শান্তি লাগতাছে।”, মাথাটা আলতো করে বুকের উপর রেখে বলল।
কণ্ঠস্বর খানিকটা কম্পিত শোনায়। বাদলের একজোড়া হাত তার পিঠ পাড় করে। চোখ বন্ধ করে নেয়। বুকের উপর উষ্ণতা অনুভব করে। কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়েছে অনামিকার চোখ থেকে। কোনো কথা বলে না। কতক্ষণ এভাবেই একে অপরের সাথে মিশে থাকে। কতকাল যে এই শান্তি অনুভব করেনি সে। সারাক্ষণ একটা চাপা কষ্ট বুকে পুষে বেড়িয়েছে। ঠোঁটে ছিল মিথ্যে হাসি। আজকাল সে অকারণে হাসতে শিখেছে। এলোমেলো ভাবনায় হারাতে ভালো লাগে। এই ভাবনাগুলোকে সত্যি করে পেতে চায়। খুব বেশি কিছু তো তার চাওয়া নেই। জীবনে যারা অল্পতে খুশি থাকে তাদের থেকে সেই অল্পটাও কেড়ে নেওয়া হয়! অনামিকা অনেক হারিয়েছে। আর হারানোর শক্তি নেই তার। আরেকটু শক্ত করে ধরে। এখানেই জীবনটা কেটে গেলে মন্দ হতো না। আর যদি এই দুটো চোখ খুলতে না হতো তবে ভালোই হতো। পরপারে অন্তত এটুকু শান্তি নিয়ে মরতে পারতো।
অনামিকার চোখ ভেঙে আজ ঘুম আসছে। এতটা শান্তি সে কখনো পায়নি। বিছানায় মাথা এলিয়ে দিতেই ঘুমের রাজ্যে পৌঁছে যায়। এই রাজ্যের রাজরানী সে। এখানে সে যাই চায় তাই হয়। আজ সে তার বাদলের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। অবচেতন মনে এটুকুতেই আনন্দ খুঁজে নিতে দোষের কিছু নেই। হ্যাঁ সে আনন্দে আছে, আনন্দে ময়ূরের মতো পেখম মেলে নাচছে।
বেশ রাত করে বাড়ি ফিরে বাদল। বাজারে গেলে রাত করে আসে বলে রেহানা সবসময় তার টেবিলে খাবার ঢেকে রেখে কামরার দরজা বাইরে থেকে তালা মেরে যায়। বাদলের কাছে চাবি থাকে সেই চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঢুকে সে। আজ আনন্দে তার পেট ভরা খেতে মন চাচ্ছে না তবু খাবার নিয়ে বসে। আনমনে খেয়ে চলেছে। কোনো কিছুর খেয়াল নেই। কিছুক্ষণ পরপর মৃদু হাসছে। চোখেমুখে ছড়িয়ে আছে আনন্দ। কবে যে অনামিকাকে বউ করে ঘরে আনবে। বউ! তার বউ হবে। ভাবতেও লজ্জা লাগছে। কখন যে পুরো বোল পেটে পুরে ফেলে সেদিকে একটুও খেয়াল করেনি। নিজেই নিজের উপর হেসে দেয়।
ঘুমাতে গিয়ে পরশের কথা খেয়াল হয় বাদলের। পরশ কেন অনামিকার বিয়ের এত তাড়া করছে! এখানে নিশ্চয়ই তার কোনো স্বার্থ রয়েছে। শিলার মৃত্যুর সাথে পরশের কোনো হাত নেই তো? মুহূর্তেই মাথার বন্ধ তালা খুলতে লাগে। যদি সে ভুল না করে তাহলে পরশ তার আর অনামিকার কথা জেনে গেছে। আর এজন্যই সে চাইছে না তাদের কোনোরকম সম্পর্ক থাকুক। এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে।
সকাল বেলা কয়লা দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে কলপাড়ে যায়। লুঙ্গিটাকে তুলে পিঁড়ির উপর বসে পড়ে। ভাবছিল পুলিশের সাথে দেখা করে নিজের ভাবনাগুলো বলবে। কিন্তু তার কাছে কোনো প্রমাণ নেই। সে কীভাবে প্রমাণ করবে। এই কাজ করলে এখন শুধু শুধু অনামিকাকেও হয়রানি করবে পুলিশ। এই সরকারের গোলামদের কোনো ভরসা নেই। একটা পেলেই হলো। যেখানে কাজ করার সেখানে তো করবে না আর যেটা স্বাভাবিক সেটাকে টেনেহিঁচড়ে নাড়িভুঁড়ি বের না করে খ্যান্ত হয় না।
মিলন তার কাছে এসে নীরবে বসে। মাটিতে কাঠি দিয়ে আঁকিবুঁকি করছে। ম্লান গলায় সহসা শুধালো, “শিলা কী আর আইবো না মামু? আমার একলা একলা পড়তে ভাল্লাগে না, খাইতেও ভাল্লাগে না। আমার খেলারও যে কেউ নাই। ওরে নিয়া আসো না, মাটির নিচে ক্যান পুইতা রাখছো? ওইহানে তো অন্ধকার। হেয় কী কোনো ভুল করছিল? শাস্তি দিছ তারে?”
বাদল দাঁত মাজা বন্ধ করে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে তার দিকে। তার চোখের মণিজোড়া উত্তরের চায়। এই বাচ্চাটাকে কী উত্তর দেবে ভেবে পায় না সে। মিলন তার কাঙ্ক্ষিত উত্তর না পেয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। প্যান্টের পেছনে একগাদা সাদা মাটি লেগে আছে। তার যাওয়ার পানে ক্ষণকাল তাকিয়ে থেকে কলে চাপ দেয়। ঝরঝর করে ঠান্ডা পানি বেরিয়ে আসে। মুখের ভেতর পানি নিয়ে গড়গড়া কুলি করে।
১৮.
বাদল আর অনামিকার প্রতিদিন দেখা হতে লাগে। কোনোদিন বিকেলে, কোনোদিন সন্ধ্যায়। যেখানে সেই চিরচেনা জায়গায়। যেখানে তাদের লোকে দেখার ভয় নেই। নীরবে বসে সময় কাটায় তারা। ভালোবাসার কথা বলে। গুনগুন করে গান গায়। সময়টা বেশ ভালোই যাচ্ছিল। তার মধ্যে বাদলের চিঠি আসে ঢাকা থেকে। চিঠি পেয়ে বাদল অতোটা খুশি নেই। অনামিকা বিকেলে যখন পড়াতে আসে তখন সে ছোট্ট একটা চিরকুট লিখে দেখা করতে ডাকে। কিছুটা অবাক হয় সে। একটু আগেই তাদের দেখা হয়েছে। এখন আবার সন্ধ্যা পর কেন ডাকছে তাকে!
মিলনকে পড়িয়ে একবার বাড়িতে যায় অনামিকা। সন্ধ্যা পর তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমাতে গেল বলে নিজের কামরায় গিয়ে রিনিকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। সবার নজর আড়াল করে সুপারি বাগানের দিকে পা বাড়ায় সে। বাদল সেখানে খড়ের ঘরটার ভেতর শুয়ে অপেক্ষা করছিল। ঘরের উপরে চাল না থাকায় আকাশের বুকে চাঁদের পাশে মিটিমিটি করে জ্বলতে থাকা তারা গুনছে সে। অনামিকা এসে তার পাশে শুয়ে পড়ে।
“এহন আবার ডাকছো ক্যান?”
“ক্যান ডাকতে পারুম না?”, বাদলের কণ্ঠে বিষন্নতা।
অনামিকা তার একটা হাত টেনে নিয়ে তার উপরে মাথা রাখে। চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলে, “বিশ্বাস করছি, ভালোবাসা দিছি কিন্তু খরিদ করি নাও নাই আমারে। যহন তহন ডাকবা না পাড়ায় জানাজানি হইলে পরে,খরিদ কইরা নিয়া যাতি হবেনে।”
“জানাজানি হইলে তো ভালোই। তয়, খরিদ করুম না তোমারে! এক বিঘা জমি মোহরানা দিয়া এক্কেবারে বউ বানাইয়া নিয়া আসুম।”
সারামুখে সে-হাসি ছড়িয়ে পড়লো। লজ্জায় মুখ রাঙা হয়ে আসে। আলতো করে তার বুকে লুকোয়। বাদলের মুখে আজ আনন্দ নেই। যে কথা বলতে তাকে ডেকেছে কীভাবে শুরু করবে কিছুই জানে না। তার প্রতিক্রিয়াটাও কেমন হবে কে জানে। একটা অজানা ভয় কাজ করছে। যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে জানে না তা ভুল নাকি। তবে এ ছাড়া তার কাছে কোনো পথও খোলা নেই।
চলবে…
লিখা: Bornali Suhana – বর্ণালি সোহানা